মেঘবন্দী (১৫) ... মেঘ বৃষ্টির পাঁচালী / লিজা
মেঘ বৃষ্টির পাঁচালী
লিজা
লোকটি দ্রুত হাটছে । শুকনো খরখরে শরীরে যত দ্রুত সম্ভব পাড়া ছাড়িয়ে একটু নির্জন জায়গার খোঁজে হেটে যাচ্ছে । আর হয়তো মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বৃষ্টি নামবে । লোকটি আন্দাজ করে নেয়, আজ ঝুম বৃষ্টিই হবে; একেবারে আকাশ পাতাল তছনছ করে বৃষ্টি নামবে আজকে । বাতাসের বুক চিরে দিয়ে অজস্র তীরের মত নেমে আসবে ওরা । মাতালের মত হেলেদুলে ঢলে পড়বে বিরসা মাটির বুকে । লোকটি ভাবতে ভাবতে হাটে, হাটে আর ভাবে । কোন এক জিনিসের প্রেমেই মজেছে সে, এ তারে দেখা দেয় কালেভদ্রে । অথচ লোকটি কত দিনরাত উদাস বসে অপেক্ষা করে, হেলায় ঠেলে সরায় ময়নার চান্দের জ্যোৎস্না ।
আজকে সেই দিন । সকালের স্যাঁতসেঁতে ঘুম হারাম করে দিয়ে ডাক পেড়েছিল পোড়ামুখো মেঘ । সনাতন ঘুমোতে পারেনি আর । চন্দ্রাহতের মত উঠে বসে ঝিম মেরে ছিল । আর তারপর সেই নির্জনের খোঁজে হেটে চলেছে । এত্ত সকাল যে, ময়নার ঘুমন্ত শরীর এখনও গভীর রাতের মত ভেঙ্গেচুরে আছে । পাড়ার কুকুরগুলো সারারাতের পাহারাদারি সেরে মরার ঘুম ঘুমুচ্ছে । ভোরের নরম আকাশ গুমরাচ্ছে বিকট মেঘের দাপটে । সনাতনের রক্তে কাঁপন লাগে । আদিম উল্লাসে হায়েনার মত মুখ তুলে চীৎকার করতে ইচ্ছা হয় । মেঘেরা দলা পাকাচ্ছে, কালো থেকে ঘোর কালো হয়ে যাচ্ছে পুরো আকাশ । সনাতন জানে, আজ দুনিয়া ভাইস্যা যাবে । দ্রুত হাটতে থাকে সে । যতক্ষন না মূল রাস্তার পাশে এসে পৌঁছায়, সনাতন থামেনা ।
সে তার প্রিয় গাছটার কোলে এসে দাঁড়াতেই, শ্রাবণের প্রথম জলের ধারা নামে আকাশ থেকে । ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে বৃষ্টির বেগ । সনাতনের হাড় জিরজিরে শরীর কেঁপে ওঠে । চারিদিক নিকষ কালো হয়ে যায় । সনাতনের ঘোলাটে চোখ প্রানপণে আঁধার খুঁড়ে খুঁড়ে বৃষ্টির রূপ দেখে নেয় । জলার শ্যাওলাজমা থলথলে শরীর উথলে উঠেছে নতুন জলের ছোঁয়ায় । সে খানিকটা দূরে বসেও শুনতে পায়, পদ্মার শীৎকার । প্রমত্তা পদ্মা বুঝি আজ পাগল হয়ে যাবে ।
পথঘাট, গাছের পাতায় জল টইটুম্বুর করে, সনাতনের তখন মনে হয় তার এ জল ধরে রাখার উপায় নেই । তার এই জীর্ণ ক্ষতময় কাঠামোখানা আজ শুধু জল চেখে দেখছে , একদম গভীরে যে অন্তঃসলিলা নদীটি রয়েছে তা হয়তো বা শুকিয়ে খটখটে । সনাতনের একটু দুঃখ বোধ হয় । তার পুরাতন প্রেমিকা বুঝি মনঃক্ষুণ্ণ হবে প্রেমিকের এ বেহাল দশা দেখে । সনাতন হাটু মুড়ে বসে গাছের গোড়ায় । জলের ধারা তার গা বেয়ে মাটি ডিঙ্গিয়ে পাশের বালিময় মাঠে নেমে যাচ্ছে । সনাতন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে ।
২
তার জন্ম হয়েছিল কোন মাসে সে বলতে পারবে না । এমন কেউ নেই যে তাকে গিয়ে শুধোয় । তবে এই একরকম সুবিধাই হয়েছে বলা যায় । সনাতন অনায়াসে যে কোন মৌসুমকেই বেছে নিতে পারে । শীত, গ্রীষ্ম বা তার প্রিয় বর্ষা । ঝুম বৃষ্টির তলে বসে ভাবতে ভালোই লাগে, এমন এক অঝোর ক্রন্দনের দিন তার জন্ম হয়েছিল কোন এক একতলা টিনে ছাওয়া বাড়ির শোবার ঘরে । বাড়িটা পাকা হলে দোষ নেই । যদিও সনাতন ঠিক শিওর না আদৌ কোন দেয়ালঘেরা ঘরে সে জন্মেছিল কিনা । হয়তো রাস্তার পাশে বা হয়তো ......... কত কিছুই তো হতে পারে । তবে সনাতন তার সাধ্যমত সেরাটাই ভেবে নেয় ।
টিনের চালে বৃষ্টির ঝনঝন শব্দের সাথে তার সদ্য জন্ম নেয়া শরীর থেকে চিল চীৎকার ভেসে এসেছিল হয়তোবা । সেই কান্না বা চীৎকার হয়তো মধুবর্ষন করেছিল তার কাল্পনিক মা বাবার কানে । এর চেয়ে বেশী কিছু ভাবে না সনাতন । এইটুকু ভেবেই মনটা আনন্দে ভরে যায় । ইচ্ছে হয় বৃষ্টির গায়ে গা এলিয়ে দিয়ে একটা বিড়ি ফুঁকতে । তবে বিড়ি টানতে হলে তাকে এখন বৃষ্টিহীন আড়াল খুজতে হবে । আবার আড়ালে দাড়ালে এই বৃষ্টিকে কিছুক্ষনের জন্য ত্যাগ করতে হবে । সনাতন এবার একটু দ্বিধাগ্রস্থ হয় । কোনটা বেশী দরকার, বিড়ি না বৃষ্টি ।
সেই কাকভোরে সনাতন পাগলের মত ছুটে এসেছিল এখানে । তার ক্ষতবহুল পেটের ভিতরটা এখন একটু একটু জানান দিচ্ছে আসন্ন বেদনার । সনাতন তবু পাত্তা দেয়না । গাছের গায়ে হেলান দিয়ে ক্লান্ত ভাবে দাঁড়ায় । আকন্ঠ পান করে বৃষ্টির অবিরল ধারা । তার দেহের কণায় কণায় মিশিয়ে দেয় এই জলসুধা ।
সনাতন অনেক ভেবছে বৃষ্টির সাথে তার এই সম্পর্কের কথা । যেদিন এক ভরা শ্রাবণের রাতে সে গারো মেয়ে ময়নার হাত ধরে ছুটেছিল জলছত্র, জলইএর শালবন পিছনে ফেলে , সেদিনও তার কল্পনার জন্মক্ষনের মত ঝন ঝন বৃষ্টি হচ্ছিল । ময়নার পিচ্ছিল হাত বারবার তার মুঠো থেকে সরে যাচ্ছিল । নিবিড় অন্ধকারে সেদিন কি করে যে মধুপুর ছাড়িয়ে এসেছিল ওরা দুজন, তা চিন্তা করলে সনাতনের এখনো গা শিউরে ওঠে । বৃষ্টি ছিল বলে গারো পাড়ার কেউ তাদের পিছু নেয়নি, এজন্য সে বারবার প্রণাম ঠোকে বৃষ্টির জলধারাকে । ময়না যদিও এখনও ভুলতে পারে না তার জন্মস্থানের কথা, ঘন অরন্যের কথা । কিন্তু সনাতন তাকে এই বলে সান্ত্বনা দেয়, সে নিজে কোথায় জন্মেছিল এর কোন ঠিক নেই । কোন স্মৃতি নেই । কোন গ্রাম নেই তার । ময়না তখন নিজের দুঃখকে দাড়িপাল্লায় সমান সমান ভাগ করে নেয় । এক ভাগ সনাতনের আর এক ভাগ নিজের ।
আজ তাই ভিজতে ভিজতে সনাতন ভাবে, ভাগ্যটা তার নেহাত মন্দ না । ময়না তার সবকিছুর জোগান দিয়ে যাচ্ছে । কত কিছু করে তার জন্য । মাঝেমধ্যে অবাক লাগে, তারমতো নষ্ট লোকেরও ভালোবাসার মানুষ আছে !! এ যে অনেক বড় পাওয়া !! তার ক্রমশ ভালো লাগায় শরীর ঝিম ঝিম করে । আবার ঝট করে তার জন্মের কল্পনাটা ফিরে আসে । তখন মনে হয়, তার বুঝি বা মৃত্যুও হবে এইরকম কোন ঘোর বরষার দিনে । অন্তত ভেবে নিতে পারে সে । যদি স্বাভাবিক মৃত্যু নাও হয়, সে হয়তো বাধ্য হতে পারে নিজেকে হত্যা করতে । ভরা শ্রাবণের কোন এক দুপুরে তার বিষে নীল শরীর ঠান্ডা মেরে পড়ে থাকবে রাস্তায়, হয়তো এই গাছটার তলাতেই । এইরকম মৃত্যুচিন্তা সনাতনের মনে পুলক জাগায় । তার শরীরের পশমগুলো দাঁড়িয়ে যায় । সে গাছের কোল থেকে সরে এসে রাস্তায় দাঁড়ায় । ভিজতে ভিজতে দেখে, কেউ একজন হেটে আসছে । নির্জন রাস্তায় তার পানি ছপছপ করে আসাটা বড় সুন্দর লাগে । সনাতন হঠাত চেনে তাকে । শাড়ি লেপ্টে শরীরের অলিগলি ঢেকে ময়না হেটে আসছে । তাকে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগে । মনে হয়, এতোক্ষন যে বৃষ্টি তাকে আশ্রয় দিচ্ছিল, সে ফেলে যেতেই ময়না ছুটে আসছে দু হাত বাড়িয়ে । ঠিক তখুনি সনাতনের মনে পড়ে, আজ এই বাদলার দিনে ময়নার কোন ইনকাম হবে না । তা না হলে খুব কষ্টে কাটবে দিনটা । আজ আর কোন ভ্রষ্ট কলঙ্কিত পুরুষ এ মুখো হবে বলে মনে হয় না । ময়না যত কাছে এগুতে থাকে সনাতনের চিন্তা ততই বাড়ে । দেখে ময়নার শরীর আরো স্পষ্ট হয়েছে ।দ্রুত আর অনিশ্চিত পায়ে হেটে আসছে সে । চোখেমুখে তার প্রবল দুশ্চিন্তা, নাকি আকুতি সনাতন বুঝতে পারে না ।ময়না তার সামনে এসে দাঁড়ায় । নির্বাক মুখ তুলে তাকায় আর সনাতন গাছের পাশে বৃষ্টিভেজা আরো একটি গাছ হয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকে ।
সুপার লাইক
লিজার নতুন লেখা চাই।
নেয়া লেখা দেন গো আপাজান!!
এই মেয়েটা এত্তো কম লিখে কেনো?
অতি সুন্দর।
মন্তব্য করুন