ইউজার লগইন

চোখের জল হয়ে ওঠে ছল

ভালোবাসা, প্রেম, প্রণয় ও পরিণয়- শব্দগুলো একে অন্যের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। এদের সাথে আরও একটি শব্দ অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পৃক্ত, আর তা হলো ভালোলাগা। এই ভালোলাগা থেকেই ভালোবাসার জন্ম। কিংবা অন্যভাবে বললে ভালোলাগাই হচ্ছে ভালোবাসার সুতিকাগার। ভালোবাসা মানুষের এক গভীর মনোদৈহিক অনুভূতি। এ অনুভূতি সকলের মাঝেই প্রবাহমান। প্রতিটি সম্পর্কের ভিত্তিমূল এই ভালোবাসা। যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে সম্পর্ক মূল্যহীন। ভালোবাসা অন্তঃমানবিক সম্পর্ককে দৃঢ় করে। আর ভালোবাসা হ্রাস পেলে ব্যক্তি সর্ম্পকে অবনতি ঘটে। পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি যে ভালোবাসা সেই ভালোবাসার প্রকাশ ভঙ্গি একেকজনের কাছে একেক রকম। প্রকৃত পক্ষে ভালোবাসা পূর্ণতা পায় বহিঃপ্রকাশের মধ্য দিয়ে। ভালোবাসা মানব মনের এক ধরনের আবেগজনিত অনুভূতি। এই আবেগেই মানুষকে ভালোবাসতে তাড়িত করে। আবেগ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ ঊসড়ঃরড়হ। ল্যাটিন শব্দ ঊসড়াবৎব থেকে যার উৎপত্তি। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বাইরের জগতের কোন উদ্দীপকের প্রতি প্রতিক্রিয়া করতে গিয়ে প্রাণী উত্তেজিত হয়। প্রাণীর এইরূপ উত্তেজিত অবস্থা বা আলোড়িত অবস্থাকে আবেগ বলা হয়। আবেগের সংঙ্গা দিতে গিয়ে উডওয়ার্থ ও মারকুইস (১৯৫৭) বলেন-“আবেগ হলো ব্যক্তির আলোড়িত অবস্থা।” ওয়েবস্টার তার ঞযব হবি ওহঃবৎহধঃরড়হধষ উরপঃরড়হধৎু তে আবেগের একটি কার্যকরী সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তিনি বলেন-“আবেগ হলো একটি অভ্যন্তরীণ ভারসাম্যচ্যুত শারীরিক অবস্থা যা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দ্বারা অনুভব করা যায় এবং ¯œায়ু ও মাংসপেশী শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া, হরমোন ও অন্যান্য শারিরীক পরিবর্তন কাজের প্রস্তুতি তৈরি করে, যার প্রকাশ হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। এই আবেগ তাড়িত ভালোবাসা মানুষের বেঁচে থাকার সঞ্জিবনী শক্তি। এই শক্তি দুর্দমনীয়, দুরন্ত, দুর্বার। এই ভালোবাসা একসময় প্রেমে পরিণত হয়। এই প্রেম নর-নারীর মধ্যে সৃষ্টি করে অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। এই বন্ধন মানুষকে করেছে সৃজনশীল, কর্মঠ তথা কর্মমূখী। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় “বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি/চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী/অর্ধেক তার নর।” অর্থাৎ বিশ্বের সমস্ত সৃষ্টিশীল কাজের আধাআধি অংশীদার নারী-পুরুষ। এ তো গেল সার্বজনীন। আর সৃজনশীল মানুষ মাত্রই তার মধ্যে আছে ভালোবাসা, আছে প্রেম। সেই প্রেম তাকে প্ররোচিত করে শিল্প-সাহিত্য, সংগীত সৃষ্টিতে। যার ফলে আজ আমরা পেয়েছি অসংখ্য বিশ্ব বরেণ্য শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি তথা মহাজ্ঞানী মহাজন। প্রেম বা ভালোবাসা যাই বলি না কেন এর রয়েছে দু’টি স্তর। একটি আত্মিক অন্যটি দৈহিক। প্রথমোক্তটি ভালোবাসতে প্রাণীকে আবেগ দ্বারা তাড়িত করে। আর পরেরটি তাকে প্রণয়ের পথ ধরে টেনে নিয়ে যায় পরিণয়ে দিকে। এই প্রেম বা ভালোবাসার সূত্রপাত হয়েছে মানব সৃষ্টির সেই প্রথম যুগ থেকে। যাহোক, ফিরে যাই পূর্বের কথায়। মানব-মানবীর এই প্রেমের ফলশ্রুতিতে আমরা যে বিশ্বমানের সাহিত্য পেয়েছি তার কোন তুলনা হয় না। উদাহরণ হিসেবে আবারও নজরুলের আরও একটি পঙক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে-
“আলগা কর গো খোপার বাঁধন/ দিল ওয়াহি মেরা ফাস গায়ি।
বিনদ বেণীর জেরিন ফিতায় আন্ধা ইশক মেরা বাসাস গায়ি।”
আর কবি গুরুর শেষের কবিতার আমিত লাবণ্যের কথা সাহিত্যের মুগ্ধ পাঠক মাত্রই অবগত। অথবা “জীবে প্রেম করে যেইজন সেই জন সেবীছে ঈশ্বর।” অর্থাৎ জীবে প্রেমের মাঝেই নিহিত ঈশ্বর প্রেম সে কথা সাহিত্যই শিখায়। কবিগুরুর প্রেম পর্বের গানগুলো প্রেমের অমিয় নির্জাস। এ পর্বের একটি চরণ তো না বললেই নয়। কবি লিখেছে-“প্রেমে জল হয়ে যাও গলে।” সত্যিই প্রেম মানে তো নিছক দেহ সর্বস্ব প্রেম নয়। প্রেম মানে দুটি প্রাণ একাকার হয়ে যাওয়া।
প্রেমের একটি ধারা প্লেটনিক লাভ বা নিঃস্কাম প্রেম। প্লেটনিক লাভ কনসেপ্টটি বিশ্বময় আলোচনার বড় তুলেছিল। অথবা কথাটা এভাবে বলা চলে এখনও আলোচনার টেবিলে এর পক্ষে-বিপক্ষে মানুষ মুখরিত হয়। বিশ্ব সাহিত্যে ‘রোমিও এন্ড জুলিয়েট’ এক অনবদ্য সৃষ্টি। এর বিষয়বস্তু নর-নারীর প্রেম। প্রেম তাড়িত হয়ে কবি কণ্ঠে ধ্বনিত হয়। ‘তুমি যে আমার কবিতা/আমার বাঁশির রাগিনী’।
প্রেমে যেমন আছে পাবার আনন্দ তেমনি আছে বিরহ। তাই ‘প্রেমের নাম বেদনা’ শীর্ষক জনপ্রিয় এই গানটি সৃষ্টি হয়েছিল। নর-নারীর প্রেমের বাইরেও আমরা আর এক ধরনের প্রেম মানুষের মধ্যে দেখতে পাই। আর তা হলো ঈশ্বরের প্রেম। প্রেমের এ ধারাটিই সাহিত্য সুফিবাদের জন্ম দিয়েছে।
লালন সাহিত্যিকে অর্থাৎ লালনগীতির বিষয় বস্তুর এক বড় বিষয় ঈশ্বর প্রেম। অন্য কথায় বললে এভাবে বলা যেতে পারে। লালন সাহিত্যের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ঈশ্বর প্রেম। তবে লালন সাহিত্যকে সুফি সাহিত্য বলা যায় কিনা তা সাহিত্য যোদ্ধাগণই ভাল বলতে পারেন। লালন সাহিত্যের একটি ধারা হলো ঈশ্বর প্রেম। আর তার সাহিত্যকর্মের আর একটি ধারা হলো মানব প্রেম। অর্থাৎ তিনি মানবতার কথা বলেছেন।
কবিতাকে বলা হয় উচ্চ মার্গিয় সাহিত্য যে কারণে কবিতার পাঠক সংখ্যা অন্য সাহিত্যের তুলনায় কম। যাহোক, আমার আলোচনার বিষয় এটা নয়। তবে এটা আমি হলফ করে বলতে পারি পৃথিবীতে যত কবিতা লেখা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আসলে সাহিত্যাঙ্গনে এমন হাজার উপাদান পাওয়া যাবে যার মূলে রয়েছে এই প্রেম।
বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক শরৎ চন্দ্র। তার সাহিত্য কর্ম পাঠক হৃদয়কে আজও স্পর্শ করে। তার অমর সৃষ্টি ‘দেবদাস’। এ চরিত্রের কথা পাঠকের হৃদয়কে আজও ছুঁয়ে যায়। উইলিয়াম শেকস্পিয়রের অমর সৃষ্টি এ্যান্টনি এবং ক্লিওপেট্রা। তাদের বিয়োগন্ত প্রেম কাহিনী শেকস্পিয়রের সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ। বিশ্ব সংস্কৃতিতে প্রেমকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে রোমান্টিক চলচিত্রগুলো অধিক জনপ্রিয়। ‘টাইটানিক’ মুভিটির কথা তো সবারই জানা। সেখানেও এক চমৎকার রোমান্টিকতা লক্ষ করা গেছে। প্রিন্সেস ডায়ানা আর চার্লসের কথা কে না জানে? শুধু বৃটিশ রাজ পরিবার নয় হালে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনেও এ প্রেমের বাতাস লেগেছে। পাকিস্তনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা-রাব্বানী ও জারদারি পুত্র বিলওয়ালের প্রেম কাহিনী কেবল তাদের দেশে নয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও ব্যাপক আলোচনার ঝড় তুলেছে। সবই প্রেমের কারণে।
তবে প্রেমের ইতিহাসে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তার নামে আজ বিশ্বব্যাপী পালিত হয় ভালবাসার এই বিশেষ দিন ‘ভ্যালেন্টাইনস্ ডে’। যার ছোঁয়া লেগেছে আমাদের দেশেও। তরুণ-তরুণীরা ব্যাপক উৎসাহে দিনটিকে পালন করে। একে অন্যকে উপহার দেওয়া, ঘুরে বেড়ানোসহ নানা ভাবে দিনটি উদ্যাপিত হয়। বিবাহিত জুটিরাও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। তারাও তাদের মত করে দিনটি পালন করে থাকেন বিশ্বময়। যে ভালোবাসা বা প্রেম মানুষের প্রাণস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়, পারস্পরিক বন্ধনকে দৃঢ় করে তাই তো প্রকৃত প্রেম। সম্রাট শাজাহানের সেই তাজমহল তো আর হবে না হয়ত। তবে প্রতি প্রাণে ভালোবাসার স্তম্ভ গড়ে উঠবে, প্রাণে প্রাণে ভালোবাসায় ¯স্তম্ভ হবে মানব সমাজ। সবশেষে কবিগুরুর কাছে ফিরে যাব। তাঁর ভাষায় বলব- ‘প্রেমে জল হয়ে যাও গলে’ ।

পোস্টটি ৭ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মীর's picture


প্রেমময় লেখা, চালিয়ে যান। সঙ্গে প্রেমও।

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

মিদুল's picture

নিজের সম্পর্কে

আমি লেখালেখি করতে পছন্দ করি ৷ কিন্তু তেমন একটা সুযোগ পাই না ৷ তাই লেখাপড়ার পাশাপাশি কিছু সময়ে লেখালেখি করি ৷