ইউজার লগইন

এক অদ্ভুত ইচ্ছে পূরণের সকাল

গত ক'দিন ধরে পড়াশোনায় মন বসছে না। আজ একটা মিডটার্ম ছিলো, টেক-হোম। অন্যসময় যেখানে টেক-হোম এক্সামের সময় সারা রাতের ঘুমকে ছুটিতে পাঠিয়ে প্রশ্নের সমাধান করতে থাকি, সেখানে গতরাতে কেমন গা-ছাড়া মেজাজে বিছানায় শুয়ে ছিলাম, এক্সাম না দিয়ে।

সারারাত জেগে ঘুমের সত্যিকারের চেষ্টাটা নিলাম সকাল ০৮ঃ৩০-এর দিকে। যদি ১০ঃ০০ টার ক্লাসটা ধরতে চাই ঠিক সময়ে, বাসা থেকে বেরোতে হবে ঠিক ০৯ঃ৩০-এ আর তাই কোনভাবেই ০৯ঃ১০ এর পরে বিছানায় পড়ে থাকার সুযোগ নেই।

ঠিক সকাল ০৯ঃ১০-এ বিছানা ছেড়ে খুবই তড়িঘড়ি করে বাসা থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিলাম কিন্তু তার পরেও বাইরে বের হতে বেজে গেলো ০৯ঃ৪০। পুরোটা পথ হেঁটে যেতে হবে এবং সত্যিকার অর্থেই আমি আসলে দেরি করে ফেলেছি। একই প্রোফেসারের আগের দিনের ক্লাসটা মিস দিয়েছি ঠিক ঘুমের কারনেই, যদিও বিকেলে ঘুম থেকে উঠে তাঁর কোর্সের মিড-টার্মটা ঠিকই জমা দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু এইবার আর ক্লাস মিস দিতে চাচ্ছিনা। প্রথমত, আমার উপর আমার প্রোফেসাররা খুব সন্তুষ্ট, যা আমি কোনভাবেই খামখেয়ালির বশবর্তী হয়ে নষ্ট করতে চাই না। দ্বিতীয়ত, গতক্লাসে স্পেশাল রিলেটিভিটির পাঠ শুরু হয়েছিলো কেবল। দৈর্ঘ্য সঙ্কোচন আর সময় প্রসারনের মত ব্যাপারগুলোই সাধারণত প্রথম ক্লাসে পড়ানো হয় এবং তা পড়তে পড়তে বোঝার চেয়ে অভ্যস্ততাই তৈরি হয়ে গেছে বেশি। কিন্তু আজকের ক্লাসটা আর রিলেটিভিটির সূচনাতে পড়ে থাকবেনা।

এসব চিন্তা করতে করতেই সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথটা ধরে হাঁটা শুরু করলাম। আর একটু পরপরই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম যে ঠিক যে সময়টাতে যতটুকু রাস্তা পার হলে ঠিক ১০ঃ০০ টায় ক্লাসে পৌছনো সম্ভব ঠিক ততটুকু পথ অতিক্রম করেছি কিনা। কিন্তু হতাশ হয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম যে আমি আস্তে আস্তে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে পথ অতিক্রম করতে পারছিনা। সাথে যুক্ত হয়েছে বৃষ্টি আর ঝড়ো বাতাস যখন কিনা তাপমাত্রা ১ ডিগ্রী সেলসিয়াসের কাছাকাছিতে এবং আমি তীব্র ঠাণ্ডা আর বৃষ্টির দিনে পরে বেরিয়েছি একজোড়া স্যান্ডেল! ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে পা আর চলেনা, তবুও চালাতে হচ্ছে!

একটা সময় ভাবতে লাগলাম যে কি ভালোই না হতো যদি কোন ভদ্রলোক/ভদ্রমহিলা তার গাড়ি থামিয়ে বলতো যে, "এই যে মেয়ে, তোমার কি রাইড লাগবে? দেখে মনে হচ্ছে তুমি ভার্সিটির ছাত্রী তা আমি ওদিকেই যাচ্ছি!" কিন্তু আমার ভাবনা শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকলোনা। এরপর ভাবনার গতিবিধিটা ছিলো এমন যে- কোন বয়সী ভদ্রলোক/ভদ্রমহিলা আমাকে রাইড দেবার মত আন্তরিকতা দেখাতে পারে- সেটার সবচেয়ে সম্ভাব্য উত্তর বের করা, যুক্তি উপস্থাপন আর তার বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে। প্রথমেই আমি আমার চিন্তা থেকে সমস্ত তরুণ-তরুণীদের বাদ দিয়ে দিলাম। কারণ আমেরিকান তরুণ-তরুণীরা এত ব্যস্ত আর দৌড়ের উপর থাকে (কিছুটা বয়সগত চাঞ্চল্যের কারণেও) যে তাদের আশে-পাশে তাকানোর সময় নেই। তালিকায় থাকলো বাকি মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক/ভদ্রমহিলা। ভাবনার এই পর্যায়ে এসে কোন যুক্তি দাড় করানোর আগেই একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকের ছবি ভেসে উঠলো। কেন একজন মধ্যবয়স্ক মহিলার পরিবর্তে একজন ভদ্রলোকের ছবি কল্পনায় ভেসে উঠলো এটা নিয়ে ভাবনা শুরু করতে গিয়েই হঠাৎ মনে হলো পাশ থেকে কোন গাড়ি যেন হাল্কা বীপ্‌ দিচ্ছে। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলাম আমার সমস্ত যুক্তির গাঁথুনিকে ধসিয়ে দিয়ে এক অতি সুদর্শন তরুণ জানালা থেকে গলা বাড়িয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলছে, "Hey! Would you mind if I want to give you a ride? I am going to the school too" আমি এতোটাই অবাক হয়ে গেলাম কিছুক্ষণ নড়তে পারিনি। তারপর একটা মিশ্র হাসি আর মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানিয়ে গাড়ির কাছে পৌছনোর জন্য রাস্তা পার হতে হতেই ভাবতে লাগলাম, আমার ভাবনা থেকে বাদ পড়ে গিয়েছিলো যে আমাকে লিফট দিতে চাওয়া ভদ্রলোকের গাড়ি কি ধরনের হতে পারে এই বিষয়টা এবং আমি নিশ্চিত যে আমি যদি এর সম্ভাব্য উত্তর যুক্তি দিয়ে দাঁড় করিয়ে ফেলতামও, সেটাও ধসে পড়তো। কারণ গাড়িটা ছিলো একটা বেশ ফ্যাশনেবল স্পোর্টসকার। আমার ঘোর তখনো কাটেনি এবং ঘোর লাগা অবস্থাতেই গাড়ির দরজা খুলে ফেললাম। দরজা খুলতেই দেখি সিটে একগাঁদা আপেল রাখা আর সিটের নিচে পা রাখার জায়গাটা ভর্তি কনভার্সে। আপেলগুলো সরাতে সরাতেই সে আমাকে বললো যে আমি যেন ছড়ানো-ছিটানো কনভার্সের তোয়াক্কা না করে নিঃসঙ্কোচে সেগুলোর উপর পা রেখেই সিটে বসে পড়ি এবং আমি তাই করলাম। একটু পর সে জিজ্ঞেস করলো যে আমি প্রতিদিন এভাবে হেঁটে আসি কিনা এবং আমি তাকে জানালাম যে আমি অধিকাংশ দিন হেঁটে ক্যাম্পাসে আসি।

বলাবাহুল্য, এই প্রশ্নটা নিউ ইংল্যান্ডের মত জায়গায় করা খুবই স্বাভাবিক- কারণ রাস্তায় একমাত্র আমিই হাঁটি। একদিন কেবল আমার পেছনে আরো একজন হেঁটে যাচ্ছিলো এবং ততদিনে 'আমি একাই এখানকার রাস্তাঘাটে হেঁটে থাকি'- এই ধারনাটার সাথে এতো অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে আমার কাছে মনে হচ্ছিলো সে আমাকে পেছন থেকে যেকোনো সময় আক্রমণ করে বসতে পারে!

সে জানতে চাইলো যে আমি কোন দেশ থেকে এসেছি। আমার ভালো লাগলো যে সে আমাকে ভারতীয় বলে বসেনি। আমি বললাম যে আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি এবং সে আরো জানতে চাইলো আমি এখানে কি পড়ছি এবং আন্ডারগ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট কিনা। আমি জানালাম যে আমি ফিজিক্সে মাস্টার্স করছি এবং সে ফিজিক্সের প্রতি তার সমীহ প্রকাশ করলো। সে নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানালো যে সে ফিন্যান্সে পড়ছে এবং আগামী বছর সে সিনিয়র হবে। এবার আমি তাকে স্টেরিওটাইপড্‌ করে ফেলে জানতে চাইলাম যে সে পর্তুগীজ কিনা (তার ইংরেজি আমেরিকানদের মতো ছিলোনা এবং নিউ ইংল্যান্ডে প্রচুর পর্তুগীজ আছে)। প্রশ্নটা করেই বুঝে গেলাম যে আমি হয়তো ভুল অনুমান করেছি- কারন তার চেহারা খুব বেশি তীক্ষ্ণ যা আমি এখানকার পর্তুগিজদের ভেতরে দেখিনি, পর্তুগালের পর্তুগীজদের চেহারার কথা বলতে পারিনা। সে হেসে জানালো যে সে গ্রীক এবং পড়াশোনা করতে সে আমেরিকাতে এসেছে। এই প্রথম আমি কোন গ্রীক মানুষের সাথে পরিচিত হলাম এবং মনে মনে মেনে নিলাম যে গ্রীক তরুণেরা সত্যিকার অর্থেই সুদর্শন হয়ে থাকে। নিশ্চয়ই গ্রীক তরুণীরাও অনেক সুন্দরী হয়ে থাকে এবং এর সাথে সাথে এই চিন্তা মাথায় চলে এলো যে তরুণটি নিশ্চয়ই গ্রীসের বেশ অবস্থাসম্পন্ন ঘরের ছেলে নতুবা অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে হাবুডুবু খাওয়া দেশটি থেকে এখানে ফিন্যান্সে আন্ডারগ্রাড পড়তে আসতে পারার কথা নয়।

তার নাম জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলাম না, কারণ এখনো গন্তব্যে পৌঁছনোর কিছুটা পথ বাকি। গ্রীক মানবের অদ্ভুত নাম হলে আমি কিছুতেই কয়েক সেকেন্ডের বেশি মনে রাখতে পারবোনা এবং আমি ততক্ষণে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি যে আমি এই ঘটনাটা নিয়ে লিখবো কারণ আজ থেকেই থ্যাঙ্কসগিভিং-এর বন্ধ শুরু কাজেই লেখালেখির জন্য সময় পাওয়া যাবে আর আমার তার নাম ভুললে চলবে না। অবশেষে যখন সে আমাকে ডিপার্টমেন্টের সামনে নামিয়ে দেওয়ার জন্য গাড়ি থামালো আমি তার নাম জিজ্ঞেস করলাম এবং সে উত্তরে জানালো যে তার নাম ভার্সেল্লি এবং আমি আমার নাম জানিয়ে তাকে অনেক ধন্যবাদ জানালাম। সে হাসতে হাসতে জানালো যে সে যদি কখনো আমাকে ভার্সিটিতে আসার পথে দেখতে পায়- তবে আজকের মতই আমার পাশে তার গাড়ির গতি কমিয়ে বীপ্‌ দিয়ে তার উপস্থিতি জানান দেবে।

ভার্সেল্লিকে কি বলে আমার পক্ষ থেকে সবচেয়ে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানানো যায়, এটা উপলব্ধি যখন করতে পারলাম তখন সে কোন গ্রীক দেব-দেবীর পূজারী বা আদৌ কোন দেব-দেবীতে বিশ্বাসী কিনা- সব কিছু অগ্রাহ্য করেই এই বলে তাকে বিদায় জানালাম, "May God bless you".

ক্লাসরুমের দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ঘড়িতে বাজে ০৯ঃ৫৯।

পোস্টটি ১৬ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

দূরতম গর্জন's picture


খুব অগোছালো... সবকিছু ভুলে যাই... অসম্ভব ঢিলে... আত্মবিশ্বাসে ভাটা পড়েছে্‌। আজকাল মস্তিষ্কে জং ধরে গেছে.

আপনি খুব সময় মেনে চলেন, খুবই হিসেবী। হয়তো কোনো কারনে আত্মবিশ্বাসে ভাটা পড়লেও আপনি খুবই গোছানো মানুষ।

পথচলা শুভ হোক। পশ্চিমা দেশে আমাদের দেশের মতো এতটা ক্রাইম হয় না। তাই ভয় নেই। আমি সুইডেনের মতো ঘাউড়া দেশেও রাত ৩-৪টা বনের মাঝে থেকে লিফট পেয়েছি।

সারাহ্‌'s picture


ধন্যবাদ! সুইডেন ঘাউড়া কেন??

সারাহ্‌'s picture


ধন্যবাদ! সুইডেন ঘাউড়া কেন??

দূরতম গর্জন's picture


প্রচন্ড নিয়মতান্ত্রিক এবং ঐতিহ্যে অহং মাখানো মানুষ এরা। যদিও রেসিস্ট না খুব বেশী তবু এরকম অহম নিয়ে চলা মানুষগুলো যে কখনো কখনো লিফট দেয় তাও আমার মতো বিদেশীকে সেটাই অবাক করার বিষয়। তবে নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে এরা যে কতটা ঘাউড়া হয় সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না

আরাফাত শান্ত's picture


এরকম সকাল আরো আসুক
অনেক অনেক শুভকামনা।।

সারাহ্‌'s picture


Smile ধন্যবাদ!

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


বাহ। পারফেক্ট টাইমিং।

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


ও, আরেকটা কথা।
আপনার লেখার হাত ভালো,
নিয়মিত এখানে দেখতে পেলে ভালো লাগবে।

এবি তে স্বাগতম.. Smile

সারাহ্‌'s picture


ধন্যবাদ Smile

আমি নিয়মিত লেখার চেষ্টা করবো।

১০

জাহিদ জুয়েল's picture


ভাল লাগল Smile

১১

সারাহ্‌'s picture


Smile Thanks a lot.

১২

সারাহ্‌'s picture


"একটা জিনিস বলতে পারি বাংলা লেখা যেখানেই পাই পড়া শুরু করি চাই সেটা ঝালমুরির ঠোংগায় লেখা হোক"

আমারও একই অভ্যাস আছে Smile

১৩

তানবীরা's picture


গ্রীকদের গায়ের রঙ বেশ ভাল, এরা দেখতে বেশ হয় .......

এরকম রাইড বিপদজনক, মেয়েদের দেশে এবং বিদেশে সব জায়গায় সাবধান হতে হয় Sad(

১৪

সারাহ্‌'s picture


আপু, ধন্যবাদ বড় আপুর মতো উপদেশ দেবার জন্য। দেশ থেকে আশার আগে ক্যানিব্যালিজম সম্পর্কে পড়ে এসেছিলাম। অধিকাংশ ক্যানিব্যাল যে রাইড দিতে গিয়ে শিকার ধরে তাও পড়েছিলাম। কিন্তু ছেলেটাকে দেখে বুঝেছিলাম সে ভার্সিটির দিকেই যাচ্ছে, মনটাও সাই দিলো ভেতর থেকে। তাই কেন যেন উঠে পড়লাম। মীর ভাইয়ার কাছ থেকে আপনার কথা শুনেছি অনেক। আপনাকে ফেইসবুকে অ্যাড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি। এক্সেপ্ট করলে খুশি হবো Smile

১৫

তানবীরা's picture


আমি চিনতে পারিনি বোধহয়। সব রিকোয়েস্ট খুলে দেখি না। একটা ম্যাসেজ দিও Laughing out loud

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

সারাহ্‌'s picture

নিজের সম্পর্কে

খুব অগোছালো... সবকিছু ভুলে যাই... অসম্ভব ঢিলে... আত্মবিশ্বাসে ভাটা পড়েছে্‌। আজকাল মস্তিষ্কে জং ধরে গেছে...