যায় বেলা - অবেলায়
একটা সময় ছিল যখন সকাল সাড়ে দশটা থেকে এগারোটা বা রাত দশটা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত মাথায় লাল ব্যান্ড বেঁধে মিছিল করতাম। মিছিলে গলা ফাটিয়ে শ্লোগান দিতামঃ
এই সমাজ জীর্ণ সমাজ
              এই সমাজ ভাঙতে হবে
ভাঙতে গেলে বাঁধবে লড়াই
              এই লড়াইয়ে জিততে হবে
এই লড়াইয়ে জিতবে কারা
              কৃষক-শ্রমিক-সর্বহারা
ইতিহাসে জিতেছে কারা
              কৃষক-শ্রমিক-সর্বহারা
দুনিয়ার মজদুর
              এক হও, লড়াই কর
এক হও, যুদ্ধ কর
               দুনিয়ার মজদুর
বিশ্বে আছে এক বাদ
                মার্কসবাদ - লেনিনবাদ
সর্বহারার মতবাদ
                মার্কসবাদ - লেনিনবাদ
আমরা জানি “মিছিলের সব হাত-কণ্ঠ-পা এক নয়; সেখানে সংসারী আছে, সংসার বিরাগী আছে”। আমাদের সেই ক্ষুদ্রায়তন মিছিলের সদস্যরাও তার ব্যতিক্রম নয়। একেতো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টা আকার-আয়তন-ছাত্র সংখ্যায় দেশের সবচে’ ছোট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়; তার ওপর আমাদের দলটা ছিলো আরো ছোট। সবচে’ বড় মিছিলটাতেও পঞ্চাশ জন হতোনা। বেশির ভাগ দিন জনা দশেক। এই নিয়মিত দশজ্নের সবাইকে বাম-প্রগতিশীল বলে ভাবার কোনো কারণ নেই। কেউ এসেছে অন্য দলগুলো পছন্দ নয় বলে। কেউ এসেছে এই দলটা একটু গরম গরম কথা বলে তাই। কেউ এসেছে তাদের পরিবারের কোন একজন এক কালে এই দলটা করত বলে।
ছাত্র সংগঠনটার মূল দলের অবস্থা ছিল কেরোসিন। ব্রাকেটে ব্রাকেটে বন্দী হতে হতে ডাল-পালা, শাখা-প্রশাখা কিছুই অবশিষ্ট ছিলনা। কোন কোন ভাগাড়ের শকুন আবার ভাগাড়েই ফিরে গিয়েছিল। সেদিক দিয়ে ছাত্র সংগঠনটার অবস্থা কিছুটা ভালো ছিল। এই ভালো থাকার একটা বড় কারণ ছিল সহিংসতায় এরা এগিয়ে ছিল। আমাদের পাশের বাড়ির বিশ্ববিদ্যালয়ে এরা “ক্যাডার” নামে পরিচিত ছিল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েও শিবির পেটানো বা রাজাকার তাড়ানো আন্দোলনে এদের ভূমিকা প্রধাণ ছিল।
এক সময় আবিষ্কার করলাম দলের মাথার দিক থেকে শুরু করে লেজের দিক পর্যন্ত খুব কম জনই দলের ঘোষিত আদর্শ ও মতবাদে বিশ্বাস করে। কেউ কেউ তো একেবারে উলটো আদর্শে বিশ্বাসী ছিল। তবু একটা ক্লাবের মতো দলটা কিছুদিন আমাদের এখানে টিকে ছিল।
দুই দশক আগে তখনই দেখেছিলাম কীভাবে কারো কারো মধ্যে লোভ ঢুকে যাচ্ছে। চাঁদাবাজি, ভোটের সময় ভাড়াটে খাটা, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কাজগুলোর কমিশন বা বখড়া নেয়া, জুয়া বা মাদক ব্যবসায় ভাগ বসানো সবই একটু একটু করে ঢুকে যাচ্ছিল। আমাদের শেষের দুই বছর রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় চূড়ান্ত অধঃপতন আর দেখতে হয়নি। এর জন্য নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে হয়।
ছাত্র রাজনীতিতে মূল দলের মতো হালুয়া-রুটির ব্যবস্থা যেদিন থেকে শুরু হয়েছে, অধঃপতনটা সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে। আজ সেটা একেবারেই ধ্বসে পড়েছে। সামান্য ব্যতিক্রম আছে, তবে তা এত সামান্য যে তার প্রভাব চোখে পড়েনা।
কয়েক মাস আগে বিপণন কর্মী নিয়োগের এক ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলাম। সেখানে দেখি একজনের মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ভালো ফলাফল করা কিন্তু কয়েক বছর গ্যাপ দিয়ে পাশ কোর্সে গ্রামের এক অখ্যাত কলেজ থেকে বিএ পাশ। জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছিল। চাকুরীপ্রার্থী উত্তর দিলেন তিনি ঢাকার একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন। হলে সীট পাবার জন্য কালো চশমা দলের সদস্য হয়েছিলেন। পরে সেখানে এক গণ্ডগোলে কালো চশমাদের হাতে এক পুলিশ অফিসার নিহত হলে তাকে হল-বিশ্ববিদ্যালয় দুই-ই ছাড়তে হয়। পড়াশোনায় ছেদ পড়ে। পরে গ্রাম থেকে পাশ কোর্সে অনিয়মিত ছাত্র হিসাবে স্নাতক হতে হয়। গণিতবিদ হবার স্বপ্ন মুছে ফেলে এখন বিপণন কর্মী হতে হয়েছে।
একই বোর্ডে একই দিনে আরেক জন প্রার্থী দেখি এক নামকড়া কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছেন, তারপর আর পড়াশোনা করেননি। কেন স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশোনা করেননি (বাংলাদেশে কৃষিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী না থাকলে কৃষিবিদ হিসাবে চাকুরী পাওয়া মুশকিল) আর কেন কৃষিবিদ না হয়ে বিপণন কর্মী হয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বললেন একই ধরনের গল্প। এই ভদ্রলোক কালো কোট দলের সদস্য ছিলেন। তিনিও এক গণ্ডগোলে পড়ে সাত বছর আর নিজের ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারেননি। ফলাফল কৃষিবিদ হবার স্বপ্ন মুছে বিপণন কর্মী হওয়া।
ছাত্র রাজনীতির জন্য এমন দিন-দুপুরে স্বপ্ন খুন হয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মূল দলের দুর্বৃত্তায়ন তার ছাত্র সংগঠনকেও কলুষিত করছে। ছাত্ররা এই লোভ-মোহ থেকে বের হতে চাইলেও সেটা হতে পারছেনা মূল দলের গডফাদারদের জন্য।
গত বিশ বছর ধরে দুটি দল পালাক্রমে ক্ষমতায় আসায় ছাত্রনেতাদের মধ্যে একটা ট্রেন্ড চালু হয়েছে। নিজ দল ক্ষমতায় না থাকলে তারা বিদেশে পাড়ি জমায়। সেখানে আগে করা চাঁদাবাজি-কমিশন-বখড়ায় প্রাপ্ত টাকা ব্যয় করে বিলাসী দিন যাপন করে। কেউ কেউ ডিগ্রী বেচে এমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে মাস্টার্স, পিএইচডি ইত্যাদি ডিগ্রী সংগ্রহ করে। এদের পাসপোর্ট হয় অন্য রঙের, সন্তানরা হয় অন্য দেশের নাগরিক। পরের টার্মে এরাই সরকারের হোমড়া-চোমড়া বনে যায়। তারা যে নিজের দেশকে ত্যাগ করেছে, এবং দেশটা এখন তাদের কাছে লুটের ক্ষেত্র ছাড়া কিছু নয় সেই বিবেচনা করা হয়না। কেউ কেউ কোন পদে না থেকেও এমন বিলাসী জীবন-যাপন করে যে তা দেখে বর্তমান ছাত্রদের মনে অমন হবার শখ জাগে। পাইকারী হারে ছাত্রনেতাদের বেচা-কেনাটা সামরিক শাসকেরা শুরু করেছিল। আর এখন সাবেক সামরিক-বেসামরিক কর্তা আর রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ী সবাই ছাত্রনেতাদের কেনার জন্য উদগ্রীব।
উপরে বলা দুটো দলের মধ্যে প্রথম দলের (সব হারানোর দল) লোকসংখ্যা বেশি। তবু দ্বিতীয় দলকে দেখে অনেকেই লোভে পড়ে যায়। সবচে’ ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে এই দ্বিতীয় দলটিই ভবিষ্যতে দেশ চালাবে। একটু লক্ষ করলে দেখবেন আমাদের প্রধান প্রধান রাজনীতিবিদদের মূল নাড়াটা দেশের বাইরে বাঁধা। পরিবারের সদস্যদের বড় অংশ দেশের বাইরে থাকে। পরিবারের প্রায় সবাই অন্য রঙের পাসপোর্টধারী। নিজের দলের ক্ষমতায় থাকার টার্ম শেষ হতে নিলেই এরা বিদেশে পাড়ি জমায়। তাই ছাত্র রাজনীতিকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার বানাতে বা ছাত্রদের ধ্বংসের পথে ঠেলে দিতে এদের একটুও বাঁধেনা।
এত সব কিছু দেখেও আমি কোন বিবেচনাতেই ছাত্রদেরকে রাজনীতির বাইরে থাকতে দিতে রাজী নই। তবে সেটা হালুয়া-রুটির রাজনীতি নয়। নিজেদের, নিজের শিক্ষায়তনের, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে তাদের ভাবতেই হবে এবং তা নিয়ে কথা বলতে ও আন্দোলন করতে হবে। নিজেদেরকে এভাবে ভবিষ্যত নেতৃত্বের উপযুক্ত করে তুলতে না পারলে দেশের নেতৃত্ব দুর্বৃত্তদের হাতেই যাবে। সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চার পাশে রাজনীতির পাঠটা না থাকলে নিজের বা দেশের কারো সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়।
দুর্বৃত্তদের অস্ত্রের জোর আছে সত্য, তবে সাধারণের যে সঙ্ঘশক্তি আছে সেটার প্রকাশ না ঘটাতে পারলে দুর্বৃত্তকে পরাজিত করা যাবেনা।
দোহাইঃ ইতিপূর্বে নিজের খোমাখাতায় নোট হিসাবে প্রকাশিত।





লেখাটি ভালো লাগলো। তবে প্রতি অনুচ্ছেদে জাস্টিফাইয়ের জাস্টিফিকেশন বোঝা গেলো না 
 
ছাত্ররাজনীতি তো হয় মূলত বড় দলের প্ল্যাটফর্মে; দুর্বৃত্তদের শেখানো-পড়ানো মতেই। তাহলে হালুয়ারুটিবিহীন ছাত্ররাজনীতি কীভাবে হবে!
আমার মনে হয় রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্রসংগঠন নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। যার শখ হয় মূল দলে গিয়ে মোষ তাড়াবে। ছাত্রদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজের জন্য রাজনৈতিক ব্যানার অপ্রয়োজনীয়।
১। জাস্টিফিকেশনের কোড দিয়েছিলাম অনভিজ্ঞতাবশতঃ। ঠিক করে দিলাম।
২। "ছাত্ররাজনীতি তো হয় মূলত বড় দলের প্ল্যাটফর্মে; দুর্বৃত্তদের শেখানো-পড়ানো মতেই। তাহলে হালুয়ারুটিবিহীন ছাত্ররাজনীতি কীভাবে হবে! "
হালুয়া-রুটির লোভটা ত্যাগ করা কঠিন, তবে ছাত্রদেরই এই লোভটা ত্যাগ করার মেরুদণ্ডটা আছে। বুড়ো হলে মেরুদণ্ড নরম হয়ে যায়। বড় দলের প্ল্যাটফর্মে থাকলেও নেতার অনৈতিক নির্দেশটা অমান্য করার সাহসও ছাত্রদেরই থাকে। ষাটের দশকে ছাত্ররাজনীতিটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কিন্তু অমনই ছিল। বিষয়টা এখন কঠিন, তবে অসম্ভব না।
৩। "আমার মনে হয় রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্রসংগঠন নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। যার শখ হয় মূল দলে গিয়ে মোষ তাড়াবে। ছাত্রদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজের জন্য রাজনৈতিক ব্যানার অপ্রয়োজনীয়।"
এতে রাজনীতি বিমুখতা তৈরি হবে। তার ফল ভালো হবে না। এজন্য বলেছিলাম, "সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চার পাশে রাজনীতির পাঠটা না থাকলে নিজের বা দেশের কারো সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়"।
শেষে প্লেটোর কথাটা মনে করিয়ে দেই, “One of the penalties for refusing to participate in politics is that you end up being governed by your inferiors”।
আমার মনে হয় ছাত্র রাজনীতি কঠোরভাবে থাকা উচিত। সমাজ সচেতনতা ছোটবেলা থেকেই চর্চার বিষয়। তবে অন্য জায়গায় মতো এটাও কলুষিত হয়ে গেছে। কলুষবিহীন ছাত্র রাজনীতির চর্চা ভবিষ্যতে হয়তো সৎ নেতার জন্ম দিতে পারে। নইলে রাজনীতি পুরাই মাস্তান নির্ভর ব্যাপার হয়ে যাবে এই এখন কার মতো।
কোন জায়গায় ফাঁকা থাকে না। ভালো ছাত্ররা রাজনীতিতে আসার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে বলেই, মাস্তানরা এখন খালি মাঠে গোল দিয়ে যাচ্ছে।
সহমত
সহমত। সীমাবদ্ধ পরিসরে স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতির চর্চাটা ছাত্রাবস্থায় (অবশ্যই আঠারো বছরের আগে না) করা থাকলে বড় হলে আরো বড় পরিসরে সেটা ঠিকভাবে করা সম্ভব হবে। আর প্রকৃতি শূন্যস্থান পূরণ করে ফেলে, তাই মেধাবীরা রাজনীতিতে না আসলে দুষ্টবুদ্ধির দুর্বৃত্তরাই মাঠ দখল করবে।
একমত ! বিশেষ করে , নিজেদেরকে ভবিষ্যত নেতৃত্বের উপযুক্ত করে তুলতে না পারলে দেশের নেতৃত্ব দুর্বৃত্তদের হাতেই যাবে । আমারো একই মত ।
চর্চাটা জরুরী। এটা না থাকলে মূলক্ষেত্রে ভুল করার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
দুর্বৃত্তদের অস্ত্রের জোর আছে সত্য, তবে সাধারণের যে সঙ্ঘশক্তি আছে সেটার প্রকাশ না ঘটাতে পারলে দুর্বৃত্তকে পরাজিত করা যাবেনা।
ভাল বলেছেন। মিশরের অবস্থা মনে পড়ে।
ঠিক, শুধু মিশর কেন? আমরাও কি বার বার একই কাজ করে দেখাইনি?
-আমাদের সকল স্তরের নেতা-ফেতারাই হালুয়া-রুটির স্বাদ পেয়ে গেছে। তার মজাটা ছাড়ানো মনে হয় কারো পক্ষে আর সম্ভব না!
হালুয়া-রুটি সবসময়ই ছিল দাদা। তবু মানুষ কখনো না কখনো হালুয়া-রুটিকে ছুঁড়ে ফেলে পতাকাটা হাতে তুলে নেয়। সাম্প্রতিক তিউনিসিয়া, মিশর, সিরিয়া আর ইয়েমেনকে দেখুন। আমরাও অমন করেছি '৫২-তে, '৬৬-তে, '৬৯-এ, '৭১-এ, '৯০-এ .......
ধ্বংশের মুখোমুখি হয়ে আসেন ফুল খেলি
কী বললেন, বুঝলাম না।
দুর্বৃত্তদের হাত থেকে দেশটাকে উদ্ধার করতে হলে সৎ ও সাহসী নেতৃত্ব নিয়ে ছাত্রনেতাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে । তারুণ্যের উদ্যম, উচ্ছাস, আবেগ ও দেশপ্রেম ছাড়া আর কোন বিকল্প আছে বলে মনে হয়না ।
মূল দায়িত্বটা কিন্তু জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিবিদদের। ছাত্ররা নিজেদের কাজের পাশাপাশি তাদের কাজে সাহায্য করতে পারেন, তাদের ভুল দেখিয়ে দিতে পারেন। ছাত্ররা ভবিষ্যতের নেতা, এখনকার নয়।
মন্তব্য করুন