নিশিমনের নৌকাযাত্রা
পর্বঃ ১
ভোরের আলো ভালোমত না ফুটতেই নিশিমন ঘরে তার সদ্য মৃত স্বামীর লাশ রেখেই নবাবি নৌকা ভাসিয়েছে পাথার জলে। সেই কবে ছোট্ট বেলায় নৌকা চালিয়েছিলো শখ করে, তারপর আর কখনো হাল ধরা হয়নি। আজ এই আলো আধাঁরে চোখে নোনতা জলের দাগ থাকতে থাকতেই অপটু হাতে আবার নৌকার হাল ধরেছে। আকাশে আবছা গাঢ় নীলের আভাস থাকলেও পাথারের জলে ঝুলে রয়েছে অন্ধকার। নিশিমনের নবাবি নৌকা অন্ধকার ফুটো করেই ভাসতে ভাসতে যেন চলে যাচ্ছে দূর আকাশে মিটমিট করা তারার দিকে। ছেড়ে আসা ঘরে যে মৃত পড়ে আছে মকিম মাঝি, সে একদিন রাতে দূরের দৃশ্যমান তারাগুলো দেখিয়ে নিশিমনকে বলেছিলো, দেখরে বউ, ওইখানে মনে হয় আল্লার আরশ। তার নিচে আসমান জমিন। জমিনের মধ্যে আকুল পাথার। আর পাথারের পাড়ে শুধু তুই আর আমি। তখন সদ্য বিবাহিত নিশিমন নাকের নথ দুলিয়ে বলেছিলো যাও, তুমি আর আমি একা না। ওই যে ঝিঁঝিঁ পোকা গুলা ডাকে, ওরাওতো আছে আমাগো লগে। লোকটা যখন হাসতো তখন মনে হত যেন হাসির শব্দে আশেপাশের গাছপালা নড়ছে। মকিম মাঝি তেমন হাসি হেসে সেই রাত্রি দ্বিপ্রহরে জড়িয়ে ধরেছিলো নিশিমনকে। গ্রন্থিল পেশি আর শক্ত পায়ের চাপে নিজের নরম দেহটা পিষ্ঠ করতে করতে নিশিমন শুনেছিলো লোকটা বলছে থাকুক, ঝিঁঝিঁ পোকা থাকুক, আকাশের তারা থাকুক, পাথারের জল থাকুক, আর বুকের মধ্যে তুই থাক। আমাদের মিলনে যে ফল ধরবে তোর গাছে তার নাম রাখবো হাকিম। মকিম মাঝির ছেলে হাকিম হবে আমার নবাবি নাওয়ের সর্দার। পুরোন এই সব কথা ভাবতে ভাবতে নিশিমন একা ভেসে চলে পাথারের জলে। কোথায় সেই মকিম মাঝি, কোথায় তার মানববৃক্ষের ফল নবাবি নাওয়ের সর্দার হাকিম। যে লোকটা বিগত দশ বছর একদিনের জন্যও ছেড়ে থাকেনি তাকে, গ্রামের লোকজনের বউপাগলা উপাধিতেও কর্ণপাত করেনি কোনদিন সেই মকিম মাঝি এখন লাশ হয়ে পড়ে আছে ঘরে। কই, সবইতো ঠিক আছে আল্লাহ্র দুনিয়ায়। লোকটা চারদিনের জ্বরে মরে গেলো অথচ পাথারের জলতো কাঁপলো না এতটুকু ! ঝিঁঝিঁ গুলোওতো থামালো না শব্দ, সেইতো অন্ধকার কেটে ভোর হচ্ছে। শুধু দুনিয়াতে মকিম মাঝি নাই। আল্লাহ্ এ তোমার কেমন আচার ! নিশিমন দাঁড় বায়। অন্ধকার ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে আহাজারির নদী পেরিয়ে সে যেন যেতে চায় ওই দূর তারার কাছে- আল্লাহ্র আরশ যেখানে।
ভোরের ভোঁতা একটা আলো ছড়াতে শুরু করেছে চারদিকে। জলের উপর ঝুলে রয়েছে কুয়াশা। তারপরও পাথারের অগভীর জলের তলে দেখা যায় লতাপাতা, মাছ, প্যাঁককাদা। নিশিমনের চোখ থেকে একফোটা জল গড়িয়ে পড়ে পাথারে, সেটার তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে এমনভাবে যেন কেউ দুর্বল সাতারে কুয়াশা তাড়াতে চাইছে। নিশিমন কথা বলে নিজের সাথে- এই নাও, এই নবাবি নাওটা লোকটা পেয়েছিল তার দাদার কাছ থেকে। সেই আমলে এই নৌকায় করে পাথারের জলে ভাসতেন নবাব জমিদারেরা। মাঝির ছেলে মাঝি হয়ে মকিম পেয়েছিলো এই নাও উত্তরাধিকার সূত্রে। তারপর কত যতœ প্রত্যাশায় সে এই নৌকা বাঁচিয়ে রেখেছিলো নিজের উত্তরাধিকারের জন্য। নিশিমনকে মকিম প্রায় বলতো তার স্বপ্নের কথা। তার যখন ছেলে হবে তখন নাম রাখা হবে হাকিম। বাপের নামের সাথে মিলিয়ে পুত্রের নাম। দুজন মিলে এই নাও নিয়ে প্রতিবছর বৈশাখী আড়ংয়ে পাথারে খেলবে নৌকাবাইচ। ঘাটের সামনে বেঁধে রাখা তার নবাবি নাও দেখে পাথার দিয়ে বর্ষায় নতুন বউ নাইওর যেতে যেতে মুগ্ধ হয়ে বলবে, ওই দেখা যায় বাপ বেটার নবাবি নাও।
লেখা ভালো লাগছে।
এই লাইনটা একটু দেখবেন আবার?
আগামী পর্বের জন্য অধীর অপেক্ষায়...
ঠিকাছে , চলুক ...........
লেখা ভালো লাগছে।
চলুক...
আগামী পর্বের অপেক্ষায়।
মন্তব্য করুন