ইউজার লগইন

বাজেট: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বলির পাঁঠা

হাত-পা বাঁধা থাকলে, যে কোন মানুষকে সহজেই নির্যাতন করা যায়। একজন অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যক্তিও তাকে আঘাত করার ক্ষমতা রাখে। কারন, বাঁধা অবস্থায় নির্যাতিত ব্যক্তির কেবল নির্যাতনের শিকার হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অনেকটা সেরকমই মনে করা হয়, অন্তত সরকার সংশ্লিষ্টরা সেটাই মনে করে। তাই তাদের বলির পাঠা বানিয়ে রক্ত চুষে খাওয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার।

সম্প্রতি ২০১২-১৩ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত নতুন বাজেটের আলোকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি’র ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হয়েছে। একইসাথে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ওপর থেকে ৯ শতাংশ হারে কর আদায়ের মাধ্যমে কার্যত শিক্ষার্থীদের নিকট থেকেই অর্থ আদায়ের পরিকল্পনা করেছে সরকার। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে এখন থেকে পূর্বের তুলনায় শিক্ষার্থীদের অপেক্ষাকৃত বেশি টাকা গুনতে হবে ।

নতুন বাজেটে প্রতিবারের মত এবারও শিক্ষাখাতে বরাদ্দের পরিমান হতাশাজনক। মাত্র ১১.৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে শিক্ষাখাতে। দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য এত কম বাজেটে কিভাবে সার্বজনীন শিক্ষা বাস্তবায়ন সম্ভব? এই বাজেটে নিজ খরচে পরিচালিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নূন্যতম ভুর্তুকি দেয়ার পরিকল্পনা তো দূরের কথা উল্টো কর আরোপের মধ্য দিয়ে শিক্ষাকে মূলত পন্যে রূপ দেয়ার ষড়যন্ত্রকে চুড়ান্ত বৈধতা দেয়া হয়েছে। একইসাথে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর দীর্ঘদিনের চাওয়া শিক্ষাখাতে বাজেটের ২৫ ভাগ বরাদ্দের দাবিকেও অপমান করা হয়েছে চরমভাবে।

এ বছর শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দেয়া ২১ হাজার ৪০৮ কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্যে রয়েছে ৯ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্যে রয়েছে ১১ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় এই বাজেটে ১৫৭১ কোটি টাকা বেশি দেখানো হলেও মুদ্রাস্ফিতি বিবেচনা করলে দেখা যায়- এটা কোন বৃদ্ধি নয়, পূর্বের বাজেটেরই পুনরাবৃত্তি। এই বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভুর্তুকি দেয়া কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক কাজে সহায়তা করার কোন প্রকল্পও প্রস্তাব করা হয়নি।

এর আগে গত ২০১০-১১ অর্থ বছরে একইভাবে শিক্ষার্থীদের বেতন-ফি’র ওপর ৪.৫ শতাংশ হারে কর আরেোপ করা হয়েছিল। ওই কর আরোপের পর যখন দেখা গেল করের টাকাও বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের নিকট থেকেই আদায় করছে, তখন শিক্ষার্থীরা ফুসে উঠেছিল। ২০১০ সালের জুন মাসে বেসরকাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসলে ঢাকা শহরে ব্যপক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ছাত্রদের ব্যপক আন্দোলনের মুখে সরকার সেসময় কর প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিল। শিক্ষামন্ত্রী নিজে সেসময় ঘোষনা দিয়েছিলেন যে, শিক্ষার্থীদের বেতন-ফি’র ওপর কোন প্রকার কর আরোপ করা হবে না।

অথচ সে কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছেন সরকার সংশ্লিষ্টরা। তারা পুনরায় কর আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তবে এবার কর আরোপ করা হয়েছে নতুন কৌশলে। তাতে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ করার কোন সুযোগ নেই বলে মনে করছে সরকার। সেই ধারনা থেকেই শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের ভর্তির ওপরেই এই কর বসানো হয়েছে। যখন শিক্ষার্থীরা ভর্তি হবে, সেসময়ই ভর্তির সাথে মোটা অঙ্কের কর দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি না থাকায় এর প্রতিবাদ করারও কোন সুযোগ থাকে না। ফলে যে নতুন ছেলেটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে এসেছে, সে ছেলেটি প্রতিবাদ না করেই কর দিতে বাধ্য হবে। মূলত শিক্ষার্থীদের অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে এই কর আদায়ের পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী।

বর্তমানে দেশে ৬২ টি অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী অধ্যায়ন করছে। অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। ভর্তির ওপর কর আরোপের ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ফি’এর পরিমান বেড়ে যাবে। সেই বর্ধিত ফিও বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ আদায় করবে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে ওঠে আসা শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে, অতীতে যেমনটা হয়েছে! স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীদের সেই টাকা পরিশোধ করতে মধ্যবিত্ত বাবা-মা’রই দ্বারস্থ হতে হবে।

বিভিন্ন কৌশলে শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে অর্থ আদায় নতুন নয়। অতীতের সব সরকারই এই নীতি অবলম্বন করে এসেছে। ইউজিসি’র ২০ বছর মেয়াদী প্রকল্পের আলোকে ২০২৬ সালের মধ্যে প্রত্যেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজস্ব আয়ের খাত থেকে চলতে হবে। এটি মূলত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বেসরকারিকরন প্রকল্প। সরকার শুধু সেটাতেই ক্ষান্ত নয়, এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিনত করে কর আদায়ের পরিকল্পনা করেছে। অথচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে কোন লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষনা করা হয়নি। লাভজনক নয় এমন প্রতিষ্ঠান থেকে কিভাবে কর আদায় করা যায়-আমার বোধগম্য নয়।

প্রতিবছর বাজেটের ঘাটতি পূরন করতেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে অযৌক্তিকভাবে কর আরোপ করা হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর কর আরোপ- সেই প্রক্রিয়ারই অংশ। উর্ধ্বমুখি বাড়ি ভাড়ার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যের যাতাকালে পিষ্ট হয়ে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে ওঠে আসা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেড় লাখ শিক্ষার্থী এমনিতেই সংকটাপন্ন জীবনযাপন করছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় অঙ্কের খরচের সাথে কর যুক্ত হলে তাদের জীবন আরো সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে। বাজেট জনগনের জন্য কিন্তু সেই বাজেটই যদি জনগনকে আশার আলো না দেখিয়ে উল্টো জীবনকে বিষাদময় করে তোলে তবে সে বাজেটের কোন প্রয়োজনীয়তা নেই।

শিক্ষা আমাদের মৌলিক অধিকার। সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মৌলিক অধিকার পূরন করতে বাধ্য। সরকার মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন করতে না পারুক অন্তত পরিবারের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের ওপর কর আরোপ করে তাদের শিক্ষাজীবনকে আরো বিষাদময় করে তোলার কোন অধিকার সরকারের নেই।

পোস্টটি ৫ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

রন's picture


শিক্ষা খাত থেকে কর আদায় ব্যাপার টা গ্রহনযোগ্য নয় আমার কাছেও তবে আমাদের মত গরীব দেশে যেভাবে প্রাইভেট ভার্সিটি গড়ে উঠেছে এবং এদের পরিচালনা ব্যবস্থা দেখার পর কর আরোপের ব্যাপারটা খুব একটা অবাক করেনা আমাকে! এতে করে কারো অপর খুব একটা প্রভাব পড়বে বলেও আমার মনে হয়না! বরং সরকারের কিছু টাকা আয় হয়ে গেলো!

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


টিপ সই

তানবীরা's picture


এ ধারনাটা ঠিক না। দেশের মানুষ অনুপাতেতো ভার্সিটি বাড়ে নাই। অনেকেই পেট কেটে তার সনতানকে পড়ান

মাহবুব সুমন's picture


বেসরকারী ( ব্যক্তি মালিকাধীন ) বিশ্ববিদ্যালয়ে কেনো ভর্তুকি দেয়া হবে ?

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

সিয়াম সারোয়ার জামিল's picture

নিজের সম্পর্কে

গর্তজীবী হতে চেয়েছিলাম, শোষক আমাকে রাস্তায় নামিয়েছে। এখন আমার লক্ষ্য রাজপথ, যার মালিক কেবলই জনগন।