বর্তমান সরকার, শিক্ষাব্যবস্থা এবং একজন ছাত্রের বিশ্লেষণ
কয়েকদিন ধরেই সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় আর গুণীজনদের জন্য বরাদ্দকৃত বিশেষায়িত পাতাগুলো পড়ছি। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তারা যা লিখেছেন তাতে আমি স্তম্ভিত, বিশেষক্ষেত্রে কষ্টও পেয়েছি :(। আর বিজ্ঞ সাংবাদিকদের লেখাগুলো পড়ে তো হাসতে হাসতে আমার পেটই ফেটে যাওয়ার জোগাড়। আমার একটাই প্রশ্ন, তারা কি কখনো ছাত্র-ছাত্রীদের জিজ্ঞেস করেছেন বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তাদের সমস্যা কি? আমি জানি, তারা কেউই জিজ্ঞাসা করেননি আর করলেও সেটা আওয়াজ ছাড়াই চেপে গেছেন। এসব নিয়ে আমি এই পোস্টেরই কোন একদিকে কিছু কথা বলব। তবে তার আগে মজার কিছু বলি।
আওয়ামী সরকার আর বিএনপি সরকারের শিক্ষাখাতে উন্নয়নের কথা চিন্তা করলে আমি বলব আওয়ামী সরকার এই একটা দিকে অনেক এগিয়ে। আর যে খাতে পিছিয়ে সেটা হল চেতনা খাত। তারা এই খাতে জনগণকে শুধু আঘাতই দিয়ে গেছেন। যাক যা বলছিলাম, আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে বড় অবদান তারা ছাত্র-ছাত্রীদের ১৯৯৬ সালের প্রাগৈতিহাসিক বইগুলো থেকে রেহাই দিয়েছেন। মাঝখানে যখন চারদলীয় ঐক্যজোট সরকার ছিল তারা এই বইগুলোর কোন উন্নয়ন করেননি। কিন্তু আওয়ামী সরকার এই বইগুলোকে অনেকটাই হালনাগাদ এবং যুগোপযোগী করেছেন। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা হল যারা সমালোচনা করছেন তাদের মতিভ্রম আর সরকারের ব্যর্থতা। আমি ধারাবাহিকভাবে বলছি।
প্রথমে ভাল দিকগুলো দিয়েই শুরু করা যাক। বইগুলো অনেকটাই যুগোপযোগী। এর প্রেক্ষিতে আমার এক বন্ধু বলেছিল, ‘বইগুলো আমাদের বইয়ের চাইতে অনেক ছোট, জুনিয়রদের চাপ আমাদের চেয়ে অনেক কম’। কিন্তু রিয়েলিটি কি? আমার ছোটবোন ক্লাস এইটে পড়ে। আমি ওকে প্রায়ই পড়াই। সেদিক থেকেই বলছি। আগের এইটের বইয়ে পৃষ্ঠা বেশি ছিল, বর্ণনা বেশি ছিল। কিন্তু এখন অল্প পাতায় অনেক বেশি টপিক যুক্ত করা হয়েছে। এর সমালোচনা করে অনেকেই বলেছিলেন যে বেশি টপিক দিয়ে লাভ কি হল যদি না বর্ণনাই থাকল! আমি খুব টাস্কিত হয়ে তাদের দিকে তাকিয়েছিলাম। কারণ আমার মনে হয়নি তারা কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। পড়লে আর যাই হোক এরকম ছন্নছাড়া প্রশ্ন করতে পারতেন না। বিস্তারিত পড়াশুনার জায়গা বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল লেভেল নয়। স্কুলে মানুষ শুধু স্বাভাবিক জিনিসগুলো সম্বন্ধে জানবে। এজন্যেই বিশ্বের সব দেশের স্কুল গুলোতে ছাত্রদের পিএইচডি করানোর বৃথা চেষ্টা করা হয়না যেমনটা হয় আমাদের এই দেশে। একজন ছাত্র যদি স্কুলেই সব বিষয়ে বিস্তারিত ধারণা পেয়ে যায় তবে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কি দরকার?
তবে সরকার যে অকাজটা করেছে সেটা হল বইগুলোকে নাপিত দিয়ে সম্পাদনা করিয়ে। কারণ কোন বিজ্ঞজন দিয়ে সম্পাদনা করানো হলে এত ভুল থাকত না বইয়ে। আর যেইসেই ভুল নয়, রীতিমত ভুলের পাহাড়। এমনকি বানান সতর্কতাতেও বানান ভুল। আমি জানি না কোন সম্পাদকমন্ডলী এর সাথে যুক্ত ছিলেন। জানলে বাড়িতে গিয়ে জুতো মেরে আসতাম নতুন প্রজন্মকে ভুলভাল শেখানোর জন্য। সরকার এখনও একটা বিষয় পেরে উঠেনি সেটা হল বইগুলো রসাত্মক করা। অন্ততপক্ষে ক্লাস এইট পর্যন্ত বইগুলো রসপূর্ণ করা উচিত ছিল। অবশ্য তথ্যপ্রযুক্তি বই বেশ রসপূর্ণ, এরকম সব কয়টাতেই হওয়া উচিত।
হুম, এবার বলব সৃজনশীল প্রশ্ন-পদ্ধতি নিয়ে। এটা নিয়ে জাতীয় এলার্জি দেখা দিয়েছে। বিশেষত অভিভাবকমন্ডলী আর সাংবাদিকদের। অনেক অভিভাবকদের মুখেই শোনা যায় এটা নাকি একটা ফালতু পদ্ধতি। আমি অবশ্য তাতে রাগ করি না। কারণ সৃজনশীল পদ্ধতি ভাল না মন্দ এটা তারাই উপলব্ধি করতে পারেন যারা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নামক পুলসিরাত পার হয়েছেন।
স্কুল-কলেজ লেভেলে আমাদের যেটা করানো হয় সেটা অনেকটা তুলসী পাতার রস খাওয়ানোর মত। আগের দিনে কাশি হলে তুলসী পাতা বেঁটে রস বের করে মধুর সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো হত, এমনকি এখনও হয়। কাশি নিরাময়ে এটা একটা কার্যকর পদ্ধতি। আর আমাদের শিক্ষকরা আমাদের পাঠ্য বইগুলো তেমনই বেঁটে বেঁটে ছোবড়া বানিয়ে চিরতা দিয়ে গেলানোর চেষ্টা করেন। আমরা তেতো জিনিস গিলতে চাই না কিন্তু ছেঁচা খাওয়ার ভয়ে তেতো ঔষধ গেলার মত করেই ঐ ছোবড়া গিলে ফেলি। কিন্তু তা তো আর হজম হয় না, হয় বদহজম। তারপর পরীক্ষার হলে গিয়ে স্রেফ উগড়ে দিয়ে আসি। তাই প্রকৃত শিক্ষা আসলে হয় না। সেদিক থেকে ভাবলে সৃজনশীল পদ্ধতি মুক্তির একটা বড় রকমের আশ্বাস। কিন্তু আমাদের শিক্ষকমন্ডলী বোধ হয় আমাদের মুক্তি দিতে নারাজ। শিক্ষাব্যবস্থা বদলেছে, বইয়ের বচন বদলেছে কিন্তু শিক্ষকদের বাচন বদলায়নি। এখনও তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় “জয় বাবা মুখস্থ”।
অবশ্য শিক্ষকমন্ডলীকে এভাবে দোষারোপ করা অন্যায় যেহেতু সরকারই জনগণের পাছায় পিন মেরে দিচ্ছে । “সরকার আমাদের দিয়েছে টয়লেট কিন্তু কেড়ে নিয়েছে কমোড”। সরকারের উচিত ছিল শিক্ষকদের সঠিক ট্রেনিং দেওয়া যাতে তারা নিজেরাই গাইড নির্ভর হয়ে না পড়ে। অনেক স্কুল আছে যেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের একটা গাইড ধরিয়ে দিয়ে বলা হয় এই গাইড থেকে এক্সামে সব প্রশ্ন আসবে। আর ছাত্র-ছাত্রীরা লেগে যায় সেটা মুখস্থ করে আমলনামা ভারি করার কাজে যাতে সেই আমলনামার জোরে পরীক্ষা নামক পুলসিরাত পার হয়ে যেতে পার। এটা কিন্তু আদৌ সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির উদ্দেশ্য ছিল না। অনেক অভিভাবককে আমি দেখেছি যারা গাইড কিনে ছেলে-মেয়েদের গাইড মুখস্থ করাচ্ছেন; বইয়ে যে বোঝার মত, উপলব্ধি করার মত অনেককিছু আছে তারা তা স্বীকার করতে চান না অথবা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করতে পারেন না।
গুণীজনেরা ও সাংবাদিকেরা এসব নিয়ে অনেক আগে থেকেই আলোচনা-সমালোচনা করে চলেছেন। কিন্তু তারা কেউই মাঠে নেমে দেখেননি শিক্ষার বর্তমান অবস্থা। সাংবাদিকেরা যেসকল বিশ্লেষণ করেছেন পত্র-পত্রিকায় তা রীতিমত হাস্যকর। এ দেশে জার্নালিজম থেকে পাস করা সাংবাদিক নেহাত কম। বেশিরভাগ সাংবাদিকের শিক্ষার ঝুলি অতটা ভারি নয়, বিশেষ করে আঞ্চলিক ও ফটো-সাংবাদিকদের। এমন সাংবাদিক দেখার সৌভাগ্যও আমার হয়েছে যে শুধু কোনমতে এস.এস.সি’র বৈতরণী নদী পার করেছেন। কিন্তু বুলি ছাড়ার সময় তাদের দেখে মনে হয় একেকজন হলেন মহা শিক্ষিত, জ্ঞানী মানুষ।
সরকার আরেকটা মহাকাজ করেছে স্কুল শিক্ষকদের কোচিং করানোর অনুমতি দিয়ে। মন্ত্রী মহাশয় যে কিছু ফল-মূল ইয়ে মানে ইয়ে পেয়ে অনুমতিটা দিয়েছেন তাতে আমি নিঃসন্দেহ। কারণ এমন গাজাখুঁরি অনুমতি সরকার কিভাবে দিল তা আল্লাহ মালুম। এতে কিন্তু সাধারণ জনগণই শোষণ হচ্ছে। সরকারের উচিত ছিল শিক্ষকদের বেতনটা বাড়িয়ে চাপ দিয়ে তাদেরকে ক্লাসে পড়াতে বাধ্য করা। এখন একটা চমৎকার সিস্টেম দাঁড়িয়ে গেছে। ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাসে স্কুল-কলেজের ক্লাসে বসে তাদের কোর্সের নাম শোনে, স্কুল-কলেজের কোচিংয়ে সেটার ট্রেইলার দেখে, পুরো ছবিটা দেখার জন্য তাদের আবার বিভিন্ন কোচিং কোম্পানিতে দৌড়াতে হয়। অতঃপর উপযুক্তভাবে জ্ঞান-নেত্র বিকশিত হবার জন্য অভিভাবকেরা বাসায় শিক্ষক রেখে দেন। এতে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো কিন্তু ফান্দে পড়ে কান্দে। সরকার যদি একটু সচেষ্ট হয় তাহলে হয়ত অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মা তাদের ডাক্তার দেখাবার খরচটা পেয়ে যান।
অনেক কথা বলে ফেললাম। আসলে মনের মধ্যে এসব ঘুরপাক খাচ্ছিল কয়েকদিন ধরেই। সব এমনভাবে বের হল যে হয়ত আগা-মাথা পাওয়া দুষ্কর। এতদূর পড়ার জন্য ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।
মন্তব্য করুন