ইউজার লগইন

ধূসর গোধূলিঃ মৌমাছি

dhusor godhuli-13.jpg

বাড়ি এসে অয়ন দেখে বাবা ফেরেনি তখনো। মা উঠান ঝাড়ু দিয়ে এসে বলে,
-তোদের কি নাওয়া-খাওয়া লাগব না?
-একটু পর যাই মা, দুই একদিন দেরীতে খাইলে কিছু অয়না, শিউলি বলে।
-আপা দেখ, ঐ ডালটায় কত্তবড় দুইডা সপরি! ঘরের সামনের পেয়ারা গাছটার মাথার দিকে আঙ্গুল তুলে শিউলিকে দেখায় বকুল। অয়ন গলা বাড়িয়ে বকুলের দেখানো হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে বড় দু’টো ডাঁসা পেয়ারা যেন ওর দিকে তাকিয়ে আছে। একলাফে সিঁড়ি থেকে উঠানে নেমে পেয়ারা গাছটার কাছে গিয়ে বলে,
-এইডা আমার গাছ, ছোটদি তুই আমার গাছের পেয়ারা ধরবি না কইলাম। এই দুইডার একটা আমার আরেকটা বড়দির।
-ক্যান, তুই আমার গাছ থেইক্যা বড়ই খাস না?
-হ খাই, তোরটা তো আমি খামুই কিন্তু আমার গাছের পেয়ারা তুই ধরতে পারবি না, বাবা কইছে এইডা আমার গাছ।
-দ্যাখ আপা, কেমন হিংসুইটে অইছে!
-থাউক, অরে খ্যাপাইস না। যা পাইড়া নিয়া আয়, একটা অরে দে আরেকটা তুই আর আমি ভাগ কইরা খামুনে।

বকুল একটা বাঁশ দিয়া পেয়ারা দু’টো পেড়ে একটা অয়নকে দিয়ে দেয়। তিনজনে সিঁড়িতে বসে পেয়ারা খাচ্ছে হঠাৎ সুপারি গাছগুলোর ফাঁক গলে অয়ন দেখতে পায় বড় রাস্তা দিয়ে বাবা সাইকেলে চেপে বাড়ি ফিরছেন। এক লাফে সিঁড়ি থেকে নেমে বড় পুকুরের পাড় ধরে রাস্তার দিকে ছুটতে থাকে ও। অয়নকে আসতে দেখে মাস্টারসাব সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়ান। কাছাকাছি এলে জিজ্ঞেস করেন,
-কি বাজান, এত ছোটাছুটি ক্যান?
-বাবা, আমি সাইকেলে চড়ুম, আমারে নিয়া ঐ বড় রাস্তায় ঘুরতে অইব।
-ঠিক আছে ওডো, তোমারে ঘুরাইয়া নিয়া আহি
বেশ কিছুক্ষণ সাইকেলে চড়ে সখ মিটার পর বাবার সাথে বাড়ি ফিরে।
দুপুর ঘনিয়ে গেছে বেশ আগেই। প্রতিদিন মন্টুমামার সাথেই গোসল করে, আজ বাবাকে পুকুরে আসতে দেখে অয়নও নেমে পড়ে। ও মন্টুমামার কাছে সাঁতার শিখেছে আগেই, তবে একটানা বেশীক্ষণ ভেসে থাকতে পারে না। মন্টুমামা তাই একটি কলাগাছ কেটে পুকুরে ভাসিয়ে রেখেছে। গোসলের সময় অয়ন ওটাকে আঁকড়ে ধরে সারা পুকুরজুড়ে সাঁতার কাটতে থাকে। এই পুকুরের মাঝখানটা অনেক গভীর। অয়ন অনেকদিন ডুব দিয়ে মাটি তুলে আনার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি, কোনদিন মাটি ছুঁতেই পারেনি। যত নীচে যাওয়া যায় পানি ততই ঠাণ্ডা। গরমের সময় ও অনেকদিন ধরে পানির নীচে ডুব দিয়ে থেকেছে। মন্টুমামা অনেক ভাল সাঁতার কাটতে পারে, একডুবে একেবারে পুকুরের মাঝখানে চলে যায়। ডুব দিয়ে মাছও ধরতে পারে। একদিন ঘাটের নীচ থেকে খালি হাতেই শিং মাছ ধরেছিল। অনেকক্ষণ সাঁতার কাটার পর বাবা বলে, এইবার উইঠা আস বাজান, বেশীক্ষণ পানিতে থাকলে ঠাণ্ডা লাইগা যাইব। বাবার কথামত অয়ন উঠে আসে।
বিকেলে সুবলকে নিয়ে মালতি আসে অয়নদের বাড়ি। মালতি শিউলির সাথে গল্পে মশগুল হয়ে পড়লে আয়ন আর সুবল বেরিয়ে পড়ে।
-তোদের বাড়ি নৌকা নাই?
-আছে তো! একটা ছোড নৌকা আছে, মন্টুমামা অইডায় কইরা ধান আনা নেওয়া করে। দক্ষিণ ধারে খালের মধ্যে বান্ধা আছে। অয়ন হাত দিয়ে বাড়ির দক্ষিণ দিকটা দেখিয়ে দেয়। তারপর বলে- ক্যান, তুই নৌকায় চড়বি?
-হ, ল নৌকা নিয়া খালে ঘুইরা আহি
দুজন মিলে এগিয়ে চলে যেখানে নৌকাটা বাঁধা আছে। খালের একেবারে কাছে এসে দেখে ঝোপের আড়ালে বাঁধা নৌকাটা পানিতে প্রায় ডুবে আছে। এখন চড়তে হলে পানি সেঁচে আগে এটাকে ভাসাতে হবে ভেবে দমে যায় ওরা।
-না রে, এইডায় চড়তে অইলে দুইজনরেই খালে নাইমা আগে পানি হিচতে অইব
-সুবল জানোস? আমগো ছাড়াবাড়ির বাগানের মধ্যের বড় আমগাছটায় অনেক বড় একটা মৌমাছির বাসা বানাইছে, দেখবি?
-সহ্যই? ল, যাই।
দুজনে উঠানের পাশ ঘেঁষে সাজনা গাছটার নীচে দিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়াবাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো। সুবল দেখল অয়নদের এই বাগানটা ওদের বাড়ির উত্তর বাগানের চেয়েও বেশ বড় আর গাছপালাও অনেক বেশী। পথের দু’পাশে ছোট ছোট প্রচুর গাব গাছ, দু’হাত দিয়ে এগুলো সরিয়ে সরু পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে ওরা দাঁড়ায় বড় আমগাছটার নীচে। উপর দিকে তাকিয়ে দেখে গাছের মাঝামাঝি আড়াআড়ি ভাবে ঝোলানো একটি ডালে অনেক বড় একটি মৌমাছির বাসা। গত শীতের সময় ওদের উত্তর বাগানের পুকুরের মধ্যে হেলানো জামগাছটাতে একটা মৌমাছির বাসা হয়েছিল, বাবা, কাকা আর গোপালদা মিলে ওটা কেটেছিল। এক বালতি মধু হয়েছিল সেবার। গোপালদা মৌমাছির হুল খেয়ে দুইদিন জ্বরে পড়েছিল। অয়নদের মৌমাছির এই বাসাটা আরও বড়। ওর খুব ইচ্ছে হচ্ছে এটা কাটার সাময় এখানে থাকে। অয়নকে জিজ্ঞেস করে,
-তোরা এইডা কবে কাটবি? অয়নকে জিজ্ঞেস করে সুবল
-বাবা কইছে কাইল বিহানবেলা কাটবে।
-তাইলে বিহানে আমি আমুনে।
সকাল থেকেই অস্থির হয়ে আছে অয়ন। সুবল এসে পড়েছে সেই কখন! দুজনে মিলে মৌমাছির বাসাটা আরেকবার দেখে এসেছে। পুকুরঘাটে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো ছমির আর মালেকের জন্য, মন্টুমামা বলেছে ওরা এসে পড়লেই মধু কাটতে যাবে। সুবল বলে- জানোস? মৌমাছির হুল খাইলে জ্বর আইসা যায়। ধোঁয়া দিলে মৌমাছিগুলান উড়তে থাহে, ঐ সময় বইসা পড়তে হয়। দু’জনে কথা বলার ফাঁকে ছমির আর মালেক এসে হাজির হয়। বাগানের পথ ধরে মন্টুর পিছন পিছন এগিয়ে গিয়ে বড় আমগাছটার নীচে দাঁড়ায় ওরা। উপরে তাকিয়ে দেখে চাকের চারপাশে মৌমাছিগুলো ভন ভন করে উড়ে বেড়াচ্ছে। ছমির গাছের কাঁচা পাতা, ডাল আর খেড় দিয়ে তৈরি আটিটাতে আগুন ধরিয়ে ধোঁয়া তৈরির কাজটা শুরু করে দেয়। অয়ন কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে দেখে ধোঁয়াটা কেমন সাপের মত কুন্ডুলী পাকিয়ে উপরদিকে উঠে যাচ্ছে আর ছড়িয়ে পড়ছে মৌমাছির চাকের আশেপাশের অনেকটা জায়গা জুড়ে। মৌমাছিগুলো মৌচাক ছেঁড়ে আকাশের দিকে ছড়িয়ে পড়ে, কয়েকটা কাছাকাছি আসতেই দৌড়ে একটু দূরে গিয়ে মাটিতে বসে পড়ে ওরা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওগুলো বাসা ছেঁড়ে অনেক দূরে উড়ে যায়, অয়নের বেশ খারাপই লাগে ওদেরকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য। ও দেখলো, মন্টুমামা খেজুরগাছ কাটার বড় ধারালো দা’টা দিয়ে কেমন কচ করে কেটে দিল চাকটা, নীচে মালেকের ধরে রাখা বড় বলটা পুরোটাই ভরে গেছে। কেটে ফেলা চাক্টার সাথে তখনও কয়েকটা মৌমাছি লেগে ছিল।

বাজারের পশ্চিম দিকে, মূল বাজারে ঢোকার ঠিক আগে নদীর পাড়ে হারু মেম্বরের চালের আড়ত। প্রতিদিন বস্তায় বস্তায় ধান ভ্যান, নৌকা করে আসে। পাঁচ ছয়টা মেশিনে ধান ভেঙ্গে তুষ আলাদা করে বস্তায় চাল ভরা চলছে। নারী পুরুষ মিলে দশ পনেরো জন লোক সবসময় কাজ করে।
স্বাধীনতার পূর্বে হারুন মিয়ার বাপ হাশেম গাজীর আর্থিক অবস্থা ততটা স্বচ্ছল ছিলনা। মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে এরা হিন্দু পারবারগুলোর উপর অত্যাচার শুরু করে, তারপর অনেক হিন্দু পরিবার গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেলে ওদের ধন সম্পদ লুট করতেও দেখেছে গ্রামের কেউ কেউ। একসময় মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে বাপ-বেটা গ্রাম থেকে পালিয়ে যায় ফিরে আসে যুদ্ধ শেষ হবার পর। অবশ্য ফিরে আসার কিছুদিনের মধ্যেই খুন হয়ে যায় হাসেম গাজী, শোনা যায় মুক্তিযোদ্ধারাই মেরে ফেলে তাকে। কয়েক মাস পার হবার পর অবস্থা পাল্টে যায়। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে একসময় দেখা যায় হঠাৎ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয় কিছু লোক। হারুন মিয়া তাদের একজন। স-মিল, ধান-চালের আড়ত, হাটের ইজারা; এসব করে গ্রামে বেশ আধিপত্য বিস্তার করে। বাপ মারা যাবার পর হারুন মিয়ার দাপট যেন আরও বেড়ে যায়। কয়েক বছর আগে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহন করে মেম্বার হতে না পারলেও নিজের নামের সাথে মেম্বর কথাটি জুড়ে যায়। সেই থেকে হারুন মিয়া হয়ে যায় হারুন মেম্বার ওরফে হারু মেম্বর। পঞ্চাশ বছর বয়সে ঘরে দুইটি বউ থাকলেও উঠতি বয়সের কোন তরুণী দেখলে তার শরীরের মধ্যে উথাল পাথাল ঢেউ খেলে যায়, চাউলের কলে কাজ করা মধ্যবয়স্ক মহিলাদের ঘর্মাক্ত শরীর দেখে তার চোখ আটকে যায়!

চলবে.....
• ধূসর গোধূলিঃ চেনা পথের গল্প...
• ধূসর গোধূলিঃ হারানো দিনের ডাক...
• ধূসর গোধূলিঃ দুরন্তপনা
• ধূসর গোধূলিঃ মায়া
• ধূসর গোধূলিঃ কোটাখালীর বাঁকে
• ধূসর গোধূলিঃ কাকতাড়ুয়া

পোস্টটি ৮ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

তানবীরা's picture


পড়লাম, পরেরটার আশায়

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


ধন্যবাদ, পরেরটা আসছে... Smile

আহসান হাবীব's picture


সময়ের অভাবে আপনার সব লেখাগুলো পড়তে পারি না। সময় হলে একটা একটা করে পড়ার ইচ্ছা আছে। চালিয়ে যান। ভাল থাকবেন। Love

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


ধন্যবাদ, কেমন আছেন হাবীব সাহেব?

সামছা আকিদা জাহান's picture


পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


ধন্যবাদ আপুনি, পরের পর্ব চলে আসছে... Smile

আরাফাত শান্ত's picture


টিপ সই

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


ধইন্যা পাতা

মীর's picture


যথারীতি অনিন্দ্য।

১০

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


কমেন্টে যথারীতি ভালোলাগা... Big smile

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture

নিজের সম্পর্কে

খুব সাধারণ মানুষ। ভালবাসি দেশ, দেশের মানুষ। ঘৃণা করি কপটতা, মিথ্যাচার আর অবশ্যই অবশ্যই রাজাকারদের। স্বপ্ন দেখি নতুন দিনের, একটি সন্ত্রাসমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের।