গোপালপুরের গণহত্যা
৫ই মে, ১৯৭১। নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার গোপালপুর সদর। অপারেশন সার্চ লাইটের নামে বাঙ্গালী নিধনের অংশ হিসেবে রাজশাহীতে অবস্থিত সেনা সদর দফতর থেকে স্থল পথ এবং আকাশপথ ব্যবহার করে সেনা পাঠানো হয় পাবনা, ঈশ্বরদী এবং নাটোরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে। আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত সেনাবাহিনী দখল করে নেয় বাঙ্গালীদের ঘাঁটি গোপালপুরের চিনিকল। প্রায় ২০০ চিনিকলের বাঙ্গালী কর্মচারীকে জড়ো করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে।
উক্ত অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত লেঃ আনোয়ারুল আজিম স্বেচ্ছায় ধরে দিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীদের অনুরোধ করে সাধারণ নিরীহ মানুষদের ছেড়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু না, পাকিস্তানী সেনারাতো বাঙ্গালী নিধনের আদেশপ্রাপ্ত। তারা প্রথমে স্বপরিবারে হত্যা করে আনোয়ারুল আজিমকে। অতঃপর বন্দী চিনিকলের কর্মচারীদের চিনিকলের ভিতরে একটি পুকুরের সামনে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে তাদেরও। মৃতদেহগুলো পুকুরে ফেলে দেয়া হয় এবং পরবর্তীতে সেই পুকুরের নামকরণ করা হয় "শহিদসাগর"। শহিদ লেঃ আজিমের নামানুসারে গোপালপুর রেলওয়ে স্টেশনের নাম হয় "আজিমনগর"।
সেদিনের সেই ঘটনায় গুলিবিদ্ধদের মাঝ থেকে মাত্র পাঁচজন সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। তারা হলেন আব্দুল জলিল সিকদার, খোরশেদ আলম, আবুল হোসেইন, ইমাদ উদ্দিন এবং ইঞ্জিল সর্দার।
উক্ত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী খন্দকার জালাল আহমেদের ভাষ্য, "১৯৭১ সালের ৫ মে সকাল সাড়ে ১০টায় দায়িত্ব পালন করছিলাম। দুজন পাকিস্তানি সেনা আমার দুই পাশে এসে দাঁড়াল। একজন পিঠে রাইফেল ঠেকিয়ে বলল, ‘ইয়ে বাঙালি, মিটিং মে চল’। এ সময় মাথায় সাদা রুমাল বাঁধা মঞ্জুর ইমান নামের একজন অবাঙালি কর্মচারী বাঙালিদের শনাক্ত করে দিচ্ছিল। এর মধ্যে মিলের কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট আনোয়ারুল আজিমকেও ধরে আনা হয়। একজন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা আজিমকে বলে, ‘কিসনে মেজর আসলামকে মারা হায়’? তিনি বলেন, জানি না। আজিম এ সময় হানাদারদের সঙ্গে তর্ক শুরু করেন। পরে নরপশুরা আমাদের মিলের অফিসার্স কোয়ার্টারের পুকুরঘাটে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘাতকদের ১৩টি স্বয়ংক্রিয় এলএমজি একসঙ্গে আমাদের ওপর গর্জে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে পুকুরঘাট লাশের স্তূপে পরিণত হয়। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মিলে কর্মরত প্রায় ২০০ শ্রমিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। মৃত্যু নিশ্চিত করতে আমাদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে পানির মধ্যে গড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। একসময় জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখি, আমার মাথাটা ঘাটের ওপর এবং দেহের অর্ধেক অংশ পানির মধ্যে ডুবে আছে। লাশের স্তূপের মধ্যে উল্টে-পাল্টে জীবন্ত কাউকে খুঁজছিলেন আমার সহকর্মী মেহমান আলী। বুঝলাম, তিনিই আমাকে লাশের স্তূপ থেকে উদ্ধার করেছেন। বহু কষ্টে উঠে বসতেই দেখতে পেলাম, পাশে পড়ে আছে ছোট ভাই মান্নানের লাশ। হত্যার আগে ও আমাকে পালিয়ে যেতে বলেছিল।"
তার কাছ থেকে আরো জানা যায়, ব্রাশফায়ারের আগমূহুর্তে চিনিকলের মান্নান নামের এক হিসাব সহকারী শায়িত অবস্থায় মাথা উঁচু করে পবিত্র কুরান শরীফের আয়াত পাঠ করছিলেন। তাকে পাকিস্তানী সেনাসদস্যরা জিজ্ঞেস করে সে মৌলভী কিনা? এবং তাকে ছেড়ে দিতে চায়। কিন্তু মান্নান একা যেতে রাজি হয়নি বরং অন্যদেরও ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করে। নাহ, পশুদের হৃদয়ে মায়ামমতা থাকলেও ছিলো না পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হৃদয়ে। তারা সেদিন মান্নানকে পৈশাচিক নির্যাতন করে হত্যা করে। লাশগুলো পুকুরে ফেলে দেয়ার পরে চিনিকলের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা তখনও জীবিত ছিলেন। তিনি অর্ধডুবন্ত অবস্থায় কুরান তেলোয়াত করছিলো। কয়েকজন পাকিস্তানী সেনাসদস্য তাকে বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে।
আর মাত্র কিছুক্ষণ পরেই ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে ফিরে আসবে সেই ৫ই মে। বছরেই এই দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি শহিদ লেঃ আজিমসহ গোপালপুর গণহত্যায় নিহত সকল শহিদকে।
দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়....
কত শহীদের আত্মদানে এসেছে বাংলাদেশ
শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি নিহত সকল শহীদদের
মন্তব্য করুন