জানো, এই ব্রিজের মধ্যে আমার রক্ত আছে...
নভেম্বর মাসে ছেলটির বিয়ে হলো। দীর্ঘ ১২ বছরের প্রেমের সফল পরিণতি। ছেলেটি তখন কুমিল্লাতে চাকুরী করে। মেয়েটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। এম এ ক্লাসে। মেয়েটির বাবা থাকেন নারায়ণগন্জ। সেই সূত্রে মেয়েটিও নারায়ণগন্জ থাকে। মাঝে মাঝে কুমিল্লাতে যায়। ছেলেটি আসে নারায়ণগন্জ।
ছেলেটি কোম্পানির কাজে সারাদিন মটর সাইকেল দাবড়িয়ে বেড়ায়। আজ কুমিল্লা তো কাল চাঁদপুর, পরশু বি বাড়িয়া। পাশাপাশি ফেনী, নোয়াখালী যখোন তখোন। ফোনে (তখন মোবাইল এভেলেবল ছিলো না) মাঝে-মধ্যে কথা হয় মেয়েটির সাথে। কোনো এক বিষ্যুদবার অফিস শেষে ছেলেটি মটর সাইকেল নিয়ে সোজা চলে এলো নারায়ণগন্জ। শুক্কুরবার সারাদিন মেয়েটিকে নিয়ে ঢাকা আর নারায়ণগন্জ-এ ঘুরলো। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে !
শনিবার খুব সকালে ছেলেটি মেয়েটির কাছে বিদায় নিয়ে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। অফিস ৯ টায়। চিটাগাং রোড হয়ে ছেলেটি মটর সাইকেল ছুটালো কুমিল্লার পথে। সকাল বেলার রোদবিহিন চমৎকার আবহাওয়া। হেলমেট না পরেই ড্রাইভ করছে ছেলেটি। কাঁচপুর ব্রিজ, সোনারগাঁ, মেঘনা ব্রিজ পার হয়ে গেল। অবশেষে পৌঁছলো দাউদকান্দি ব্রিজ। ব্রিজের এক তৃতীয়াংশ পার হয়েছে। হঠাৎ সামনে নজর পড়লো। চমকে উঠলো ছেলেটি। একটা ট্রাক সোজা এগিয়ে আসছে তার দিকে। রাস্তার ডান দিক ধরে। ছেলেটি বায়ে চাপতে চাপতে ব্রিজের ফুটপাতের সাথে মিশে গেছে। ট্রাকটা ছেলেটির মটর সাইকেল থেকে মাত্র ১০/১২ হাত দুরে...
হঠাৎ করে জেগে উঠলো ট্রাকের ড্রাইভার (এতোক্ষণ সম্ভবত ঘুমাচ্ছিলো)। পাগলের মতো ট্রাকের হুইল ঘুরাতে লাগলো বামে। ঘুরিয়েও ফেললো কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। ট্রাকের পুরো শরীর ঘোরালেও পেছনের চাকার উপরে থাকা 'মার্টঘার্ট' প্রচন্ড জোরে বাড়ি মারলো মটর সাইকেলের ডান দিকে। ছেলেটির ডান হাতের দুটো আঙ্গুল ফেটে আটকে গেলো এক্সেলেটরের সাথে। ডান পায়ের দুটো আঙ্গুলের হাড় মড়াৎ করে ভেঙ্গে গেলো। এর মধ্যে ১৫/২০ গজ চলে গেছে ট্রাকটি। তারপর ব্রেক চেপেছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছেলেটিকে মটর সাইকেলের উপর বসে থাকতে দেখে ভুত দেখার মতো ভয় পেয়েছে। সে ভেবেছে এতোক্ষণে মটর সাইকেল আরোহী ইন্নালিল্লাহে...রাজেউন হয়ে গেছে। ছেলেটিকে জিন্দা দেখে ট্রাকের গতি বাড়িয়ে দিলো ৩ গুন। আর ছেলেটি...?? ছেলেটি ক্ষাণিক সময় ঝিম মেরে রইলো। ভাবনাগুলোও এলামেলো। এখন কী করবে, না করবে কিছুই ভাবতে পারছিলো না। শেষতক বাস্তবে ফিরে এলো।
ইতোমধ্যে তার ডান হাত আর ডান পা থেকে ঝরনার স্রোতের মতো রক্ত বেরুতে লাগলো। পকেট থেকে রুমাল বের করলো ছেলেটি। অনেক কষ্টে ডান হাতটাকে ছাড়িয়ে আনলো মটর সাইকেলের স্টেয়ারিং থেকে। পুরো ডান হাতে রুমাল পেঁচালো। দুটো আঙ্গুলের অবস্থা বিচ্ছিরি রকোমের খারাপ। মাংশ আর হাড্ডি থেঁতলে গেছে। ডান পায়ের অবস্থা আরো খারাপ। পা, রক্ত আর মোজায় মাখামাখি। মাঝে মাঝে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে ছেলেটির। অসহ্য ব্যথায় জ্ঞান হারাবার দশা। যে কোনো মূহুর্ত্যে জ্ঞান হারাতে পারে- এটা বুঝতে পারছে ছেলেটি। এই অবস্থায় ও সে ভাবছে মটর সাইকেলের কথা।
আশ্চর্যজনক ভাবে মটর সাইকেলের তেমন কিস্যু হয়নি। স্টার্ট দেয়া অবস্থায় আছে। অনেক কষ্টে ছেলেটি মটর সাইকেলে চেপে বসলো। গিয়ার বদলে আস্তে আস্তে চালাতে শুরু করলো। কোনো রকমে ব্রিজের মাঝামাঝি পৌঁছাতে পেরেছে। হে আল্লাহ ! আরেকটু শক্তি দাও !! মনে মনে জপছে ছেলেটি। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার শার্ট, পেন্ট। বাম হাতে অনেক কষ্টে রুমালটা চিপে রক্তেগুলো ফেলে দিলো। আবার পেঁচিয়ে নিলো হাতে।
মটর সাইকেলের এক্সেলেটর চাপার মতো শক্তি আর অবশিষ্ট নেই তার। মটর সাইকেল নিওট্রল করে ব্রিজের মাঝ থেকে ছেড়ে দিলো। আস্তে আস্তে মটর সাইকেল চলছে...ছেলেটি তলিয়ে যাচ্ছে অতলে... কতো যুগ পরে গিয়ে ব্রিজের পুর্বপার্শ্বে পৌঁছালো। টোল ঘরের লোকজন দৌড়ে এলো। ছেলেটি কোনো মতে মানিব্যাগ আর মটর সাইকেলের চাবিটা ওদের দিকে ছুঁড়ে দিয়েই জ্ঞান হারালো। এরপর আর কিছু মনে নেই তার....
ছেলেটি জ্ঞান ফেরার পর দেখলো- বিশাল একটা রুমে শুয়ে আছে। ছাদটা অনেক উপরে । খুব ধীরে একটা ফ্যান ঘুরছে। তার বিছানার পাশে ছোট দুই ভাই আর ছোট বোনটা দাঁড়িয়ে...। উঠতে গিয়ে টের পেল, তার ডান হাত আর ডান পা ভারী, নাড়াতে পারছে না। ঝট করে সব মনে পড়লো তার....দাউদকান্দি ব্রিজ....ট্রাকের সাথে ধাক্কা...ডান হাত আর ডান পা থেকে রক্ত পড়া....মটর সাইকেল নিয়ে কোনো মতে টোল প্লাজায় পোঁছানো...
ছোট ভাইটাকে ডেকে জানতে চাইলো- তার মটর সাইকেলের কী অবস্থা ? ওটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না, আশ্বস্ত করলো ছোট ভাই। ইতোমধ্যে লোক পাঠানো হয়েছে মটর সাইকেল আনার জন্য। পায়ের অবস্থা খুব খারাপ- ধরেই নিয়েছে ছেলেটি। ভয়ে কাউকে পায়ের অবস্থা সম্পর্কে কিছুই বলছে না...। পুরো ডান হাতে প্লাস্টার। হাত গলায় ঝুলানো। খুব ঘুম পাচ্ছে তার । ছোট বোনটি পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে...কখন জানি ঘুমিয়েও পড়লো...
আবার যখোন ঘুম ভেঙ্গেছে, তখোন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সারা রুমে অনেক মানুষ ! ছেলেটির অফিসের ৩/৪ জন, ছোট বোন এবং তার হাফ ডজন বান্ধবী, ছেলেটির কিছু বন্ধু বান্ধব.... ছেলেটির চোখ খুঁজছে আরো কাউকে.... ছোট বোন ফিসফিস করে বললো- "মেজো, তোমার বউ কে আনার জন্যে লোক পাঠানো হয়েছে, পোঁছে যাবে ঘন্টা খানেকের মধ্যে..."। দাউদকান্দি ব্রিজের টোল প্লাজায় এসে জ্ঞান হারানোর পরের ঘটনা জানা গেলো ছোট ভাইয়ের কাছে... ছেলেটির মানিব্যাগ থেকে আইডি কার্ড দেখে তারা ছেলেটিকে কুমিল্লার বাস তিষা এক্সপ্রেসে পাঠিয়ে দিলো। বাস কাউন্টারে পোঁছার পর ওরা ফোন করলো ছেলেটির অফিসে। অফিস থেকে লোক জন এসে তাকে নিয়ে গেলো সদর হাসপাতালে। হাতের একটা আঙ্গুলের তেমন কিছু হয়নি। অন্যটাকে মেরামত করতে গিয়ে এদিক সেদিক থেকে মাংশ আর চামড়া টেনে সেলাই দিতে হয়েছে মাত্র ১৮ টা। পায়ের দুটো আঙ্গুলের হাড় ভেঙ্গেছে। পুরো ডান পা প্লাস্টার করা । ১৫ দিন বাদে খুলে দেবে। এ ১৫ দিন নো নড়ন চড়ন...
সন্ধ্যার মধ্যে ছেলেটির বউ এল। সারা রাস্তায় যে কেঁদেছে তার সাক্ষ্য দিচ্ছে তার চোখ দুটি। যাকগে, ৩ দিন পর ছেলেটিকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। ক্র্যাচ কেনা হলো তার জন্যে। সারাটা সময় বিছানা শুয়ে বই পড়া আর টিভি দেখা ছাড়া কোন কাজ নেই ছেলেটির...
এভাবেই একদিন ছেলেটি সুস্থ হয়ে উঠে। আস্তে আস্তে অফিসে যাওয়া শুরু করে। প্রায় মাস তিনেক তাকে ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটতে হয়েছে...এখনও দাইদকান্দি ব্রিজের উপর দিয়ে কোথাও যাবার সময় সেদিনের স্মৃতিটা চোখের সামনে ভেসে উঠে। পাশে কেউ থাকলে বলে. " জানো, এই ব্রিজের মধ্যে আমার রক্ত আছে..." ?
ভাল
কী .....?
এই ব্রীজগুলোয় ঠিক কতো মানুষের রক্ত আছে? আক্ষরিক অর্থেই রক্ত থাকলে রক্তের প্লাবন হতো নিশ্চয়ই!
এই সব ব্রীজে আসলেই যে কত মানুষের রক্ত লেগে আছে কে জানে !!!
শুধু রক্ত না, জীবন ও লেগে আছে এইসব ব্রীজে।
এটা কি গল্প? নাকি সত্যি ঘটনা ?
ভয়ানক সইত্য ঘটনা...
সত্যি গল্প মনে হচ্ছে.....লেখা প্রাঞ্জল হয়েছে নিঃসন্দেহে
একশ ভাগ হালাল, খাঁটি এবং সইত্য...
সত্যি গল্প মনে হচ্ছে.....লেখা প্রাঞ্জল হয়েছে নিঃসন্দেহে
একটানে পড়লাম।এমন যেন না হয় অার। যেকোন দুঘর্টনা শুনলেই বুকের ভিতরটা ভয়ে কুঁকড়ে যায়।সৃষ্টিকরতাকে সবসময় বলি সবাইকে নিরাপদে রাখো।
একটানে পড়লাম... মানে কী ? লেখা অাবার টান দিয়া পড়ে কেমতে ? কতকিছু জানার অাছে !!
প্রতিমুহূর্তে ভয় ধরিয়ে শেষে এসে হাঁফ ছাড়া... ঘটনা মনে হচ্ছে আপনার নিজেরই
সব যাত্রা নিরাপদ হোক
গল্পের নায়কের নাম মেসবাহ ইয়াযাদ।
আপনি বিয়াপক বুদ্ধিমতী...
আপনি বিয়াপক বুদ্ধিমতী...
আর লং রুটে বাইক নয়
আমারে একটা বাইক আছে... এইটার জন্য আমার মায়ের প্রেসার সব সময় হাই থাকে
... কিন্তু ঢাকাতে বাইকের চাইতে ভাল বাহন আর কিছু হতে পারে না
আর লং রুটে বাইক নয় কিন্তু ঢাকাতে বাইকের চাইতে ভাল বাহন আর কিছু হতে পারে না
পাংখা লেখা হইছে বস।
পাংখা, পাংখা, পাংখা, পাংখা... পাংখা হৈলো মন....
প্যাথেটিক
কোন্টা করুণ...?
বস, আ্মি কুমিল্লার মানুষ। এই ব্রীজগুলো দিয়ে যাওয়ার সময় ড্রাইভারকে সারাক্ষন বলতে থাকি, সালাহউদ্দিন সাবধানে, সালাহউদ্দিন আস্তে। কি ভয় লাগে। আমার মেয়েটা থাকে সাথে।
আমার আব্বুরও চিটাগাং রোডের পাশে এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিলো। মারাত্বক। অনেক টাকা নিয়ে নিজের মোটর সাইকেলে যাচ্ছিলেন নিজের কাজে। আব্বুর ভাষার জমির পাশে পরেছিলেন, কেউ এসে জুতো খুলে নিয়ে যায়তো কেউ এসে ঘড়ি খুলে। টাকার ব্যাগ লুট কিন্তু কেউ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় না।
দীর্ঘজীবি হোন আপনে। বাই দি ওয়ে, আমার আব্বু নারায়নগঞ্জে ব্যবসা করতেন ঃ)
কুমিল্লায় টমছম ব্রিজ, ঝাউতলা, বাগিচা গাঁও অার রেসকোর্সে ছিলাম দীর্ঘদিন...
নারায়ণগঞ্জেও ছিলাম ৫/৬ বছর। এসএসসি, এইচএসসি নারয়ণগঞ্জে। শ্বশুরবাড়িও সেখানে...
একটা টেকনিক্যাল মিসটেক হয়ে গেছে ভাইডি, আমার আম্মি আব্বু কুমিল্লার আমি ঢাকাতে বর্ণ এন্ড ব্রড আপ। আর নারায়নগঞ্জে আব্বুর সূতার ব্যবসা ছিল তাই রোজ যাতায়ত করত।
তবে আপনি ল্যাব এইডের পাশে বসেন? দেখা হবে নিশ্চয় ঃ) ঐখানে কাছে আমার বাবার বাড়ি আর উইমেন্স ফেডারেশনের ছাত্রী ছিলাম আমি। মহুয়া চটপটি খেয়ে বড় হয়েছি আমি ঃ)
মন্তব্য করুন