পুরণ হওয়া আর না হওয়া শখেরা
ছোট বেলায় খুব মনে হতো, উকিল হব। যুক্তি তর্ক দিয়ে ফাটিয়ে দেবো। সব মামলাতেই আমি জিতবো। প্রতিদিন পকেট ভরে টাকা কামাই করবো। এরপর একটু বড় হবার পর মনে হলো- দুর, কিসের ওকালতি ! আমি পুলিশ হব। গাড়ি থামাবো। চোর বাটপার ধরবো। মানুষরে ভয় দেখাবো। মেলা টাকা কামাই হবে। আসলে সেসময় টাকাটাই আমার কাছে মূখ্য ছিলো। অন্য সব কিছু গৌণ।
আস্তে আস্তে বুঝে গেলাম, জীবনে টাকাটাই সব নয়। স্বাধীনতাটাই হচ্ছে আসল কথা। একটা বাউন্ডুলে ব্যাপার-স্যাপার না থাকলে কিসের কী ? নিজের একটা মোটর সাইকেল থাকবে। সারাদিন সেটায় চড়ে ঘুরে বেড়াবো দেশের এ মাথা থেকে সে মাথা। সে আশা আমার পরবর্তীতে পূরণ হয়েছে। মোটর সাইকেলে না হলেও সারা দেশের কানাচে কানাচে ঘুরে বেড়ানোর দুর্লভ সুযোগ হয়েছে।
আমার চরিত্রের মধ্যে যাযাবর একটা ব্যাপার সেই ছোটবেলা থেকেই আসন গেড়েছে। বেশিদিন ঘরে মন টেকেনা। আবার অন্যদিকে ঘরের বাইরে বেশিদিন থাকলে ঘরের জন্য মন পোড়ে। কী আজব সাইকোলজিরে বাবা ! তারপরও কয়দিন পর পর বাইরে বেরিয়ে পড়লেই যেনো জীবনের ফুয়েল সংগ্রহ হয়। আমি পূর্ণদ্যমে পরবর্তী দিনগুলো পার করতে পারি।
বাবা চাইতেন সরকারি চাকর হই। অল্প পয়সার এই কষ্টের জীবনে বাবা যে কী মজা পেয়েছেন, জানিনা ! সারাটা জীবন আমরা ৬ ভাইবোনের সংসারে কত অভাব আর অনটন দেখেছি। পয়সার অভাবে কোনোদিন প্রাইভেট মাস্টার রেখে পড়া হয়নি আমাদের। ৩ রুমের সরকারি বাসায় আমাদের ছিলো ২ টা টেবিল। সেখানে আর খাটে বসে আমরা পড়তাম। সেকালে জোরে পড়ার প্রচলন ছিলো। একজনের পড়ার শব্দে অন্যজনের অসুবিধা হতো। অথচ কিছুই করার ছিলো না আমাদের। সাধ আর সাধ্যের মাঝে ছিলো বিস্তর ফাঁরাক।
মা চেয়েছিলেন, আমি বা আমাদের ভাই বোনদের মধ্যে কেউ একজন ডাক্তার হোক। সেটা আমরা কেউ হতে পারিনি। বিভিন্ন কারনে। আমি বেশ ছোট বেলাতেই মানে স্কুল জীবনেই পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করি। সেটা বড় ভাইকে দেখে। একসময় মনে হলো- সাংবাদিক হবো। সাংবাদিকদের সমাজের সকল মানুষ কেমন সমঝে চলে...। পুলিশ ও ওদের ভয় পায়। এটা আমার মধ্যে অনেকদিন প্রভাব ফেলেছিলো।
বড় ভাইকে দেখে দেখে সুন্দর করে কথা বলা, মানে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা শিখেছি। একসময় মনে হলো টেলিভিশনে খবর পড়বো। সে উদ্দেশ্যে একবার উচ্চারণ আর কন্ঠশীলন এসবের উপর কোর্স ও করেছিলাম। সব গুড়ে বালি। জীবনের প্রথম চাকরী নিলাম সেলস এ। সেটাও স্কয়ারের মত কোম্পানিতে। সেই পেশায় মেলা দিন কাটিয়ে দিলাম। ১২/১৩ বছর কম সময় না। তবে বেশিদিন এক কোম্পানিতে থাকা আমার ধাতে ছিলো না। ফলে এর মধ্যে ৩/৪ টা কোম্পানি বদল করলাম।
কোম্পানিতে থাকাবস্থায় আমার মোটর সাইকেল ছিলো। সেটা নিয়ে প্রায়ই এজেলা সে জেলায় যেতাম। যতটা কাজে তার চেয়ে বেশি অকাজে মানে ঘুরতে। হাইওয়েতে মোটর সাইকেল চালাতে গিয়ে একটা শখ মাথা চাড়া দিয়েছিলো আমার। চলন্ত ট্রাকের সাথে সরাসরি মোটর সাইকেলের সংঘর্ষ লাগিয়ে দিয়ে দেখা, কী হয় ! সে আশা আমার পূরণ হয়েছিলো। ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, একবার ঢাকা থেকে কুমিল্লা যাবার পথে দাউদকান্দি ব্রিজের উপর ট্রাকের সাথে আমার বাইকের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। তারপর মাসখানেক হাত-পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে বিছানায় শুয়ে ছিলাম। ঘরে তখন নতুন বৌ...
বিভিন্ন সময়ে মানে বিয়ে, ঈদ- এসব অনুষ্টানের সময় মনে হতো- সব খরচ আমি একাই করবো। পরিবারের অন্য কাউকে করতে দিবো না। তাই করেছিলামও বেশ কয়েক বছর। এতে কী পরিমান যে তৃপ্তি পেতাম ! বন্ধুরা মিলে খাবো- বিলটা কিন্তু আমিই দেব। শ্রেফ মানসিক তৃপ্তির জন্যই এসব করতাম। আবার আমার কাছে টাকা নাই, সেটাও বলে দিতাম। এরকম ছোট খাটো অনেক ইচ্ছাই আমার পূরণ হয়েছে জীবনে। সত্যি বলতে কী, টাকা-পয়সার প্রতি মোহ আমার কোনো কালেই ছিলো না। এটা আমার স্বজনরা জানে। টাকা জমানোর চিন্তা প্রথম মাথায় আসে রোদ্দুর হবার পরে। একটু বৈষয়িক হবার চেষ্টা করি তখন। কিন্তু এত দিনের স্বভাব ! সে আর পারলাম কৈ ?
সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে চাই আমি। কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাই না। কয়টা পয়সা হাতে এলই ঘুরতে মন চায় । প্রায় পারলেও সব সময় পারিনা। সংসার আমাকে পিছু টানে। তারপরও আমি স্বীকার করি, আমার সংসারের মানুষগুলো আমাকে ছাড় না দিলে আমার জীবনের অনেক ইচ্ছেই পূরণ হকো না। আমার বৌকে হাজারো থ্যাংকু যে, সে আমাকে এ ছাড়টা দিয়েছে। আমার পাগলামীতে সে কখনো বাধাতো দেয়নি বরং উৎসাহ দিয়েছে বিভিন্ন সময়ে। ৫ মাসের অসুস্থ রোদ্দুরকে রেখে আমি ২/৩ ঘন্টার নোটিশে সুন্দরবনের দিকে যাত্রা করি। আমার বৌ কিছু বলেনা। তার মাকে ডেকে আনে তার কাছে...। সেই সব দিনের কথা ভুলি কী করে !
তারমানে এই নয় যে, আমি দায়িত্বহীন পিতা বা স্বামী। আমার দায়িত্বের শতভাগ না হলেও অনেক ভাগ আমি পালন করেছি জীবনে। চেনা অনেকের চেয়েও বেশি দায়িত্ববান হিসাবে নিজেকে দাবী করি আমি। আমি মনে করি, একজন দায়িত্ববান বাবা হিসাবে আমি এখন পর্যন্ত অনেক সফল মানুষ। ছেলেরা এখনও আমাকে অনেক পছন্দ করে, ভালোবাসে। তাদের কোনো অব্দার বা প্রয়োজন আমি অপূর্ণ রাখিনি, রাখিনা। মাস শুরু হলে পুরো মাসের বাজার করার লিস্ট ও আমি করি। আমার বৌ জানে, সংসারে এক মাসের জন্য কী কী জিনিসের দরকার, সেটা আমি ভালোই জানি।
বন্ধুত্বকে আমি বেশ বড় করে দেখি। আমার বন্ধুদের আমি ভালোবাসি, সম্মান করি। ওদের যে কোনো সমস্যায় ছুটে যাই। ওদের পাশে দাঁড়াই। সেটা সকাল, দুপুর বা মধ্যরাত- যখনই হোক। আমি আমাকে ঈর্ষা করি। আমার এত্ত এত্ত বন্ধু। জীবনে কজন মানুষের এমন বন্ধু ভাগ্য হয়, জানিনা ! আমার খারাপ সময়ে বন্ধুরাও আমার পাশে দাঁড়ায়। কিছুই বলেনা ওরা। পাশে এসে দাঁড়ালে ওদের উপস্থিতিই আমার জন্য অনেক কিছু বয়ে আনে। এই জীবনে আমি আর তেমন কিছু চাইনা আসলে।
যদি ভুল করে আমার হাতে অনেক টাকা এসে পড়ে, আমি বেরিয়ে পড়বো সে টাকা আর পাসপোর্ট নিয়ে। একটা একটা দেশ ঘুরবো। বিশেষ করে ইউরোপের সব কটি দেশে যাবার ইচ্ছে আছে। হয়তো এ আশা কোনোদিন পূর্ণ হবেনা। তাতেও আমার কোনো আক্ষেপ নেই। জীবনের সব আশা পূর্ণ হতে নেই। তাহলে জীবনের আর কোনো আনন্দ থাকেনা।
একটাইতো জীবন। সেটাও অনেক ছোট। এই ছোট জীবনের যেখানে যা পাই, তা থেকে আনন্দগুলো নিতে ভুলিনা। দুঃখটা থাকনা দুরে। অন্য কোথাও। নিজেকে সুখি ভাবতে পারে কজন মানুষ ! আমি পারি। সুখতো জটিল কোনো বস্তু নয়। অল্প পাওয়াতে তুষ্ট থাকাই সুখ। সব কিছু থেকে আনন্দ নিংড়ে নিলেই সুখ। সুখ নিজের কাছে ঘুর ঘুর করে সব সময়। তাকে দেখতে হয়। বুঝতে হয়। নিজের করে নিতে হয়। তবেইতো, আপনি- আমি- আমরা সুখি...
কন্যা রাশির জাতকরা মনে হয় সবসময় এরকমই হয় ভাইয়া। আমি একজন কন্যারাশির জাতককে চিনি। সেও এরকম।
আপনি কী করে জানলেন, আমি কন্যা রাশির জাতক ?
অবশ্য আপনারইতো জানবার কথা। প্রিয়'রাইতো জানবে....
লেখা তো ভালো লাগলো, কিন্তু মনে হলো ভাবীর সামনে দাঁড়িয়ে কনফেশন দিচ্ছেন।
সেটা খারাপ না অবশ্য। যীশুর সামনে কফেস করার চেয়ে বৌ-এর সামনে কনফেস করা উত্তম!
যাহোক, আপ্নার অপূর্ণ ইচ্ছাগুলোও পূরণ হোক, শুভকামনা
স্যরি টু সে, কামাল ভাই- আপনার এই ধারনাটা ভুল...


বৌয়ের সামনে কনফেস করার কিছু নেই আমার
আমার সারা দুনিয়াটা ঘোরার সখ ছাড়া তেমন কোনো আশা অপূর্ণ নেই...
তারপরও শুভকামনার জন্য শুভকামনা
অপূর্ণ ইচ্ছেগুলো পূরণ হোক - অনেক ভাল লেগেছে। শুভকামনা
সব ইচ্ছে পূরণ হতে নেই
আমারো মনে হইসে কনফেস করতিসেন

আপনার সব ইচ্ছা পূরণ হোক
এমন মায়া করে বললে...

তারপরও বলি, তোমার মনে হওয়াটা কামাল ভাইয়ের মত 'ভুল'
আমিও চাইনা, আমার সব ইচ্ছা পূরণ হোক
আপনার সব ইচ্ছা পূরন হোক এই কামনা করি।
শুভ কামনার জন্য জন্য থ্যাংকু ভাস্তে
নিজের মত 'য়াযাদ' থাকেন...
~
ভালো বলেছেন, থ্যাংকু
জীবন ইজ ইকুয়েল টু পূরণ হওয়া আর না হওয়া শখেরা
একদম কারেক্ট কথা ক্যাপ্টেন
লাভু
আমারো কয়দিন পর পর ঘুরতে না গেলে অস্থির লাগে
যা যা শখ ছিলো পূরণ করে ফেলছি অবশ্য এখন নতুন শখ খুজতেছি।
কন কি ভাই সাহেব, তাজ্জব কথা
আপনেতো একটা বিয়াও করতারেন্নাই ওহনতরি
আমার সবগুলা না পুরণ হওয়া শখের কথা মনে করায়া দেওয়ায় মাইনাস...
দুর, ম্যালা সময় আছে। বেশিরভাগ শখই দেখবা পূরণ হৈয়া গেছে...
আমার এটাকে কনফেশন মনে হয় নাই। বরং অনেক মোটিভেশনাল একটা লেখা মনে হইসে। এ ধরনের লেখাই আসলে বেশি জরুরি। কারণ আপনার মতো করে ভাবে আরো অনেকেই। তাদের কাছে এমন লেখাগুলো সুড়ঙ্গের মুখে আলো খুঁজে পাবার মতোই বিষয় হয়ে ধরা দেয় মেসবাহ ভাই
খাইছে...

অনেক কঠিন কঠিন কথা কৈলেন
বুইঝা আর না বুইঝা আপনেরে থ্যাংকু দিলাম
আমিও আপনারে থ্যাংকু'র জবাবে ভালোবাসা দিলাম
অনুভূতির দারুন প্রকাশ...শেষ প্যারাটা ফাটাফাটি...হ্যাটস্্ অফ ..আপনার-আমার-আমাদের সবার শখ আর ইচ্ছা গুলো পূরণ হোক....
পুনশ্চঃ ভাবীকে স্যালুট।
ওয়ালাইকুম..... (আপনার ভাবীর তরফ থেইকা)
ভাবীর সহ্য শক্তি আরও বাড়ুক-আমিন
কত আর বাড়বে ?
ও এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে।
জানে, আমি এমনই
আমাদের দাদাভাই তো এমনই। এমনই থাকুক শত জন্ম ধরে।
সব চাওয়া পূরণ হোক---দোয়া করি।
থ্যাংকু থ্যাংকু
মন্তব্য করুন