ইউজার লগইন

দু:খিত শিশির - ভালবাসার বিনিময় মূল্য নিশ্চিত জেন পৃথিবীতে নয় - আশা যদি করতেই চাও - তবে প্রার্থনা কর প্রাপ্তি যেন পরকালে হয়.

দু:খিত শিশির - ভালবাসার বিনিময় মূল্য নিশ্চিত জেন পৃথিবীতে নয় - আশা যদি করতেই চাও - তবে প্রার্থনা কর প্রাপ্তি যেন পরকালে হয়.

প্রিয় ল্যাপটপটা বেকায়দা ভঙ্গিতে ফ্লোরে পড়ে আছে - ডালাটা প্রায় বিচ্ছিন্ন - বোঝা যায় - অক্ষম আক্রোশের প্রথম ঝড়টা তার উপর দিয়েই গেছে - দেয়াল জোড়া ডেকোরেশন গ্লাসে চির ধরেছে - ভারী কিছুর আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট - বুকশেলফের সমস্ত বই মেঝেতে লুটাচ্ছে - দামী গীটারটাকে ভেঙ্গে দু' টুকরো করা হয়েছে - দরজায় দাঁড়িয়ে ক্ষতির পরিমাণ মাপছি - ব্যাকুল চোখ খুঁজছে পছন্দের মানুষটিকে - ওই তো আছে - প্রমাণ সদৃশ খাটের এক কোনায় বাঁকাচোরা ভঙ্গিতে পড়ে আছে ছেলেটি - আমার একসময়কার ভীষণ স্নেহের পাত্র - শিশির - আমার প্রাক্তন ছাত্র
.
বিত্তবান মানুষদের প্রতি আমার এক ধরনের অকারণ ঘৃণা আছে - এই শ্রেণী থেকে নিরাপদ দুরত্বে থাকতেই আমার ভালো লাগে - শিশিরদের পরিবারটি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল - মফস্বল ছেড়ে তখন মাত্র রাজধানীতে পা রেখেছি - ন্যুনতম বেতনে একখানা চাকরি করি - আর্থিক টানা পোড়নে ভীষণ বিব্রত - কাজেই সহায়ক উপার্জনের পথ হিসেবে বেছে নিলাম গৃহশিক্ষকের দায়িত্ব.

কাজটা জুটিয়ে দিয়েছিলেন এক সহকর্মী - প্রথম দিনটির কথা বেশ মনে আছে - বারিধারায় বিলাস বহুল অট্টালিকার সামনে দাঁড়িয়ে বোধ করা অস্বস্তিটার কথাও মনে পড়ে - আমার মফস্বলী চোখে ওই বাড়ির জৌলুস বড় বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল - মানুষগুলোকে কিন্তু মন্দ মনে হয়নি - ধনাঢ্য এক শিল্পপতি - তার আধুনিকা সঙ্গিনী আর ফুটফুটে দুটো কিশোর কিশোরী - শিশির-শর্মী - বাড়াবাড়ি রকমের ঐশ্বর্যের মাঝেও কোথায় যেন একটা বিরল বিনয় ছিল পরিবারটির মাঝে - আমার ভালো লেগেছিল.

সময়টা সত্যি ভালো কেটেছে - ছেলে মেয়ে দুটোকে বড় ভালো লাগত - ওরাও ছিল ভীষণ নি:সংকোচ - আমার মত ঘাড়ত্যাড়া অসামাজিক আপদকেও কিভাবে যেন ওরা নিজেদের জীবনের অপরিহার্য অংশ ভাবতে শুরু করেছিল - সুন্দর সময়টা আরও দীর্ঘ হতে পারত - কিন্তু হয়নি - আমি নিজে থেকেই সরে এসেছিলাম - পরিবারের কর্তা হুট করে এই চলে আসার ব্যাখ্যা দাবি করেছিলেন - কর্ত্রীর কন্ঠে অনুরোধ ছিল - ছেলেমেয়ে দুটোর বোধহয় একধরনের আকুতিও ছিল - কিন্তু আমি কিছু না বলেই সরে এসেছিলাম - সব বিচ্ছেদের ব্যাখ্যা থাকে না - ব্যাখ্যা থাকলেও হয়ত ত়া দেয়া যায় না.

যোগাযোগটা কিন্তু ছিল - ঈদ পার্বনে ম্যাসেজ পেতাম - দাওয়াত থাকত - হুট করে হয়ত চলে আসত পছন্দের কোনো উপহার - মাঝে মাঝে সশরীরে হাজির হয়ে যেত দুই ভাইবোন - আমিই লুকিয়ে বেড়াতাম - নানা অজুহাতে নিমন্ত্রণ এড়াতাম - ওরা যেন বুঝেও না বোঝার ভান করত.

ভেবেছিলাম আর কখনো ও বাড়িতে পা দেব না - কিন্তু দিতে হলো - কাক ডাকা ভোরে শর্মীর উদ্বেগমাখা ফোনটা এবার কেন যেন এড়াতে পারলাম না - আবার যেতে হলো সেই ঠিকানায় - অনেক কিছুই বদলেছে - বাড়িখানার জৌলুস আরো বেড়েছে - বেড়েছে গাড়ি বারান্দায় রাখা গাড়ির সংখ্যা - নতুন একখানা বাগান হয়েছে - একটা সুইমিংপুল - এগুলো আগে ছিল না - বেল টেপার আগেই দরজা খুলে গেল - ভদ্রমহিলা একটু ও বদলাননি - আগের মতই পরিপাটি - মার্জিত - কিন্তু চেহারার উদ্বেগটুকু আমার নজর এড়ায় না - মায়ের পেছনেই মেয়ে - তার চেহারা ও কেমন ফ্যাকাশে - একটা অমঙ্গল আশঙ্কায় আমার ভেতরটা কেমন যেন শিউরে ওঠে .

আমার জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়েই ভদ্রমহিলা বলতে শুরু করলেন - সমস্যা শিশির কে নিয়ে - কিছুদিন থেকেই ছেলেটা নাকি বদলে গেছে - খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম - পড়াশোনায় মন নেই - মেজাজ খিটখিটে - প্রশ্ন করলে নিরুত্তর থাকে - গত রাত থেকে সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে - রীতিমত অপ্রকৃতস্থের মত আচরণ করছে - শুরু করেছে ভয়াবহ চিৎকার আর ভাংচুর - এদিকে গৃহকর্তা ব্যবসা উপলক্ষ্যে দেশের বাইরে - মা মেয়ে কি করবে বুঝতে না পেরে সকাল হতেই আমাকে ফোন দিয়েছে - আমি বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম - বিপদের সময় ধনাঢ্য এই পরিবারটি আর কাউকে না পেয়ে প্রাক্তন এক সাধারণ গৃহশিক্ষক কে ডেকে এনেছে - কখনো তো বুঝিনি এরা আমাকে এতখানি বিশ্বাস করে - এই ভরসা কি আদৌ আমার প্রাপ্য ?

ধ্বংসস্তূপের মাঝে পড়ে থাকা দেহটা এবার নড়তে শুরু করেছে - বুঝতে পারছি শিশির আমার উপস্থিতি টের পেয়েছে - মানুষটা আমার দিকে ফিরছে - দু' জোড়া চোখ এক হচ্ছে - ছেলেটা আসলেও অনেক বদলে গেছে - চুলগুলো উসকোখুসকো - চোখের নিচে রাতজাগা ক্লান্তির কালিমা - শারীরিক ভাষাটা যেন পুরোপুরি নেতিবাচক - আমি ডাক্তার নই - কিন্তু পরিষ্কার ভাবে জানি ওর কি হয়েছে - যে মুহুর্তে আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়েছি তখন থেকেই আমি জানি সমস্যাটা কোথায় ?

দুটো মানুষ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে - নীরবতা ভাঙ্গার প্রতীক্ষা - আমিই ভাঙ্গলাম - 'শী লেফট ইউ' - এটা কোনো প্রশ্ন নয় - অনেকটা যেন স্বগোতক্তি - ছেলেটাকে বুঝতে দেয়া যে তার সমস্যটা আমি জানি - আমি বুঝি - শিশির এখনো নিরুত্তর - আমি ঘরময় হাঁটছি - ভাঙ্গা গীটারটা ছুঁয়ে দেখছি - আমার তাড়া নেই - এই তো এখন উবু হয়ে ল্যাপটপটা তুলে নিলাম - নাহ - এটা একেবারেই গেছে - আর ঠিক হবে না - শিশির নিরব - কিন্তু ওর দৃষ্টি আমাকে অনুসরণ করছে - ও জানে - আমি আরো কিছু বলব - হয়ত কিছু জিজ্ঞেস করব - কিংবা স্বান্তনার কোনো কথা বলব - আমি এখন ওর বিছানায় বসে আছি - আমাদের মাঝে মাত্র কয়েক হাতের ব্যবধান - দরজার বাইরে কাদের যেন উপস্থিতি টের পাচ্ছি - সম্ভবত মা মেয়ে - ঘরের মাঝে কেমন একটা আরষ্টতা - তাকালাম ওর দিকে - চোখ দুটোতে কি গভীর বিষাদ - এই চোখ আমার ছাত্রের নয় - এই চোখ এক আহত প্রেমিকের - আমি তাকিয়ে আছি - অপেক্ষা করছি - জানি ওই মুখ খুলবে -

সত্যিই সে মুখ খুলল - 'আই লাভ হার, স্যার' - আমি জানি শব্দ গুলো তার ভেতর থেকে এসেছে - স্বরতন্ত্রী তো ছিল গৌণ মাধ্যম - ডান বাম অলিন্দে তার দারুণ আলোড়ন উঠেছে - রক্তস্রোতে কষ্টের বান ডেকেছে - শিরা উপশিরা গুলো আবেগে কেঁপে উঠেছে - তবেই না এই শব্দগুলো সৃষ্টি হয়েছে - সবচেয়ে কঠিন কথাটা সে বলে ফেলেছে - এবার তাকে কাঁদতে হবে - প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম - তার চোখ দুটো ভিজতে শুরু করেছে - আধো আধো স্বরে অনেক কথা বলছে সে - আমি শুনছি - গভীর সহানুভুতি নিয়ে শুনছি - কখনো বা সুচতুর শব্দ প্রক্ষেপনে তাকে স্বান্তনা দিচ্ছি - বুঝতে পারছি - আমার কথা গুলো বোকা ছেলেটাকে স্পর্শ করতে শুরু করেছে - সে ভাবতে শুরু করেছে - সব বেদনার স্মৃতি সে ভুলে যেতে পারবে - নতুন করে কাউকে ভালবাসতে পারবে - সবকিছু হবে আগের চেয়েও সুন্দর - এখন শিশির আর বলছে না - আমিই বলছি - একজন বিতার্কিকের দক্ষতায় বলছি - বলছি একজন কবির সুললিত চাতুর্যে - একজন দার্শনিকের প্রলুব্ধকর প্রজ্ঞায় - একজন বক্তার মোহিনী কপটতায় - কিন্তু আমি জানি - আমি সত্য বলছি না - এখানে আমার পাশে যে ছেলেটি বসে আছে সে আপাদমস্তক শুদ্ধাচারী প্রেমিক - তাই তার হবে নীলকন্ঠের জীবন - অসহ্য যন্ত্রণার নির্ঘুম রাতেরা লিখবে তার ভাগ্যলিপি - অভিশাপ দিতে শেখেনি তার হৃদয় - তাই আত্মপীড়নের মর্মন্তুদ প্রহরগুলো হবে তার সঙ্গী - সুবিশাল পবিত্র কষ্টেরা যখন তাকে ক্ষতবিক্ষত করবে - সেদিন সে জানবে - আমি তাকে মিথ্যে বলেছিলাম - প্রকৃতি প্রেমিকদেরকে ভালবাসার ক্ষমতা দিয়েছে অকুন্ঠে - কিন্তু সম্ভাব্য প্রাপ্তির খাতায় এঁকে দিয়েছে একখানা সুবিশাল গাণিতিক শুন্য - দু:খিত শিশির - ভালবাসার বিনিময় মূল্য নিশ্চিত জেন পৃথিবীতে নয় - আশা যদি করতেই চাও - তবে প্রার্থনা কর প্রাপ্তি যেন পরকালে হয়.

পোস্টটি ১১ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

আরাফাত শান্ত's picture


ভাল লাগলো!~

মীর's picture


লেখা ভালো লাগলো।

টুটুল's picture


সুন্দর

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


চমৎকার!

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


চমৎকার একটা লেখা ।

তানবীরা's picture


বানান ভুল ছাড়া বাকি লেখাটুকু খুবই হৃদয়কাড়া

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

হাসান আদনান's picture

নিজের সম্পর্কে

কিছু মানুষ জন্মায় - একাকিত্বের বীজমন্ত্র নিয়ে - জীবন তাদেরকে খেলায় - নাকি তারা জীবন কে নিয়ে খেলে - বোঝা দায় - সম্পর্ক - সেটা বন্ধুত্বের হোক - হোক ভালবাসার কিংবা রক্তের - তারা এড়িয়ে চলে - কিংবা কে জানে - বন্ধনে জড়ানোর যোগ্যতা হয়ত প্রকৃতি তাদের কে দেয়নি - অর্থহীন জীবন - মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠা - তারপর অঘুমো বিভীষিকাময় মুহূর্ত গুলো - তবু কাউকে ডাকা নয় - ডাকার জন্য যে প্রণোদনা লাগে তারা তা হারিয়ে ফেলেছে - শুধু ভোরের প্রতীক্ষা - যদিও জানে - ভোর আসবে না - এসব মানুষের জীবনে ভোর আসেনা- আসতে নেই - প্রসারিত কোনো হাতেই এরা হাত রাখে না - বিশ্বাস এদের নড়ে গেছে শুরুতেই - যেন সিজোফ্রেনিয়ার রোগী - এক বিচিত্র জগৎ - কোনো বন্ধন নেই - ভুল হলো- একটি বন্ধন আছে - থাকে - বিধাতার সাথে - সে বন্ধনে কখনো প্রার্থনা থাকে - কখনো ঘৃণা - কখনো অসম লড়াই - আর কখনো সীমাহীন - ব্যাখ্যাতীত অভিমান (আমি হয়ত এমনই একজন )