ইউজার লগইন

জীবিকা অথবা জীবন- ২

গতকালই কুমিল্লার কালাসোনা থেকে এসেছে মনু মিয়া। তার ইচ্ছে কাজ করে বেশ কিছু টাকা জমলে গ্রামে ফিরে গিয়ে বোন রহিমার বিয়ে দেবে। এখানকার কোনো একটি বেকারিতেই কর্মরত তার মামা যাদু সরকার। কিন্তু এখানে এলেই যে কাজ পাওয়া যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা দিয়ে আসতে পারেনি তার মামা। এলাকায় কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে যে, বিহারি মালিকরা নতুন করে কোনো বাঙালীকে কাজে নেবে না। পুরোনো যত বাঙালী কর্মচারি আছে তাদেরও আস্তে ধীরে বরখাস্ত করে দেবে।

গ্রামাঞ্চলে বলতে গেলে তেমন কাজকাম নেই। ধান পাকার আগে এখন আর কারো কাছে কাজও তেমন নেই। যদিও যাদু সরকার তাকে যাওয়ার জন্য কোনো সংবাদ পাঠায়নি, তবুও মনু মিয়া অনন্যোপায় হয়ে চলে এসেছে। মা আর বোনটির জন্য যে সামান্য কিছু চাল রেখে এসেছে তা বড় জোর দু সপ্তাহ চলবে। কিন্তু সে সময়কালের মাঝে তাকে যে করেই হোক টাকা-পয়সা নিয়ে ফিরে গিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়ে আসতে হবে।

মনু মিয়া বাস ভাড়ার অভাবে কাঠ বোঝাই একটি ট্রাকে করে ঢাকা শহরের ঠাটারী বাজার এলাকায় নামতে বাধ্য হয়ে, শেষপর্যন্ত হেঁটে হেঁটে এতটা পথ এসেছে। জামতলার ভাইয়া বেকারি খুঁজে পেতে তাকে জিজ্ঞেস করতে হয়েছে বেশ কজনকে। কিন্তু লোকজনের কথামত বেকারির সামনে এসে যাদু সরকারের কথা জানতে চাইলে কেউ বলতে পারে না তেমন। মনেমনে খানিকটা দমে গেলেও সে সাহস করে বেকারির টিনের দরজায় বসে ঝিমুতে থাকা দ্বার রক্ষককে ভয়েভয়ে শুধায়, এই ব্যাহারিত যাদু মামু চারহি করে, একটা খবর দিতারবেন? আমি তার ভাইগ্না মনু মিয়া!

দ্বাররক্ষী হয়তো বিরক্ত হয় কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ শুনে নিদ্রাছুট রক্তিম দৃষ্টি মেলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে মনু মিয়ার প্রতি।

মনু মিয়া ফের দ্বিগুণ উৎসাহে বলতে আরম্ভ করলে তাকে শুনতে হয়, ইধার যাদু-উদু কই নেহি হ্যায়!

এ কোন জগতের ভাষা বলছে লোকটি? মনু মিয়া বিস্মিত হয়ে তাকায়। দেখতে তো মানুষের মতই সব কিছু। কিন্তু ভাষাটা এমন বিশ্রী কেন? এমন ভাষায় কি কেউ কথা বলে? তারা মানুষ নাকি মানুষের মতই দেখতে ভিন্ন কোনো প্রাণী? অবশ্য বানর দেখতেও অনেকটা মানুষের মতই। কিন্তু তার ভাষা চিঁচিঁ ধরনের। তবে মানুষের মতই এর কণ্ঠস্বর পরিষ্কার। ভাষাটাই কেবল দুর্বোধ্য!

মনু মিয়া বিরস মুখে বেকারির অদূরে একটি চালার নিচে বসে থাকে। তার স্পষ্ট মনে আছে যে, তাকে এই ভাইয়া বেকারির কথাই বলেছিলো তার মামা। তাহলে কি তাকে মিথ্যে বলেছে? মামা কি বেকারিতে কাজ করে না? না হলে কী করে বলতে পারলো, বেকারির আশপাশেও মজার মজার স্বাদের পাউরুটি-কেক-বিস্কুটের ঘ্রাণ লেপ্টে থাকে বাতাসে। হাটবারে তাদের হাটে যেমন মুড়ি-মুড়কির হাট দিয়ে চলার সময় এক ধরনের মিঠে সুবাস হাওয়ায় মিশে থাকে। তেমনি শুঁটকি অথবা মেছোহাটা। যেখানে যে সামগ্রী বেশি থাকে সেখানকার হাওয়ায় সে সামগ্রীর ঘ্রাণ। এখানেও তেমনি পাউরুটি-কেক-বিস্কুটের ঘ্রাণ।

তার যাদু মামা বলছিলো, বেকারি এলাকার বাতাস নাকে গেলে কিছুক্ষণের ভেতরই ক্ষুধা লেগ যায়। আর এ কথার সত্যতা প্রমাণেই হয়তো তার ক্ষুধা তীব্রতর হয়ে উঠলেও কিছুই করার থাকে না। সঙ্গে টাকা-পয়সাও নেই যে কিনে খাবে কিছু। আশপাশে কোনো পুকুর বা চাপকলও দেখতে পাচ্ছে না যে, সেখান থেকে দু আঁজলা জল তুলে খাবে। সে তেমনি বেকারির টিনের দারজার সামনে বসে বসে ঝিমুতে থাকা অদ্ভুত ভাষার প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে থাকে।

বেলা প্রায় মাথার উপর চলে এসেছে। তবুও সে এখান থেকে চলে যাওয়ার কথা ভাবতে পারে না। কারণ তার মামা মিথ্যে বলে থাকলেও যেহেতু এ বেকারির নাম বলেছে, তাহলে এখানে কাজ না করলেও এর আশপাশ দিয়েই তার চলাচল হবে। ঠিক তখনই কোথাও আজান ধ্বণিত হয়। সে মাথা ঘুরিয়ে আশপাশে কোনো মসজিদ দেখতে পায় না। অথচ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে খালি গলায় কেউ আজান দিচ্ছে। তাহলে কি কোনো ঘর-বাড়ির ভেতর থেকে আজান দিচ্ছে কেউ? ঠিক তখনই সে হঠাৎ দেখতে পায়, বেকারির টিনের দরজার সামনে ঝিমুতে থাকা মানব সদৃশ প্রাণীটি উঠে দাঁড়িয়েছে। দরজাটা খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভেতরের দিকে কয়েকটি মুখ ভেসে ওঠে।

অদ্ভুত ভাষার প্রাণীটি এক একজনের শরীর হাতিয়ে দেখছে। তারপরই হাত দিয়ে বেরিয়ে যেতে ইঙ্গিত করছে। এভাবে প্রতিটি মুখই মনোযোগ দিয়ে সে পর্যবেক্ষণ করে দূর থেকে। কিন্তু তাদের কেউ যাদু সরকার নয়। মনেমনে সে যখন হতাশায় প্রায় ভেঙে পড়তে যাচ্ছিলো, দু চোখ ভরে উঠতে চাচ্ছিলো কান্নায়, ঠিক তখনই দেখা যায় যাদু সরকার হাতে একটি পুটলি মতন কিছু নিয়ে মানুষের মত প্রণীটির সঙ্গে কিছু নিয়ে কথা বলছে। কিছু কিছু কথা বেশ বুঝতে পারলো মনু মিয়া। সে তখনই উঠে ছুটে যায় যাদু সরকারের দিকে।

তাকে দেখতে পেয়ে যাদু সরকার খুশি হওয়ার বদলে কেমন অপ্রসন্ন কণ্ঠে বলে উঠলো, কিরে, তুই আইলি কী বুইজ্যা?

মামু, চোহে আর পথ দেহি না! অ্যার লাইগ্যাই আইত্তুরলাম!

কর্কশ কণ্ঠে যাদু সরকার বললো, তরে অহন আওনের কতা কইছলাম?

কি করতাম? কোনো কাম-কাইজও পাই না। বাইত বইয়া থাকলে ভাত পাম কই?

এহানো তরে ভাত দিবো ক্যাডা?

মনু মিয়া হাসে।

কিন্তু যাদু সরকারের মুখের ম্লানিমা দূর হয় না। সে তেমনি নিরস কণ্ঠে বলে, চাইরো পাইলের খবর ভালা না। বাঙালীরারে কামের থাইক্যা বার কইরা দিবো হুনতাছি। আমারই যেহানো ভাতের যোগানের আশা নাই, তর ব্যবস্থা করি কেমতে?

মামু আল্লায় একটা ব্যবস্থা করবো। তুমি আমারে রাইতটা থাহনের ব্যবস্থা কইরা দেও!

যাদু সরকার ভাগ্নের সঙ্গে রাগ দেখালেও ভেতরে ভেতরে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে কোথায় তার কাজের ব্যবস্থা করা যায় আর কাকেই বা এ ব্যাপারে অনুরোধ করা যায় তাই ভাবছিলো আর হাঁটছিলো। এমন একটা দুঃসময়ে ছেলেটা এলো যে, তার সঙ্গে দুটো মিষ্টি কথা বলার মানসিকতাও তার অবশিষ্ট নেই। যে কারণে সে নিজেই যেন নিজের কাছে ছোট হয়ে যাচ্ছিলো ক্রমশ।

(চলবে)

পোস্টটি ৯ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

নাজমুল হুদা's picture


প্লিজ, আর একটু বড় করুন । আর,তাড়াহুড়া করবার দরকার নেই, টাইপিং একবারটি দেখে দিন । আমরা উন্নত মানের একটা গল্পের আশায় আছি ।

জুলিয়ান সিদ্দিকী's picture


বড় করতে চাচ্ছি না যে! পোস্ট করার পর আমি একবার পড়ি। সে সময় ভুলচুক পেলে ঠিক করে দেই। আর হ্যাঁ, আমার আন্তরিক চেষ্টা থাকবে গল্পটির মানের ব্যাপারে যতটা কম নিরাশ হন। ভালো থাকবেন। ধন্যবাদ।

শওকত মাসুম's picture


চলুক

জুলিয়ান সিদ্দিকী's picture


বেশ! ধন্যবাদ।

সাহাদাত উদরাজী's picture


চলুক।

জুলিয়ান সিদ্দিকী's picture


হুম!

ঈশান মাহমুদ's picture


চলতে থাকুক।

জুলিয়ান সিদ্দিকী's picture


আইচ্ছা! Smile

থিও's picture


হুম Smile

১০

জুলিয়ান সিদ্দিকী's picture


Smile

১১

তানবীরা's picture


চলুক

১২

জুলিয়ান সিদ্দিকী's picture


Smile

১৩

মীর's picture


এর পরের পর্ব কৈ? এ পর্যন্ত আগেই পড়ে গিয়েছিলাম। কোন মন্তব্য করা হয় নি। যাদু সরকার-মনু মিয়ার বাড়ি কোন এলাকায় বুঝতে পারলাম না। প্রথম পর্বের একটা জায়গাতেও এমন হয়েছিলো।

এ নিয়ে তুমুল বাক-বিতণ্ডার পর হঠাৎ গোলাম আলি সিন্দুকের ডালা খুলে একতাড়া নোট ছুঁড়ে দিয়েছিলো তাম্বিরের মুখের ওপর। তারপর বলে উঠেছিলো, তোঁয়ার লগে ব্যবসা আর ন গরিম! তুঁই মালাউন ইন্ডিয়ার দালাল!

তাম্বির হাসিমুখে টাকাগুলো কুড়িয়ে নিয়ে বের হওয়ার সময় বলেছিলো, হামাক ইন্ডিয়ার দালাল কইলে, তোমাক জানি কাও মুসলিম লিগের দালাল কতি না পারে!

এখানে তাম্বিরের মুখে এটা কোন এলাকার ভাষা? হামাক>রাজশাহী, বগুড়া, নওগাঁর দিককার শব্দ। কতি না পারে>খুলনা, বাগেরহাটের দিককার টান।

১৪

জুলিয়ান সিদ্দিকী's picture


জীবিকার টানে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া মানুষদের অনেককে দেখেছি মিশ্র ভাষায় কথা বলতে। তাম্বিরের ভাষাটা এমন।

গোলাম আলি চাঁটগাঁওয়ের ভাষায় কথা বলে। (চাঁটিগ্রাম>চট্টগ্রাম>চাঁটগাঁও>চাঁটগাঁ।

মামু-ভাগিনা কুমিল্লার কালাসোনা নামের একটা গ্রামের।

লিখবো লিখবো করে হচ্ছে না। তবে অবশ্যই লিখবো। আগ্রহের জন্য ধন্যবাদ।

১৫

নাজমুল হুদা's picture


পরের পর্ব পাবো কি পাবো না ? কবে ? আর কত ধৈর্য ধরবো ?

১৬

জুলিয়ান সিদ্দিকী's picture


রাগ করে না ভাইজান! খুব শীঘ্রিই শুরু করবো। Smile

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

জুলিয়ান সিদ্দিকী's picture

নিজের সম্পর্কে

অনেক কিছুই করতে মন চায়। কিন্তু লেখলেখিতে যে আনন্দটা পাই তার তুলনা খুব কম আনন্দের সঙ্গেই চলে।