জীবিকা অথবা জীবন (শেষাংশ)
শোনা যাচ্ছিলো শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী হবেন। এ বিষয়ে রহমান সাহেব বা সালমা বেগমের বিশ্বাসের ভিত বেশ পোক্ত হলেও শৈলেশ বর্মণ নিজের মনে সে কথা ঠাঁই দিতে পারেন না। তিনি আরো নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানতে পেরেছেন যে, ভুট্টো কখনোই বাঙালিদের ক্ষমতায় বসতে দেবে না। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের একটি শিশুও মনে প্রাণে চাইবে না যে, পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যাক। লোকসানের রাজপুরীর চেয়ে লাভের আস্তাকুর ভালো। আর সে কথা পশ্চিম পাকিস্তানের শকুনগুলো ভালোই বোঝে।
শৈলেশ বর্মণ আর রহমান সাহেব ছয় দফা দাবির বিষয়গুলো নিয়ে আলাপের এক ফাঁকে সালমা বেগম বললেন, আপনেরা কি কিছু টের পাইতাছেন?
রাহমান সাহেব অবাক হয়ে বললেন, কোন ব্যাপারটা?
এই যে আমাগো চাইরো দিকে বিহারি মানুষ হঠাৎ কইরাই যেন বাইড়া গেছে।
শৈলেশ বর্মণ বললেন, এইটা আমিও লক্ষ্য করতেছি। ভাবতাছি ইন্ডিয়া যামুগা। এখানের পরিস্থিতি কখন খারাপ হইয়া যায় বলা যায় না। আমি তিন চাইরদিনের ভিতর না আইলে বুঝবি পাকিস্তানে আর নাই।
তাইলে তো খুবই দুশ্চিন্তার কথা! বলেই রহমান সাহেব কেমন গুম হয়ে বসে রইলেন।
সালমা বেগম বললেন, আমরা ঘর-বাড়ি তালা দিয়া গেলে যাইতে তো পারিই।
আমিও সেইটাই কইতে চাইছিলাম। বলে, তিনি কেমন বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন সালমা বেগমের মুখের দিকে।
সেদিন বাজার থেকে আসার পথে আজগর তার বিহারি বন্ধুদের মাঝখান থেকে উঠে এসে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলেছিলো, টাউনের অবস্থা বেশি ভালা না। তুই গ্যারাম দেশের কম বুদ্ধির মানুষ, এখানে থাকলে মারা পড়বি। এ ছাড়াও সাহেবের নুন-নিমক খাইছি অনেকদিন তার লাইগ্যাই কথাডা কইলাম।
রহমান সাহেব আর শৈলেশ বর্মণের কথাবার্তার কিছু কিছু রান্নাঘর থেকেই শুনতে পাচ্ছিলো মনু মিয়া। তখনই যেন আজগরের বলা কথাগুলোর গভীরতা উপলব্ধি করতে পারে।
রান্না প্রায় হয়ে এসেছিলো। আগুনের আঁচ কমিয়ে দিয়ে মনু মিয়া ভাবলো যে, এমন একটা কঠিন পরিস্থিতিতে এই বয়স্ক মানুষ দুজনকে কী করে সে ছেড়ে যাবে? তারা যদি শহর ছেড়ে যেতে না চান তাহলে স্বার্থপরের মতো নিজের প্রাণ বাঁচাতে সে চলে যেতে পারে যে কোনো সময়ই। কিন্তু সেটা কি ঠিক হবে? বিপদের সময় তাদের দেখার মতো তো আর কেউ নাই!
রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে সে ড্রয়িং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে পায় তিনটা মুখই কেমন যেন গভীর একটা বিষাদের অন্ধকারে চাপা পড়ে আছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সে ভাবলো যে, কী কথা দিয়ে শুরু করতে পারে। দুপুর প্রায় পেরিয়ে গেছে। তাই একবার কেশে গলা পরিষ্কার করে বললো, রান্দা তো পরায় শ্যাষ! আফনেরা খাইতেন টাইতেন না?
তিনজনই যেন খানিকটা চমকে ফিরে তাকায় মনু মিয়ার দিকে। তখনই মনু মিয়া বলে উঠলো, কয়দিন আগে দিয়া আজগইরায় কইসিল, আমরা এহেনো থাকলে মারা পড়তারি! অ্যার লাইগ্যা কইতাসলাম যে, সময় থাকতে দুই একদিনের ভিতরে আফনেরা আমার লগে লন। টাউনের থাইক্যা আমরার গ্যারামের ভিতরে বিফদ-আফদ কম অওনের কতা!
মনু মিয়ার কথা শুনলেও তিনজনের কেউ তেমন একটা সমর্থন করলেন না। কিন্তু তার মনে হলো, তারা তিনজনই পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা সেরে ফেলেছেন, যা পাঠ করা তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের সামর্থ্যে কুলায়নি। কিছুক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে বলার মতো তেমন কিছু না পেয়ে হঠাৎ সে রান্না ঘরের দিকে ছুটে গেল।
মনু মিয়া চলে গেলে সালমা বেগম বললেন, পোলাটার কথা আপনেরা খেয়াল করছেন?
রহমান সাহেব বলে উঠলেন, পোলার কথার আগেই বদমাইশটা আমারেও এই কথা কইছে। হ্যায় যে মিছা ডর দেখায় নাই তাও বুঝতাছি। কিন্তু এমন বিপদে কই যাই? এমন কাউরে তো চিনি না যার বাইত্যে গিয়া উঠতে পারি।
তা ছাড়া যাগোরে চিনি তারা তো ঢাকাইয়া মানুষই।
শৈলেশ ভাই কী কন? বলে, তার মুখের দিকে তাকান সালমা বেগম।
শৈলেশ বর্মণ কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললেন, তিন ভুবনে তো তগো দুইজন ছাড়া আমার কেউ নাই।
তো ইন্ডিয়া কার কাছে যাইয়া উঠবেন বইল্যা ঠিক করছিলেন?
তেমন কেউ নাই। আমার মতই একটা পোলারে পড়ার খরচ দিতাম। কইলকাতা। ভাবছিলাম তার কাছে যাইয়াই প্রথমে উঠি, তারপর ঠিক করা যাইবো কই থাকি বা কী করি। ডাক্তার মানুষ এত সমস্যা হওনের তো কথা না!
রহমান সাহেব বললেন, কাইলকা ছাব্বিশ তারিখ পোলারা ফোন করনের কথা। দেখি তাগো লগে কথা কইয়া।
শৈলেশ বর্মণ বললেন, তোরা দুইজনে পোলাগো কাছেই তো থাকলে পারস। এত ট্যাকা পয়সা কই রাখবি?
রহমান সাহেব মৃদু হেসে বললেন, আম্রিকান কনস্যুলেটে গেছিলাম তো তরে কয়বার কমু? সামনের মাসের পাঁচ তারিখ যাইবার কইছে। কিন্তু দেশটারে ছাইড়া যাইতে মন চায় না রে! এহানেই পয়দা হইলাম, বড় হইলাম, ঘর-বাড়ি ব্যবসাপাতি বড় করলাম, সব ছাইড়া হুট কইরা ক্যামনে যাই?
শৈলেশ বর্মণের মনোযোগ রহমান সাহেবের প্রতি নেই তা পরিষ্কার বুঝতে পারলেন তিনি। কিছু একটা নিয়ে তিনি নেজের ভেতরই বুঁদ হয়ে আছেন বলে মনে হয়। তাই রহমান সাহেব, স্ত্রীকে বললেন, মনু মিয়ারে তাইলে কাইলকা ট্যাকা-পয়সা দিয়া তার বাইত্যে পাঠাইয়া দেও। আমরা আইজকা রাইতেই ঠিক কইরা ফালামু কী করন যায়।
তারপর তিনি খানিকটা জোর দিয়েই বললেন, ডাক্তার কী কস?
শৈলেশ বর্মণ চমকে উঠে বললেন, কী, কী কইলাম?
তুই কী এত চিন্তা করস? আইজ আর যাইয়া কাম নাই। থাইকা যা। তিনজনে মিল্যা কিছু একটা ঠিক করন যাইবো।
সন্ধ্যা হয়ে আসছিলো। মনু মিয়া রান্না সেরে সব কিছু গোছগাছ করে বাইরে বেঁধে রাখা গাভীটাকে নিয়ে গোয়ালে নিয়ে বাঁধে। তারপর বেশ কিছুটা খড় নিয়ে গাভীটার সামনে ছড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসে। গোয়াল ঘরের দরজাটা টেনে বাইরে দিয়ে শিকল আটকে দিয়ে প্রায় মাটিতে শুয়ে পড়ে মুরগির খোঁয়াড়ে উঁকি দিয়ে দেখে। সবগুলো মোরগ-মুরগি ঢুকেছে কি না বা কোনোটা বাইরে রয়ে গেছে কি না বুঝতে না পারলেও খোঁয়াড়ের দরজাটা বন্ধ করে দেয়। আজ কাজের ঝামেলায় বেশ দেরি হয়ে গেছে। এখনই তাকে গা গোসল দিয়ে বেরুতে হবে। এই ক’দিনে বেশ কতগুলো ডিম জমে গেছে। ইসুব মিয়াকে সবগুলো বুঝিয়ে দিতে হবে।
ইসুব মিয়া দোকানে থাকলেও বললো, ডিমগুলো যেন সে তার ঘরে পৌঁছিয়ে দিয়ে আসে। মেয়েটার জ্বর আজ কদিন ধরে। তার অবস্থাটাও যেন দেখে আসে।
মনু মিয়া খানিকটা অবাক না হয়ে পারে না। বাপ হয়ে মেয়ের চাইতে দোকানদারীটা মূল্যবান হয়ে উঠলো এই বুড়োর কাছে? নিজে মেয়ের তত্ত্বতালাশ না করে বলছে অচেনা আরেকটি মানুষকে!
ফিরতে ফিরতে মনু মিয়ার বেশ কিছুটা দেরিই হয়। মেয়েটা নানা কথায় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে তাকে আটকে রাখছিলো। শেষে প্রায় জোর করেই সে বেরিয়ে এসেছে।
গেটে তালা লাগিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকতেই সে দেখতে পায় সালমা বেগম টেবিলে খাবার দিয়ে নিজেও খেতে বসেছেন। মনু মিয়াকে দেখতে পেয়ে তিনি বললেন, তুইও খাইয়া শুইয়া পড়!
মনু মিয়া রান্না ঘরে গিয়ে নিজের জন্য খাবার নিয়ে মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে বসতেই অকস্মাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে পুরো বাড়িটাই যেন অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যায়। তখনই সে উঠে দুটো হ্যারিকেন জ্বালিয়ে একটি খাওয়ার টেবিলের দিয়ে ফিরে আসে। খাওয়ার প্রায় শেষ পর্যায়েই শুনতে পায় দূরে কোথাও দুম দুম ক্র্যাক-ক্র্যাক, ট্যাশ-ট্যাশ করে বিচিত্র শব্দ হচ্ছে। সে অবাক হয়ে কান পেতে শুনতে চেষ্টা করে। প্রথমটায় ভেবেছিলো কোনো বিয়ে বাড়ির পটকা ফাটার শব্দ বুঝি। কিন্তু শব্দগুলো বার বার ধ্বনিত হলে সে বুঝতে পারে যে, এগুলো সাধারণ কোনো শব্দ নয়। খুবই নতুন ধরণের শব্দ। যে শব্দগুলো মনের ভেতর কৌতূহল সৃষ্টি করার বদলে কেমন যেন ভীতির সঞ্চার করছে।
খাওয়া শেষ করে সে ডাইনিং রুমে এলে দেখতে পায় তিনজনই কেমন বিভ্রান্ত। রহমান সাহেব রেডিওতে ঘরঘরে বিচিত্র শব্দ শুনতে শুনতে বলে উঠলেন, কাইলকার থাইক্যা কার্ফু! তখনই অকস্মাৎ শৈলেশ বর্মণ ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন, শহরটারে শ্যাষ কইরা ফালাইলো রে!
মনু মিয়াকে কেউ কিছু না বললেও কেন যেন তার মনে হচ্ছিলো যে, বাইরের অন্ধকারে ভয়াবহ কিছু একটা হচ্ছে!
সালমা বেগম খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন আগেই। হাত ধুয়ে বললেন, মনু মিয়া, তুই কি এই রাইতের মধ্যে তোর বাইত্যে যাইতে পারবি?
মনে অয় না। এত রাইতে গাড়ি পাওয়া যাইতো না! বলে মাথা ঝাঁকায় সে।
দেখ, যেমনেই পারস! কাইল থাইক্যা বাইরে বাইর হওন যাইবো না। বলতে বলতে তিনি দ্রুত পায়ে শোয়ার ঘরে গিয়ে হাতে টাকা নিয়ে ফিরে আসেন। তারপর মনু মিয়ার হাতে টাকাগুলো গুঁজে দিয়ে আবার বলেন, সাবধানে বাইর হইয়া যা। ফুল বাড়িয়ার দিকে না গিয়া বেবিট্যাক্সি নিয়া মেঘনা ঘাটে যাগা। দেরি করিস না ভাই! যা, নাইলে জানে বাঁচবি না! বলতে বলতে তিনি মনু মিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
বিভ্রান্ত মনু মিয়া কী করবে বুঝতে না পারলেও তার মন বলছিলো, যে করেই হোক ঢাকা শহর ছেড়ে তাকে বেরিয়ে যেতে হবে রাতের ভেতরই। আর সে কথা মনে হতেই সালমা বেগমের পা ছুঁয়ে দ্রুত দরজার বাইরে বেরিয়ে পড়লেও গেটের দিকে যায় না। সে ভালো করেই জানে গেটের বাইরে আজগর আর তার বিহারি বন্ধুরা আছে। তাই ত্রস্ত পায়ে গোয়াল ঘরের দিকে এগিয়ে যায় সে। তারপর গোয়াল ঘরের দরজা বেয়ে চালে উঠে দেয়াল ধরে বাইরের দিকে ঝুলে পড়ে আরো গাঢ় অন্ধকারে লাফিয়ে পড়ে।
( সমাপ্ত)
২/৯/২০১১
আগের পর্বগুলোর লিঙ্ক দেন।প্রিয়তে নিমু।

যেহেতু প্রিয়তে নিতে চান ব্যবস্থাটা আরো সুবিধাজনক কইরা দিলাম।
-------------------------------------------------------------------------------------
পুরা জীবিকা অথবা জীবন এখানে
--------------------------------------------------------------------------------------
মনে হচ্ছে হঠাৎ করেই যেনো শেষ হয়ে গেলো।
বুজি, আপাতত শেষ না কইরা উপায় নাই। যেহেতু প্লট বড়, একটানা শেষ করা সময় সাপেক্ষ। তাই ভাবনাটারে তিনটা পর্যায়ে ভাগ করলাম। সুযোগ আর সময় পাইলে দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করার ইচ্ছা আছে।
শুরু থেকে এ পর্যন্ত থাকার জন্য -
দয়া করে একটু সময় বের করেন ... প্লিজ
মন্তব্য করুন