ছায়া ও টিকটিকির সঙ্গে সংলাপ
টেবিলের ওপর পড়ে থাকা বইটির দিকে তাকিয়ে থাকে আলো -‘ছায়াহীন কায়া’। দেখে আর ভাবে, ভাবতে থাকে। লাটিম ঘুরতে ঘুরতে যেমন ঝিম ধরে থাকে-এক পায়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, তেমনি মেরুদণ্ডটা ঠিক সোজা করে আপন মনে বসে আছে সে। ফাঁকে একবার নিজের ছায়ার দিকেও থাকায় । সে বোঝে না ছায়াহীন কায়া কীভাবে হয় ? আনমনে সে আবার ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু আগে টিকটিকি তাকে ফোন করে। ভাগ্যিস বাবা তখন বাসার বাইরে। আজ টিউটরও নেই।
—কে বলছ? আলো ?
জ্বী, আলো।
আঙ্কেল কেমন আছ ?
হ্যাঁ, ভালো।
এখন স্কুলে আস না ? আর তো দেখা হল না।
না, এখন আমাদের ক্লাস অফ—জেএসসি পরীক্ষা ।
ক্লাস কখন শুরু হবে ? আবার কখন স্কুলে আসছ ?
পরীক্ষা শেষে। রাখি।–বলে ফোনটা রেখে দেয় সে। টিকটিকিটা বেশ ভদ্র। বয়স ৪০ এর বেশিই। ইঞ্জিনিয়ার। তার যমজ দুমেয়ে—আলোর আগের স্কুল ক্রিয়েটিভে—ক্লাস ওয়ানে পড়ে। টিকটিকি মোবাইলের স্ক্রিনে ওদের ছবিও দেখায়। সে প্রিন্সিপ্যাল কাশেম স্যারকে চেনে; তাদের পাশে গ্রিন ভিউতে থাকে। টিকটিকি আলোকে একটি ফোন নম্বর দেয়- আলো অনিচ্ছায় নেয়। মেয়ে দুটোর ছবি দেখাতে দেখাতে স্যারের কথা বলতে বলতে আলোর ফোন নম্বর চাইলে সে তার মায়ের নম্বরটা দেয়। বলে, তার মোবাইল নেই- বাবা মোবাইল নিয়ে রেখে দিয়েছে। টিকটিকি সব কথা বেশ ভালোভাবে শুনে; আলোকে বলে-পরীক্ষার জন্যে কী মোবাইলটা নিয়ে নিতে হয়; ওটা নিয়ে নেয়া ভাল হয়নি। এ কথাগুলো সে একটু সহজে বিশ্বাস করে। টিকটিকি নিজেকে ভদ্রলোক আর প্রকৌশলী বলে পরিচয় দিলে তার আর কী করার থাকে বুঝতে সে পারে না। সহসা সেদিন কেন ওই ফোন নাম্বারটা দিতে গেল- কিছুইতো সে এখনো বুঝে ওঠতে পারে না।
আলো—শহরের একটি সরকারি স্কুলে নাইনে পড়ে—নিজকে আলাদা ভাবে। একটু আলাদা ভাবাটা তার বেশ ভালো লাগে। সে ছায়াকে বলে, দেখো—আমি কিন্তু সবার মতো নয়—আমার স্বপ্ন অনেক বড়, আমার চেতনা অনেক নিবিড়, আমি অনেক শান্তশিষ্ট সহজ প্রকৃতির ; এভাবে আমি আলাদা।
ছায়া আলোর কথাগুলো শোনে। ছায়াকে তার বেশ ভালো লাগে। সে কখনো আলোর সাথে দ্বিমত করে না। ছায়া তার দিনরাত্রির সাথি।
আলো আবার বলতে শুরু করে, আলাদা আমার শরীর—গায়ের রঙ আম্মুর মতো; আর আব্বুর মতো লম্বা। আলাদা আমার নাম—আলো আজাদ। আমি জানি, এই নামে পৃথিবীতে একজনই আছে আর সে বাংলাদেশে—আমি। ছায়া আলোর ভালো শ্রোতাবন্ধু-মাঝে মাঝে মাথা নেড়ে তার কথায় সায় দেয়।
সে আবার বলে, অচেনা কেউ আমাকে দেখলে সহসা ভুল করে বলে বসে-তুমি কোন্ কলেজে পড় ? আমি একটু ইতস্তত বোধ করি। আমি এখনো স্কুলের গন্ডি পার হয়নি। বয়স ১৫ পেরিয়ে। কথা গুলো শুনতে শুনতে ছায়ার হাসি পায়। ছায়া হাসে। আলো আর ছায়া এক সঙ্গে হাসতে থাকে।
আলো তখন বলে, আমি একটু অন্তর্মুখি। আমি জানি, আমার মধ্যে কী যাদু লুকিয়ে আছে; কোন্ স্বপ্ন আমাকে দিনরাত তাড়া করছে। কিন্তু কাউকে বলি না-কারণ বললেই বিপদ; আমার স্বাধীনতা-সুখময়তার সামনে তৈরি হতে পারে এক সীমানাপ্রাচীর। নসিহত নির্দেশনা অ্যাডভাইজের জ্বালা এমনিতে বাঁচি না। এই সব ভাবি—কোন কিছু বলা হতে দূরে থাকি। আমার যত্ন আত্তি সব মা-ই করেন; বাবা, কেনাকাটায় তখন সঙ্গ দেন মাত্র। আমি কোন কিছু আব্বুকে বলি না-কেন বলি না তা জানি না। কলমকাগজ, স্কুলফি আর পরীক্ষার ফি-সব মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিই । এই সব ভাবি—কোন কিছু বলা হতে দূরে থাকি। ছায়া আলোর সব কথা শোনে আর মনে মনে বলে-তুমি বেশ বাকপটু, বুদ্ধিমান-তাইতো তোমাকে আমার বেশ পছন্দ।
আলো ছায়াকে তার কষ্টের কথা শেয়ার করতে শুরু করে; যেটি সঙ্গোপনে লুকিয়ে আছে—যে বেদনা টনটন করে ওঠে পাকা ফোঁড়ার মতো, মেনে নেয়া বেশ কঠিন, সেটি। দুমাস ধরে আব্বু মোবাইলটা আটকে রেখেছে; তার দাদুআপুর পরামর্শ আর টিউটরের সমর্থনে।
কেন তোমার ফোনটা জব্দ করল কেন ? এটাতো খুব কষ্টের কথা। আসলে বাবা মারা কী যে চায় তারা তা নিজেও জানে না।
আলোর গলা ধরে আসে, সে বলতে থাকে, তাঁদের আপত্তি—আমি পড়াশুনা কম করছি। আমার জেএসসির রেজাল্টও পিএসসির চেয়ে খারাপ-বৃত্তি পাইনি। মোবাইল ফোন লেখাপড়ার অ্যাটেনশন নষ্ট করে। আমি বুঝি না- আমি পড়ায় মনোযোগ দিলে একটি জড় পদার্থ-মোবাইল ফোন কী করে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে। আমি এই ফোন দিয়ে কী করি ? নাচি না কাশি—শিট। আমি এখনও মোবাইল ফোনের ব্যবহার জানি না। আমার বয়স কম।-–এই সকল অদ্ভুদ অজুহাতে আমার মোবাইলটি আটকে রাখে। আব্বু-আম্মু ঠিকই জানে আমার চেয়ে কম বয়সে মনুষ্য সন্তান পাইলট হয়ে আকাশ কাঁপিয়েছে। গলির মোড়ে যে শিশুটি খবরের কাগজ ফেরি করে তার হাতেও আছে কয়েকটি মডার্ন সেট। আমি বুঝি—আব্বু দাদুআপুকে ভীষণ ভয় পায়; দাদু না বললে এই মোবাইল আমি আর ফেরত পাব না। এবার শীতের ছুটিতে গ্রামে যাব- দাদুকেই হাতে পায়ে ধরে রাজি করব।
ছায়া জানতে চায়, সে মোবাইলটি কীভাবে পেল?—তখন আব্বু ঢাকা। বন্ধুরা—সাইফুল, তপু, শান্ত ও রড্রিক্স—বার বার ফোন করে। সৌরভ আকাশ ফাহিম হাই হ্যালো করে-ওরা কাজিন। সবার তো মোবাইল আছে। এদের সঙ্গে আলাপ করলে কোথায় দোষটি লুকিয়ে থাকে আমি বুঝি না, তারা বোঝে। মাঝে মাঝে মার কাছ থেকে চেয়ে নিতাম তার এই ফোন; আর একটি মোবাইলের কথা বলে বলে বার বার তার কাছে ধর্না দিতে থাকতাম। বন্ধুদের সাথে আলাপটা জমে গেলে এটি আম্মু আর নেয়নি-অন্য একটি সেট কিনে নেয়।
ছায়া আলোর কথাগুলো শোনে। তার মন বেশ খারাপ হয়ে যায়। বলে—এখন তোমার সময় কাটে কীভাবে ? সন্ধ্যায় কোথাও খেলতে যাও ? কার সাথে খেল ? কোন মাঠে ?
—স্কুল আর বাসা। অন্য কোথাও যাই না। রেগুলার টিউটর আসে, পড়ি। স্কুল আছে—পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র বসে—ক্লাসের সময় নেই। খেলার বিশাল মাঠ-খেলতে যাব, হেডস্যারের পারমিশন চাই। মর্নিং শিফটের ছেলেরা ক্লাস শেষে খেলতে পারবে না-তখন ডে শিফটের ক্লাস চলে। কিন্তু আমরা দেখি ক্লাবগুলোর কাছে মাঠ ভাড়া দেন তিনি-চড়া দামে। প্রাইভেট ব্যাঙ্কগুলোর ফ্যামিলি নাইট হয় স্কুল মাঠে-মহাসমারোহে।
উফ, এভাবে কোন খোঁয়াড়ে তো মানুষ থাকতে পারে না। তোমরা তোমাদের অসুবিধার কথা জানাও না কেন?—বয়স ১৮ না হওয়ায় আমরা দেশের কোন নাগরিক নয়, ভোটার নয়-আমাদের অনেক অধিকার বৈধ নয়। এই ভাবে আমরা বেড়ে ওঠি। আমরা বুঝি না-আমরা কী শিশু, না তরুণ? আমরা কী মানুষ, না কোন উনমানুষ ? আমাদের সবুজপেলব স্বপ্নগুলো দিন দিন নীল হতে হতে কেউ কেউ ভুল ভ্রান্তির চোরাবালিতে আটকে যায়। এই সব ভেবে ভেবে সন্ধ্যা নাগাদ পড়তে বসে আলো। বাবামা তখন ডাইনিং টেবিলে বসে আলাপ করছে। —হঠাৎ মোবাইলটা আবার বেজে ওঠে। মা আলোকে ডেকে বলে, তোমার ফোন। সে সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে ফোন ধরে।
জ্বী, আমি ভালো।
জ্বী, এখন বাসায়। সরি, একটু বিজি।
জী, এখন না। এখন একটু পড়ছি । সামনে পরীক্ষা।
জ্বী, রাখি।—আলো দেখে বাবা সহসা তার সামনে যমের মতো দাঁড়িয়ে। সে ফোনটা রাখতে না রাখতেই বাবা তা তুলে নেয়—বার বার জানতে চায়–উনি কে? আলো কার সাথে এত সম্মান দেখিয়ে কথা বলল-এর হেতুটা কী ? সে তাকে বুঝিয়ে বলে- ভদ্রলোক একজন ইঞ্জিনিয়ার মানুষ। ইঞ্জিনিয়ার আরিফ। সমবায় আবাসিকে থাকেন। দুসপ্তাহ আগে রয়েল হসপিটালে ছোট ফুপির বেবি দেখতে গেলে তাঁর সাথে আলাপ হয়। উনি কথায় কথায় তাঁর যমজ মেয়েদের কথা বলেন-ওরা নাকি ক্রিয়েটিভ জুয়েলসে পড়ে। বাবা তখন গোয়েন্দা পুলিশের মতো জেরা করতে শুরু করে। একজন টিন এজ ছেলের সঙ্গে তার এত আলাপের দরকার কী? আলাপ হলে তা-তো সেখানেই শেষ ; বার বার ফোন করে তাকে বাইরে যেতে বলার কারণটা কী? এটি কি সে ভেবে দেখেছে ? বাবা, জীবন এত সহজ ? দেখি বলে সে লাউড স্পিকার অন করে আলো আর তার মায়ের সামনে কল ব্যাক করল—
হ্যালো, হ্যালো।
হ্যালো, হ্যালো।
আমি আলোর বাবা বলছি। একটু আগে আপনিই কী ফোন করেছিলেন ?
জ্বী, স্লামালাইকুম।
ওয়া লাইকুমুস সালাম। আপনার পরিচয়টা বলবেন প্লিজ ?
আমি ইঞ্জিনিয়ার আরিফ।
ফাইন। আচ্ছা, আলোর সঙ্গে আপনার আলাপটা কিসের বলুন তো ? সে তো অনেক ছোট- হয়তো আপনার সন্তানের বয়সী।
সরি, সেদিন ওর সঙ্গে সানমারে দেখা- আর আলাপ। বললাম ক্রিয়েটিভে আমার ছেলেটা পড়ে। এমনিতেই একটু ফোন করছিলাম। সরি, আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন।
আপনি কি করেন? কোথায় পড়ালেখা করেছেন?
আমি সুইডিশ পলিটেকনিক হতে ইলেক্ট্রনিক্সে পড়ি—পরে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং করি বুয়েট থেকে।
ঠিক আছে। আমি মনে করি, একজন কিশোরের সঙ্গে আপনার বয়সী কারো এ রকম যোগাযোগ সুন্দর বা স্বাভাবিক নয়। আমি চাই আপনি আলোর সাথে আর কোন যোগাযোগ রাখবেন না, কোন ধরনের আলাপ করবেন না। যদি কোন প্রয়োজন হয়, আমার সাথে সরাসরি কথা বলবেন-আমি আপনাকে সাদরে গ্রহণ করব।—এই বলে বাবা ফোনটা রেখে দেয়। রাগে তাঁর মুখ লাল হয়ে যায়, সে বলে ওঠে- ধাপ্পাবাজির জায়গা পায় না। সুইডিশে ইলেক্ট্রনিক্স ডিপার্টমেন্ট নেই, আর ডিপ্লোমা পড়ে বুয়েটে পড়ার সুযোগ কখনো ছিল না, এখনো নেই। টিকটিকি কোথাকার! আলো আর তার মা ভয়ে কাঁপতে থাকে। ওর কথার অমিলগুলো তারা সহজে ধরে ফেলে। বুঝতে পারে সেদিন রাতে টিকটিকিটা কোন হীন স্বার্থে তার সাথে বাসায় ফেরার জন্যে আলোকে ডাকে এবং আজ আবার এই সন্ধ্যায় ইনিয়ে বিনিয়ে বের হতে অনুরোধ করে। বুঝতে পারে, টিকটিকিরা কখনো মানুষ হয় না।
আলো জানে—বাবামা তাকে কত ভালোবাসে। বাজারের সেরা কেডস সব কাজিনের আগে সে পরে, সেরা জিন্সটি পুরো শহর তন্নতন্ন করে খুঁজে তারা কিনে। আসলে বাবাভীতিটা তার কাছে সংক্রমিত। বাবাকে—চাচু, ফুপি ও আম্মু—ভয় পায় । সেও এভাবে ভয় পেতে শুরু করে। অথচ বাবা কখনো তাকে বকেনি, গালি দেয়নি বা মারেনি। সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবামায়ের সন্তান।
পড়লাম, ভালই লাগলো। তবে ঠিক শিশুতোষ মনে হল না। আরও লিখুন, ভাল থাকুন।
গল্পটি মূলত রিরাইট করেছি। প্রথমে এটি প্রথম পুরুষে লিখি।
তারপরে সংলাপ শৈলীতে নিয়ে আসি। মনে হয় এতে গল্পের কিশোরময়তা হ্রাস পেয়েছে। ইচ্ছে হলে মূলরূপ পড়ে নিতে পারেন। নিচে লিংকটি দিলাম।http://www.choturmatrik.com/blogs/%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A6-%E0%A6%86%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B9/%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%A0%E0%A7%8B%E0%A6%AB%E0%A7%8B%E0%A6%A8-%E0%A6%93-%E0%A6%9F%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%9F%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%BF-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B7%E0%A7%9F%E0%A6%95-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%B0 শুভেচ্ছা নিন। ধন্যবাদ।
সুনদর গলপ
ভালো এফোর্ট!
শিশুদের জন্য আসলে খেলার মাঠ, মুক্তবায়ুতে খেলাধুলা বা বিনোদনের খুব অভাব আমাদের দেশে। পার্কের সংখ্যারও অভাব। দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে পার্ক খুবই কম।
এই বোধটা দারুন
মন্তব্য করুন