ইউজার লগইন

ঝরা সময়ের গল্প

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসগুলো খুব জোরে চলে। টিএসসি, শাহবাগ মোড় হয়ে বাসটা চলতে থাকে দুরন্ত গতিতে। ব্যাপারটা ভালো লাগে মেয়েটার। দ্রুত বদলে যেতে থাকা পথঘাট দেখতে দেখতে ভুলে থাকা যায় অনেক কিছু।

বৃষ্টি হয়েছে। তবু বিকেলটা ভালো যায়নি ওর। ছেলেটাকে ভালবাসত মেয়েটা। কিন্তু যেটুকু ভালবাসত সেটুকু ভালো ছেলেটা বাসত না। আধভেজা হয়ে বাসে চড়ে এসব কথাই ভুলে যেতে চাইছিলো ও। ক্যাম্পাসে পিছু নিয়েছিলো যে ছেলেটা তার কথাও ভুলে যেতে চাইছিলো। শুরুতে সব ছেলেরা একই কথা বলে, বন্ধু হতে চায়, তারপর প্রেমিক হতে চায়। তারপর অভিভাবক হয়ে যেতে চায়। যেন খাচায় পুরে রাখতে পারলেই ক্ষান্ত হবে। আর একটা সময়ে বুঝিয়ে দেয় যে সম্পর্ক শেষ করার ব্যাপারটা চুল দাড়ি কামাবার মত সহজ কাজ। রোজ রোজ ছেলেদের ন্যাকামি সহ্য করতে করতে বড্ড বিরক্ত জমেছে।

যে ছেলেটাকে ভালবাসত তার কথা খুব মনে পড়ছিল বিকেল বেলায়। কি যন্ত্রণার এই জীবন। কাউকে কিছু বোঝানো যায় না। কষ্টগুলো শুধু ফিরে ফিরে আসে আর মনের ভিতর সবকিছু ভেঙ্গেচুরে রেখে যায়। এ সবের মাঝে কোত্থেকে এক ছেলে এসে কথা কইতে চায়। যেন মামার বাড়ির আব্দার। আর কেমন নির্লজ্জ, চলে যেতে বললেও যায় না। কোনো অপমান যেন গায়েই লাগে না এদের। শুরুতে খুব কাতর ভাব করবে, তারপর একটা সময় আসল চেহারা চেনা যাবে। এর চেয়ে ভালো আর কারও সাথেই সম্পর্ক না করা। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল- একই ভুল আর কক্ষনো করবে না।

কাঁদলে নাকি চোখ পরিস্কার হয়, পৃথিবীর সবকিছু নতুন করে দেখা যায়। একফোঁটা জল চোখের কোনাটা ভিজিয়ে দিলো ওর। লাল রঙের বাসটা তখনো ছুটে চলেছে। আর ভেজা বাতাসের ঝাঁপটা পরশ দিয়ে যাচ্ছে।

২.
অফিসের লোকজন খুব ব্যস্ত ভাবে খবর লিখে যাচ্ছে। লোকাল বাসের ভিতরে নানান ধরনের মানুষের ঘামের গন্ধ উপেক্ষা করে অফিসে পৌঁছেছে ছেলেটা। কিন্তু খবরে মনোযোগ দিতে পারছেনা।

বেশ কিছুদিন ধরেই কোনোকিছু ভালো লাগে না ছেলেটার। যেন বছরের পর বছর ধরে ভালো না লাগার কারণ খুঁজছে। এই দিশেহারা সময়ে সে নিজের জীবন নিয়ে কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারে না, ভবিষ্যতের পরিকল্পনাও চূড়ান্ত করে ফেলতে পারে কোনোভাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা কেউ খুব ভালো রেজাল্ট করে, কেউ বিকেল বেলায় প্রেমিকার হাত ধরে ক্যাম্পাসে হাঁটা হাঁটি করে। এ সব কিছু ছেলেটার পাশ কাটিয়ে চলে যায়, আর ওর বুকের ভিতরের একটা পাথরের ওজন প্রতিদিন বাড়তে থাকে।

বহুদিন আগে পাথরটার জন্ম দিয়েছিলো ও নিজেই। একটা মেয়েকে ভালোবেসে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই নানা রকম নেশার খপ্পরে পড়ে রেজাল্ট খারাপ হচ্ছিলো। এ রকম একটা ছেলেকে বিদায় জানাতে কারো দ্বিধায় ভুগতে হয় না। এরপর একটা একটা করে দিন পার হচ্ছিলো, শীত বসন্তের মত। ততদিনে নেশার অন্ধকারে প্রায় শেষ হতে বসেছে সব।

এরকম সময়ে এক বিকেলে পার্কের কাছাকাছি একটা যায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলো উদ্ভ্রান্ত ছেলেটা। কলমিলতার মত একটা মেয়ে তখন ওর পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। কাউকে কোনোদিন ভালবাসবে না - এরকম অভিমান ছিলো ওরও। কিন্তু মেয়েটাকে দেখার পর থেকে আর এক বার সত্যিকারের বেঁচে থাকার ইচ্ছা হলো ওর। মেয়েটার মনের ভিতরে নিশ্চয়ই একটা নদী আছে। সাঙ্গু অথবা মাতামুহুরির মত। দাশবাবুর কবিতা পড়ে মেয়েটার মন নিশ্চয়ই অনেক ভালো না লাগায় ছটফট করে। মেয়েটা নিশ্চয়ই আমার মত এই কংক্রিটের জঙ্গল ছেঁড়ে পালাতে চায়।

এই দিশেহারা সময়ের সব কথা বলতে পারলে নিশ্চয়ই বাঁচার একটা উপায় বের করে ফেলতে পারবে সে। এসব কথা জানাতেই বিকেলবেলায় মেয়েটার পিছু নিয়েছিলো ছেলেটা। কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই ওর কথা শুনতে রাজি হল না। এক কথায় জানিয়ে দিলো- দেখুন, আমার অনেক বন্ধু আছে, বিরক্ত করবেন না, প্লিজ। বড় রাস্তার মাঝখানে এক ঝাঁপটা বৃষ্টিতে আধভেজা হয়েও মেয়েটা একবারো তাকালো না ওর দিকে। নিগৃহীত হবার অনুভুতি নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকলো যুবক।

পত্রিকা অফিসের কীবোর্ডের খটখটানি মহাজাগতিক গুঞ্জনে রুপান্তরিত হয়। সেই গুঞ্জনে হারিয়ে যায় যুবকের সত্যিকারের বেঁচে থাকার ইচ্ছেগুলো।

৩.
তারপর অনেকদিন। কেউ কিচ্ছু জানে না। শুধু কাগজে ছাপা হয়েছিলো আরও একজন মাদকাসক্তের ঝরে পড়ার গল্প।

পোস্টটি ১১ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

আরাফাত শান্ত's picture


টিপ সই

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

নিয়োনেট's picture

নিজের সম্পর্কে

অতীতের ভিত্তিতে নিজেকে ডিফাইন করা অর্থহীন। আর আগামীও অদেখা। বর্তমানে আমি কী সেটা যদি এখন বলি, সেই তথ্য খানিক সময় পরে ইনভ্যালিড হয়ে যাবে, যেহেতু মানুষ প্রতি সেকেন্ডে বদলায়। ফলে, নিজের সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলাটা কঠিন কাজ।