রবীন্দ্রনাথের গান আর নস্টালজিয়ার ফাঁদ
শিবলী ভাই প্রায়ই গাইতো, ক্যাম্পাসের ফুটপাতের গাড়িঘোড়ার শব্দের মাজখানে বা ষোলোতলার ছাদের বাতাসের শোঁশোঁর পাশঘেষে, আমিও কান পেতে শুনতাম। আমার আপণ হৃদয় গহন দ্বারে বারেবারে, কান পেতে রই। এই গান, অথবা আরও অনেক অনেক গান। খালি গলায়। আমার কি যে ভালো লাগতো! শুনতে শুনতে ভাবনার অলিগলিতে হারিয়ে যেতাম। অথবা ভ্রমরটার মত বিবাগী হতাম পদ্মফুলের জন্য, আর সঙ্গিবিহীন অন্ধকারে হতাম রাতের পাখির মত একাকী।
আজকে সন্ধেটায়ও কি যে হলো- বাজারসদাই করে ফিরছিলাম, সেলসিয়াস স্কেলে তাপমাত্রা শুন্য ডিগ্রীর নীচে, এর ভেতরেই দেখা পেলাম ফাল্গুনে গানটা মনের ভেতরে বেজে উঠলো। ভাবলাম একবার গানটা শুনলেই হয়, ইউটিউব যখন আছে। তিতাসেরটাই ছাড়লাম। অনেক অনেকদিন এই গানটা ও গাইতো আর সেইসাথে সুন্দর করে গিটার বাজাতো। ইউটিউবের অটোপ্লে অন করা ছিলো বিধায় গানটা শেষ হবার পর চালু হয়ে গেলো সাহানা বাজপাইর একটা রবীন্দ্রসঙ্গিতের আলবাম। সেখানে শুনলাম শিবলী ভাইয়ের গানটা। আর এখন ইউটিউব বাজাচ্ছে আমার মল্লিকাবনে যখন প্রথম ধরেছে কলি। গাচ্ছে খুব সম্ভবত অলকা ইয়াকনিগ।
এর পরের গানটা হলো একটুকু ছোঁয়া লাগে। এইটা শুনতে শুনতে মনে পড়ে যাবে নিপু দাদার কথা। গ্রামের সবাই ডাকতো নিরুপেন নামে। ভালো নাম নৃপেন্দ্রনাথ। দু'হাজার দশ কি এগারো সাল হবে, তখন আমার একটা সেলফোন হয়েছে যদ্দুর মনেপড়ে। গ্রামীনফোনের মন্থরগতির জিপিআরএস অথবা আইবিএ হোস্টেলের দশ কিলোবাইট পার সেকেন্ডের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট হয়ে আমার কাছে পৌঁছে গেলো নিপু'দার গাওয়া এই গানটা। টেক্সাসের কোনো এক অলস ইউকেন্ডে কী-বোর্ড বাজিয়ে এই গানটা রেকর্ড করে গুগল টকে পাঠিয়েছিলো নিপু'দা। হয়তো হিউস্টনের আকাশে তখন ঝলমলে রোদ্দুর ছিলো, আর আমার আকাশে ছিলো কালশিটে মেঘ।
এই লেখাটা কোন দিকে যাচ্ছে জানি না। শিরোনাম যেহেতু লেখা হয়ে গেছে আগেই, তাই আর কোনো কিছু নিয়ে না ভাবলেও চলবে। আমার ইউটিউব এখন বাজাচ্ছে বেইস গিটার সমেত সোমলতার মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো। অভ্র আর ডয়েচ কী বোর্ড জনিত ঝামেলায় হাওয়া লিখতে গিয়ে হয়ে গ্যালো হাওউয়া। মনে পড়ে গ্যালো বরিশাল এলাকার মানুষের মুখের এই গালি। যেটাকে আমাদের খুলনা এলাকায় বলে শাউয়ো। শাউয়ো থেকে শাউয়া। অতঃপর বরিশাল এলাকায় সেইটাকে বানায়ে ফেললো হাউয়া। শাউয়ো > শাউয়া > হাউয়া। শব্দের এই ধরণের পরিবর্তনকে কী বলে সেটা ক্লাস নাইন টেনে থাকতে বলে দিতে পারতাম। বাংলা ব্যাকরণ বই গুলে খেয়েছিলাম কিনা, তাই ভাষার এইসব ব্যাপারস্যাপার এখনও আমার চোখে পড়ে আরকি!
যাইহোক অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। লিখতে লিখতে হারিয়ে গিয়েছিলাম।
সন্ধ্যেবেলার জলখাবারের খিদে আর ব্রেকিং ব্যাডের সিজন ফাইভের ডাক অগ্রাহ্য করে রবীন্দ্রনাথের গান আর নস্টালজিয়ার ফাঁদে পা দিয়ে সঁপে দিলাম জীবনের অতি মূল্যবান একটি সন্ধ্যা। অথচ এখনও ইউটিউব বাজাচ্ছে, আমি রুপে তোমায় ভোলাবো না, ভালোবাসায় ভোলাবো, আমি হাত দিয়ে দ্বার খুলবো নাকো, গান দিয়ে দ্বার খোলাবো। সোমলতা এই গানটা খুউব ভালো গাচ্ছে। আমার মনে পড়লো সেঁজুতি আর মানসীদের কথা। যাদের গান শুনে শুনে আপনাতেই আমার দ্বার খুলে গিয়েছিলো অনেকবার। আমি ওদের সবাইকেই ভালোবেসেছিলাম, তবে সেই ভালোবাসা বাস্তবের কঠিনের সামনে দাঁড়াতে পারে নাই। এই একটা জায়গায় এসে কী-বোর্ডে আমার আঙ্গুল নিথর হয়ে যায়। ভালোবাসার কাছে আমি হেরেছি প্রতিবারেই। যদি অন্তত একটা বারও জিততাম, বা ড্র করতাম, বা অন্তত যদি সত্যিকারের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসতে পারতাম, তবে নিশ্চয়ই আজ আমার সব থাকতো।
ব্রেকিং ব্যাডের ডাক অগ্রাহ্য করে কাজ করতে পারা বিরাট ব্যপার। রেসপেক্ট!
লাস্টের প্যারা পড়ে মনে হলো, ভালোই হয়েছে কখনও ভালবাসার সাথে লড়াইয়ে জিততে পারিসনি বলে। যখন জিতবি তখন সেটা বাস্তবের কাঠিন্যকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে বানের জলের মতো। ভাবিস না।
থাঙ্ক ইউ ভাইয়া!
মন্তব্য করুন