অপহৃত উৎসব বিষয়ক কিছু কথা
১. দূর্গাপুজা ও কোরবানির ঈদ চলে গেল হাত ধরাধরি করে। মাতৃরুপেনু সংস্থিতা দেবী দূর্গা সপরিবারে পিত্রালয়ে নাইওর এসে এবারো দমন করলেন অশুভশক্তির প্রতীক দেবদ্রোহী মহিষাসুরকে। মৃত্যুর কিছুকাল পূর্বে নিজের মৃত্যুদৃশ্য স্বপ্নে দেখে ভীত মহিষাসুর ভদ্রকালীকে তুষ্ট করেছিলেন। ভদ্রকালী তাঁকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি না দিলেও তাঁর ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে বরদান করতে ইচ্ছুক হন। মহিষাসুর দেবতাদের যজ্ঞভাগ বর চাইলে দেবী সেই বর দিতে অস্বীকৃত হন; কিন্তু মহিষাসুরকে এই বর দেন যে যেখানেই দেবী পূজিতা হবেন, সেখানেই তাঁর চরণতলে মহিষাসুরেরও স্থান হবে। মায়ের গৃহে সকলেরই ঠাঁই আছে।
ভেবে দেখলে, কোরবানির ঈদ ও দুর্গাপুজার দর্শন প্রায় একই। এই ঈদ মূলত পশু কোরবানি অর্থাৎ প্রতীকী অর্থে অশুভ’কে নিধন করা, এবং আল্লাহর নেয়ামত সমাজের বঞ্ছিতদের সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য পালন হয়। গরীব ধনী সকলের স্থান আছে ঈশ্বরের ঘরে, সবাইকে শামিল করতে পারলে তবেই না যথার্থ উৎসব।
২. ৯/১১-র পর থেকে মুসলমানরা সারা পৃথিবীতে একটা টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে গেছে। ভাবটা এমন যেন এই দুনিয়ার সবাই মুসলমানদের থেকে বেশি বুঝে। মুসলমানেরা যাই করে সবতেই যেন অন্যদের আপত্তি। তাদের উঠা, বসা, খাওয়া, দাওয়া, পোশাক, সামাজিক মূল্যবোধ, আচার, ব্যবহার সবেতেই যেন জঙ্গীবাদের বোঁটকা গন্ধ পান অন্যরা। ফলে মুসলমানরা সবসময় ডিফেন্সিভ, সবসময় অন্যদের কৈফিয়ত দিয়ে যান —আসলে আমরা হলাম মডারেট মুসলিম বুঝলেন? এই দেখুন আমাদের নারীদের বোরকা পড়তে বাধ্য করা হয়না, বা আমদের দেশে ২ টা বৌ নিয়ে সংসার করা যায়না, ইত্যাদি। অবশ্য আজ পেপারে দেখালাম, রুমি নামক এক ছাগল দুই বৌ নিয়ে সংসারে করে দেখায়ে দিবে ঘোষনা দিয়েছে। বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার। যে পাব্লিক হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রীকে ভার্চুয়ালি প্রায় গনধর্ষন করলেন, এখন তারা চুপ কেন? হূমায়ূনতো আইনসঙ্গতভাবে প্রথম বিবাহ-বিচ্ছেদ করে দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। রুমি ভাইসাব তো রীতিমত হারেম খুলে বসলেন। একে আপনারা কি বলবেন? যা হোক। এবার শুনলাম মুসলমানদের আরেকটি সামাজিক অনুষ্ঠানে আবার সারা পৃথিবীর মুখভার। কোরবানি কেন দিতে হবে? কি নিষ্ঠুর ভাবে পশুনিধন, আহা! এই মুসলমান জাতটাই বর্বর, শালা!
বাংলাদেশের নিযুক্ত এক বিদেশী কূটনীতিকের গল্প শুনলাম এক বন্ধুর কাছে। সে নাকি তার এক বন্ধুকে ডেকে এনেছে সূদুর অস্ট্রেলিয়া থেকে, বাংলাদেশীদের বর্বরতা দেখাবে বলে-- কিভাবে প্রথমে পশুটাকে ধরে বেঁধে ফেলে চার-পাঁচজন মানুষ তাকে আল্লহু আকবর বলে নৃশংসভাবে জবাই করে, এরপরে দিনমান চলে সেই মাংস কাটা, বিতরন, ও খাওয়া। ঐ কূটনীতিক ও তার বন্ধু এক বাংলাদেশীর বাড়িতে নিমন্ত্রন নিয়েছেন ঈদের দিনে। বাংলাদেশী লোকটি মহাখুশি। তাদেরকে সকালে গিয়ে নিয়ে এসেছেন নিজের বাসায়, অতিথি যেন ঠিক জানতে পারে আমাদের দেশের উৎসবের খুঁটিনাটি। বিদেশীরাও ফটাস ফটাস করে ছবি তুলছেন, তারা দামি ডিএসএলআর ক্যামেরায় বন্দী করে রাখবেন গরু জবাই ও মাংসকাটা, যাতে অন্যদের কাছেও বাংলাদেশী মুসলমানদের পশুত্ত্বর প্রমান দিতে কোন অসুবিধা না হয়। একই ধারায় আরেকটা লেখা দেখলাম বিডিনিউজ অপিনিয়নে “মুসলিম ভাইবোনদের প্রতি খোলা চিঠি নামে” একজন মার্কিন পশু অধিকার এক্টিভিস্ট ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা লিখেছে আসলে এই প্রথাটি কত আমানবিক, ও বর্বর।
আমাদের কাছ থেকে আমাদেরই উৎসব অপহরন করতে চাচ্ছেন তারা, কিন্তু আবার মুখে বলছেন পশু অধিকারের বুলি। এদিকে আমরা মুসলমানরা আবারো ডিফেন্সিভ। কথায় কথায় ইব্রাহীম নবীকে টেনে আনি। মাথা চুলকে ভাবি, আল্লাহর হুকুম তামিল তো করতেই হইবো।
আমি মনে মনে বলে উঠি হায়রে, তোরা বুঝলিনা যে এটা শুধু গরু মারা না। তোরা বুঝলিনা যে বছরের এই একটা দিনে বিত্তশালীরা তার পাতের খাবারটি গরীবের সাথে শেয়ার করতে বাধ্য। বছরের মাত্র এই একটা দিনেই গ্রামের অনেক মানুষ মাংস খেতে পারে। তারা সারাপাড়া ঘুরে ঘুরে একটু মাংস নিয়ে এসে অন্তঃত একদিনই মেয়ে-জামাইকে আপায়্যন করাতে পারে। এটা কি মানবিক না?
তোমরা বুঝলে না, এসব কিছুই বুঝলে না।
গ্রামের মেঠো পথ, ফুলের গন্ধ, ঝিঁঝির ডাক
তোমরা কোনোদিন বুঝলে না, বুঝলে না নদীর গান, পাতার শব্দ
বুঝলে না সজনে ডাঁটা, পুঁইশাক, কুমড়োলতা
তোমরা হৃদয় বুঝলে না, বুঝলে লোহার আড়ত,
তোমরা কিছু বুঝলে না, কিছু বুঝলে না, কিছু বুঝলে না
শুধু বুঝলে চোরাগোপ্তা, বুঝলে রক্তপাত। (মহাদেব সাহা)
পাদটীকাঃ বিদেশী ঐ কূটনীতিক ও তার বন্ধুকে বাংলাদেশী গৃহকর্তা রীতি অনুসারে ৫ কেজি কোরবানির মাংস দিয়েছিলেন। তিনি ওটা খাবেন না। বন্ধুকে বলেছেন, ওখানে নাকি হাইজিন মেইন্টেন করা হয়নাই। সেটা তাঁর ড্রাইভারকে দিয়ে দিয়েছেন। কত বড় মানবদরদী তিনি বুঝে নিন। অপরিচ্ছন্ন বলে যেটা উনি নিজে খেতে পারবেন না, সেটা ড্রাইভার খেলে তার কোন আপত্তি নাই। একেতো বাংলাদেশী, তারউপরে ড্রাইভার। এরা আবার মানুষ নাকি!
৩. একটা গল্প বলি। আমার এক মামাতো বোন আছে, বয়স সাত। শিশুটির মা আমেরিকান, তাই সে বড় হয়েছে আমেরিকার একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে, সুপারমার্কেটের খাবার খেয়ে। এদিকে পশুপাখিও তার বড় প্রিয়। গত গ্রীষ্মে সে প্রথম আবিস্কার করলো বিফ আসে গরু থেকে। এতদিন তার জানা ছিলো না মাংস কোত্থেকে আসে। এই শুনে পিচ্চি কেঁদেকেটে আকাশ মাথায় তুলে ফেলল- mommy, why do they have to kill cows? কাঁদতে কাঁদতে হেচকি তোলার এক পর্যায়ে আমি আর ওর মা ওকে নিয়ে গেলাম ম্যাকডোনাল্ডে। সেখানে শিশুদের খেলার ব্যবস্থা আছে। মা তাকে হ্যামবার্গার, আর চিপস কিনে দিতে সে কান্না থামিয়ে খেলা শুরু করলো। মা তখন আমাকে চোখ টিপে আস্তে করে বলে, ও কিন্তু এখনো জানেনা বার্গার যে বিফ দিয়ে বানানো।
আমার কেন যেন মনেহয় বেশিরভাগ আমেরিকানই ঐ সাত বছর বয়সী শিশুটির মত।
৪. আমাদের পরিবারের কোরবানি হয় গ্রামের বাড়িতে। সাধারনত কোরবানির পরে গ্রাম থেকে কেউ একজন মাংস নিয়ে ঢাকা আসে। এবার আসছিলেন আমাদের গ্রামসম্পর্কের আত্মীয় ও পুরাতন পারিবারিক সহমর্মী আমজাদ ভাই। বয়স ৫০-৫৫ হবে। মাংসের সাথে বোধহয় কিছুটা জমির চালও ছিলো। রাত্রে রাজশাহী থেকে বাস ঢাকা পৌছায়। গাবতলী থেকে সিএনজি করে আমাদের বাসায় রওনা দেয়ার কিছুক্ষন পরে সিএনজি চালক বলেন, ভাই ইঞ্জিনে একটু সমস্যা হচ্ছে। নামেন দেখি একটু। উনি নিচে নামতেই পাশ থেতে দুইজন উনাকে ধাক্কা মেরে ফেলে সিএনজিসহ গায়েব। আমজাদ ভাই পড়ে থাকেন রাস্তায়। পরে একটি লেগুনা তাকে উঠিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সামনে দায়িত্বরত পুলিশের কাছে নামিয়ে দেন। মা ফোন করতে পুলিশ ফোন ধরে। পরে উনাকে বাড়ীতে নিয়ে যায় আমার ভাই। আমজাদ ভাইয়ের মুখে শুনলাম, উনি বসে থাকতে থাকতেই নাকি একজন রিকশাওয়ালা এসে কাঁদছিলো পুলিশের কাছে। তাকে ছুরি মেরে ছিনতাই করে নিয়ে গেছে তার রিকশা। এভাবেই আজকাল উৎসব ছিনতাই হয়ে যায় শহরের পথে ঘাটে।
৫. আমার মাতামহ শুক্রবারে স্নান শেষে মাঝে মাঝে ভাগবতগীতা নিয়ে বসতেন। একদিন ১০ বছরের আমি কাছে গিয়ে বসে বললাম, দাদু একটা গল্প বলেন। উনি বল্লেন, জানিস জগতে কোন মানুষটি সুখী? আমার জানা ছিলো না, আজও নাই, মাথা নাড়িয়ে বললাম, না। উনি গীতা’র পাতায় আঙ্গুল দিয়ে দাগিয়ে বললেন “অঋনী, অপ্রবাসী, দিনান্তে শাকান্নও গ্রহন করিলেও, সেই ব্যক্তি প্রকৃত সুখী।” আমার দাদু প্রকৃত সুখ পেয়েছিলেন কিনা জানিনা। অনেক সাম্প্রদায়িক আঘাতের পরেও দেশ ছাড়েননি তিনি, ঋনও ছিলোনা কারো কাছে। পূজার সময়ে আমাদের রাজশাহীর সোনাদিঘীর মোড়ে বইয়ের দোকানে নিয়ে যেতেন তিনি। আমার ভাই পেত নতুন বই, আমি ল্যাংবোট। তখন দেখেছি হিন্দু-মুসলমান ভেদে তাঁর ছাত্ররা পা ধরে সালাম করতো তাকে। দাদুবাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখ গোলগোল করে দেখাতাম মা দুর্গার বিসর্জনের মিছিল। সঞ্চি’র দেখাদেখি আমরাও প্রনামে দুইহাত তুলতাম ঠাকুরের উদ্দেশ্যে। কিছুদিন আগে শুনেছি দুর্গাপূজার রমরমা নাকি আর নেই রাজশাহীতে। উৎসব ফিকে হয়ে এসেছে। কিছুটা হলেও অপহৃত হয়েছে।
৬. গত পাঁচবছর ঈদ খালি আসে আর যায় ফেসবুকের পাতায়। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো। আমি ভোজনরসিক মানুষ, তাই খাবারদাবারের কথাই মনেহত সবচেয়ে বেশি। এখন কিছুটা সয়ে গেছে। নিজেই রাঁধি যা খেতে মন চায়। কিন্তু উৎসবটা নাই। আমার উৎসব অনুপস্থিত। আমেরিকান উৎসবগুলোতে আমি ঠিক যুত পাইনা। হ্যালোইন, থ্যাঙ্কসগিভিং, ক্রিসমাস ভাল লাগে, কিন্তু ঠিক দেশের মতন কি আর আর হয় বলেন?
সুন্দর করে আদরযত্নে কাগজে মুড়িয়ে দেশে রেখে এসেছি আমার উৎসবগুলোকে-- আমার শহরে, আমার গ্রামে, আমার বাড়িতে, আমার আলমারিতে মায়ের না পড়া সিল্কের শাড়ির ভাঁজের ভিতরের খবরের কাগজের নীচে। যেদিন ফিরে যাবো, সেদিনে বন্ধুদের আড্ডায় ঠিক কড়ায় গন্ডায় বুঝে নিব সব উৎসবগুলোকে।
( লেখাটি প্রিয়বন্ধু রায়েহাত শুভ'কে উৎসর্গ করা হলো )
যাক... এদ্দিন পর লেখলেন কিছু একটা...
৫নং নিয়ে- আমার মাতৃদেবী হয়তো গীতার টোনে বলে না, কিন্তু তার কথার মূলভাব একই। ছোটখাট দু'একটা বিষয় বাদে, উনি সুখী এইটুকু দাবী আমিই করতে পারি। তাইলে উনার নিজের দাবী নিশ্চই আরো জোরালো হবে...
মায়েদের জোরালো দাবীগুলো আরো জোরালো হোক।
এই আবালচো কুটনীতিক্যা কি নিজেগো দ্যাশের গরু মারন দেখসে কুনুদিন? বোকচো আইছে বর্বরতা খুজতে। ইয়ের ভিত্রে দিয়া শাল্গাস হান্দায়া চৌরাস্তায় খাড়া করাইয়া থোওন দর্কার এগ্লারে।
হো বাইসাব, আমিও তাই কই।
শালারা কিযে ভাবে নিজেগো। যতসব আবাল!
কি আর্ভাব্বো? ফারসট ওয়াল্ড থিকা আইসা ভাবে পুরাই সিবিয়াব্দুল্লা হইয়া গেসে।
প্রথা যতই বর্বর হোক না কেনো প্রথাকে সমর্থন করার মানুষ কমে না। সেটা যেকোনো প্রথার ক্ষেত্রেই সত্য।
এই দেশে ইংরেজ এসেছে ১৬৫০ এর পর, লক্ষণ সেন খিড়কি-দরজা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর মুসলিম শাসকেরা এই দেহ প্রায় ৪০০ বছর শাসন করেছে, কিন্তু যেহেতু ধর্মীয় প্রথা সুতরাং পরমতসহিষ্ণু মুসলিক শাসকেরা কেউই সতীদাহ প্রথার বিপক্ষে কিছু বলেন নাই, প্রথা নিন্দনীয় বর্বর হলেও অবশ্য পালনীয় এবং সেটা পালনের স্বাধীনতা তার আছে।
আমেরিকায় প্রকাশ্যে রক্তপাত কিংবা প্রকাশ্যে হত্যা নিষিদ্ধ হলেও ব্যক্তিগত পরিমন্ডলে যেকোনো বীভৎস ধর্মমতের চর্চা করা সম্ভব। ব্যক্তিগত বিষয়ের পরিধিটা মূলত ব্যক্তিগত আড়ালের পরিমাপেই নির্ধারিত হয়।
একদল খ্রীষ্টান মিশনারী এবং তাদের শিক্ষায় ও আদর্শে দীক্ষিত আরও কয়েকজন কুৎসিত কালো বাঙালী যারা ধর্মীয় সংস্কারবাদী তারা যখন সতীদাহ প্রথা নিয়ে চিৎকার শুরু করেছিলো তখন তারাও এই বাইরের শক্তির প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে একটা প্রথাকে বর্বর বলার অনুযোগটা শুনেছে। জমিদার লাঠিয়াল দিয়ে ইংরেজ পেয়াদা ঠেঙিয়ে নিজের মা কিংবা বোন যেনো শান্তিতে প্রথা আর ধর্ম রেখে পুড়ে মরতে পারে সেটা নিশ্চিত করেছে।
সে সময়ে মানতেই হবে একজন বিধবার জীবন মানেই মোটামুটি যাবজ্জীবন যৌন নির্যাতন, সে অবস্থাকে একজনকে রক্ষা করতো এই সতীদাহ প্রথা, অবশিষ্ঠ সবাইকেই সামাজিক বেশ্যা বানিয়ে একজনকে পুড়িয়ে ধর্ম রক্ষার দায় বেশ প্রশংসিত প্রথাই ছিলো।
মানত পুরণে সন্তানকে বলি দেওয়ার রীতিটাও নিন্দনীয় হলেও গোপনে ব্যক্তিগত ধর্মচর্চার স্বাধীনতায় পালিত হলো। দুই যুগ আগে এইসব বলিদানকারীদের আইনত হত্যাকারী ঘোষণা করায় এখন অন্তত লোকজন উৎসব করে শিশু বলি দেখে পিতা মাতার ধর্মপালনের নিষ্ঠা মেপে সম্ভ্রম দেখায় না।
আমাদের দেশের কোরবানী প্রথাটাও অন্তত মীর মোশাররফ হোসেনে সময়েও ততটা প্রথা ছিলো না। সে হিসেবে ১২৫ থেকে ১৫০ বছরের একটা প্রথা নিয়েএত হা হুতাশের কিছু নেই। খুব ক্লিশে কয়েকটা যুক্তি দেখলাম, সেটা আরো মর্মান্তিক ইমোশন্যাল লেগপুলিং মনে হয়েছে।
আপনার যুক্তিগুলো আসলে রেইনার এবার্ট সাহেবের কাছে অলরেডি শুনে এসেছি, সেগুলোও ক্লিশে, নতুন কিছু থাকলে বলেন। কোরবানি'র ঈদ মীর মশাররফ হোসেনের আমলে প্রচলিত ছিলোনা যে বললেন, ঐটাও কি রেফারেন্স দ্বারা ব্যাক করবেন?
আমি নিজে প্রথাগত জীবনে বিশ্বাসী না। তবে কিছু প্রথার সামাজিক মূল্য আছে আমার কাছে। আপনার যদি আমাকে বর্বর মনে হয়ে থাকে সেটা আমার লেখার দূর্বলতা। আপনার লেখা পড়ে আপনাকে বুদ্ধিমান, বিচক্ষনই মনে হয় সবসময়। কিন্তু আপনি যেভাবে সতীদাহ, সন্তান বলি, আর গরু কোরবানিকে একই নিক্তিতে বিচার করলেন তা আমার কাছে ভীতিকরই লাগলো।
মর্মান্তিক ইমোশনাল লেগ পুলিং এর জন্য অবশ্য তেমন খারাপ লাগতেসে না।এরিস্টটলের মতে সার্থক লেখার তিনি ভিত্তির অন্যতম ভিত্তি, Pathos, যে ব্যবহার করতে শিখলাম, সেটাও আমার একটি ক্ষুদ্র অর্জন।
মীর মোশাররফ হোসেন ১৮৮৯ সালে লিখেছিলেন 'গো জীবন', সেখানে তিনি মুসলমানদের অনুরোধ করেছিলেন গো হত্যা বন্ধ করতে, অবশ্য পরিণতিতে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় এবং পরবর্তীতে তিনি নিজেই অতিরিক্ত মুসলমান হয়ে গো জীবন লেখার পাপস্খলন করে গেছেন।
সামাজিক প্রতিক্রিয়ায় এভাবে পিছিয়ে এসে ধর্মপ্রাণ মুসলমান হয়ে ওঠা মীর মোশাররফ হোসেনের ব্যক্তিগত জীবনে খুব বেশী একগুঁয়ে লড়াইয়ের ইতিহাস নেই, নিঝঞ্ঝাট বাঁচতে চাওয়া মানুষটা যখন কোরবানীতে গরু হত্যা নিষিদ্ধ করার পক্ষে কোনো লেখা লিখেন তখন অনুমাণ করতে হয় প্রথাটা ততটা বলিষ্ঠ হয়ে উঠে নি। অবশ্য পরিস্থিতির অন্য পাঠও থাকতে পারে।
প্রায় না-মুসলিম আতরাফ মুসলমানেরা ধনে সমৃদ্ধ ছিলো না, ধর্মে আন্তরিক ছিলো না অন্তত এই অঞ্চলে ফারায়েজী আর ওয়াহাবী ইসলামীআন্দোলন শুরুর আগে, তাদের ধর্মপালনে তেমন আগ্রহ ছিলো না। ধর্মপালনে অনাগ্রহী দরিদ্র আতরাফেরা উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে কিছুটা ধনার্জন করলেও তার আগ পর্যন্ত তারা মূলত কৃষক দরিদ্র, তারা যে নিয়ম করে ঘরের গরু কোরবানী করতে ব্যাগ্র ছিলো এমনটা বিশ্বাস করার কারণ নেই।
যদি কোরবানী প্রথাটা ততটাই প্রচলিত থাকতো বিশেষত বাংলা সংবাদপত্রের সূচনার দিনগুলোতে, যখন রামমোহন মৃত্যু বরণ করেছে এবং প্রতিদন্ডী হিন্দু ধর্মপ্রচারক প্রসারক পত্রিকাটির গ্রাহক সংখ্যা কয়েক শত থেকে বেড়ে কয়েক হাজার হয়েছে সে সময়ে সেসব পত্রিকায় ব্যপকহারে গোহত্যার সংবাদ আসতো।
আমি যতটুকু পুরোনো পত্রিকা দেখেছি কিংবা পুরোনো পত্রিকার সংকলন দেখেছি ১৮৫০ এর দিকেও গো হত্যা বিষয়ে উত্তেজনা তেমন চোখে পরে নি।
উত্তর ভারতে পরিস্থিতি ভিন্ন রকম ছিলো, সেখানে ইংরেজ শাসনের শুরু থেকেই এক দল মুসলিম মধ্যবিত্তের উদ্ভব হয়েছিলো। তাদের হয়তো কোরবানী দেওয়ার মতো উদ্বৃত্ব ধন ছিলো। তবে গোহত্যা বিষয়টা রাজনীতির গুরুতর অস্ত্র হয়ে উঠেছে ১৮৭০ সাল থেকে, সে সময়ে প্রায় প্রতিবছরই কোরবানীতে দাঙ্গা হয়েছে এবং কোরবানীর প্রতি জান কুরবান করে দেওয়া ধর্মবোধের জন্ম হয়েছে।
অশিক্ষিত আতরাফ মুসলমানদের ভেতরে শিক্ষার আলো জ্বালাতে এসেছে উত্তর ভারতের শিক্ষিত মুসলমানেরা, তাদের সাথেই সম্ভবত এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রথা হিসেবে কোরবানীর আগমন হয়েছে।
যাই হোক ঐতিহাসিক বক্তব্য তেমন প্রয়োজনীয় কিছু না। কেউ যদি বিশ্বাস করে ১৩০০ সাল থেকেই প্রতিবছর মহাসমারোহে কোরবানী পালিত হচ্ছে বাংলাদেশে সেটাও আপত্তিকর কিছু না। তবে গরীবের দুটো মাংস খেতে পারবে এ জন্য কোরবানী পালিত হওয়া উচিত যুক্তিটা হুইল চেয়ারে বসে থাকা যুক্তি, ওটাকে এরিস্টটল প্লেটো হেরোডিটাসের নাম দিয়ে দিলে সেটা নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াবে এমন না।
গরীবেরা দু চারটা মাংসের টুকরো খেয়ে সারা বছর কোরবানী ঈদের প্রতীক্ষা করে, ওদের ছেলে মেয়েদের দু চার টুকরা মাংসের জন্য বছরে একটা দিন একটা গরু জবেহ করতে হয় বিষয়টা যুক্তি হিসেবে উপস্থাপনের জন্য যথেষ্ঠ আবেগ থাকতে হয় ভেতরে। আপনার ভেতরে তার চেয়ে বেশী আবেগই আছে।
এই লেখাটা বেশি চমৎকার হইসে।
থ্যাঙ্কস, মীর। আছেন কেমন?
অসাধারণ লেগেছে লেখাটা। আদিখ্যেতো অসহ্য
বার্গার এর উদাহরনটা বেশ, দ্যান আসবে অন্য যুকতি। ওরা পশুকে আরামদায়কভাবে হত্যা করে, আমাদের মতো কষট দিয়ে নয়। মারলেও ভালবেসে মারে
ধন্যবাদ, তাতাপু।
লেখা ভালো লেগেছে।

আমি ধর্ম তেমন পালন করিনা-
মাগার কোরবানীতে থাকি-
ধন্যবাদ অনিমেষ।
আমিও ধর্ম পালন করিনা, তবে যেকোন খাওয়া দাওয়ায় অংশগ্রহন করতে আপত্তি করিনা।
লেখাটা পড়ে মনটা কেমন জানি করে উঠলো।

এতো কম কেন যে লিখেন।
দেসিভাই, কেমুন চইলছে গো?
চইলছে আগের মুতোই।
চমৎকার লেখা
ধন্যবাদ মাসুম ভাই। কবিদের ভিড়ে যে আমার খুঁজে পাইসেন, তাতেই আমি ধন্য।
দারুন!
...কেন যেন মনেহয় বেশিরভাগ মানুষই ঐ সাত বছর বয়সী শিশুটির মত!
~
কেমন আছেন?
পড়লাম।
ঘুরে ফিরে একই লেকচার সব।
আপনার কাছে নতুন লেকচারের দাবি থাকলো।
চমৎকার একটি লেখা। খুব ভালো লাগলো। শেষ প্যারাটি মন ছুঁয়ে যায়।
ধন্যবাদ আসমা আপা!
এতদিন ধরে না লেখার অমার্জনীয় অপরাধ মাফ করে দেওয়ার মত লেখা!
পুরোটা লেখাই চমৎকার।
২ এর শুরুর কথাটার জন্য স্যালুট।
তয় একটা কথা,
আর ডুব দিয়েন না প্লিজ!
খবর কি তোর?
আবার চোখ রাঙ্গাস? শাজাহান সাবরে ডাকুম নাকি?
আমার আর খপর! এগজ্যামের চিন্তায় চুল দাড়ি সব বড় হইয়া যাইতাছে, কুন্দিন জানি পুলিশ আইসা জেএম্পি বইলা ধইরা নিয়া যায়!!
সেটা তো খুব ভয়ের কথা!
তয় আমার কথা হইলো এগজামের চিন্তা করে লাভ নাই, এর চেয়ে রোজ নিয়ম করে সানি লিওনের সিনেমা দেখলে জ্ঞানবুদ্ধি বৃদ্ধি পাবে।
কুনডা? 'জসিম ২' ছবিটার কথা বলতেছো?!
আমি তো হিন্দী মুফি দেখি না!
তয় এই মুফিতে 'অক্ষন অক্ষন' গানটা বড়ই সৌন্দর্য!
একটি ব্যক্তিগত বিরক্তি জানাই। আমাদের পরিচিত এক সেলেব বড়ভাই(!) তার ফেসবুকিয় মজর্াদা অক্ষুন্ন রাখাতে কোরবানী নিয়ে ইয়াব্বড় স্টেটাস দিতে থাকলেন.. এবং এসময়ের ফার্মের মুরগীগুলো "লাইক" তো বটেই "রাইট বস", "মুসলমান খারাপ" টাইপ বক্তব্য দিয়ে তার পেইজ গরম করে রাখলো.. অথচ এই রমজানে এই বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবিকে আমি নিজে অন্তত পাঁচবার পুরান ঢাকার বিরিয়ানি হাউজে চেক ইন করতে .. যাই হোক কোন বিরিয়ানি হাউজে তো আর "করলা/উস্তা'র বিরিয়ানি বেঁচেনা, তাইনা। তখন হাড্ডি চাবিয়ে, ইনফ্যাক্ট সারাজীবন হাড্ডি চাবিয়ে মুসলমানের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে তার যে প্রয়াস - তা খুবই বিনোদনপূর্ণ ছিল।
আপু, "৯/১১-র পর থেকে মুসলমানরা সারা পৃথিবীতে একটা টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে গেছে। ভাবটা এমন যেন এই দুনিয়ার সবাই মুসলমানদের থেকে বেশি বুঝে। মুসলমানেরা যাই করে সবতেই যেন অন্যদের আপত্তি। তাদের উঠা, বসা, খাওয়া, দাওয়া, পোশাক, সামাজিক মূল্যবোধ, আচার, ব্যবহার সবেতেই যেন জঙ্গীবাদের বোঁটকা গন্ধ পান অন্যরা। "
I agree.. some how i m a victim also..
ধন্যবাদ রুম্পা। আমি নিজে ধর্মপরায়ন মানুষ না, মুসলমান ধর্মের বেশিরভাগ ব্যাপারে আমার নিজেরও রিজার্ভেশন আছে। তবে ঈদ-পূজা-বড়দিন এগুলোর সামাজিক বা অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে আমার কাছে। যুক্তির দুই কোপে কৃষ্টি বা উৎসবকে বলি দেওয়া সহজ। আপনার সাথে একমত যে যারা এই যুক্তিগুলো দেন তারা আসলে নিজেদের দূর্বলতাগুলোর দিকে যথেষ্ঠ মনোযোগী নন। তবে এটা আমার নিজস্ব মত। এক্ষেত্রে বলে রাখি, আমি আবেগী মানুষ।
ও আফা,
অনলাইনে থাইকাও ঝিম মাইরা বইসা আছেন ক্যান?!
একটা টু শব্দ নাই! আছেন কেমন? মিস্যু..
তুই তো বড়ই ডিস্টাপ করিস। কি অবস্থা হইলো দেশটার, অ্যাঁ? একটু আরাম করে ঝিমানোও যাবেনা। ভেরি ব্যাড!
উঠো উঠো! ঘুমেত্তে উঠো তো!!
মন্তব্য করুন