ইউজার লগইন

" বিবর্ণ ঈদ "

সামনে কুরবানীর ঈদ। পাড়ায় ,পাড়ায় ব্যাস্ততা । ঘরের বৌ ঝি সকলে মিলে চাউলের গুড়ি ধুপছে ঢেঁকিতে। চাউলের গুঁড়োর রুটির সাথে ঈদের তাজা গরুর মাংস খেতে বেশ দারুন লাগে। দূ'জন কামলা লাকড়ী পাড়ছে উঠানের কোনায়। রুপকের ছোট বোন তার বান্ধবী রুকু'কে নিয়ে আমের চাটনি বানাচ্ছে।আমের চাটনি রুপকের একটা প্রিয় খাবার । গত কয়েক মাস শহর থেকে থেকে , গ্রামে কেমন যেন লাগছে। এর মাঝে রুপকের মা জননী কয়েকবার এসে জেনে গেল কিছু লাগবে কিনা। আগে যখন বাড়ীতে থাকত তখন এত খবর নিত না । আসলে রুপক এখন অনেক বড় হয়ে গেছে । সেই সাথে ভার্সিটিতে লেখা পড়া করে আলাদা একটা ব্যাপার আছে না। গ্রামে বেশ গরম পড়ছে।
বোনের বান্ধবী আমের চাটনি নিয়ে এল রুপকের রুমে । চোখে চোখে কি যেন বলতে চাইল কিন্তু রুপক তা বুঝতে পারল না । কিচুক্ষণ পাশে বসে রইল । রুপক তার লেখা পড়ার খোজ নিল । এমন সময় ওর মা ডেকে উঠায় বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেল। এরপর রুপকের দুষ্ট বোন এসে ঢুকল ।
কি ব্যাপার সাহেব। কেমন কথা হল । অনেক সুযোগ দিয়েছি।
কি আর কথা হবে । তোমার বান্ধবীর তো বোবা হয়ে বসে ছিল।
ব্যাপার কি ভাইয়া দু'জনে দুজনকে চাস , কিন্তু কেউ কাউকে বলিস না।
তুই কি চাস আমি তাকে প্রথমে প্রপোজ করি।
করলে কি দোষ।
তা তুই বুঝবি না । এমনিতেই তুই অনেক পেকে গেছিস।
রুপক'রা ভাই বোন পিঠাপিঠি বয়সের। তাই খুনসুটি সারাদিন লেগেই থাকে । মঝে মাঝে তাদের মা খুব বকা দেয় দুজনকে। কিন্তু এতদিনের চলে আসা অভ্যাস সহজে দূর হয় না । তবে রুপক তার বোন'টিকে অনেক অনেক ভালবাসে । রুপকদের ছোট পরিবার । তাদের পরিবারে কোন অশান্তি নেই । পরিবারের সকলে বেশ সহজ এবং অনেক সরল। রুপক যদি কখনও তার কোন ক্লাসমেট মেয়ে বান্ধবী কে নিয়ে ঘরে আসে , তার মা অন্য মায়েদের মত তাকে কখনও সন্দেহের চোখে দেখেন না । তিনি হাসি মুখে রুপকের গেস্টের সাথে কথা বলেন এবং চা পানির ব্যাবস্থা সামর্থ্য মত করেন । সেই জন্য রুপক তার মাকে নিয়ে গর্বিত।
রুপকের বাবা গ্রামের বাজারে ছোটখাট মুদি দোকানের ব্যাবসা করে ।তিনি খুব সাধারন মানুষ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। গ্রামের সকলে তার বাবাকে অনেক শ্রদ্ধা করে। রুপক তার বন্ধু বান্ধবের সাথে বাবার পরিচয় দিতে কখনও লজ্জিত হয়না অন্য অনেকের মত। তার বাবা খেটে খায় ,তাদেরকে খাওয়ায় এটাই রুপকের গর্ব।তার যে আয় হয় তাতে রুপকদের বেশ চলে যায় সাধারন ভাবে। রুপক আর তার বোন এবং তার ছোট ভাইয়ের তেমন কোন অতিরিক্ত চাহিদা নাই। রুপকের মা তাদেরকে তার নিজের আদর্শে গড়ে তুলেছেন। তিনি অন্যায়ের সাথে কখনও আপোষ করতে জানেন না । রুপকের মায়ের কারনে রুপকদের পরিবারের কেউ মিথ্যা কথা বলে না । রুপকের মা সবসময় বলে
" বাবা তোমার যতটূকু আছে তাই তোমার । অন্যের কাছে যদি বেশি ও থাকে সেটা তার। অন্যের জিনিসের উপর কখনও লোভ করো না "
ঈদের জন্য গরু কেনার দায়িত্ত সবসময় রুপকের বাবার উপর থাকে । রুপকরা চার শরীক মেলে কুরবানী দেয় । ইয়রুপকদের সাথে যারা শরীক হয় তারা ও রুপকদের মতই সাধারন এবং সৎ মানুষ । প্রতি বছর কুরবানের আগে সব শরিক মিলে আলোচনা করা হয় এবার কত টাকা আছে কার কাছে । তারপর সামর্থ্য অনুযায়ী গরু কেনার বাজেট করা হয় । অন্য শরীক'রা রুপকের বাবার কাছে টাকা জমা দেয় । রুপকের বাবা সেই টাকা নিজের কাছে রেখে দেয় এবং নির্দিষ্ট দিনে অন্য সবাই মিলে চার মাইল দুরের হাটে গরু কিনতে যায়। রুপক বড় হবার পর থেকে মাঝে মাঝে গঞ্জে যায় গরু কেনার সময় । কিন্তু রুপকের বাবা রুপককে এসব কাজে তেমন যেতে দেননা । কেন তা রুপক বুঝেনা । কিংবা বুঝার চেস্টা ও করে না । লেখা পড়া আর ভার্সিটি নিয়েই রুপকের দিন চলে যায় । আর হ্যা ইদানীং মাঝে মাঝে তার মনটা উদাস হয়ে যায় । কিন্তু কেন রুপক তা জানেনা।
দেখতে দেখতে ঈদের সময় ঘনিয়ে আসতে লাগল। রুপকের মা মহা ব্যাস্ত। চালের গুড়ো বানানো লাকড়ি কেটে শুকানো এরকম অনেক কাজ। মসলা গুঁড়ো করা । সাথে রুপকের বোন এবং তার বান্ধবী রুকুকে ও দেখা যায়। রুকুর প্রতি রুপক কেমন দুর্বলতা অনুভব করে কিন্তু সে কথা বলার সাহস পায়না।
রুপকের বোন সকাল থেকে ফুলের মালা বানাচ্ছে মনের আনন্দে। কারন আজ গরু কেনা হবে । গরু প্রতি বছর রুপকদের বাড়ীতে এনে রাখা হয় ঈদের আগ পর্যন্ত । রুপকের বাবা এবং অন্য শরীক'রা বেলা বারোটার দিকে গরু কিনতে রওনা দেয় গরুর হাটের উদ্দেশ্য। রুপক যেতে চাইলে তার বাবা নিষেধ করে। তাকে কিছু খড় আর ঘাসের জোগাড় রাখতে বলে তারা হাটে চলে যায়।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নামে কিন্তু রুপকের বাবা এবং অন্য সকলে মিলে গরু নিয়ে এখনো ফিরে আসেনি। তাই রুপকের মা চিন্তিত হয়ে ঘরের দাওয়ায় বসে আছেন। রুপক হারিকেনের মৃদু আলোতে দুর্গেশ নন্দিনী পড়ছে। দেখতে দেখতে রাত অনেক হয়ে গেল কিন্তু রুপকের বাবার ফেরার নাম নেই। তার মা মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগল। রুপক ঘর থেকে বেরিয়ে পাড়ার দোকানের কাছে এসে বাবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু তাদের ফেরার কোন নাম নেই।
রুপকের বাবা এবং তার সাথের অন্য শরীক'রা নির্দিষ্ট হাটে গরু না পেয়ে সেখান থেকে আর ছয় কিমি দুরের হাটে চলে যায়। যেতে যেতে তাদের মোটামুটি সন্ধ্যা হয়ে যায়। তারপর ও তারা চারজন নির্ভয়ে সেই হাটে পৌঁছে । হাটে সুন্দর এবং নাদুস নাদুস একটি গরু তারা পছন্দ করে কেনে নেয়। এরপর বাড়ীর উদ্দেশ্য রওনা দেয়। তাদের অনুরোধে যে লোক গরু বিক্রী করেছে সেও আসে। তাদের এগিয়ে দিতে। দুই গ্রাম পেরিয়ে যখন তারা অন্য গ্রাম দিয়ে যাচ্ছিল সেই সময় "ধর ধর" বলে রব উঠে।তাদের সামনে দিয়ে একজন একটি গরু নিয়ে যাচ্ছে। তাদের দেখে সেই গরু ওয়ালা বলে
ভাই আপনারা কি সামনের গ্রামের উপর দিয়ে যাবেন।
হ্যাঁ ।
তাহলে আমার গরুটা ও সঙ্গে করে নিন। আমি একটু প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিয়ে আসছি।
আচ্ছা ঠিক আছে।
পেছন থেকে সেই সময় চীৎকার শুনা গেল গরু চোর ধর , গরু চোর ধর। চোর যায়, গরু চোর।
কয়েক মিনিটের মধ্যে পাড়ার একদল লোক চোরাই গরু সহ রুপকের বাবা সহ অন্য সকলকে চোর মনে করে ধরে ফেলে । তারা যতই বুঝতে চায় আমরা চোর না । তারা তাদের কথা শুনেই না । একদফা গ্রামের উচ্ছৃঙ্খল ছেলেরা তাদের প্রহার করে হাত বেধে চেয়ারম্যান বাড়ীর দিকে নিয়ে যায়।
রুপকের বাবা এবং অন্য চারজন যতই মিনতি করে বলে আমরা চোর নই। তারা ততই প্রহার করতে থাকে । সহজ সরল রুপকের বাবা জীবনে কখনও এমন মার খায় নি । গনপিটুনির সময় তিনি অজ্ঞান হয়ে যান । অজ্ঞান অবস্থায় তাদেরকে চেয়ারম্যান বাড়ীর দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। চেয়ারম্যান বাড়ীতে যাওয়ার পূর্বেই রুপকের বাবা রহমান মৃত্য বরন করে। সেই গ্রামের চেয়ারম্যান বাকী তিনজনের কথা শুনে বুঝতে পারেন এরা চোর নয় । তারপর ও রুপকদের গ্রামে রাত তিনটায় খবর আসে । রুপক এবং গ্রামের একদল লোক ছুটে চলে সেই দুরের গ্রামে। রুপক কে সে সময় তার বাবার মৃত্যে সংবাদ দেওয়া হয়নি।
পরদিন পুলিশ আসে সেই গ্রামে। কিন্তু কাকে অভিযুক্ত করবে বুঝতে পারে না চেয়ারম্যানের মধ্যস্থততায় ঘটনাকে দুঃখজনক বলে ডায়রী করা হয় আর রুপকের বাবার মৃত্যের জন্য পুরো গ্রামের সবাই ক্ষমা চায়। রুপক দুঃখ ভরাক্রান্ত হৃদয়ে বাবার মৃতদেহ নিয়ে ঈদের আনন্দের পরিবর্তে এক শোকের বার্তা নিয়ে নিজ গ্রামের দিকে চলতে থাকে। তাদের পেছনে কেউ একজন কুরবানীর গরু নিয়ে আসছে। গরুর দুচোখ বেয়ে অন্যরকম অশ্রু ঝরছে, যেমন অশ্রু ঝরছে রুপকের ব্যাথিত বুকে ।

পোস্টটি ৮ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

ঈশান মাহমুদ's picture


বেদনাবিধুর গল্প। এভাবে অনেকেরই ঈদের আনন্দ শেষ পর্যন্ত ম্লান হয়ে যায়, প্রিয় জন ফিরে আসে না বলে।

তৌহিদ উল্লাহ শাকিল's picture


ধন্যবাদ ভাইয়া

মীর's picture


বেদনার গল্প। পড়ে কষ্ট পেলাম।

তৌহিদ উল্লাহ শাকিল's picture


জীবনের একটা অংশ হল কষ্ট । তাই কষ্ট পেলে ধৈর্য ধরা চাই

টুটুল's picture


Sad

তৌহিদ উল্লাহ শাকিল's picture


Smile Smile

প্রিয়'s picture


বেদনাবিধুর গল্প।

তৌহিদ উল্লাহ শাকিল's picture


ঠিক তাই

তানবীরা's picture


Sad(

ঈদ মুবারাক

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

তৌহিদ উল্লাহ শাকিল's picture

নিজের সম্পর্কে

দেশের বাইরে আজ এই শহর থেকে কাল অন্য শহরে যাযাবরের মত ছুটে চলছি বিরামহীন। । জন্ম ১৯৮১ সালের ৭ই ডিসেম্বর কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত লাকসাম থানার কান্দিরপাড় গ্রামে। । বাবা বেঁচে নেই। তাই জীবিকা এবং কর্মসংস্থানে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমাই ২০০৩ সালে । সেই থেকে এখন ছুটে চলছি । । মাঝে মাঝে কিছু লিখি । কি লিখি তা নিজে ও জানি না ।। কেউ বলে ভাল লিখি, কেউ বলে কিছুই হয়না । আসলে কি হয় আমি নিজে ও জানিনা । তাই ছুটছি এখন সাহিত্যের রস আস্বাদনে ।