ইউজার লগইন

বর্ণমালা

‘হাই, গ্র্যান্ড পা । হাউ আর ইউ’( বলে আজাদ সাহেবের একমাত্র নাতী ভেতরে চলে গেল )

আজাদ সাহেব স্থির হয়ে বসে রইলেন আরামদায়ক সোফায়। সময় কত দ্রুত গড়িয়ে যায়। এক সময় তিনি ও যুবক ছিলেন । সেই উম্মাতাল দিনে তিনি ও মুক্তির মিছিলে ছিলেন । যদিও আজ কেউ তাকে চিনে না । কেউ তার খবর রাখে না । নাতির রুম থেকে হিন্দি গানের সুর শুনা যাচ্ছে উচ্চ স্বরে ।“মুন্নি বদনাম…।“

পরিবারের সকলকে তিনি অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছেন । সেই স্বাধীনতার সুযোগে ছেলে , নাতি আজ যা ইচ্ছে তাই করে যাচ্ছে দেশের রাজনীতি বিদদের মত ।একসময় পাকিস্তানের হায়নাদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন তিনি , বাঙ্গালী জাতি কে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছিলেন তিনি এবং সকল যুদ্ধারা । সেই স্বাধীনতার মানে যদি এমন হত তাহলে কি দেশ স্বাধীন হত ? প্রশ্নটা মাঝে মাঝে মনের গভীরে খোঁচা দেয় আজাদ সাহেবের ।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তিনি তখন তরুন । গরম রক্তে শরীর টগবগ করে । ভার্সিটির ক্যাম্পাসে একদিন শুনলেন রাষ্ট্র ভাষা বাংলা থাকবে না । সেই থেকে আন্দোলনে নেমে পড়লেন । ভাষা আন্দোলন। সালাম , বরকত , রফিক , জব্বারের নাম সবাই জানলে ও আজাদ সাহেব এবং সেই মিছিলে থাকা অগনিত ছাত্র জনতার সকলের নাম কি সবাই জানে । সেই নেপথ্য নায়কের তিনি ও একজন । আজ একাশি বছর বয়সে মনে হয় , এগুলো তো সেদিনের ঘটনা । রাতের পর রাত জেগে পোস্টার ব্যানার পেস্টুন লেখা ছিল উত্তাল সেই সময়ের নিত্য দিনের কাজ । অভুক্ত থাকলে ও ক্ষুধার কথা মনে জাগেনি তখন ভাষার জন্য অপরিসীম ভালবাসায় ।

সেই আজাদ সাহেবের আজ কষ্ট লাগে যখন ভাষার বিকৃত উপস্থাপন হয় । যখন বাংলা ভুলে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলে মেয়ে বাবা মাকে আর বাবা কিংবা মা বলে না ডেকে ডেড কিংবা মাম্মি বলে ডাকে । আধা বাংলা আধা হিন্দি এবং ইংলিশ মিলিয়ে বক্তৃতা দেয় যখন কোন রাজনীতিবিদ , তখন আজাদ সাহেবের কষ্ট লাগে । কিন্তু কাকে বলবেন সে কথা । নিজের ছেলেই তার কথা শুনেনা । অন্য কারো শুনতে দায় পড়েছে।

একসময় চাকুরীর খাতিরে আজাদ সাহেবকে জার্মান , ইটালী এবং বেলজিয়াম যেতে হয়েছিল । সেখানে তিনি দেখেছেন সকলে নিজের ভাষাকে কত সন্মান করে । এরা সকলেই কম বেশী ইংরেজি জানে তাই বলে প্রথম সাক্ষাতে ইংরেজি বলে না । নিজেদের ভাষা ব্যাবহার করে । সকল প্রতিষ্ঠানে নিজ ভাষায় লেখা সাইনবোর্ড সেই সাথে ছোট করে ইংরেজিতে লেখা । আর তার নিজের দেশে সব বিদেশি সংস্কৃতি দেখে তার খুব খারাপ লাগে । বেশীর ভাগ হোটেল, দোকান , ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি নামের ছড়াছড়ি । তখন বুকের গভীর থেকে আবারো দীর্ঘ শ্বাস আসে , আজাদ সাহেবের । কোথায় সেই সব বর্ণমালা যার জন্য ঝরেছে অজস্র রক্ত ?

অনেক জোড়াতালি দেওয়া প্যান্ট এবং হাত কাটা শার্ট পড়ে নিজের ছেলেকে বেরুতে দেখে ঘেন্না লাগে আজাদ সাহেবের । তার পর ও বলে “ কিরে দাদু , এগুলো কি পড়েছিস”

“ওহ!গ্র্যান্ড পা । ইউ নো দিস ইজ ফ্যাশান”

“কথায় কথায় ইংরেজি বলবে না , আমি তোমার চেয়ে ও ভালো ইংরেজি জানি , প্রথমে নিজের দেশকে ভালবাস । তারপর অন্য দেশের সংস্কৃতি লালন কর”

নাতি এই কথার কোন উত্তর না দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল গান গাইতে গাইতে ।

অনেক দিন ধরে একটি বর্ণমালার বই খুজছেন আজাদ সাহেব । সেই বর্ণমালা গুলো দেখতে তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে । নাতীর বইয়ের তাকে তন্ন তন্ন করে খুজে ও তিনি বর্ণমালার একটি বই পেলেন না । অ , আ ,ই, এই শব্দগুলো দেখতে কেন জানি ভীষণ ইচ্ছে করছে । বয়সের ভারে ঠিকমত হাটা চলা করতে ও তার কষ্ট হয় । ছেলেকে বেশ কিছুদিন ধরে বলেছেন কিন্তু তার নাকি খেয়াল থাকে না । ছেলের বউকে ও বলেছেন তার ও নাকি সময় নেই । আজ ভাবছেন নিজেই একবার যাবেন কষ্ট করে লাইব্রেরীতে ।

রাস্তায় কিসের যেন মিছিল হচ্ছে , সেদিকে তাকাবার সময় নেই আজাদ সাহেবের । তিনি তখন বর্ণমালার বইয়ের জন্য উদগ্রীব । বহু কষ্টে লাইব্রেরীর সামনে এসে দাঁড়ালেন । সেখান থেকে বর্ণমালার বই নিয়ে রাস্তা চলতে লাগলেন ধীর গতিতে। মাঝে মাঝে উল্টিয়ে দেখছেন , চিরচেনা অ,আ,ই,ঈ ।মনে হচ্ছে তিনি ফিরে যাচ্ছেন বায়ান্নতে । রাস্তায় তখন পুলিশ আর মিছিলকারীদের গোলাগুলি। সেই ভীড় ঠেলে বৃদ্ধ আজাদ সাহেবের পক্ষে বেরিয়ে আসা দুঃসাধ্য ।

রাস্তার একপাশে পড়ে আছে আজাদ সাহেব । সম্ভবত গুলি লেগেছে , মুখ দিয়ে রক্তের একটি ক্ষীণ ধারা বয়ে যাচ্ছে । বর্ণমালার বইটি পাশে পড়ে আছে । বাতাসে একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে , সে দিকে পরম তৃপ্তিতে চেয়ে আছেন আজাদ সাহেব। সেই সময় রাস্তা দিয়ে ছোট একটি ছেলে যাচ্ছে । আজাদ সাহেব ইশারায় তাকে ডাকলেন । ছেলেটির হাতে বর্ণমালার বইটি দিলেন । বইটি পেয়ে ছেলেটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল । সে একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পড়তে লাগল । অ তে অজগর আসছে তেড়ে । আ তে ………।

আজাদ সাহেবের মুখে তখন রক্তে মেশানো একটি তৃপ্তির হাসি। শেষ পর্যন্ত তিনি বর্ণমালা নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে পেরেছেন।

পোস্টটি ৮ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

লীনা দিলরুবা's picture


বেশী সিনেমাটিক হয়ে গিয়েছে।

তৌহিদ উল্লাহ শাকিল's picture


বাস্তব জীবন এখন সিনেমার গল্পকে ও হার মানায় ।

এ টি এম কাদের's picture


শাকিল সাহেব, এক বুড়ো মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা না করে কি লেখা শেষ করা যেতনা ? খুবই কষ্ট হয় যখন দেখি একজন মুক্তিযোদ্ধা ঘরে বাইরে সর্বত্র নিগৃহীত বা অবহেলিত হচ্ছেন ! আর আপনিতো মৃতুই দিয়ে দিলেন ! ভাল ! আর ক'দিনই বা আছে মুক্তিরা ! ২০ / ৩০ বছর পর প্রাকৃতিক নিয়মেই কোন মুক্তিযোদ্ধা আর অবশিষ্ট থাকবেন না ।

তৌহিদ উল্লাহ শাকিল's picture


এ টি এম কাদের ভাই অত্যান্ত বিনয়ের সাথে বলছি , মুক্তিযুদ্ধাদের ছোট করার জন্য আমার এই লেখা নয় । এই লেখা সমাজে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধাদের বর্তমান চিত্র তুলে ধরেছি মাত্র । আশা করি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন ।

শওকত মাসুম's picture


পড়লাম

তৌহিদ উল্লাহ শাকিল's picture


ধন্যবাদ

প্রিয়'s picture


পড়লাম

তানবীরা's picture


টিপ সই

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

তৌহিদ উল্লাহ শাকিল's picture

নিজের সম্পর্কে

দেশের বাইরে আজ এই শহর থেকে কাল অন্য শহরে যাযাবরের মত ছুটে চলছি বিরামহীন। । জন্ম ১৯৮১ সালের ৭ই ডিসেম্বর কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত লাকসাম থানার কান্দিরপাড় গ্রামে। । বাবা বেঁচে নেই। তাই জীবিকা এবং কর্মসংস্থানে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমাই ২০০৩ সালে । সেই থেকে এখন ছুটে চলছি । । মাঝে মাঝে কিছু লিখি । কি লিখি তা নিজে ও জানি না ।। কেউ বলে ভাল লিখি, কেউ বলে কিছুই হয়না । আসলে কি হয় আমি নিজে ও জানিনা । তাই ছুটছি এখন সাহিত্যের রস আস্বাদনে ।