গত পরশু রাতের ঘটনা
মোটর সাইকেল চালানো আমার দীর্ঘদিনে অভ্যাস। সেই ছোট বেলায় বাবা যখন দুপুরে বাসায় খেতে আসতেন, তখন তার হোন্ডা ৫০ সিসি চা-চামুচ দিয়ে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে পড়তাম কলোনী থেকে। সে সাইকেলের কোনো গিয়ার ছিলো না। ক্লাস ছিলো না। স্টার্ট দিয়ে পেছনে গিয়ার দিলেই হতো। তারপর সামনে ২ টা গিয়ার... ব্যস। সেটা চলতে শুরু করতো। বাবা খেয়ে আবার অফিসে যাবার আগেই আবার ফিরে আসতাম। তখন ৭/৮ ক্লাসে পড়ি আমি।
তারপর আরেকটু বড় হয়ে মোটামুটি মোটর সাইকেল চালানোর কলাকৌশল শিখে যাই। কোনো ওস্তাদ ছাড়াই। ড্রাইভিং এ আমিই আমার ওস্তাদ। খুব বেশি চালানোর সুযোগ পেতাম না। বাবারটাই ছিলো সবেধন নিলমনী। বাবা টের পেতেন ঠিকই, কিছু বলতেন না। বরাবরের মত একদিন দুপুরে বাবার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। ঘন্টাখানেক চালিয়ে এসে দেখি, বাবা দাঁড়িয়ে আছেন সিঁড়ির নিচে। আমি আস্তে করে তার কাছে গিয়ে সাইকেল থামাই। এত তাড়াতাড়ি বাবা বেরুবেন, বুঝতে পারিনি। সেদিন অফিসের জরুরি কাজ থাকাতে বাবা খেয়েই বেরিয়ে পড়েছিলেন। যথাস্থানে সাইকেল না পেয়ে বুঝলেন, পুত্রের কীর্তি। কিছু বললেন না, সাইকেল নিয়ে চলে গেলেন অফিসে। আমি হাতে- নাতে ধরা পড়ার আতঙ্ক নিয়ে বাসায় গেলাম। রাতে ফিরে বাবা আমাকে ডাকলেন। বললেন, আর কোনোদিন যদি তার মোটর সাইকেল নিয়ে বের হই, তাহলে আমাকে স্রেফ বাসা থেকে বের করে দেবেন। এই কথায় আমার মধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া হলোনা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। বাবার এরপরের কথাটা আমাকে ব্যাপক নাড়া দিলো। বললেন, 'আমি চাই নিজে একটা মোটর সাইকেলের মালিক হয়ে তারপর সেটা যত খুশি চালাও...'।
অনেক বছর আর আমার মোটর সাইকেল চালানো হয়নি। সুযোগ যে পাইনি, তা নয়। কিন্তু চালাতে গেলেই বাবার সে কথাটা আমার কানে বাজতো। আর চালাতাম না। এভাবে অনেক বছর কেটে গেল। আমি চাকরী শুরু করলাম। স্কয়ার ছেড়ে আরেকটা চাকরীতে মানে অ্যারোমেটিকে জয়েন করলাম। একদিন কোম্পানি থেকে একটা চিঠি পেলাম- আমার কাজের সুবিধার জন্য কোম্পানি থেকে আমার নামে একটা মোটর সাইকেল বরাদ্ধ করা হয়েছে। আমি রাজি থাকলে সেটা ঢাকা থেকে আমার কর্মস্থল কুমিল্লায় পাঠিয়ে দেয়া হবে। সেটা সম্ভবত ৯৫ সাল। অফিসের চিঠিটা নিয়ে বাবার সামনে গেলাম। চিঠিটা তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিলাম। তিনি পড়লেন। বললেন, 'তুমি যথেষ্ঠ বড় হয়েছো, সিদ্ধান্তটা তোমাকেই নিতে হবে...'। পরদিন সম্মতি জানিয়ে হেড অফিসে জানিয়ে দিলাম। তার দুদিন পরে ঝকঝকে একটা হিরো হোন্ডা চলে এলো আমার নামে। সাথে কাগজ-পত্র। একটা হেলমেট। চাবি। সেই আমার অফিসিয়ালি মোটর সাইকেল চালানো শুরু।
তারপর অ্যারোমেটিক ছেড়ে এসিআইতে। সেখানেও যথারীতি মোটর সাইকেল পেলাম। সে মোটর সাইকেল অবশ্য আমার নামে ছিলো। প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা করে বেতন থেকে কাটা হত। মোটর সাইকেলের দাম ছিলো ৭০ হাজার টাকা। প্রতি মাসে মেনটেইনেন্স বাবাদ পেতাম ৫০০ টাকা আর সারা মাসে যে কয় মাইল চালাতাম- প্রতি মাইলে ১ টাকা করে পেতাম, তেলের দাম হিসাবে। যত খুশি চালাও... তেল নিয়ে ভাবনা, আর না আর না...। মাসে ১ হাজার করে ৭০ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়নি কোম্পানিকে আমার। ৫০ মাসের মাথায় এসিআই ছেড়ে দিলাম। আমার জমা হলো- ৫০ হাজার। কোম্পানি আমাকে একটা অপশন দিলো- ২০ হাজার টাকা দিয়ে মোটর সাইকেলটা নিয়ে নিতে। অথবা মোটর সাইকেল জমা দিলে কোম্পানি আমার জমানো ৫০ হাজার ফেরৎ দেবে। আমি মোটর সাইকেল জমা দিয়ে ৫০ হাজার টাকা ফেরৎ নিলাম।
তারপর অনেকদিন মোটর সাইকেল ছাড়াই কাটালাম। একদিন প্রথম আলোর নওরোজ একটা মোটর সাইকেল কিনে আনলো। ৯০ হাজার টাকা দিয়ে। সেটা দেখতে সবাই গেলো। আমিও। কী সুন্দর রঙ...। নওরোজ চোখের সামনে দিয়ে আমার প্রিয় রঙ্গের সে সাইকেলে চড়ে ঘুরে বেড়ায়, আমি চেয়ে চেয়ে দেখি... ৯০ হাজার টাকার যোগাড় আর হয়না। ওরকম একটা সাইকেলও কেনা হয়না আমার। মাঝে-মধ্যে নওরোজের সাইকেলের পেছনে চড়ে এদিক সেদিক যাই। একদিন নওরোজকে বললাম- মোটর সাইকেলটা বেচলে যেনো আমাকে বলে...। এভাবে বছর তিনেক কেটে যায়। ২০০৭ সালের ১৩ এপ্রিল নওরোজ আমার অফিসে আসে। আমি তখন ল্যাবএইডে। এসেই বলে ওর কিছু টাকার দরকার। একটা চেক দিতে বলে। কত টাকা ? বলে ৬০ হাজার। আমি চেক কেটে দেই। নওরোজ সেটা নিয়ে চলে যায়। পরদির ১৪ এপ্রিল মানে পহেলা বৈশাখ নওরোজ ফোন করে ওর বাসায় যেতে বলে। বনানীর বাসায় যাই আমি। ফেরার পথে নওরোজ আমার হাতে মোটর সাইকেলের চাবি আর হেলমেটটা তুলে দেয়...। আমি কিছু বুঝতে পারিনা। ও হাসে। গ্যারেজে গিয়ে মোটর সাইকেল সম্পর্কে একটা দীর্ঘ বক্তৃতা দেয়। কেনার পর থেকে এই মোটর সাইকেলে কী কী পার্টস লাগিয়েছে- সেসব জানায়। অনেক যত্ন করত সে তার মোটর সাইকেলকে। আমিও যেনো যত্ন করি...। আমি বোকার মত তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। আজ থেকে আমি আস্ত একটা মোটর সাইকেলের মালিক ! তাও আমার প্রিয় রঙ্গের...। মোটর সাইকেল নিয়ে বাসায় ফিরি। ছেলে মহাখুশি, ছেলের মা অভিসম্পাত দেয় নওরোজকে। আমি হাসি।
গত পরশু রাতের ঘটনা। বন্ধু মিলনের মা ল্যাবএইডে ভর্তি আছেন। তাঁর একটা মেজর অপারেশন হয়েছে। খালাম্মার স্টমাক ক্যান্সার। এক্কেবারে প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়েছে। মাসখানেকের মধ্যেই অপারেশন করা হলো। আমি প্রতিদিন একবার তাঁকে দেখতে যাই। সো শুক্রবারও গেলাম বিকেল বেলায়। খালাম্মাকে দেখে, মিলনের সাথে আড্ডা মেরে গেলাম ধানমন্ডিতে একটা কাজে। কাজ সারতে সারতে রাত ১০ টা। বাসায় ফিরছি। ল্যাবএইড পেরিয়ে সেন্ট্রাল হাসপাতালের সামনে যেতেই ফুটপাত থেকে মায়ের হাত ছেড়ে একটা ৩/৪ বছরের ছেলে দৌড় দিলো। দৌড়ে আমার সাইকেলের সামনে... আমি ততক্ষণে বেকুব হয়ে গেলাম। সাইকেল খুব বেশি স্পিডে ছিলোনা। ছেলেটা ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়লো রাস্তায়...। আমিও পড়লাম সাইকেল নিয়ে। চারদিক থেকে লোকজন দৌড়ে এলো। আমাকে উঠালো। ছেলেটাকে উঠালো। বিচ্ছিরিভাবে ছেলেটার বাম হাত, বাম পা আর গালের বেশ কিছু অংশ ছিলে গেছে... তার মায়ের সেকি চিৎকার! আমার খুব খারাপ লাগছিলো। যদিও একরত্তি দোষ ছিলো না আমার। আশেপাশের অনেকেই আমাকে চেনে। সবাই বললো, আমাকে চলে যেতে... পারলাম না যেতে। ছেলেটাকে নিয়ে পাশের সেন্ট্রাল হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে গেলাম। ডাক্তার ছেলেটার হাত- পা- গালে ওয়াশ করে দিলেন। ব্যথায় ছেলেটার চিৎকার... সমুদ্দুরের চেহারাটা ভাসছে আমার চোখের সামনে। ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরলাম। ডাক্তারি এইসব ঝামেলা শেষ করতে করতে প্রায় ১১ টা বাজলো। বাইরে বেরিয়ে এলাম। কিছু ওষুধ আর ফল কিনে দিলাম। একটা সিগারেট ধরালাম। ছেলেটার মা এসে আমার হাত জড়িয়ে ধরলো... বাবা, আপনি আমার ছেলেটার জন্য যা করেছেন.... এই টাইপের কথা বলতে লাগলেন। অঝোরে কাঁদছেন মহিলা। আমি কিছু বললাম না। কি বলবো ? শুধু জানতে চাইলাম, আপনার বাসা কোথায় ? বললেন- খুলনা থেকে ঢাকায় এসেছেন ছেলের বাবাকে খুঁজতে। পাননি... ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছেন। এখন খুলনায় ফিরে যাবেন। কিন্তু এর মধ্যে এই অবস্থা ! খুলনা যাবার মত টাকা আছে ? মহিলা কিছু বলছেন নি, নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার কান্না বেড়ে গেলো। কিছু টাকা তার হাতে গুঁজে দিয়ে বললাম, খুলনায় ফিরে যান... আর সাবধানে থাকবেন...। মহিলাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা হলাম...
মটরসাইকেল সাবধানে চালাইয়েন।
সাবধানেইতো চালাই, মাগার অন্যরা সাবধান না হৈলে কী করুম
আপনার জন্য একটু শ্রদ্ধা রেখে গেলাম।
বিনা বাক্যে গ্রহণ করলাম
গাড়ি চালাবার সময় এই ভয়টাই বেশি। হঠাৎ করে কেউ কেউ দৌড় দেয়। তখন কন্ট্রোল রাখা মুশকিল।
প্রত্যেকেরেই একটা করে কাহিনী আছে। ওই মহিলারও একটা কাহিনী আছে মনে হচ্ছে। সেটাও মনে হচ্ছে অনেক বেদনাদায়ক।
মহিলা আর তার ছেলের জন্য মনটা কেমন জানি করছে
আমি যেইদিন ড্রাইভিং শেখার জন্য প্রথম রাস্তায় নামি সেইদিন এক আদমি দৌড় দিছিলো মরতে। কপাল গুনে মরে নাই আর আমিও মার্ডারার হই নাই।
আপনার কপাল ভালো
শেষ প্যারার প্রথম কয়েক লাইন পড়ার পরে আর স্ক্রল করে নিচে নামবো কিনা ভাবছিলাম...যাক কমের মধ্যে গেছে। পরের ঘটনা আপনার জন্য স্বাভাবিক। মোটর সাইকেলে দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা সবসময় বেশি...নিরাপদে থাকুন সবসময়।
~
সবাই নিরাপদে রাস্তায় চলাচল করুক
দাদাভাই সাইকেল সাবধানে চালাইয়েন। আপনার কোন দোষ ছিলো না কিন্তু অনেকে আবার খুব বেপরোয়া চালায়। জানেন তো একবার কি ভয়ংকয় এক এক্সিডেন্ট এর শিকার হয়েছিলাম আমি! জাস্ট প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম। পথেরই একজন আমাকে ল্যাবএইডে নিয়ে গিয়েছিলো, আমার ফোন থেকে আমার বাসায় ফোন করে জানিয়েছিলো। আর গাড়ি চালাচ্ছিলো যে ছেলেটা সে জানোয়ারের মত গাড়ি চালিয়ে আসছিলো। আজও ভুলতে পারি না, জ্ঞান ফেরার পর ড. প্রথম জানতে চাইলো, আমি দেখতে পাচ্ছি কিনা। চোখের কোণাটায় ১.৫ ইঞ্চি গর্ত হয়েছিলো। সেই দাগ এখনো আছে---- কপালে, চোেখর কোণে, নাকে। খুব ভয় পাই যখন সামনে থেকে একটা গাড়ি আসতে দেখি। সবসময় মনে হয় এই বুঝি আমাকে ধাক্কা দিয়ে চলে যাবে।:(
অচেনা সেই মহিলা তার স্বামেকে যেন খুঁজে পায়। ছেলেটা যেন তার বাবাকে ফিরে পায়।
আমিন
আপনে একটু খারাপ হওয়ার চেষ্টা করেন। ভালো মানুষ বেশিদিন বাঁচে না।
খারাপ মানুষরা বুঝি বেশিদিন বাঁচে ? তাইলেতো খারাপ হৈতেই হয় আমি বেশিদিন বাঁচতে চাই
খারাপ মানুষরা বুঝি বেশিদিন বাঁচে ? তাইলেতো খারাপ হৈতেই হয় আমি বেশিদিন বাঁচতে চাই
আজকেই আপনার লেখায় কমেন্টস করলাম।
এক সময় আমিও মটর সাইকেল চালাতাম।
এখন ছেড়ে দিছি।
লেখা সাবলিল হইছে ওস্তাদ!!
মোটর সাইকেল চালানো ছাড়ছেন, ভালো কথা। রাস্তায় হঠাৎ আবার দৌড় দিয়েন্না
ধন্যবাদ আপনেরে
সবই কোপাল
'কোপাল' কৈয়াতো পাঙ্গাশ মাছের পেটির কথা মনে করাইয়া দিলা ক্রাপ্টেন !
খুব ভালো হয়ছে ভাইয়া।
কি , লেখা ?
থ্যাংকু
অচেনা সেই মহিলা তার স্বামীকে যেন খুঁজে পায়। ছেলেটা যেন তার বাবাকে ফিরে পায়।
আপনিও ভাল থাকুন।
লেখা ভাল লেগেছে।
আপনিও ভাল থাকুন।
কিছু বলার নাই আসলে। আপনি ভালো থাকেন।
আপনিও ভাল থাকুন।
একটি রাতের ঘটনায় কত রাতের ঘটনা যে লুকিয়ে থাকে! ঐ মা, ঐ ছেলে আপনার জীবনের অংশ হয়ে গেল। আপনিও হয়ে গেলেন তাদের জীবনের অংশ! কতজন কতকিছু হারিয়ে খুঁজে পায়; ছেলেটি যেন খুঁজে পায় তার বাবাকে। আর ভবিষ্যতে কোনো বিপদে পড়লে যেন খুঁজে পায় আপনার মতো মানুষকে! ভালো থাকবেন!!
ভাই মানুষ এত ভালো হয় ক্যামনে? আমারে একটু ভালো হইতে শিখাবেন?
বাইকে তামাম তরুন সমাজের ব্যাপক আগ্রহ থাকলেও আমার কোনো আগ্রহ নাই। বাইকে চড়তেও ভালো লাগে না বন্ধুরা কেউ কিনতেছে সেইটাতেও উৎসাহ দেই না!
বাইকে না চড়ার চেষ্টায় থাকি সবসময়। দু চাকার উপরে একটা জিনিস চলে সেটার উপরে ভরসা? কখনও না। যদিওবা চড়ি তবে ত্রিরিশ এর উপরে স্পীড গেলেই নেমে পড়ি। বাইক চালায়েছিলাম সেই পিচ্চিকালে, এরপরেও আর না, আমি গাড়ির লোক গাড়িই ভাল, নিরাপদ।
আপনার জন্য একটু শ্রদ্ধা রেখে গেলাম।
ভাই সেলাম
ওয়ালাইকুম
শইলডা বালা
কতদিন লেখেন্না (এবি আর মোর ব্যক্তিগত পাতায়...)
লিখবো লিখবো। সব পাতাতেই লিখবো। আপনি কেমন আছেন? আমার শইল অত্যধিক ভালো। আর মন ততোধিক ভালো। চিন্তা করতেসি এই খুশিতে আজকে মিডনাইট ইন প্যারিস মুভিটা দেখে ফেলবো
আপনার কি এফবিতে অ্যাকাউন্ট নাই ? থাকলে জানাইবেন ? আমার মেইল এ...
মন্তব্য করুন