বিলাতের দিনরাত্রি...১
বিলাত চলে আসার সিদ্ধান্তটা বড়ো আচমকা ছিলো, নিজের সাথে আড়াইটে বছর অন এন্ড অফ যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা খেলছিলাম... তারপরে হঠাৎ করে মনে হলো... বাহ! বেশ ক্লান্ত লাগছে তো। একবার এই কথা মনে হলো তো আর যায় কোথা... দিনরাত মনে হতে লাগলো। তিন বছরের
চাকরি জীবনে যতোদূর সম্বল ছিলো একাট্টা করে চলে এলাম এই দেশে। বাপ-মাকে ম্যানেজ করতে গিয়ে অবশ্য তেরোটা বেজেছিলো। এর মাঝখানে নিশীথ সূর্যের দেশে একটা চাকরী'র অফার পেয়ে গেলাম... কিন্তু নিজের আবেগের লাগাম তখনো নিজের হাতে ছিলোনা, তাই সাহস করে উঠতে পারিনি... যাই হোক বিলাতের দশটা মাসের জীবন নিয়ে লিখার ইচ্ছে ছিলো অনেক, আর তাই এই সিরিজ।
ছবি: গ্রীনিচ সানডে মার্কেট
গেলো বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে বিলাত এসেছি, আমার ফুপাতো ভাই একজন থাকতো লন্ডনেই, মোটামুটি তার ভরসায়ই আসা। তদ্দিনে দু'বার ইউরোপ দেখা হয়ে গেছে, তাই মনে আলাদা কোন উত্তেজনা নাই... তবু বিলাত বলে কথা। তো এসে ঢুকলাম ইস্ট লন্ডনের এক সিলেটি খালাম্মার বাসায়, অনেকটা পেয়িং গেস্টএর মতো ব্যাপার। সেই খালাম্মার কথা আমি তো একটা বর্ণও বুঝিনা, কথা বলা লাগে তার মেয়ের সাথে... তাও ইংরেজীতে। সে এক কঠিন অবস্থা। খালাম্মা আর তার মেয়ের জেনারেশান গ্যাপের হাল দেখে আমার মোটামুটি চোখ চড়কগাছ। এমনিতে নূতন জীবনে অভ্যস্ত হবার চেষ্টা, সাথে পড়াশোনা আর কাজ, আর এর উপরে রাত তিনটে'র সময়ে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে খালাম্মা তার দুঃখের ইতিহাস শোনান। নিজের ভাষার ই একটা অবোধ্য সংস্করণের দশভাগ কোনরকমে উদ্ধার করি মাথা ব্যথা আর বিরক্তি নিয়ে, বহু কষ্টে তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঘন্টা খানেকের মধ্যে আবার ঘুমুতে যাই। পড়াশুনার বারোটা আর কাজের তেরোটা বেজেছে। তারমধ্যে চরম রকম বিষন্নতায় আচ্ছন্ন। ক্লাসের সময়টুকু কেবল আমোদে যায় খানিক, বাসায় ফিরে নিজের জন্য অখাদ্য গোছের কিছু একটা সেদ্ধ দেই (একলা নিজের জন্য রান্না করার মতো বিরক্তিকর আমার কাছে কিছু নাই)। আর মাঝে মাঝে নিজেকে চাংগা করার জন্য আমার সেই আন্দাজি হাঁটবার বিলাসিতা।হেঁটে হেঁটে অদ্ভুত সব রাস্তায় চলে যেতাম, সানডে মার্কেটে ঘুরে পুরান বই কিনতাম... মাকড়সা'র জালির মতো ছড়িয়ে থাকা গলি-ঘুঁপচিতে ঘুরে বেড়ানো একটা নেশার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিলো আমার কাছে।
এক সপ্তাহ বাদে মালপত্র সমেত মৌসুমকে কভেন্ট্রি রেখে আসতে গেলাম, সে আরেক কাহিনী। এক ভারতীয় দূর সম্পর্কের বন্ধুর বাসায় সারারাত ছারপোকার কামড় আর বিটকেল গন্ধের অত্যাচার সহ্য করে সকালে দুজনে পালিয়ে চলে এলাম হেমেল হেম্পস্টেডে... তদ্দিনে আরেক বান্ধবী তাজীনও হাজির ওর হেমেলের খালার বাসায়। খালার বাসায় দুটো দিন আরাম আয়েশ করে নিয়ে, এক বাসা ঠিক করে মৌসুমকে আবার কভেন্ট্রি'তে রেখে এলাম।
ছবি: ছবি: ট্যুরিস্ট
ওই সময় আমার কাছে ক্যামেরা ছিলোনা, তাই ছবিও তেমন নাই... মাঝে তাজীনও চলে এলো লন্ডন এলো একদিন দেখা করতে... সেন্ট্রালে গেলাম... দুইজনে মিলে ট্রাফালগার স্কোয়ারে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি হইলো... খ্যাত বাংগালের মতো কিছু ছবি তুললাম। আরেকদিন ইউনির দুই বন্ধুর সাথে বড়ো ঘড়িটার সামনে থেকে বাকিংহাম প্যালেস পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি হইলো। ট্যুরিস্টি সফর বলতে যা বোঝায়, তার তেমন কিছুই করা হয়নাই, টেকা পয়সা নাই, গরীব মানুষ, তাই ঘরেই থাকছি বেশিরভাগ সময়।
পুরো রুটিনে একমাত্র শান্তি ইউনি ক্যাম্পাস। থেমস এর পাড়ে পুরনো রয়েল ন্যাভাল কলেজ এর জায়গা নিয়ে এখন গ্রিনীচ... কি যে অদ্ভুত সুন্দর এই ক্যাম্পাস আর তার আশেপাশের জায়গা! আশেপাশে মিউজিয়ামেরও অভাব নাই, তাই ঘোরাঘুরি নেহায়েত মন্দ হতোনা। আর খাবারে জায়গাও অনেক ছিলো, আমাদের একটা খাউরা পাট্টি ছিলো: আমি, ফিলিস্তিনি অ্যামেরিকান খাল দারইউশ, আরেক বাংগালী অসীমদা, ভারতীয় আভানি আর প্রশান্ত, আর নাইজেরিয়ান ব্রিটিশ কেন... আমরা প্রায়ই বিভিন্ন আস্তানায় ঢুঁ মারতাম খাবারের খোঁজে... লন্ডনে এসে আর কিছু করি না করি, খাবারের কমতি ছিলোনা ( আমার বিশাল বপু'র উন্নতি দেখেই সবাই টের পাবেন সেইটা)। যাই হোক এ ছিলো আমার প্রথম দুই মাসের কাহিনী... একঘেঁয়ে গঁৎবাঁধা রুটিন... লন্ডন জীবন শুরু হলো তাজীন আর আমার একসাথে একটা বাড়ি খুঁজে তাতে থাকতে শুরু করা দিয়ে... সেই গল্প পরের পর্বে।
ছবি: গ্রীনিচ ক্যাম্পাস
সিলেটি ভাষা শিখছেননি ??
একটু.... বুঝবার পারি...
দুইটা সিরিজ একসাথে? বাহ্, চলুক।
আমাদের মতো পাঠকদেরই লাভ
চলুক.....।
চমৎকার উপভোগ্য একটা সিরিজের শুভ সূচনা হয়ে গেলো। অনেক ধন্যবাদ আনিকা।
এক্সকিউজ মি। নিজের ভাষার একটা অবোধ্য সংস্করন মানে কি?
ভাষা ব্যবহারে একটু বিনয়ী হলে ভাল হয়।
বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনার লেখা পড়ে আপনাকে অহংকারী গোছের মানুষ মনে হচ্ছে।
হিহি! ভাইজান কি সিলটি? ভাই আমি সিলটি কিছু বুঝিনা, তাই তারে অবোধ্য কইছি... ওই খালাম্মাও তো আমার কথা কিছু বুঝতোনা, তার কাছে আমারটাও অবোধ্য... এইটারে অহংকারী লাগে?
মানুষ মাত্রেই অহংকারী... বাইরইয়া যাইতেই পারে এট্টু... মাফ কইরা দিয়েন। তয় ওই দুই মাস যেমনে কাটাইছি... এই লেখায় অহংকারের বদলে ''ছাইড়া দে মা কাইন্দা বাঁচি'' ভাব হওনের কথা...
দারুন একটা সিরিজ চালু করলেন। নরওয়ে নিয়া লেখাটা সেইরকম হয়েছিল। পুরাটা পড়ছিলাম।
আমার এক বন্ধু ছিলো ৬/৭ মাস, তার ঘটনা গুলা মেইলে পাইতাম, টারে কৈতাম ব্লগ লেখতে, কিন্তু সে শেয়ার করতে চাইতো না সবার সাথে, সেই স্টাইলটা পাইলাম, এই সিরিজে--
গুড গুড---
খাইছে... আমি সত্যি আপনের সেই বন্ধু না।
ভাল লাগছে। লন্ডন মিস করি। আমার খুব পছন্দের জায়গা। একবার ছাত্র জীবনে একা একা ১৫ দিন ছিলাম। কি যে মজার সময় ছিলসেটা।
একা?
এইসব জনসম্মুখে জিগাইতে নাই।
ছাত্র জীবনে, ১৫ দিন, একা, লন্ডনে ? তখন কীসব জানি ঘটছিলো ! এট্টু যদি খুইল্যা কৈতেন, দুলাভাই...
মনে হয় ডাক্তার দেখাইতে গেছিল।
মৌসুমের ফটুক কৈ? ভালা আছে নি?
খিতা খবর, কিলাইন আছুন। আমি তুমারে বালা পাই
মন্তব্য করুন