এলোমেলো বাচ্চাবেলা... ২ ( আমার প্রথম পড়া কিছু বই)
''উঠলো বাই, তাই কটক যাই'', '' যার হয়না নয়ে, তার হয়না নব্বইয়ে'', আম্মা ছোটবেলায় অনেক ছোট ছোট এইরকম কথন শুনাইতো। সেই সাথে আমি আসলে চরম গল্প শোনার পাগল ছিলাম। আনারকলির গল্প, হিরণ বাদশার আখ্যান, সয়ফুলমূলক-বদিউজ্জামাল, মহররমের কাহিনী ইত্যাদি হাবিজাবি গল্প শোনাবার জন্য মামাকে পাগল করে দিতাম। নানী শুনাইতো নানা নবীর জীবনী, হাদিসের ঘটনা, কোরানের ঘটনা। বড়ো খালা খুব পালাগানের ভক্ত ছিলেন, এক মাজারের ভক্তও ছিলেন, সেই সুবাদে তার বাড়িতে গ্রাম্য গানের আসর বসতো। কেউ কেউ সুর করে পালা গান গাইতো। রহিম-রূপভান, কাজললতা, ইউসুফ-জোলেখা আরো কতো কি শুনছি। কিছু মনে হয় বুঝতামও না ঠিকমতো, বয়েস তখনো চারের কোঠা পার হয় নাই... এইরকম গল্পের ঘোরে বই পড়ার আকাংখা তৈরী হইসিলো এক সময়ে। আমার গল্প শোনার ঘ্যানর ঘ্যানর থামাইতেই একবার আমার বাপজান রূপকথার দুইটা বই নিয়া আসছিলো, দুইটারই নাম ঠাকুরমার ঝুলি, দেবসাহিত্য কুটির প্রকাশনীর। সেই বই দুইটার একটাতে অনেক রাজারাজড়া আর রাজকন্যাদের দেহবল্লরীওয়ালা রংগিন সব ছবি ছিলো। ;-)। পোলা হইলে মনে হয় সেই কালেই মাথা ঘুরাইতো আর বাপও একটু দেখেশুনে বই আনতো। আরেকটা বই আসলে রূপকথা ছিলোনা, ছোটদের জন্যে লেখা কিছু গল্পের সংকলন ছিলো সেইটা।
প্রথম বইটাতে অনেকগুলো নামকার বিদিশী রূপকথার দিশী অনুবাদ ছিলো, রাপুনজেল এর নাম ছিলো মেঘবতী, সেই গল্পের অন্ধ রাজকুমার কেঁদে কেঁদে গান গাইতো, ''কুঁচবরণ কন্যারে তোর, মেঘবরণ চুল, কোথায় গেলি কন্যারে তুই, আমার মনের ফুল।''। ছিলো সিন্ডারেলার কিসিমের অনুবাদ, তবে লেখক মনে হয় সিন্ডারেলার সাথে আরো কিছু গল্প মিলিয়ে বানিয়েছিলেন তার গল্পটা অথবা এই গল্পটার আসলটাও আমি এখনও পড়ি নাই। সেই গল্পে এক ডাইনী থাকে, যার বাড়ি থেকে জাদুর আগুন আনে মেয়েটা, সেই আগুন নিজের বাড়িতে এনে মাটিতে পুঁতে তার থেকে কার্পাস তুলো হয়, সেই তুলো থেকে হয় অসাধারণ কাপড়, যেই কাপড়ের মাধ্যমে দেশের রাজার সাথে তার বিয়েও হয়। আরেকটা গল্প ছিলো এক চাষার ছেলেকে নিয়ে যার অকর্মণ্য দুই ভাইয়ের বদলে সে কাজকর্ম করে বেড়ায়, শেষে কি করে যেন একটা জাদুর হাঁস পেয়ে সেই হাঁসের সাথে রাজ্যের লোককে আটকে নিয়ে রাজসভায় গিয়ে গোমড়ামুখো রাজকুমারীকে হাসিয়ে তার পণ ভাংগে। এইরকমেরই আরেকটা গল্প থাকে, যেখানে চাষার ছেলে কোন এক ঘোড়ার সেবাযত্ন করে তিনটে ঘোড়ার বাচ্চা পায়। একটা সোনালী, আরেকটা রুপালী আর শেষেরটা দেখতে বদখত কিন্তু মারাত্মক বুদ্ধিমান। এই তিন ঘোড়ার বদৌলতে রাজদরবারে চাকরি পেয়ে সাত সমদ্র তের নদীর পার থেকে রাজার জন্যে এক রাজকুমারীকে ধরে আনে। শেষমেষ বুঝতেই পারেন রাজার বদলে চাষার ছেলের সাথেই বিয়ে হয় রাজকুমারীর। আরেকটা গল্প ছিলো মনে হয় দুই বোনের, যাদের দরোজার সামনে দুইরং এর গোলাপ ফুটে থাকতো। এই বইটা হাতে পাওয়ার পরে মাত্র দুমাসে আমি রিডিং পড়তে শিখে ফেলেছিলাম আর আমার তখন বয়েস চারও হয় নাই।
আরেকটা যে বই ছিলো সেইটার কথা আমার বিন্দুবিসর্গ মনে নাই। কেবল একটা গল্প মনে আছে। যেইখানে একটা বোকাটে পড়তে না চাওয়া ছেলে ভূগোল পড়তে বসে স্বপ্নে কিলিমানজারো পর্বতে চলে যায়, তুষারের মধ্যে মাথায় ছাগরের চামড়ার টুপি পরে বসে থাকে। অনেক অনেক দিন বাদে অসলো থেকে কভেন্ট্রি যাওয়ার সময়ে ট্রেনের জন্য ওয়েট করতে করতে জেসমিন নামের এক আফ্রিকান মহিলার সাথে কথা হয়েছিলো যার বাড়ি কিলিমানজারো'র ঠিক নিচের কোন পাহাড়ী সমতলে। মহিলার এক ছেলে আর এক মেয়ে, ওই মহিলার সাথে কথা বলতে বলতে আমার কেমন আজিব একটা নস্টালজিয়া জন্ম নিসলো।
তৃতীয় বইটা মনে হয় ছিলো ছোটবড়ো কিছু বিদেশী হাসির গল্পের সংকলন। আগের বইগুলা থ্রিতে উঠে হারিয়ে গেসলো, কিন্তু এইটা কেমনে জানি ফাইভ পর্যন্ত টিকে ছিলো। ওইখানে একটা লুজার মার্কা প্রেমিক চরিত্র ছিলো সেরিওজা নামে, যার কানে চিমনি সাফ করার ঝুল লেগে ছিলো। আর শেষে বেশ নাটকীয় দৃশ্য ছিলো। টুল থেকে নায়িকা সেরিওজার কোলে পড়ে গিয়ে গদগদ হয়ে প্রেমের কথা স্বীকার করে। এর বাইরেও আরো অনেক গল্প ছিলো। খুব পছন্দের একটা গল্পের নাম ছিলো, ''ডেইজী ফুলগুলো খাসনে বাপ।'' ওই গল্পে চরম দস্যি কিছু বাচ্চাকাচ্চার মা বাচ্চাদেরকে সবরকমের দুষ্টুমি মানা করে গিয়ে শেষে আবিষ্কার করেছিলেন যে টেবিলের উপরে রাখা ডেইজী ফুলের গোছার ডাঁটা বাদে কিছুই অবশিষ্ট ছিলোনা। তারই স্বগতোক্তি ছিলো শিরোনামটা যে, বলতে ভুলে গিয়েছিলেন, ''ডেইজী ফুলগুলো খাসনে বাপ।''
কয়েকটা মনে পড়ে যাওয়া ছোট সাইজের গল্প আপনাদের জন্য শেয়ার করতেসি। বিশ বছর আগের স্মৃতি কতোদূর কাজ করতেসে জানিনা। এর মধ্যে কিছু গল্প তখন কিছুই বুঝি নাই, কিন্তু আমার মেমরী মাঝেমাঝে বাজেরকমভাবে ভালো, এখন বুঝতে পেরে ভাবি আমার বাপ যদি জানতো সেই বয়েসে আমি সেইসব পড়সি, কোনকালে হার্টফেইল খাইতো কে জানে!
গল্প এক:
এক সেনাসদস্য মরুভূমিতে ট্রেইনিং শেষে ফেরত এসেছে, তো এক সহকর্মী জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন কেটেছে তার সেই সময়, অল্প কথায় তার জবাব, ''যেই বাড়িটাতে ছিলাম সেইটা যদি ওখানে দেওয়া স্যুপের মতো শীতল হতো, স্যুপটা যদি সাথে পাওয়া ভাজা মুরগীর মতো গরম হতো, মুরগীটা যদি বাড়ির গৃহপরিচারিকাটির মতো নরোম হতো আর গৃহপরিচারিকাটি যদি বুড়ো গৃহকর্ত্রীর মতো প্রেম করতে উৎসাহী হতো, তাইলেই জম্পেশ কেটেছে বলা যেতো।''
গল্প দুই:
এক ভুলোমনা অংকের প্রফেসর হোটেল রুমে ভুলে তার ছাতাটা রেখে গেছেন। কিছুদূর যাবার পরে মনে পড়ায় রুমের সামনে এসে দেখেন সেই রুম ইতোমধ্যে এক দম্পতির দখলে। তারা আবার কঠিন প্রেম শুরু করেছেন।
পুরুষ কণ্ঠ: বলোতো এই সুন্দর হাত দুখানা কার?
আহ্লাদী নারী কণ্ঠ: কেন? তোমার?
পুরুষ কণ্ঠ: আর এই নরোম গাল?
আহ্লাদী নারী কণ্ঠ: সেও তোমার?
পুরুষ কণ্ঠ: এই কমলা ঠোঁটগুলো
আহ্লাদী নারী কণ্ঠ: তোমার, তোমার।
এই পর্যন্ত শুনে প্রফেসর সায়েব আর থাকতে না পেরে বললেন দরোজায় মুখ ঠেকিয়ে বললেন, ''এই যে মশাই, শুনুন। এই ঘরের সমস্ত কিছুই আপানার হতে পারে, কিন্তু টেবিলের কোনায় যেই বেগুনী ছাতাটা দেখছেন সেইটা কিন্তু আমার।''
গল্প তিন:
এইটা মনে হয় আব্রাহাম লিংকনের বলা। একবার কোন এক শহরে আবহাওয়া অফিসের চরম দুরবস্থা। তারা বৃষ্টি হবে বললে খটখটে রোদ্দূর থাকে দিনমান। আর রোদের কথা বললে তুষারঝড়। তো এক ছেলে রোজ অফিসে ফোন করে ঠিক খবরটা জানিয়ে দেয়। তাকে যেকে আবহাওয়া অফিসে চাকরী দেবার কথা বল্লে সে জানালো এতে তার কোন ক্রেডিট নাই, সমস্ত ক্রেডিট তার গাধাদের, যার আবহাওয়া পরিবর্তন এলেই কান নাড়িয়ে আগাম জানিয়ে দেয়। এরপরে সেই গাধাদের ডেকে চাকরীতে নেওয়া হলো। এরপরে লিংকনের ভাষ্যমতে, ''কিন্তু সেইটাই ছিলো মস্তো বড়ো ভুল, কারণ এর পর থেকে সরকারী চাকুরীতে কেবল গাধারাই আবেদন করে আর তাদেরই নিয়োগ দেওয়া হয়।''
আপনার কত কি মনে আছে! আমার তো এভাবে মনে নাই।
পাকনা ছিলাম কিনা...
বাচ্চাবেলার কথা শুনতে বড়-ই ভালু পাই!
আপনি তো বেশ দুষ্টু আছেন!!
লেখা ভাল্লাগছে, সিরিজটা দীর্ঘজীবী হোক!
ছি ছি ! আমার মতো ভালো মানুষরে দুষ্টু বলেন
সিরিজটা দীর্ঘজীবী হোক!
আলহামদুলিল্লাহ!
), ঘুরন্তি সিরিজ আর পরিবার সিরিজ পড়তাম চাই। ও হ্যাঁ, তুমি করে বললাম বলে নিশ্চয়ই মাইন্ড করো নাই।
সামুতে তোমার নানা নিয়া একটা গল্প লিখছিলা। পড়তে অন্যরকম লাগছিল। তোমার দুঃখ সিরিজ (
আমার ছেলেবেলা মানে উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর বাঘ-শিয়ালের গল্প!
এই বইটা আমিও পড়ছিলাম। আমারও এইটার নাম মনে নাই। শুধু একটা গল্পে একটা ছেলে হাইতি দ্বীপপুঞ্জে ঘুরে-ফিরে বেড়ায় সেটা মনে আছে। আর কয়েকটা গল্প ছিলো কলকাতার। আমি এখনও বইটাকে খুব খুঁজি।
হ
কি স্মৃতিশক্তিরে বাবা!!
মন্তব্য করুন