প্রসংগ: ইঁদুর ও মানুষ (পর্ব ১)
জন স্টাইনবেকের ''অফ মাইস এন্ড ম্যান'', আমার অসম্ভব প্রিয় কিছু বইয়ের একটা। এক সপ্তা ধরে শয্যাশায়ী থেকে অনেকগুলো পুরানো বই রিভাইজ করছিলাম, তার মধ্যে এই নভেলাটাও পড়েছি, আর পড়ে আবারও মুগ্ধ হয়েছি। মাত্র ১০৬ পাতার এই বইটা থেকে রোজ না হোক, এক দুই দিন পর পর একটা করে পাতা অনুবাদ করবো ভাবছি। আমার অগণিত শেষ না হওয়া প্রজেক্টে আরেকটা যোগ হবে হয়তো। আগেও অন্য একটা ব্লগে বেনামে প্রকাশিত।
-----------------------------------------------------------------------
সোলদাদের কয়েক মাইল দক্ষিণে সালিনাস নদী এসে পাহাড়ের পায়ের তলায় গভীর আর সবুজ হয়ে মিশে গেছে। সেই সংকীর্ণ জলাশয়ে এসে শেষ হবার আগের রাস্তাটুকু প্রখর সূর্যে তেতে থাকা হলদে বালির উপর দিয়ে এঁকেবেঁকে পার হয়ে আসায় নদীর পানি যেন এখানে খানিকটা উষ্ণও। নদীর একপাশে ছোট ছোট সোনারংয়া পাহাড়গুলো মাথা তুলে মিলিয়েছে শক্ত আর পাথুরে গ্যাবিলান পর্বতমালার সাথে। আর উপত্যকার পাশটিতে তীর ঘেরা সারি সারি উইলোগাছে- প্রতি বসন্তে নতুন পাতায় সবুজ হয়ে উঠে তারা আর তাদের নীচু শাখাগুলিতে শীতের তুষার প্লাবনের ক্ষতচিহ্ন রয়ে যায়। সাইকামোর গাছের চিত্রল, সাদা আর বাঁকানো ডালপালাও দেয়ালের মতো ঘিরে থাকে নদীর ধার। গাছের নীচের বালুময় তীরে পাতারা এতো গভীর আর মুচমুচে হয়ে পড়ে আছে যে একটা তক্ষকও তার ভেতর দিয়ে চলতে গেলে গোটা দুনিয়াকে শব্দে চমকে দেবে। সন্ধ্যেবেলায় খরগোশেরা ঘনঝোপ থেকে বেরিয়ে আসে বালির উপরে বসবার জন্য, আর সমস্ত পারজুড়ে ভেজা সমতটের বালিতে বিছিয়ে থাকে র্যাকুনদের রাতজাগা পায়ের ছাপ, খামারের কুকুরগুলোর চওড়া পায়ের চিহ্ন আর যেই হরিণগুলো রাতের আঁধারে পানি খেতে আসে তাদের দু'ভাগ হওয়া খুরের ছাপ।
উইলোর ভেতর দিয়ে সাইকামোরদের পাশ ঘেঁষে একটা পথ আছে, খামার থেকে আসা দুষ্টু ছেলের দল নদীতে গোসল করতে আসার জন্য জংগলকে শক্ত করে পিটিয়ে সরিয়ে বানিয়েছে সেই পথ, আর সন্ধ্যেবেলায় উঁচুরাস্তা থেকে মাতালের দল টলোমলো পায়ে সেই পথ ধরে পানির পাশে জটলা বাঁধানোর জন্য নেমে আসতে গিয়েও আচ্ছাসে পিটিয়ে সরায় আশেপাশের জংগল। একটা দানবীয় সাইকামোর এর সমান্তরাল ডালের সামনে উঁচু হয়ে জমে আছে ছাই এর স্তুপ, আর ডালটার উপরে মানুষেরা বসে বসে প্রায় মসৃণ করে দিয়েছে ইতোমধ্যে।
কোন এক ঊষ্ণ দিনের সন্ধ্যায়, পাতাদের ভেতর দিয়ে ছোটখাটো একটা ঘূর্ণিমতো বয়ে যাচ্ছিলো। গাছেদের ছায়া যেন উঁচু হতে হতে পাহাড়ের চূড়া ছুঁয়ে ফেলছিলো প্রায়। বালুতীরে খরগোশেরা ছোট্ট ধুসর পাথরের মূর্তির মতো ঠায় বসে ছিলো। আর তখনি উঁচুরাস্তার দিক থেকে মুচমুচে সাইকামোর পাতার উপরে পায়ের আওয়াজ শোনা গেলো, খরগোশগুলো একদম নিঃশব্দে আড়ালে চলে গেলো, চিত্রার্পিত ধূসর একটা বক হঠাৎই শূণ্যে উঠে নদীর দিকে ঝাঁপ দিলো। কয়েক মুহূর্তের জন্য জায়গাটা যেন প্রাণহীন হয়ে গেলো, আর এর পরপরই সেই পথে দুজন মানুষ দেখা গেলো যারা সবুজ সেই জলাশয়ের পাশের খোলা জায়গাটায় এসে দাঁড়ালো।
একজন আরেকজনের পিছু পিছু সেই পথ ধরে তারা হেঁটে এলো, আর সেই খোলা জায়গাটায় এসেও একজন আরেকজনের পেছনেই ছিলো। দুজনেরই পরণে ছিলো ডেনিমের পাজামা আর পেতলের বোতামওয়ালা ডেনিমের কোট। দুয়েরই মাথায় ছিলো কালো রংএর আকারবিহীন টুপি আর কাঁধ থেকে ঝুলছিলো আঁটোসাঁটো করে বাঁধা মোড়ানো কম্বল। প্রথম মানুষটি ছোট এবং ক্ষিপ্র, তার গাঢ় মুখাবয়বে দৃশ্যমান একজোড়া অস্থির আর তীক্ষ চোখ আর সেইসাথে পেটানো গড়নের শরীর। তার সমস্ত কিছুই যেন মাপা মাপা, ছোট শক্ত একজোড়া হাত, মেদহীন বাহু, পাতলা টিকোলো নাক। তার পেছনের জন সম্পূর্ণ বিপরীত ধরণের; বিশালদেহী, আকারবিহীন মুখে বড়োবড়ো ফ্যালফ্যালে চোখ, চওড়া ঝুলে পড়া কাঁধ আর সে হাঁটছিলো ধীরে ধীরে পা দুটো টেনে টেনে, যেমন করে ভাল্লুক তার থাবা টেনে চলে। তার হাত দুটো দুপাশে না দুলে বরং যেন ঝুলছিলো।
প্রথমজন খোলা জায়গাটায় এসে দ্রুত থামলো, পেছনের জন তার গায়ের উপরে পড়ে যাচ্ছিলো প্রায়। মাথা থেকে টুপি খুলে ছোটখাটো লোকটি তার তর্জনী দিয়ে সোয়েটব্যান্ডের ঘাম ঝেড়ে ফেললো। পেছনের বিশালদেহী সংগী কম্বলের বোঝা ঝেড়ে ফেলে উবু হয়ে সবুজ জলাশয়ে নেমে পড়লো পানি খেতে। ঘোড়ার মতো চারপাশে পানি ছিটিয়ে বড়ো বড়ো চুমুকে পানি খাচ্ছিলো সে। ছোট মানুষটি খানিকটা ভয় আর অস্বস্তি নিয়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ''লেনি!'' চিৎকার করে উঠলো সে, ''লেনি! খোদার ওয়াস্তে এতো বেশি গিলিস নে!'' লেনি পুলে নাক ডুবিয়ে পানি খেয়েই যাচ্ছিলো। তাই সে নিচু হয়ে লেনির কাঁধে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বললো, ''লেনি, থাম! তুই আজ আবারও কাল রাতের মতো অসুস্থ হয়ে যাবি।''
লেনি তার টুপিসমেত মাথাটা পানির নিচে একবার ডুবিয়ে উঠে পড়লো আর তীরে বসে পড়লো। তার টুপিটা খুলে গিয়ে কাত হয়ে গিয়ে পিঠের পেছনে নীল কোটের উপর ঝুলে রইলো। ''আহ! কি আরাম!'' সে বলে উঠলো, '' জর্জ, তুইও একটু পানি খেয়ে নে, ভালো করে।'' বলেই বেশ একটা খুশির হাসি দিলো।
জর্জও তার বোঝাটা একটু আলগা করে নিয়ে আস্তে করে তীরের উপর রেখে দিলো আর বললো, '' আমার মনে হয়না এই পানিটা তেমন ভালো, দেখতে বেশি সুবিধের ঠেকছে না।''
লেনি তার বিশাল থাবা ডুবিয়ে দিলো পানিতে আর আংগুল ঘুরিয়ে পানি ছিটোলো, পানিতে বৃত্তাকার বড়ো বড়ো ঢেউ উঠে ওপারে ধাক্কা খেয়ে আবার ফিরে এলো। ঢেউগুলোকে যেতে দেখে লেনি খুশি হয়ে বলে উঠলো, ''দ্যাখ জর্জ! দ্যাখ আমি কি করেছি!''
লেনির কথার কোন জবাব না দিয়ে জর্জ হাঁটু মুড়ে পুলের পাশে বসে দ্রুত কয়েক চুমুক পানি খেয়ে নিয়ে বললো, ''নাহ! খেতে ঠিকঠাকই আছে, যদিও দেখে মনে হয় নদীটা এখানটায় বদ্ধ হয়ে আছে। লেনি, কখনো বদ্ধ জায়গার পানি খাবিনা, বুঝলি?'' এর পরেই একটু হতাশ হয়ে বললো, '' অবশ্য তুইতো নর্দমার পানিও খেয়ে ফেলবি পিপাসা পেলে।''। মুখে এক আঁজলা পানি ছিটিয়ে হাত দিয়ে মুখ, ঘাড়ের পেছনটা একটু ঘষে পরিষ্কার করে নিলো জর্জ। টুপিটা ঠিকঠাক করে নিয়ে নদী থেকে উঠে পড়লো। তীরে উঠে নিজের হাঁটুদুটিকে জড়িয়ে ধরে বসে পড়লো। লেনি এতোক্ষণ ধরে জর্জের দিকে তাকিয়ে ছিলো, সেও জর্জের দেখাদেখি নিজের হাঁটু টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো আর ঘাড় ঘুরিয়ে জর্জের দিকে তাকিয়ে মিলিয়ে নিলো ঠিকঠাক করতে পেরেছে কিনা। জর্জের টুপিটা তার চোখের উপরে আরো একটু নামানো দেখে লেনিও টেনে সেইরকম করে নিলো।
জর্জ তিরিক্ষি মেজাজে রক্তবর্ণ চোখে পানির দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপরে আপনমনেই তেতে উঠা গলায় বলে উঠলো, ''হারামজাদা বাস ড্রাইভারটার যদি কোন আক্কেল থাকতো তাইলে আমরা এতোক্ষণে খামারে পৌঁছায় যাইতে পারতাম। হাইওয়ের থেকে খালি একটু দূরে! হাহ! একটু দূরে? শালার পাক্কা চারটা মাইল! আর সেইটা নাকি একটু দূরে? হারামজাদা, খামারের কাছে থামতে চায় নাই মোটেই। অলসের হাঁড়ি একটা! মনে হয় ব্যাটা সোলদাদেই থামতেই চায় নাই। একটু ঘুরতে হবে বলে আমাদেরকে চার মাইল বাকি থাকতেই লাত্থি মেরে বাস থেকে বের করে দিয়ে বললো এইতো একটু দূরে। চার মাইলের বেশিই হবে মনে হয় যতোদূর হাঁটছি আমরা। বাপরে! কি গরমটাই পড়ছিলো আজকে!''
লেনি একটু ভয়ে ভয়ে জর্জের দিকে তাকিয়ে বললো, ''জর্জ?''
''বল, কি চাস?''
''জর্জ, আমরা কই যাচ্ছি?''
জর্জ অধৈর্য্য হাতে নিজের টুপির কোণাটা ঝেড়ে লেনির দিকে ফিরে খেঁকিয়ে উঠলো, ''অ! তুই এর মধ্যে ভুলেও গেছিস, তাই না? আমার আবার তোকে বলতে হবে, নাকি? হায় খোদা! তুই সত্যি একটা হাড়ে হারামজাদা।''
লেনি একটু নরম অপরাধী স্বরে বললো, '' ভুলে গেছি, কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি চেষ্টা করছিলাম না ভুলতে। খোদার কসম, আমি চেষ্টা করছিলাম জর্জ।''
''ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি আবার বলবো তোকে। আমার তো আর কিছু করারও নাই। সারা জীবন ধরে আমি তোকে কথাবার্তা বলতেই থাকবো, আর তুই ভুলতেই থাকবি। এরপরে আমি আবারও মনে করাইতেই থাকবো।''
''কতো চেষ্টা করেছি'' লেনি বললো, '' কিন্তু কোন লাভ হয় নাই, তবে আমার খরগোশগুলার কথা মনে আছে, জর্জ।''
''চুলায় যাক তোর খরগোশ। তোর তো সারাজীবন খালি খরগোশের কথাই মনে থাকে। যাই হোক, এবার মন দিয়ে শোন। আর নাইলে মনে রাখিস আমরা কিন্তু বিরাট ঝামেলায় পড়বো। তোর মনে আছে হাওয়ার্ড স্ট্রিটের নালাটার পাশে বসে আমরা ব্ল্যাকবোর্ডটা দেখছিলাম?''
লেনির মুখ হঠাৎ করেই খুশিতে ভরে উঠে, বলে, '' কেন থাকবেনা জর্জ? আমার সেইটা মনে আছে... কিন্তু... তারপরে আমরা কি করছিলাম জানি? মনে হয় একটা মেয়ে আসছিলো আর তুই বলছিলি... তুই বলছিলি...''
''আরে চুলায় যাক আমি কি বলছিলাম। তোর মনে আছে আমরা যে মুরে এ্যান্ড রেডি'স এ গেলাম আর ওরা আমাদেরকে কাজ করার কার্ড আর বাসের টিকিট দিলো?''
''ওহ, হ্যাঁ, জর্জ। আমার এখন মনে পড়ছে।'' লেনি দ্রুত কোটের সাইড পকেটে হাত ঢুকিয়ে আস্তে করে বললো, ''জর্জ... আমার কাছে তো কিছু নাই। আমি মনে হয় হারাইয়া ফেলছি।'' বলেই হতাশ হয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো।
''আরে তোর কাছে তো কখনো ছিলোই না, হারামী। দুইটাই আমার কাছে। তোর কি মনে হয় আমি এতোই বেকুব যে তোকে তোর কার্ড রাখতে দিবো?''
লেনি স্বস্তিতে হেসে ফেললো, ''আমি... আমি ভাবছিলাম আমি আমার সাইড পকেটে রাখছি কার্ডটা।'' আবারো পকেটে ঢুকলো ওর হাত দুটো।
তীক্ষ চোখে লেনির দিকে তাকিয়ে জর্জ বললো, ''তুই তোর পকেট থেকে কি বের করলি?''
''আ.. আমার পকেটে কিচ্ছু নাই।'' খুবই চালাকের মতো বললো লেনি।
''আমি জানি, পকেটে নাই। যা বের করছিস সেইটা তুই হাতে রাখছিস। কি রাখছিস হাতে? দেখি... কি লুকাইতেছিস?''
''সত্যি জর্জ, কিচ্ছু রাখি নাই।''
'' আয় এদিকে, দেখা বলছি।''
লেনি ওর বন্ধ হাতের মুঠোটা জর্জের কাছ থেকে অনেক দূরে রেখে বললো, ''এইটা খালি একটা ইঁদুর।''
''ইঁদুর? জ্যান্ত ইঁদুর?''
''আহ-হা! না, খালি একটা মরা ইঁদুর, জর্জ। বিশ্বাস কর আমি এটাকে মারি নাই। আমি এইটাকে খুঁজে পাইছিলাম, মরাই খুঁজে পাইছিলাম।''
''দে এদিকে'' আদেশ করলো জর্জ।
''ছাড় না জর্জ, এইটা আমারে রাখতে দে।''
''দে বলছি!'' এবার চেঁচালো জর্জ।
লেনির বন্ধ করা হাতের মুঠোটা আস্তে আস্তে জর্জের কথা মেনে নিলো। জর্জ ইঁদুরটা নিয়ে পানির অন্যপাশে জংলী ঝোপের মধ্যে ঢিল ছুঁড়ে ফেলে দিলো। তারপরে বললো, ''তুই একটা মরা ইঁদুর নিয়ে কি করতে চাস?''
''আমরা যখন হাঁটবো, আমি এইটাকে আমার আংগুল দিয়ে আদর করতাম।'' জবাব দিলো লেনি।
''শোন, তুই যখন আমার সাথে হাঁটবি তখন কোন ইঁদুরকে আদর করা লাগবে না। তোর মনে আছে আমরা এখন কই যাচ্ছি?
লেনি বিভ্রান্ত চেহারা নিয়ে জর্জের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে প্রচন্ড লজ্জায় হাঁটুতে মুখ ঢেকে বললো, ''আমি আবার ভুলে গেছি।''
''হা খোদা!'' জর্জ হাল ছেড়ে দিয়ে বললো, ''শোন, আমরা উত্তরের একটা খামারে যেরকম কাজ করতাম, সেরকমই একটা খামারে আবারো কাজ করতে যাচ্ছি।''
''উত্তরে?'' প্রশ্নবোধক দৃষ্টি লেনির।
''হ্যাঁ, উইড এ।''
''ওহ হ্যাঁ, মনে পড়েছে, উইড এ।''
''আমরা এখন যেই খামারটাতে যাবো সেইটা কোয়ার্টার মাইল দূরে। আমরা সেইখানে গিয়ে মালিকের সাথে দেখা করবো। এখন মনে রাখ, আমি মালিককে আমাদের কার্ডগুলা দিবো... কিন্তু সাবধান! তুই একটা শব্দও উচ্চারণ করবিনা। তুই খালি দাঁড়িয়ে থাকবি চুপ করে। যদি ও একবার টের পেয়ে যায় তুই কেমন হারামী, আমাদেরকে ও কাজটা দিবেনা। কিন্তু তুই কথা বলার আগেই যদি ও কাজ দিতে রাজী হয়ে যায় তাইলে আমরা কাজটা পেয়ে যাবো, বুঝলি?''
''হ্যাঁ, হ্যাঁ, এইবার বুঝছি।''
''ঠিক আছে, তাইলে বল মালিকের সাথে দেখা করতে গেলে তুই কি করবি?''
''আমি... আমি...'' লেনি ভাবতে লাগলো। চিন্তা করতে করতে ওর মুখ শক্ত হয়ে এলো, '' আ... আমি কিচ্ছু বলবোনা, আর ওইখানে গিয়ে খালি দাঁড়ায়ে থাকবো।''
''এইতো লক্ষী ছেলে, তুই এখন দুই তিনবার এই কথাটা নিজে নিজে বল, যাতে ভুলে না যাস পরে।''
লেনি নরোম স্বরে নিজের সাথে বলতে লাগলো, ''আমি কিচ্ছু বলবোনা... আমি কিচ্ছু বলবোনা... আমি কিচ্ছু বলবোনা।''
''ঠিক আছে, আর তুই উইড এ যা করেছিলি, সেইরকম খারাপ কিছুও এইবার করবিনা বুঝলি?''
লেনিকে ভীষণ দ্বিধাগ্রস্ত দেখলো, '' উইড এ যা করেছিলাম?''
''ওহ! তুই সেটাও ভুলে গেছিস? যাক, ভালোই হলো, আমিও তোকে আর মনে করিয়ে দিবোনা, নাইলে দেখা যাবে আবারও সেইরকমই কিছু একটা করে বসেছিস''
হঠা্ৎ বুঝতে পারার খুশিতে উজ্জ্বল চেহারা নিয়ে লেনি উচ্ছ্বসিত হলো, ''ওরা আমাদেরকে উইড থেকে তাড়াইয়া দিছিলো, নারে জর্জ?''
''তাড়াইয়া দিছিলো? হাহ! আমরা পালাইছিলাম, ওরা আমাদেরকে কি গরু খোঁজাটাই না খুঁজতেছিলো, ভাগ্যিস ধরতে পারে নাই।''
''হি হি হি! আমার ওইটা মনে আছে পুরাই।''
মাথার নিচে হাত দিয়ে জর্জ বালির উপরে শুয়ে পড়লো, লেনিও তার দেখাদেখি অমনি শুলো, মাঝে একবার মাথা উঠিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলো ঠিকঠাক হলো কিনা।
তিক্ত গলায় জর্জ বলে উঠলো, ''তুই যে কতো বড়ো যন্ত্রণা! আমার লেজে লেজে তুই না থাকলে কতো যে আরামে থাকতাম আমি। এমনকি একটা বউও জুটায়ে ফেলতাম হয়তো।''
লেনি কয়েক মুহুর্ত চুপ থেকে বললো, ''জর্জ, আমরা এখন একটা খামারে কাজ করতে যাবো, তাইনা রে?''
''হ্যাঁ, তোর দেখি এখনো মনে আছে। তবে একটা ব্যাপার আছে, তাই আমরা এখন এইখানেই ঘুমাবো।''
বাকি দিনটা খুব দ্রুত কেটে গেলো এরপরে। কেবল উপত্যকা থেকে গ্যাবিলান পাহাড়ের চূড়ায় সুর্যের আলোটা সরে গিয়ে তখনো জ্বলছিলো। দূরবীক্ষণের মতো নিজের মাথাটা একটু উঁচু করে রেখে একটা জলজ সাপ পাশ কেটে চলে গেলো জলাশয়ের ভেতর দিয়ে, পানিতে তাই একটা মৃদু আলোড়ন তৈরী হয়ে পাড়ের শ্যাওলাগুলোকে একটু নাড়িয়ে দিয়ে গেলো। দূরে হাইওয়ের কাছে একজন লোক চেঁচিয়ে কাউকে কিছু বললো, জবাবে সেই লোকটাও চেঁচালো। ছোট্ট একটা বাতাস এসে সাইকামোর এর শাখায় খানিক দোল দিয়ে গেলো।
''জর্জ, চলনা আমরা খামারে গিয়ে রাতে কিছু খাই, আমি জানি খামারে রাতের খাবার থাকে।''
জর্জ পাশ ফিরে শুয়ে ঝাড়ি দিলো, ''তাতে তোর কি? আমার এখানেই ভালো লাগছে। আমরা কালকে কাজে যাবো। আসার পথে মাড়াইয়ের কলগুলো দেখে এলাম। আমাদেরকে তো তাইলে ফসলের বস্তা বাঁধা-ছাঁদা আর অনেক পরিশ্রমের কাজ করা লাগবে। আজকে রাতে আমি ওসবের মধ্যে যাইতেসিনা, আমি এখানেই থাকবো রাতটা। আমার এখানেই ভালো লাগছে।''
লেনি হাঁটুতে ভর করে উঠে পড়লো, জর্জের দিকে মাথা নিচু করে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ''আমরা কি তাইলে রাতে কিছুই খাবোনা?''
''তা তো খাবোই। তুই কিছু উইলোর পড়ে থাকা ডালপালা জোগাড় করে নিয়ে আয়। আমার ঝোলার ভেতরে তিন ক্যান বিন আছে। আমি তোকে একটা দেশলাইও দিবো, তুই আগুনটা জ্বালিয়ে ফেলিস, ক্যানগুলা গরম করে বিন দিয়েই আজকে রাতের খাবার সেরে নিবো।''
'' বিনের সাথে কেচাপ খেতে আমার খুব মজা লাগে।''
''আমাদের কাছে কেচাপ নাই... যা তো! তুই আর দেরী না করে জংগলে ঢুকে ডালপালা নিয়ে আয় শিগগির, একটু পরেই চারদিক অন্ধকার হয়ে যাবে।''
লেনি হাঁচোড়পাঁচোড় করে উঠে দাঁড়ালো আর কিছুক্ষণের মধ্যে ঝোপের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেলো। জর্জ শুয়ে থেকে শিষ বাজাতে লাগলো। লেনি যেদিকে গিয়েছে সেদিকে পানিতে হঠাৎ ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ হচ্ছে শুনতে পেয়ে জর্জ উঠে বসে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো এরপরে গাঢ় স্বরে নিজের মনে মনেই একবার ফিসফিস করলো, ''হায়রে বেকুব!'', এরপরে আবারো শিষ বাজাতে শুরু করলো।
কিছুক্ষণের মধ্যই ঝোপজংগল ভেংগে লেনির আবির্ভাব, ওর হাতে একটা ছোট উইলোর ডাল। জর্জ উঠে বসে ক্ষিপ্ত গলায় নির্দেশ দিলো ''এদিকে আয় লেনি, ইঁদুরটা দে আমাকে।''
লেনি খুবই সরল মুখ করে বলে উঠলো, ''কোন ইঁদুর জর্জ? আমার কাছে তো কোন ইঁদুর নাই।''
জর্জ তার হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ''আয় বলছি এদিকে, দে ইঁদুরটা... এতো সহজে আমার কাছে কিছু লুকাতে পারবি ভেবেছিস?''
লেনি ইতঃস্তত করলো একটু, খানিকটা পিছু হটে গিয়ে উদভ্রান্তের মতো জংগলের দিকে কিছুক্ষণ এমনভাবে তাকিয়ে রইলো যেন দৌড়ে পালানোর রাস্তা খুঁজছে। ঠাণ্ডা
গলায় জর্জ বললো, ''তুই ইঁদুরটা দিবি কিনা বল? নাকি কষে লাগাবো একটা?''
''কি দিবো তোকে জর্জ?''
''হারামজাদা! তুই ভালো করেই জানিস আমি কি চাইতেসি, আবারো বলতেসি, দে ইঁদুরটা।''
ভীষণ অনিচ্ছা নিয়ে লেনি পকেটে হাতটা ঢুকালো, একটু ধরে আসা গলায় ফুঁপিয়ে উঠলো, '' আমি এইটা কেন রাখতে পারবো না? এইটা তো অন্য কারো ইঁদুর না। আমি চুরিও করি নাই, খালি রাস্তার পাশে কুড়াইয়া পাইছিলাম।''
জর্জের হাতটা আগেরমতোই দৃঢ়ভাবে লেনির দিকে বাড়ানোই ছিলো। একটা বেয়াড়া অনিচ্ছুক টেরিয়ার যেমন দিতে না চেয়েও অভ্যাসবশে মালিকের দিকে কুড়ানো বলটা নিয়ে এগিয়ে যায়, তেমনি করে ধীরে ধীরে লেনি একবার এগিয়ে এলো, একটু থেমে পেছোলো তারপরে শেষমেষ জর্জের দিকেই গেলো। লেনির হাতে জর্জ জোরে একটা থাবা বসানোর পরে শেষমেষ লেনি ভয়ে ভয়ে ইঁদুরটাকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিয়ে কৈফিয়তের স্বরে বললো, ''আমি তো এটার সাথে খারাপ কিছু করি নাই জর্জ, খালি একটু আদর করসিলাম।''
জর্জ উঠে দাঁড়ালো, এরপরে অন্ধকার জংগলের দিকে যতো দূরে পারা যায় ইঁদুরটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পানিতে নেমে হাতটা ভালোভাবে ধুয়ে নিলো। লেনির দিকে ফিরে ওকে বকলো, ''বেকুব কোথাকার! তোর কি মনে হয় নদী পার হয়ে ওইটা আনতে গিয়ে যে তোর পা ভিজেছে সেইটা আমি দেখতে পাবোনা?'' লেনির ফুঁপিয়ে উঠা কান্না শুনতে পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে গলার স্বর উঠলো আবার ওর, ''এই দ্যাখো, এখন বাচ্চাদের মতো কাঁদে! খোদা! এতো বড়ো ধাড়ি ছেলে নাকি একটা ইঁদুরের জন্য কাঁদে!'' লেনির ঠোঁট কাঁপছিলো আর চোখ থেকে পানি গড়াতে শুরু করেছিলো। লেনির কাঁধে একটা হাত রেখে জর্জ বললো, ''এই লেনি, আমি তোর সাথে রাগারাগি করার জন্য ইঁদুরটা নিয়ে যাই নাই। ইঁদুরটা মরে গন্ধ বেরোচ্ছে, আর তুই ওটাকে আদর করতে গিয়ে ঘাড়টাও ভেংগে ফেলেছিস। তুই পরে একটা জ্যান্ত ইঁদুর কিছুদিনের জন্য পুষিস।''
লেনি মাটিতে বসে পড়ে মাথাটা হতাশায় ঝুলিয়ে বললো, ''আমি কই থেকে আর ইঁদুর পাবো? আমার মনে আছে একজন ভদ্রমহিলা আমাকে ইঁদুর দিতেন, যখনি পেতেন। কিন্তু উনি আর দেন না এখন।''
জর্জ ভ্রূ কুঁচকে বললো, ''ভদ্রমহিলা? হাহ! উনি যে তোর নিজের আপন খালা, ক্লারা খালা। আর তোকে ইঁদুর দেয়া বন্ধ করবে না তো কি? তোকে যতোগুলা দিসিলো সবগুলাকে তো মেরে ফেলছিস।''
দু্ঃখী মুখে লেনি জর্জের দিকে তাকিয়ে বললো, '' ওরা কতো ছোট্ট ছিলো।'' যেন খানিকটা ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে, ''আমি খালি ওদেরকে একটু আদর করতে চাইতাম, আর ওরা একটু পরেই আংগুলে কামড় দিতো, আমি তখন রেগে গিয়ে ওদেরকে একটু মাথায় ঠুকলেই ওরা মরে যেতো - বেশি ছোট ছিলো বলেই না। ইশ জর্জ! আমরা যদি খরগোশগুলো পুষতে শুরু করতে পারতাম তাড়াতাড়ি! ওরা তো বেশি ছোট না, না রে?''
''চুলায় যাক খরগোশ! তোর কাছে জ্যান্ত ইঁদুর দিয়ে কখনোই বিশ্বাস নাই। মনে নাই ক্লারা খালা তোকে শেষে রাবারের ইঁদুর দিয়েছিলো? কিন্তু তুই তো সেইটা রাখতিই না সাথে।''
''রাবারের ইঁদুর পুষতে যে ভালো লাগেনা।''
পাহাড়ের চূড়া থেকে সূর্যের শেষ চিহ্নটুকুও মুছে গেলো, ধীরে ধীরে উপত্যকায় রাত নেমে এলো, উইলো আর সাইকামোরের বনে ঘনিয়ে এলো আলো মাখা আঁধার। একটা বড়ো রুইমাছ নদীর উপরে ভেসে উঠে একমুখ বাতাস টেনে নিয়ে আবার সেই রহস্যময় অন্ধকার পানির জগতে হারিয়ে গেলো। পানিতে বিশাল বৃত্তাকার ঢেউগুলো শুধু টিকে রইলো কিছুক্ষণ। মাথার উপরে পাতারা খসখস করছিলো বাতাসে, মাঝে মাঝে উইলোর তুলো উড়ে গিয়ে পড়ছিলো জলের উপর।
''যা তো, ওই ডালপালাগুলো নিয়ে আয়। ওইযে, ওই সাইকামোরটার পেছনে অনেকগুলা বানে ভাসা টুকরা আছে, এক্ষুণি নিয়ে আয়।'' আদেশ করলো জর্জ।
লেনি গাছটার পেছনে গিয়ে একগাদা ডালপালা আর পাতা নিয়ে এলো হাতে করে। পুরনো ছাই এর স্তুপটার উপরে সেগুলোকে গাদা করে রেখে আরো আনতে আবারো আড়ালে চলে গেলো। ততোক্ষণে রাত প্রায় হয়ে এসেছে। একটা ঘুঘু পাখা মেলে উড়ে গেলো পানির উপর দিয়ে। ডালপালার স্তুপের কাছে গিয়ে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালালো জর্জ, চিড়বিড়িয়ে আগুন জ্বলে উঠলো। ঝোলা থেকে বিনের ক্যানগুলো বের করে জর্জ আগুনের কাছেই রাখলো গরম করার জন্য। এরপরে লেনিকে ডেকে বললো, ''দেখছিস, কতো বিন! চারজন লোকে খেতে পারবে চাইলে''
আগুনের ওপাশ থেকে জর্জের দিকে তাকিয়ে লেনি বিড়বিড় করে উঠলো, ''আমার কেচাপের সাথে বিন খেতে বেশ লাগে।''
''তোকে না বললাম আমাদের কোন কেচাপ নাই! যা আমাদের নাই, তুই খালি সেইটাই চাস কেন? খোদা রে! আমি একলা থাকলে কতো যে আরামে থাকতাম! কোন ঝামেলা ছাড়াই কোন না কোন কাজ পেয়ে যেতাম। মাসের শেষে পঞ্চাশটা ডলার নিয়ে শহরে গিয়ে যা খুশি করতে পারতাম। চাইলে একটা মাগীর ঘরে সারাটা রাত থাকতে পারতাম, যেখানে ইচ্ছা খেতে পারতাম, এমনকি কোন হোটেলেও যেতে পারতাম। মনে যা চায় সবই করতে পারতাম প্রতি মাসে। এক গ্যালন হুইস্কি গিলে বেহুঁশ হয়ে যাইতাম, নাইলে একটা পুল রুমে গিয়ে আরামে তাস বা পুল খেলতাম!'' হাঁটুতে মাথা গুঁজে জর্জের ক্ষেপে যাওয়া মুখের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালো লেনি।
জর্জ ক্ষিপ্ত স্বরে বলতেই লাগলো, '' তা না! কি পাইছি আমি? পাইছি তোরে! নিজে তো একটা চাকরিও রাখতে পারিস না... আমি যে কয়টা পাইছি আজ পর্যন্ত, সবগুলা গেছে তোর জন্য। পুরা দেশটা চষে বেড়ানো লাগতেছে শুধু তোর জন্য। তাও যদি একটু শান্তি দিতি! একটার পর একটা ঝামেলা পাকাইতেই থাকিস! আর আমার জীবনটা অতিষ্ঠ হয় সেইগুলা ঠিক করে তোরে ঝামেলা থেকে বের করতে করতে।'' বলতে বলতে আরো ক্ষেপে গিয়ে একসময়ে প্রায় চিৎকার করে উঠলো, ''হারামজাদা পাগল কোথাকার! সারাটাক্ষণ আমারে দৌড়ের উপরে রাখছিস!'' ছোট মেয়েরা যেমন আরেকজনকে ভেংগিয়ে কথা বলে, তেমনি করে লেনির নকল করলে জর্জ, ''আমি তো শুধু মেয়েটার জামাটা ধরতে কেমন লাগে সেইটা দেখতে চাইছিলাম- একটা ইঁদুরকে যেমনে আদর করি তেমনে একটু আদর করতে চাইছিলাম! তো, ওই মেয়েটা কেমনে জানবে, হ্যাঁ? কেমনে জানবে যে তুই ওর জামাটা একটু ধরে দেখতে চাইছিলি শুধু? ও ভয় পেয়ে চলে যেতে চাইতেছিলো, আর তুই ইঁদুরের মতো করে ওর জামাটা নিজের মুঠোর ভেতরে জোর করে আটকে রাখলি! ও ভয়ে চিৎকার শুরু করার পরে কাউকে আর কিছু বলার সুযোগও পাওয়া গেলো না, সেচের নালার ভেতরে লুকাইয়া থাকা লাগলো সারাটা রাত। আর রাজ্যের মানুষ আমাদেরকে সবখানে খুঁজে বেড়াইতেছিলো, রাতের অন্ধকারে শেষে চোরের মতো পালাইয়া আসা লাগলো! আর শুধু কি এইবার! সবসময়েই তুই কোন না কোন ঘাপলা পাকাস! মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে তোরে কয়েক লাখ ইঁদুরের সাথে একটা খাঁচার ভিতরে ভরে রাখি, তারপরে বুঝতি মজাটা!''
এইসব বলতে বলতেই আগুনের অন্য পাশে বসে থাকা লেনির ভয়ে-দুঃখে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া মুখ দেখে জর্জের উত্তাল রাগটা হঠাৎ করেই পড়ে গেলো। একটু লজ্জিত হয়ে আগুনের শিখার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সে। চারপাশে ততোক্ষণে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার নেমে এসেছে। কিন্তু গাছের নীচে বাঁকানে ডাল-পালার আড়ালে জ্বলে উঠা আগুনটা সেই অন্ধকারকে খুব কাছে ভিড়তে দেয়নি। লেনি সেই অন্ধকারের ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে নিঃশব্দে জর্জের কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে গোড়ালির উপরে উপর ভর দিয়ে বসে পড়লো। জর্জ বিন ক্যানগুলোর অন্য পাশটা আগুনের আঁচে গরম করার জন্য ঘুরিয়ে দিচ্ছিলো, ভাব দেখালো লেনি যে ওর এতো কাছে চলে এসেছে তা খেয়ালও করেনি সে।
''জর্জ'' নরোম স্বরে ডাকলো লেনি, জবাব না পেয়ে আরেকবার ডাকলো, ''জর্জ।''
''কি চাস?''
''জর্জ, আমি এমনেই মজা করতেছিলাম, আমার কেচাপ চাইনা। এখন আমার সামনে কেচাপ থাকলেও আমি খাইতাম না, সত্যি।''
''থাকলে না হয় খাইতি, কি সমস্যা তাতে?''
''কিন্তু আমি খাইতাম না, পুরাটুকু তোর জন্য রেখে দিতাম। তুই তোর বিনে ঢেলে খাইতে পারতি। আমি ছুঁইয়াও দেখতাম না।''
জর্জ তখনও আগুনের দিকে বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। আপনমনেই বলতে লাগলো, ''তোকে ছাড়া ভালো থাকার কথা ভাবতে গেলেও আমার মাথাটা খারাপ হয়ে যায়, একটা ফোঁ
টা শান্তিও পাই না।''
লেনি তখনও হাঁটু গেড়েই বসে ছিলো। নদীর পার হয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে খানিক।
''আচ্ছা জর্জ, আমি তোকে ছেড়ে চলে গেলে তুই খুশি হবি, না?''
''কোন চুলায় যাবি শুনি?''
''ওই যে ওই পাহাড়গুলার কোন একটাতে, কোথাও একটা গুহা খুঁজে পাওয়া যাবে চাইলে।''
''হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব পারবি। খাবি কি? কি খাইতে হয় আর কি হয়না এইটুকু বোধও তো তোর নাই।''
''আমি কিছু না কিছু খুঁইজা নিবো জর্জ। আমার তো কেচাপ দেওয়া কোন মজার খাবারের দরকার নাই, যা কিছু একটা খেয়ে নিয়ে রোদে শুইয়া থাকবো। কেউ আমাকে কিছু বলবে না। একটা ইঁদুর পাইলে আমি ওইটারেও রাইখা দিতে পারি। কেউ আমার কাছ থেকে ইঁদুরটা কাইড়াও নিবেনা।''
সন্ধিৎসু দৃষ্টিতে দ্রুত লেনির চেহারায় একবার চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলো জর্জ, ''আমি তোর সাথে বেশি খারাপ ব্যবহার কইরা ফেলছি, নারে?''
''তুই আমার সাথে থাকতে না চাইলে আমি যেকোন সময়ে পাহাড়ে গিয়ে গুহা খুঁইজা নিবো।''
''নারে, শোন লেনি... আমি তো এমনি এমনি বলতেসিলাম। আমি তো চাই-ই তুই আমার সাথে থাক। ইঁদুর নিয়ে ঝামেলা হইলো তুই সবসময়ে ওগুলারে মাইরা ফেলিস। প্রথম সুযোগেই আমি তোরে একটা কুকুরের বাচ্চা এনে দিবো। তুই মনে হয় ওইটারে সহজে মারতে পারবিনা। ইঁদুরের চেয়ে বরং ভালো হবে সেইটা। চাইলে কষে আদরও করতে পারবি।''
টোপটা গিললো না লেনি, জর্জের নরম হয়ে পড়াটা টের পেয়েই যেন আগের সুরেই কথা চালাতে লাগলো, ''তুই না চাইলে, খালি একবার বললেই হবে, আমি সাথে সাথে চলে যাবো, পাহাড়ে-জংগলে যেকোন খানে। নিজের মতো থাকবো আর তখন আমার ইঁদুরও কেউ আমার কাছ থেকে নিতে পারবে না।''
''আমি চাই, তুই আমার সাথেই থাক লেনি। যীশূর কীরে, তুই একলা থাকলে কেউ তোকে শেয়াল নাইলে হায়েনা ভেবে গুলি করে বসবে কোন একদিন। নাহ! আমার সাথেই থাক তুই। তোর ক্লারা খালাও বাঁইচা থাকলে তুই একলা নিজের মতো থাকবি এইটা কখনোই চাইতো না।''
চতুর স্বরে বললো লেনি, '' তাইলে বল, যেমন আগে বলসিলি।''
''কি বলবো?''
'' ওইযে, খরগোশগুলার কথা।''
একটু তেতে উঠলো জর্জ, ''এহ! চালাকি করে কিছু করাতে পারবিনা আমাকে দিয়ে।''
লেনি অনুনয় করলো, ''বলনা, জর্জ। দোহাই লাগে... আগে যেমনে বলতি, আবার একটু বলনা।''
''তোর তো দেখি খুব মজা লাগে শুনতে। ঠিক আছে বাপু, বলছি, কিন্তু এরপরেই রাতের খাবারটা সেরে নেবো।... ''
গভীর স্বরে বহুবার পড়া কোন কবিতার মতো একটানা সে বলে চললো, ''আমাদের মতো খামারে খামারে কাজ করে বেড়ানো মানুষেরা এই দুনিয়ায় সবচেয়ে নিঃসঙ্গ। কোন পরিবার নাই, কোন জায়গার সাথে তাদের কোন টানও নাই। কোন একটা খামারে গিয়ে হাড়াভাংগা খেটে যা কিছু একটা কামায়, শহরে গিয়ে তা আবার উড়িয়ে দেয়। এরপরেই আবার আরেকটা খামারের খোঁজে লেজ দাবড়িয়ে দৌড় লাগায়, কোথাও যাওয়ার বা সামনে কিছু করার চিন্তা কখনো করেইনা।''
খুশি হয়ে উঠলো লেনি, ''একদম ঠিক- একদম ঠিক। এখন বলনা আমাদের দুইজনের জন্য ব্যাপারটা কেমন?''
জর্জ বলেই চললো, '' আমাদের ব্যাপারটা মোটেও অন্যদের মতো না। আমাদের একটা ভবিষ্যৎ আছে। আমাদের কথা মন দিয়ে শুনবে এমন মানুষ আছে আমাদের। যাওয়ার জায়গা নাই বলে একটা শুঁড়িখানায় গিয়ে পয়সা উড়ানোর কোন দরকার আমাদের নাই। অন্য মানুষগুলো জেলে পঁচে মরলেও ওদের কথা ভাববার একটা লোক পর্যন্ত নাই। কিন্তু আমরা তো ওইরকম না।''
মাঝখানে লেনি যোগ করলো, '' না, আমরা ওইরকম না। কেন? কারণ... কারণ আমার দেখাশোনা করার জন্য তুই আছিস, আর তোর জন্য আছি আমি।'' খুশিতে একগাল হেসে বললো লেনি, ''তুই বলতে থাক জর্জ।''
''তুই-ই বলনা। তোর তো দেখি পুরা মুখস্থ হয়ে গেছে।''
''না না, আমি মাঝে মাঝে ভুলে যাই। তুই ই বল আমাদের কথা।''
মন্তব্য করুন