বিলাতের দিনরাত্রি...২
একে তো চরম মন খারাপ করা দিন কাটে, তার উপরে ক্লাস থেকে ফিরে রোজ দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়াই একটু, শুনি মহিলাটি আবার কাঁদছে। কাছে গিয়ে সান্ত্বনা দেবার লোভ সামলাই কোনরকমে। চোরের মত ত্রস্তপায়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে বসে থাকি। ল্যাপটপটা কোলের উপরে নিয়ে অন্যমনস্কের মত এই সেই ওয়েব পাতায় ঘুরে বেড়াই। পাশের ঘর থেকে খসখসে বয়স্ক আর তীক্ষ্ণ কিশোরী কন্ঠের চিৎকার ভেসে আসে। মহিলাটি সিলেটি ভাষায় কি বলে যাচ্ছেন, তার পুরোটা বুঝতে পারিনা, আধাআধি যা বুঝি তাতে মনে হয় বারো বছরের মেয়েটির ব্রিটিশ উচ্ছৃংখলতা সিলেটের পাড়াগাঁ থেকে লন্ডন চলে আসা মায়ের সহ্যের বাইরে চলে গেছে। মায়ের কথা না বুঝলেও, মেয়ের মুখের ''শাট আপ, ইউ ব্লাডি হোর'' শুনে আপাদমস্তক চমকে উঠি! আবছা আবছা যা বুঝি তাতে মনে হয় মা আর মেয়ের যোজন দূরত্বে বসবাস, কারো মনোজগতে কারো প্রবেশাধিকার নেই। অ-আ পড়তে না জানা মা'টি নামাজে বসে দুহাত তুলে যে প্রার্থনা করছেন তা কখনো ঈশ্বরের কানে পৌঁছুবে কিনা কে জানে। আর মেয়েটিও আশেপাশের নিত্যদিন দেখতে পাওয়া আর দশটা বন্ধু-বান্ধব কিংবা তাদের পরিবার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটা মানুষকে নিজের মা হিসেবে দেখতে গিয়ে সব গুলিয়ে ফেলে। কি বিচিত্র মানুষের সমস্যা! শেকড়বিহীন মানুষের চেয়ে অসহায় বুঝি আর কিছু নেই।
যাই হোক আমি টের পাই আমার চলে যাবার সময় হয়েছে, কিন্তু তদ্দিনে মহিলাটির জন্য এক ধরণের মায়া জন্ম হয়েছে... আমি চলে গেলে তাকে এই দুশো পাউন্ডের জন্য একটা লোক খুঁজে বার করতে হবে... কাউন্সিলের বাড়ি ভাড়া দিয়ে তার ঠিক ন্যায় পথে পাওয়া টাকা না এইটা, কিন্তু অতোখানি অসহায়ত্ব নিয়ে ন্যায়ের বোধ তার কাছ থেকে আশা করাটা ঠিক মনে হয়না।
আমি আর তাজীন প্রায়ই বাসা খুঁজতে যাই, কোন বাড়ি যদি আমাদের পছন্দ হয় তো বাড়িওয়ালার আমাদেরকে পছন্দ হয়না, নাইলে বাড়িই পছন্দ হয়না, নাইলে বিশাল খরচের ধাক্কা... কিছুতেই আর মনমতো কিছু খুঁজে পাওয়া যায়না। শেষমেষ জোন ফাইভে একটা বাসা পাওয়া গেলো, তাজীনের ছোটখালুর একটা পুরানো অ্যাপার্টমেন্ট... এজওয়্যার নামের একটা জায়গায়। বাড়ির সামনের রাস্তা আর পাশের বিশাল মাঠ দেখে আমরা ঠিক করলাম যা থাকে কূল-কপালে এই বাড়িই আমরা নিবো।
বাড়ি নিয়া নিলাম, বাড়িতে উইঠা দেখি কঠিন অবস্থা... গিজার কাম করেনা, লাইট সব নষ্ট, হিটারে ঠাণ্ডা কাটেনা। তার উপ্রে আগে এক মাস্তান মার্কা লোক থাকতো, সে এমনি খাইস্ট্যা মার্কা ছিলো যে ঘরের অবস্থা কহতব্য না। দুই-তিন সপ্তা ধইরা আমরা ঘর সাফই খালি করলাম। সোফার উপ্রে ইউজড কটন বাড পাইয়া সোফা রাখুম না ঠিক করা হইলো, ঘরের কোণা কোণায় কালো রাবারের মতো জমাট বাঁধা ময়লা... হাতে পায়ে পলিথিন বাইন্ধা আমি দুইদিন ধরে জানালা সাফ করলাম... জানালার ভেন্টিলেশান এর ছোট্ট উইন্ডোর জায়গায় পাওয়া গেলো সমান মাপের একটা টিফিন বাটির ঢাকনা, ছাদে এক জায়গার অবস্থা দেইখা মনে হইলো ঘরের ভিতরে হোলি ফায়ার এর মতো কিছু করা হইসিলো। দুনিয়ার খাটাখাটনির পরে বসবাসযোগ্য একটা জায়গা বানানো গেলো। আমরা অবশ্য ঘরের বাইরেটা নিয়া ব্যাপক আনন্দিত। আমার ক্লাস মোটে হপ্তায় দুই্দিন... তাই ঘরে আর ঘরের আশেপাশেই বেশিরভাগ সময় কাটে... ।
ঘরে থেকেও ভবঘুরে আমরা ক'জনা। সারা রাত হয়তো হুদাই বকবক করে কাটিয়ে দিলাম... কখনো সখনো আমি বসে কাজ করার চেষ্টা করি, বাকি দুইটা ইউটিউবে গান শুনে, নাইলে ভিডিও দেখে। ঘুম থেকে রোজ বেলা করে উঠি। সারাদিনে একবেলা রান্না, বেশিরভাগ সময়ে ভাত-ডাল-ভর্তা। আমরা ভর্তা বানানোর ওস্তাদ হয়ে গেছি, মাঝে মাঝেই ভাবি এই দেশে একটা খাঁটি বাংলাদেশী খাবারের দোকান দিয়া ফেলি, এতো বাংলাদেশি এইখানে, কিন্তু সবখানে ইন্ডিয়ান কারি রেঁস্তোরার ছড়াছড়ি। তাজীনের ধারণা আমরা নিজেদেরকে নিয়া ইনফিরিয়টির কমপ্লেক্সে ভুগি, তাই কখনো আমাদের নিজস্ব খাবারকে প্রোমোট করিনা। পড়াশুনা, কামলা খাটা, মাঝেমইধ্যে ঠেইলা ঠুইলা নিজেদেরকে এদিকে সেদিকে নিয়া যাওয়া আর দুনিয়া যতো আজীব জিনিস নিয়া গপসপ করা ছাড়া আমাদের তেমন কিছু করার নাই, তাই আমরা রান্ধি-বাড়ি আর খাই। মাঝে মইধ্যে সিনেমা দেখি... আমি বাকি দুইজনের তুলনায় মোটামুটি বেক্কল কিসিমের, দুনিয়ার অর্ধেক জিনিসই জানিনা, বুঝি-ওনা... তাই তেনাদের গালির উপ্রে থাকি। কিন্তু এই এক মজার জীবন।
আপনের পড়াশোনা কি শেষ ?
হ...
এইরম ... width=570... আর height দেয়ার দর্কার নাই ... তাইলে দেখবা ছবি পোস্ট থেকে বের হয়ে যায় না
কথা ঠিক।
উপরে যে খাওয়ার ছবি দিসেন তার মধ্যে কোন গুলো ডাল ভর্তা?????
ডাল ভর্তা বানানোর পরে আর বাকি থাকতো না, ছবি তুলবার আগেই খতম... প্রতিবার ভাবতাম... আহা! ছবি তুললাম না!
অপূর্ব সব ছবি। কি মাছ ওটা? ফ্লোরেল না কড? খাসা চেহারা হয়েছে কিন্তু
মনে হয় কিপার...
বাসাটা (মানে বাসার সামনের যায়গাটা) খুবই সুন্দর
ঠিক... একদম ঠিক
খাওনগুলা দেইখা আমার ......



মাছটা মনে হয় "বাসা ফিলেট" ...
লেখাটা চমৎকার লাগলো, দুটো পর্বই
আমিও লিখতে শুরু করবো সময় পেলে
ভাল থাকবেন।
মাছটা কিপার ফিলে... লেখা শুরু কইরা দেন... খাওনগুলা আমাদের এক্সপেরিমেন্ট...
এইতো, মন ভরানো পোস্ট!
খুব আতঙ্ক হচ্ছিলো, "পরিচ্ছন্নতা অভিযানের পূর্বে"র কোন ছবি দেখতে হয় কি না
শেষের ছবিতে কোনজন কে? তিনজনকেই অনেক শুভেচ্ছা।
গোলগাপ্পা আর মাথায় কোঁকড়াচুলো বাবুই এর বাসাটা আমি, ছোটচুলের বাচ্চা মেয়েটা মৌসুম আর মধ্যের 'দ্য চায়না' গার্ল হইলো তাজীন...
ছবিগুলো খুব সুন্দর।
চুপচাপ পড়ে গেলাম
এট্টু শব্দ কইরাই পড়তেন...
ভাল্লাগল লেখাটা ।
ভালৈছে।
আবারো ভার লাগছে।
বেটি তুই অনুমতি না নিয়া ছবি ছাপাইয়া দিলি ক্যান? এমন মাইর আছে কপালে, ঝাশ্ট ইউ অএট!
হিহিহি... মাইর তো আমার কপালে এমনেও মাটিতে পড়ে না... না হয় আরো দুই-চাইরখান খামু... আর এইটা তো পাব্লিক ছবি ছাপাইসি... ফেইসবুকের লিংক থেইকা...
এইখানে মৌসুম কোন্টা?
ডাইন পাশেরটা মৌসুম সেইটা কমু না ঝে...
চশমা বেগমকে দেখেই মনে হয়েছে, এইটা আমাদের আনিকা।
আনিকা, আমার বউয়ের মুখে শুনলাম তোমরা যেখানে যাও, তিন বন্ধু (তাজিন মৌসুম এবং তুমি) একসাথে যাও। এই পোস্টে তার প্রমাণ পেলাম। তোমাদের বন্ধুত্ব সত্যি ঈর্ষণীয় । চির অটুট থাকুক তোমাদের বন্ধুত্ব, এই শুভকামনা রইলো...।
মন্তব্য করুন