সন্তানের অপেক্ষায় তারা এভাবেই জেগে থাকেন - চেনা অচেনা কত ব্যালকনিতে - এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকেন তারা - উদ্বিগ্ন - উন্মুখ - স্নেহাকুল
সিলেট থেকে ঢাকা - সরলরৈখিক দূরত্ব ২০০ কিলোমিটার - সড়কপথে ভ্রমণের হিসেবে বোধহয় আরো ৪০ কিলোমিটার যোগ হবে - দূরত্ব যেমনই হোক প্রতি সপ্তাহান্তে আমাকে যেতে হয় - যেতে হবে - ওখানে এক ভদ্রমহিলা নিয়ত অপেক্ষা করেন - তার ছেলে আসবে - দুটো দিন - অন্তত দুটো দিন তার কাছে থাকবে.
এই সপ্তাহে পারছি না যেতে - মা জানেন - তবু বোধহয় অপেক্ষা করবেন - অপেক্ষা তার অস্তিত্বে - অপেক্ষা তার অবচেতন মনে - বড় অদ্ভুত মায়েদের মন.
প্রতি বৃহস্পতিবার - অফিস শেষে সন্ধ্যায় যখন বাসে উঠি - আমার ফোন বেজে ওঠে - না দেখেই বলতে পারি - মায়ের ফোন - কিভাবে যেন তিনি টের পান ছেলে গাড়িতে উঠেছে - তারপর সেই চেনা প্রশ্ন - 'বাবা - রওনা হয়েছিস ? ভালো সীট পেয়েছিস ? সাবধানে আসবি' - আমি সাবধান থাকি - নিজের জন্য না - মায়ের জন্যই - গাড়ি হয়ত মাত্র শহর ছেড়েছে - আবার ফোন আসে - মায়ের মনে পড়েছে - ছেলে দুপুরে কিছু খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করা হয়নি - অস্থির প্রশ্ন তার - 'দুপুরে ভাত খেয়েছিস ? তরকারী কি ভালো ছিল ? খেতে সমস্যা হয়নিতো কোনও ? মায়ের মন রাখতে সত্য-মিথ্যে মিলিয়ে উত্তর দেই - কৈ মাছকে কখনও ইলিশ বানাই - কখনো সবজীকে মাংস - ডালকে অমৃত - কিন্তু ধরা পড়ে যাই - মিথ্যেটা মা বরাবরই টের পেয়ে যান - এখনো আমি এত চালাক হইনি যে মায়ের মনকে বোকা বানাতে পারব.
যাত্রাপথে প্রায় সবসময়ই জানালার পাশে বসি - এলোমেলো বাতাসের ধাক্কা - কখনো বা ধূলার মাদক গন্ধ - অথবা এক পশলা বৃষ্টির ঝাপটা - বড় ভালো লাগে - মাঝে হয়ত চোখ লেগে আসে - নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ি - চমকে দিয়ে আবার ফোন বাজে - 'কতদূর আসলি ?' - ঘুম ভাঙ্গা চোখে আমি বাইরে তাকাই - বোঝার চেষ্টা করি কোথায় আছি - আমি বোঝার আগেই মা নিখুঁত উত্তর দেন - 'বোধহয় হবিগঞ্জ' - মায়ের হিসেবজ্ঞান দেখে আমি অবাক হই - ছেলের পুরো যাত্রাপথটাই কি তিনি তার মনের বহুমাত্রিক কো-অর্ডিনেট সিস্টেমে বসিয়ে নিয়েছেন?
বাস হয়ত বিরতিতে থামছে - আবার ফোন - 'খাওয়া না খাওয়ার সীমারেখা মনে করিয়ে দেয়া কঠোর সাবধানবাণী' - আমি মনে মনে হাসি - মা আমাকে এখনো সেই স্কুল পড়ুয়া ছোট্ট ছেলেটিই ভাবেন বুঝি - আমি তো বড় হয়ে গেছি - নিজের ভালোমন্দ ভালই বুঝি - পরক্ষণেই মনে সন্দেহ জাগে - সত্যিই কি তাই ? মায়ের চেয়ে ভালো এখনো কি বুঝি ?
গাড়ি নরসিংদী পার হচ্ছে - আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই - সামনেই একটা ঝুঁকিপূর্ণ মোড় - ওদিক থেকেও দ্রুতগামী ভারী হেড লাইটের আলো - যাত্রীরা সচকিত - আমার মনেও কিছুটা উত্তেজনা - কিন্তু না - সংঘর্ষ হয়না - পাপী বান্দার সহজ মরণ নেই - ওদিকে মুঠোফোন বাজতে শুরু করেছে - মা এর উদ্বেগাকুল প্রশ্ন - 'বাসে উঠার সময় বিসমিল্লাহ বলেছিলি' - আমি অবাক হই - কিছুটা যেন থতমত খেয়ে যাই - এই সময় এই প্রশ্ন কেন করলেন মা - তবে কি ওই মুহুর্তে কোনও অজানা উপায়ে সন্তানের সম্ভাব্য বিপদের কথা তার মনে পৌঁছে গিয়েছিল ? - সর্বনিয়ন্তাই ভালো জানেন.
যাত্রাবাড়ি - শুরু হয় অবিশ্বাস্য ক্লান্তিকর যানজট - যাত্রীরা অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে - কারো উপর রাগ ঝাড়তে না পেরে গাড়ির চালককে বেছে নেয় - চালকের ভাগ্যে জোটে নিদারুণ গালাগালি - 'ব্যাটা - এদিকে আইলা কেন - ফ্যান গুলা ছাড় না কেন - গাড়ি ছাড়ার কথা ৭ টায়, ছাড়লা তো বারোটা বাজায়ে - আর যদি কোনদিন এই গাড়িতে উঠছি' - কত মন্তব্য যে ভাসতে থাকে গাড়ির ভিতরে - চালক প্রায় সময়ই নিরুত্তর থাকে - মানুষের অক্ষম অসহায়ত্বের সাথে সে পরিচিত - আমি চুপচাপ শুনি - অপেক্ষা করি জ্যাম ছাড়ার - মায়ের ফোন আসে - 'আর কতক্ষণ লাগবে' - তার এই প্রশ্নের উত্তরে মজা করে বলি - 'এই তো যাত্রাবাড়ির যাত্রা দেখছি - মা, তুমি ঘুমিয়ে পড় - আশা করি - ফজরের (?) আগেই পৌছে যাব' - মা যেন হতাশ হন - আমি কল্পচোখে দেখতে পাই - তিনি ভাত বেড়ে বসে আছেন - আমার প্রিয় মাছটা আছে - আছে খুব যত্ন করে বানানো আলুভর্তা - মুরগির প্রিপারেশনটা আছে - মাংসে আলু দেয়া হয়েছে - আচারের বয়াম'তা টেবিলের উপরে - মা কিছুই ভোলেন না - ছেলের প্রিয় খাবারগুলো বানাতে ভুলেননি - ভুলে গেছেন শুধু নিজের অতি আবশ্যক প্রেশারের ওষুধটা খেতে - জ্যাম ছাড়ে - শুনে মা কিশোরী মেয়ের মত খুশি হয়ে উঠেন - 'আর তো তাহলে মাত্র আধাঘন্টা - জলদি আয় - ভাত ঠান্ডা হয়ে যায় তো'.
ফকিরাপুল - বাহন পরিবর্তন - চারচাকা থেকে তিন চাকায় আরোহণ - বৃদ্ধ রিক্সা চালক দুর্বল কন্ঠে কিছু ভয়ে কিছু প্রত্যাশায় ভাড়া বোধহয় কিছু বেশিই চেয়ে ফেলে - হেসে মেনে নেই - মায়ের কাছে যাচ্ছি - মনের ক্ষুদ্রতার কাছে হারব কেন - কেমন যেন ছেলেমানুষ হয়ে উঠি - রাতের ঢাকা বেশ বিপদজনক - কিন্তু আমার ভয় লাগে না - ভয় কি - মা কে না দেখে মরব না - আমার স্রষ্টা অত নির্দয় নন নিশ্চয় - বাসার সামনে পৌঁছে উপরে তাকাই - যা ভেবেছি তাই - নিঝুম এই এপার্টমেন্টের সব বাসিন্দাই বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছে - না - সবাই না - ওই তো তিনতলার বারান্দায় একটি রাত জাগা অবয়ব - অসুস্থ শরীরেও কে যেন আমার অপেক্ষায় ওখানে জেগে আছেন - আমার পোড় খাওয়া হৃদয় যেন ছলকে ওঠে - চোখের কোণ কি কিছু ভিজে যায় - নাকি এ আমার মনের ভুল ? - আসলেও ভুল হয় - আমার আমাদের বারবার ভুল হয় - কেন যেন ঘরে ফিরতে বারবার আমাদের দেরী হয়ে যায় - কিন্তু মায়েরা ভুল করেন না - প্রখর রোদ হোক - হোক ঘনঘোর বর্ষা - রুদ্র ঝড় কিংবা নি:সঙ্গ নিশুতি রাত - সন্তানের অপেক্ষায় তারা এভাবেই জেগে থাকেন - চেনা অচেনা কত ব্যালকনিতে - এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকেন তারা - উদ্বিগ্ন - উন্মুখ - স্নেহাকুল হৃদয় নিয়ে.
আসলেই তাই
যাত্রাপথ হয়তো ভিন্ন ছিলো কিন্তু ঘটনা সব একই রকম। সব মায়েরাই একই রকম।
পোস্ট পড়ে আবেগে আপ্লুত হলাম।
অসাধারণ একটা লেখা। ছুয়ে যাওয়া
মায়েরা তো এমনই হয় !
আপনি অনেক ভাগ্যবান, আপনার জন্যে মা এখনো অপেক্ষা করে থাকেন।
আফসোস ! মায়ের চেহারা আমার মনে পড়ে না !
দারুণ লিখেছেন ব্রো।
খুব ভাল লাগল। আমার মা ও প্রতিক্ষায় আছে। প্রতিটি দিন গুনছে কবে গাড়িতে চড়ব।
ভাগ্যবান মানুষ।
অসাধারণ লিখেছেন মা'কে নিয়ে।
মা'রাতো এমনিই।
আমি দুর্ভগা, মা নেই...
মা' ভালো থাকুক।
অনেকদিন পর মা কে নিয়ে এত সুন্দর একটা লেখা পড়ার সৌভাগ্য হ'লো...
সত্যি তাই। এত সুন্দর লিখেছেন আপনি! পড়তে পড়তে চোখ ভিজে গেলো।আমি ঢাকা থেকে নরসিংদী যাই--প্রায়ই যাওয়া হয়। যেদিন যাব, সকাল থেকেই মা ফোন করেন...কখন বের হব---কতদূর গেলাম...একটু পরে আবার---এখন কোথায়। মাঝে মাঝে খুব রাগ হই----বলি, পথে তো জ্যাম থাকে।যদি আমার সাথে অন্য কেউ যায়, মা তাহলে তাকে ফোন করে একটু পর পর। ভোরে উঠে অফিস আসব বলে ভোর ৪টায় উঠেই রান্না করে খাইয়ে আবার দুপুরের খাবার দিয়ে দিতে হবে। কোন বারণ মানবে না। প্রত্যেক বেলায় জানতে চায় কি খেলাম...কি করলাম...কত দুশ্চিন্তা মায়েদের!আহারে মা! সব মায়েরা ভালো থাকুক। শতবর্ষ বেঁচে থাকুক সন্তানদের মাঝে।
আহা ! বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল আপনার লেখাটা পড়ে । অসাধারণ লিখেছেন ।

মন ছুয়ে গেল।

লেখায়
মন্তব্য করুন