জীবিকা অথবা জীবন- ৪
বেশ নিশ্চিন্ত মনে কাজে লেগে যায় মনু মিয়া। গরুছাগল আর হাঁস-মুরগির যত্ন-আত্তি সে ভালোই পারবে। কিন্তু রাতের বেলা যখন রান্নাঘরে বসে হাঁড়ি-পাতিল, এঁটো বাসন-পেয়ালা ধুতে বসলো তখনই তার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো কিছুক্ষণের জন্য।
গ্রামের বাড়ি যতটা কষ্টই করুক না কেন, তার মা কখনোই তাকে হাঁড়ি-পাতিল মাজার কাজ করতে বলেনি। তবে, এ কষ্টটাকেও সে দূর করে দিতে পারলো যখন মনে পড়লো, মায়ের কাছে একবার শুনছিলো যে, তার জন্মের পর তার মা বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। সে সময়গুলোতে নিকটজন কারো সহযোগিতা না পেয়ে তার বাবা নাকি সংসারের সব কাজ করতেন। ঘরবাড়ি ঝাঁট দেওয়া থেকে আরম্ভ করে রান্না-বান্না, কাপড় ধোওয়া, গোয়াল ঘর সাফ-সুতরো করা থেকে ক্ষেতের কাজেও অবহেলা করেননি। মায়ের বলা কথাগুলোর স্মৃতিটুকু যেন তাকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সালসার কাজ করলো। তখনই তার মনে হলো, বুড়িটা রান্নাঘরে একাএকা রান্না করে কোনদিন কি থেকে কি হয়ে যায় তাহলে তার কাজ চলে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়ে যায়। আর কর্মহীন অনিশ্চিত ভবিষ্যত দেখতে চায় না সে।
মানুষ দুজন খুবই ভালো মনের বলেই হয়তো যাদু সরকারের হাতে পঞ্চাশ টাকার দুটি নোট তুলে দিয়ে বলেছিলেন, মনু মিয়ার মায়ের হাতে দিবা! আর সে দৃশ্য দেখেই যেন তার মনটা বয়স্ক দুজনের প্রতি আরো দুর্বল হয়ে উঠেছিলো। যে কারণে সে তার জন্য নির্ধারিত ঘরে ঘুমুতে গেলে অন্ধকারেই বিছানা হাতড়ায়। দিনের বেলা বুড়োবুড়ি দুজনে মিলে তাকে ঘরটা দেখিয়ে বলেছিলেন, এই খাটটায় ঘুমাবি। বিছনা পাতিও আছে। অখনই সব ঠিক কইরা ল। কামে ভর্তি হইলে আর টাইম পাবি না!
কিন্তু ঘরের ভেতরকার ঘর বলে অন্ধকারটাকে যেন খুব বেশি অন্ধকার বলে মনে হয়। হয়তো ব্যাপারটি খেয়াল করেই রহমান সাহেব এগিয়ে এসে দেয়ালের সুইচ টিপে বাতি জ্বালিয়ে দিতেই ঘরটা আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
মনু মিয়া হঠাৎ ভয় পেয়ে মাগো! বলে আর্তনাদ করে উঠলে রহমান সাহেব হেসে উঠে বললেন, ডরাইলি? বাতি না জ্বালায়া আন্ধারে করতাছিলি কি? তার পর তিনি তাকে ডেকে বললেন, তর নাম জানি কি?
মনু মিয়া ত্রস্ত কণ্ঠে বলে, মনু। মনু মিয়া!
ও। অখন চাইয়া দেখ, এইটা হইলো গিয়া সুইচ। এই যে কালা মতন এইটুকা বাইর হইয়া রইছে না, এইটারে এমনে নিচের মিহি নামাইলে বাত্তি জ্বলবো। আর উপরের মিহি উঠাইলে বাত্তি অফ হইয়া যাইবো!
অফ কথাটা বুঝতে না পারলেও রহমান সাহেব দুবার বাতি জ্বালিয়ে নিভিয়ে দেখালে ব্যাপারটি তার বোধের অগোচর থাকে না। তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রহমান সাহেব বললেন, আয়। তুই করা পারছ কিনা আমারে দেখা!
ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এসে মনু মিয়া বাতি জ্বলানো নেভানো অনুশীলন করে। ভেতরে ভেতরে শিহরিত হয়। ব্যাপারটা খুবই বিস্ময়কর আর জটিল বলে মনে হয় তার কাছে।
এইবার হুইয়া পড়! বলে তিনি চটিতে শব্দ করতে করতে চলে গেলেন।
রহমান সাহেব যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই শোনা যায় তিনি কাউকে ডাকছেন, সালমা, সালমা বেগম গেলা কোনহানে?
এবার বুড়ির কণ্ঠস্বর শুনতে পায় মনু মিয়া, হইছে কি? আমি কি মরছি?
এরপর আর কোনো কথাবার্তা শেনা যায় না। হয়তো তারা তাদের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেন।
মনু মিয়া শোওয়ার আগে আরো বেশ কিছুক্ষণ বাতি জ্বালানো-নেভানো খেলা খেলে। কিন্তু বেশিক্ষণ জেগে থাকা সম্ভব হয় না। বিছানায় শুয়ে পড়লে তা মনে হয় বিছানা যেন খুব বেশিই নরম। এত নরম জায়গায় শুয়ে পড়ে তার কেমন অস্বস্তি হতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করলেও তার ঘুম আসে না। শেষটায় বিছানার চাদর আর বালিশ তুলে নিয়ে মেঝেতে পেতে শুয়ে পড়তেই পিঠের নিচে শক্ত মেঝের অস্তিত্ব টের পায়। আর হয়তো সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ে।
খুব ভোরবেলা সূর্যোদয়ের আগেই তার ঘুম ভাঙে। সুস্থ অবস্থায় কখনো ঘুম থেকে জেগে উঠে সূর্য দেখতে পেয়েছে বলে মনে পড়ে না তার। প্রতিদিনই ঘুম থেকে উঠে রাঙা হয়ে ওঠা পূবের আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেছে সে। একটু একটু করে সূর্যটাও যেন আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে জেগে উঠে চোখ মেলার আগেই চারদিক কেমন ফর্সা হয়ে উঠতে থাকে। এ সময়টার একটি অদ্ভূত মাদকতা আছে। যা তার নিজের ভাষায় সে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করতে অক্ষম। আর সে কারণেই হয়তো ব্যাপারটি তার অনুভবের চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ থাকে।
শীত প্রায় চলে গেলেও বাইরে কুয়াশার অস্তিত্ব বেশ ঘন মনে হয়। যে কারণে গাছের পাতায় পাতায় জমে থাকা শিশির টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে ফোঁটায় ফোঁটায়। আর ক্রমাগত শিশিরের ফোঁটা পতনের ফলে গাছের নিচে নানা জায়গায় মাটি সরে যাওয়াতে ছোটছোট গর্ত দেখা যাচ্ছে। এ সময়টাতে বেশ শীতশীত লাগে মনু মিয়ার। বাড়ি থেকে আসার সময় সে গরম কাপড় হিসেবে কিছুই আনেনি। আসলে তার তেমন কিছু ছিলোও না। রাতে কাঁথা গায়ে ঘুমালেও বাড়তি কিছু তার নেই। তাই এখন শীতের ভাবটা খানিকটা বেশি মনে হলে সে বিছানা থেকে চাদরটা তুলে নিয়ে গায়ে জড়ায়।
ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির পেছন দিককার গোয়াল ঘরটাতে একবার উঁকি মেরে দেখে মনু মিয়া। গতকাল সন্ধ্যায় মাগরিবের আজানের পরপরই গাইটাকে গোয়ালে বেঁধে দিয়েছিলো। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সেটা বাইরে বেরিয়ে এসেছে। কখন বেরিয়ে এসেছে সে কিছুই টের পায়নি। ঘাসের উপর শুয়ে জাবর কাটছে গাইটা।
সে এগিয়ে গিয়ে গোয়াল ঘরে উঁকি মারে ফের। খুঁটিতে দড়ি বাঁধা আছে ঠিকই। কেবল গাইটির গলাতেই দড়ি নেই। ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সে। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে একবার অবোলা-অবোধ প্রাণীটির দিকে তাকায়। আরেকবার তাকায় গোয়াল ঘরের দিকে।
সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই গতকালকের ঘটনা মনে করতে চেষ্টা করে সে। এমনও হতে পারে যে, সে গাইটাকে গোয়াল ঘরে নিয়ে এসেছিলো ঠিকই। কিন্তু কোনো কারণে না বেঁধেই ফিরে গিয়েছিলো। অনেক ভেবেও সে তেমন কিছু মনে করতে পারে না। তার ঠিকই মনে পড়ে যে, গাইটাকে বেঁধে রেখেই সে কিছুটা খড় টেনে দিয়েছিলো। তারপর হাতমুখ ধূয়ে রান্নাঘরে যাওয়ার সময় সালমা বেগম তাকে বলেছিলেন, আজগররে ডাক দেহি!
সে অবাক হয়ে বলে উঠেছিলো, আজগর ক্যাডা?
আরে ছেরা চকিদাররে আইবার ক! সালমা বেগমের কণ্ঠস্বর খানিকটা বিকৃত হলেও মুখাবয়বের কোনো পরিবর্তন পরিদৃষ্ট হয়নি।
মনু মিয়া আজগরের পাহারা ঘরের দিকে যেতে যেতে শুনতে পাচ্ছিলো গেটের ফোকর দিয়ে মাথা বের করে সে বাইরের কারো সঙ্গে কথা বলছে। সে অবস্থাতেই মনু মিয়া বললো, চহিদার বাই! তোমারে নানি ডাহে!
আজগর খানিকটা বিরক্ত হয়েছিলো হয়তো। কেমন রূঢ় কণ্ঠে বলে উঠেছিলো, চহিদার কিরে? আমি হইলাম সিক্রুডি!
তারপর সে মনু মিয়ার আগে আগে হেঁটে সালমা বেগমের সঙ্গে দেখা করলে তিনি আজগরকে বলেছিলেন, বাইরের ইয়ার দোস্তগো লগে এত পিতলা আলাপের কোন কাম? গেইটের সব তালা লাগাইয়া চাবি দিয়া যা!
তখনই আজগর ফিরে যেতে যেতে কেমন আড়চোখে একবার তাকিয়েছিলো মনু মিয়ার দিকে।
সালমা বেগম বলেছিলেন, এই চকিদারডা বদেরও বদ! অর লগে মিশবি না!
আর বলতে গেলে তখনই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায় মনু মিয়ার কাছে। একবার তার ইচ্ছে হয় আজগরের পাহারা ঘরে গিয়ে দেখে আসতে। তখনই গাইটা হঠাৎ উঠে দাঁড়ালে সে গিয়ে গাইটার গলায় দড়িটা বেঁধে দিয়ে খোলা জায়গায় নিয়ে খুঁটির সঙ্গে বাঁধে। সে সময়টাতেই তার ভাবনায় আজগর আলিকে একজন প্রকৃতই শঠ আর কুটিল চরিত্রের মানুষ বলে চিহ্নিত করে সে। ভবিষ্যতের দিনগুলোতে এখানে শান্তি মত থাকতে গেলে হয় আজগরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে নয়তো সমানে সমানে প্রতিপক্ষ হয়ে লড়তে হবে।
মনু মিয়া নিজে যেমন গ্রামের ছেলে, তেমনি হয়তো আজগর আলি। তবুও কেন আজগর আলি কুটিলতাকেই বেছে নিল তা বোধগম্য হয় না তার। এমন হতো যে তার কোনো রকম স্বার্থ জড়িয়ে আছে তেমনও তো মনে হয় না। মনে হয় না যে, সে এ বাড়িতে এসে কাজে লেগেছে বলে, আজগর আলির প্রাপ্তির পরিমাণ কমে গেছে।
তাদের পাশের গ্রাম লক্ষণ হাটের পেশকার অক্ষয় বাবুর বড় ছেলে অখিল তাদের মুনিষ সুনীলকে পছন্দ করতো না বলে তার বাবাকে বলেছিলো সুনীলকে তাড়িয়ে দিতে। কিন্তু অক্ষয় বাবু শোনেননি ছেলের কথা। তাই বাপের কাছ সুনীলকে খারাপ সাব্যস্ত করতে মাঝরাতে গরু দুটোকে ছেড়ে দিতো। আর ছাড়া পেয়ে গরু দুটো বাড়ির পাশের ক্ষেতের অর্ধেক ধানগাছ খেয়ে ফেলেছিলো। তিনচারদিন পর একই ঘটনা ঘটে। অক্ষয় বাবু বাধ্য হয়ে সুনীলকে ছাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
অখিলের কুটিলতায় তার মনোবাসনা পূরণ হয়েছিলো। সুনীল বিদায় হয়েছিলো বাড়ি থেকে। তেমন কোনো স্বার্থ থাকলে না হয় আজগরের কুটিল পথ অবলম্বনকে মেনে নেওয়া যেতো। কিন্তু আজগরের আচরণ সত্যিই বড় অদ্ভূত ঠেকে মনু মিয়ার কাছে।
(চলবে)





পড়ছি
কিছু কইয়েন। শুধু পড়ার জন্য তো পোস্ট করি না। (আপচুচ! রাগের ইমোটিকন নাই!)
আমরা পাঠকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি । তাতে কি? সুন্দরভাবে এগুচ্ছে, আপনি আপনার মত গুছিয়ে এগুতে থাকুন । আশা করছি একটি সুন্দর ছবি পাবো ।
আমার চেষ্টার ত্রুটি থাকবে না। দিনের বেলা টাইপিং খারাপ লাগে না। রাতে অন্ধকারে বসে গল্প লিখার উৎসাহ থাকে না। পাঠকের আগ্রহ থাকলেই ভালো করার তাগিদ অনুভব করি। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
অসাধারন একটা সিরিজ....
কিন্তু বেশী আলসেমি করেন
এই সিরিজটার অপেক্ষায় থাকি
ভাইগো, লেখায় আমার আলস্য নাই। সময় হচ্ছে না। আজও সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত অফিসে ছিলাম। প্রজেক্টের শেষ পর্যায়ে আমার অবস্থা খুবই কঠিন হয়ে যায়। তবে চেষ্টা তো করি যাতে তাড়াতাড়ি পোস্ট দিতে পারি।
এই সিরিজটা পড়া হয়নি, আগের গুলো পড়ে আসতে হবে
দেরি কইরেন না। দোয়া করি যেন তাড়াতাড়ি পইড়া ফেলতে পারেন।
আপনি প্রচুর অপেক্ষা করান। আর লেখাটা এত ভালো হচ্ছে যে, অপেক্ষা করানোর অপরাধে আপনাকে মাইনাস দিতে হবে।
মাইনাস দিলে দুইটা নয়তো চারটা দিয়েন।
পড়ে যাচ্ছি প্রথম থেকেই।
অভিনন্দন জানাই!
মন্তব্য করুন