জীবিকা অথবা জীবন- ৭
সকালের দিকে রাতের বাসি ভাত-তরকারি খাওয়ার পর আর কিছু করার থাকে না মনু মিয়ার। দুপুরের খানিকটা আগে দিয়ে যদি সালমা বেগম তাকে রান্নাঘরে ডাকেন তো কিছু তরি-তরকারি বা মাছ-গোস্ত কেটেকুটে চাল ধূয়ে দেওয়ার পর ফের খাওয়ার আগ পর্যন্ত তার তেমন কাজকর্ম থাকে না। দুপুরের খাওয়ার পর হাঁড়ি-বাসন-কোসন পরিষ্কার করে গাইটাকে কিছু খেতে দেয়। কোনো দিন কলের মুখে দীর্ঘ পাইপ লাগিয়ে সেই পানি দিয়ে ফেলে দেওয়া গন্ধসাবান দিয়ে ডলে গাইটাকে গোসল করায়। গাইয়ের জন্য সাবান দেখে একদিন রহমান সাহেব আর সালমা বেগম দুজনেই হাসতে হাসতে যেন পড়ে যাবেন এমন হয়। রহমান সাহেব বলেছিলেন, গরুরে সাবান দিয়া গোসল দিতে কই দেখছস? আরো জমিদারেও মনে কয় এমন করবো না!
মনু মিয়া গাইটার শরীরে সাবান ডলতে ডলতে হেসে বলেছিলো, টুকরা-টাকরা সাবান কতডি জমছে! হালায় না দিয়া কাম লাগাইতাছি!
গতকালই গাইটাকে গোসল দিয়েছে সে। এখন ঘরে শুয়ে শুয়ে সে কিছু একটা করার কথা ভাবছিলো। এভাবে শুয়ে বসে থাকাটা তার জন্য অস্বস্তিকর। এখানে আসার কদিন পরই মুরগির খাঁচাটার পাশে প্রায় মরে যাওয়া বেশ ক’টি অচেনা গাছ দেখতে পেয়েছিলো সে। সুযোগ পেলে মাঝে মাঝে সেগুলোর গোড়ায় পানি দিয়ে দিতো। গোড়ার দিকের আগাছা সাফ-সুতরো করে গোয়ালঘরের পেছনে স্তুপ করা পুরোনো গোবর সার এনে দিয়েছে। দিনে দিনে গাছগুলোর মাঝে বেশ সতেজতা ফিরে এসেছে। এখন গাছগুলোর দিকে তাকালে খুব ভালো লাগে তার। কিন্তু ফুল ফোঁটার কোনো লক্ষণ দেখতে না পেয়ে মাঝেমাঝে তার মন খারাপ হতো। তারপর দু-তিনদিন পরপর যত্ন নিতো গাছগুলোর। ভাবতো গাছগুলো হয়তো পুরুষ নয়তো বন্ধ্যা নারীর মতই ফুল-ফলহীন। তবুও তার সান্ত্বনা থাকে এই ভেবে যে, গাছগুলো তাদের জীবন ফিরে পেয়েছে। আগের চেয়ে দেখতে অনেক ভালো লাগে।
একাএকা থাকলে তার মন খারাপ হয়ে যায়। বাড়ির কথা মনে পড়ে। মরিয়ম আর মাকে দেখতে মনটা খুব ছটফট করে। কিন্তু যাদু মিয়া তাকে এক্ষুনি বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবতে বারণ করে দিয়েছে। বলেছে তারা বেশ ভালোই আছে। বাড়ির ঢালুতে একটা জমিতে লাউ আর পাতাসিম লাগিয়ে এসেছিলো সে। লাউ-সিম নাকি এখন ভালোই বিক্রি হচ্ছে। তার ইচ্ছে হয় যে, তাদের গাছের লাউ আর সিম এই দু বয়ষ্ক জনের জন্যও কিছুটা নিয়ে আসে। আর তখনই তার মনে হয়েছিলো যে, যাদু মিয়াকে যদি কথাটা বলে দিতো তাহলে হয়তো সে কিছু না কিছু নিয়ে আসতে পারতো। মনু মিয়া মনেমনে ঠিক করে রেখেছে, যাদু মিয়া এবার তার সঙ্গে দেখা করতে এলে লাউ-সিম নিয়ে আসতে বলবে।
আজও সে ঘর থেকে বেরিয়ে ফুলগাছগুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়ালে দেখতে পায় একটি গাছে রক্তের মত ঘন কলি চোখ মেলতে আরম্ভ করেছে। এতদিনকার শ্রম আর ভালোবাসার প্রতিদানের মতই মনে হচ্ছিলো ব্যাপারটি। অকস্মাৎ অপার খুশিতে কী করবে তাই যেন ভেবে পাচ্ছিলো না সে।
কিছুক্ষণ এদিক ওদিক চেয়ে নিজের অস্থিরতাকে বাগে আনতে চেষ্টা করে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কেমন অদ্ভূত ধরনের একটি কম্পন অনুভূত হলে সেখানেই ঘাসের ওপর থেবড়ে বসে পড়ে। অচেনা গাছগুলোকে বেশ আপন মনে হতে থাকে। মনে হতে থাকে গাছগুলো যেন ঠিক ঠিক তার মনের কথা বুঝতে পারে।
তার মনে পড়ে মরিয়মের যেদিন জন্ম হয় ঠিক এমনই এক অদ্ভূত ভালো লাগায় শিহরিত হচ্ছিল বারবার। সেদিন সকাল থেকেই খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো। আর বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মায়ে কোঁকানোও বাড়ছিলো। রান্নাঘরে শাড়ি দিয়ে আড়াল করে কলাপাতায় শুইয়ে দাই নানি সহ আরো মেয়েরা ভিড় করে তার মাকে ঘিরে বসেছিলো। মায়ের কষ্টে তারও কান্না পাচ্ছিলো। সে রান্নাঘরের কাছাকাছি যেতেই একজন বুড়ি মত মহিলা বললো, আরে পোলা শয়তানি না কইরা আল্লারে ডাক!
ততটুকু বয়সেই সে বুঝে গিয়েছিলো যে, আল্লা সবার ডাক শোনেন না। তার কিছু কিছু পছন্দের মানুষ আছে। তারা ডাকলে তিনি ঠিকই সাড়া দেন। কাজেই সে অন্য কিছুতে ব্যস্ত হয়ে মনের কষ্ট ভুলে থাকতে চেষ্টা করছিলো।
খুব বেশি বৃষ্টি হওয়ার কারণে হয়তো সেবার বর্ষার পানি বাড়ির উঠোনের কাছাকাছি এসে গিয়েছিলো বলে যখন তখন সেই পানিতে নেমে ছোট ছোট চক্কুনি আর দারকিলা মাছ ধরার প্রিয় খেলাটা খেলতে চেষ্টা করছিলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পর পরই রান্নাঘর থেকে কেউ না কেউ বলে উঠছিলো, আল্লারে ডাক! আল্লারে ডাক! আর তা শুনে তার মনপ্রাণ ছুটে যাচ্ছিলো রান্নাঘরের দিকে। ঠিক তখনই তার বাবা একটি নৌকা নিয়ে এসে বলছিলো, তর চাচি-জেডিগোরে ক তর মারে নাওয়ের উফরে দিয়া যাইতো!
মনু মিয়া ছুটে যাচ্ছিলো সেদিকে। আর তখনই হয়তো কারো ডাক আল্লার কাছে পৌঁছে গিয়েছিলো। একটি তীক্ষ্ণ আর যন্ত্রণাক্লিষ্ট চিৎকার শুনে সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলো। এ চিৎকার তার অনেক চেনা। কোনো শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই এমন ট্যাঁ করে একটি চিৎকার দিয়ে ওঠে। সেটা সে হয়তো খুব ভয়ের কারণে করে। অথবা নিষ্ঠুর মানুষগুলোর শক্ত হাতের চাপ সইতে না পেরেও এমনটা করতে পারে। একজন কেউ মুখ বাড়িয়ে বললো, মউন্যারে, তর বইন অইছে!
তারপরই সে ছুটে গিয়েছিলো রান্নাঘরে। শাড়ির আড়ালের বাধা অতিক্রম করে সে পৌঁছে গিয়েছিলো তার মায়ের কাছে। তার মায়ের দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছিলো। কিন্তু মা হাসছিলো তার দিকে চেয়ে। মুখ আর ঠোঁট দুটো কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিলো।
মনু মিয়া মায়ের চোখে পানি দেখে কেঁদে বলেছিলো, মা তোমার কত কষ্ট অইতাছে না?
মা এক হাত তার মাথায় রেখে বলেছিলো, আর কষ্ট নাই! তর বইনেরে দেখছসনি? দেখতে তর মতন অইছে বলে!
হঠাৎ একটি মুরগির কড়কড় শব্দ শুনে তার ভাবনার তার কেঁপে উঠে যেন। আর সঙ্গেসঙ্গে বাস্তবতা তাকে জানিয়ে দেয় মুরগিটা নিশ্চই ডিম পেড়েছে। ডিম পাড়ার আগে পরে মুরগি এমন কিছু বিচিত্র শব্দ করে জানান দেয়।
সে উঠে মুরগিটা যেদিক থেকে আসছিলো সেদিকে যায়। খড়ের গাদার কাছাকাছি মুরগিটা প্রথম ডেকে উঠেছিলো। শেষে খড়ের গাদার নিচে উঁকি দিতেই দেখতে পেলো আরেকটি মুরগি বসে আছে। তার খানিকটা পাশেই দুটি সাদা ডিম পড়ে আছে। তাহলে আরকটা মুরগি ডিম পাড়তে আরম্ভ করলো।
বসে থাকা মুরগিটাকে হুস হাস করে তাড়াতেই দেখতে পেলো আরো কিছু ডিম আছে।
মুরগিটা হয়তো সেগুলোতে তা দিতে বসেছে। সে অবাক হয়ে ভাবে যে, সে এখানে আসার আগে থেকেই এই মুরগি দুটো বাইরে বাইরে থাকে। নয়তো এ দুটো তারের খাঁচা থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
খানিকটা হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গীতে সে খড়ের গাদার নিচে ঢুকতে চেষ্টা করেও পারে না। পিঠ আটকে গেছে খড়ের গাদার মাচার বাঁশে। মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লে হয়তো সে ঢুকে ডিমটা আনতে পারতো। কিন্তু মাটিতে শুয়ে পড়েও সে সেভাবেই থাকে কিছুক্ষণ। তার মন বলে, নতুন ডিমগুলোও থাকুক। আর যে মুরগিটা তা দিতে বসেছে সেটাও তেমনি থাকুক। কিন্তু রাতের বেলা চিকা বা ইঁদুর যদি কোনো সমস্যা না করে ক্ষতি নেই। অবশ্য এমন সমস্যা থাকলে আগের মুরগিটা দশ-বারোটা ডিম নিয়ে তা দিতে বসতে পারতো না।
সে সেখান থেকে উঠে এসে গাইটার কাছে যেতে যেতে তার মনে হয় যে, এভাবে কিছু মুরগির বাচ্চা ফোটানোরও দরকার আছে।
(চলবে)





এই পর্বটা সেইরাম হইছে
শুক্রিয়া জনাব!
ভাল লাগা অব্যাহত থাকলো । "আল্লা সবার ডাক শোনেন না। তার কিছু কিছু পছন্দের মানুষ আছে। তারা ডাকলে তিনি ঠিকই সাড়া দেন।" ভালোই বলেছেন ।
অভিজ্ঞতা বলে কথা!
আর সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
ভালো লাগছে, চলতে থাকুক...।
এমন কথা শুনলে মনে সাহস পাই!
ভালো হচ্ছে দাদা
শুক্রিয়া (জনাব/জনাবা বলা যাবে না/ হয়তো আন্টিও না। তাইলে ) আপু!
মন্তব্য করুন