পাঠচক্র ব্লগ:লরেন্স লিফশুলজ-এর এই লেখাটি পড়েছেন?
লেখাটা এখানে দেয়ার লোভ সামলানো গেল না। জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ একটা লেখা। লেখাটা অনেক বড়। আগ্রহী পাঠকরা পুরোটাই পড়তে পারেন। তবে আমি গুরুত্বপূর্ণ চারটি অধ্যায় এখানে দিচ্ছি। ব্লগে এতো বড় লেখা হয়তো পুরো আসবে না। তাই বিশেষ বিশেষ অংশ এখানে দিলাম।
লেখাটার নাম বাংলাদেশ: প্রতিশ্রুতি, বিপদ ও আশা
লেখক লরেন্স লিফশুলজ।
১.
২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের কয়েক সপ্তাহের ভেতর সারা দেশে সশস্ত্র সংগ্রাম দানা বেঁধে উঠতে থাকলে বাংলাদেশের ‘সম্ভাবনা’ দেখা দিতে শুরু করে। পরের মাস নয়েক সময়ের মধ্যে লাখ লাখ মানুষ শরণার্থী শিবিরে বা সীমান্তের ওপারে তাড়াহুড়ো করে নির্মিত আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে প্রাণ হারায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সঙ্গে সংযুক্ত বিভিন্ন আধাসামরিক বাহিনীর অপারেশনের কবল থেকে বাঁচতে যাঁরা পালিয়েছেন, তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয়স্থল তৈরির আগে বৃদ্ধ ও শিশুরা ব্যাপক সংখ্যায় প্রাণ হারিয়েছেন।
মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধের ফলে যুদ্ধ বিস্তৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি নারীদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর বহু বছর ধরে পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের অধিকাংশই এই দাবিকে প্রচারণা হিসেবে নাকচ করে দিয়েছেন। ২০০০-২০০১ সালে সিনিয়র ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে ইসলামাবাদে অবস্থানকালে পাকিস্তানের পরমাণু নীতি নিয়ে গবেষণা চালাতে গিয়ে আমি পঞ্চাশজনেরও বেশি পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি। সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রায় সব সাক্ষাৎকারই বাংলাদেশ ও ১৯৭১ সালের সংঘাতসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। আমি বাংলাদেশে ছিলাম, এই দেশের ওপর একটি বইও লিখেছি। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের ঐতিহাসিক বিবরণের সঙ্গে আমি পরিচিত। আমি যেসব কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁদের অনেকেই পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করেছেন। বলতে গেলে প্রত্যেকেই বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা ও সংঘটিত যৌন নির্যাতনের বিষয়ে ব্যক্তিগত ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা নিশ্চিত করেছেন যে পূর্ব পাকিস্তানের বেশ কিছু জায়গায় নারীদের জোর করে আটক রাখা হয়েছিল এবং তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছে।
সবচেয়ে ভীতিকর বর্ণনা দিয়েছেন বীর যোদ্ধা, ভারতের বিরুদ্ধে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত ব্রিগেডিয়ার মুজাফ্ফর মালিক। জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও পিপিপির সমর্থক ব্রিগেডিয়ার মালিক ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর পাঞ্জাবের চিফ সেক্রেটারি হয়েছিলেন। ব্রিগেডিয়ার মালিক ও আমি ভালো বন্ধু ছিলাম। লাহোরে গেলেই তাঁর গুলবাগের বাসায় দেখা করতে যেতাম, অনেক সময় একসঙ্গে রাতের খাবার খেতাম। ‘একই সঙ্গে কর্মকর্তা ও ভদ্রলোকের’ বিরল দিক তখন তিনি আমার সামনে প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে তিনি আমাকে ১৯৭১ সালের সংঘাতের সময় ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউনের কয়েক মাস পর পরিস্থিতির উচ্চপর্যায়ের মূল্যায়নের জন্য তাঁর পূর্ব পাকিস্তান আগমন ও অবস্থানের বর্ণনা দিয়েছেন। প্রায় তিন মাস অবস্থান করে মূল্যায়ন শেষ করেছিলেন তিনি। অবশ্য তিনি বলেছেন যে ঢাকায় তাঁর প্রথম রাতটিই ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ।
মালিক আমাকে বলেছিলেন যে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে তাঁর কোয়ার্টার চিনিয়ে দেওয়ার পর পরই তাঁর আরাম-আয়েশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্নেল তাঁকে বলেছিলেন যে মেয়েদের আটকে রাখা হয়েছে এমন স্থান ঘুরে রাতের জন্য একটা মেয়েমানুষ বেছে নেওয়া উচিত তাঁর। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন মালিক। তিনি বলেছিলেন, এমনি ইঙ্গিত দানকারী কর্নেলকে মারতে গিয়েছিলেন প্রায়। কিন্তু শেষে তাঁকে গালমন্দ করেছেন, মর্যাদাহীন সৈনিক বলে ভর্ৎসনা করেছেন। ‘তখনই জেনে গিয়েছিলাম যে আমরা পূর্ব পাকিস্তান হারাতে চলেছি,’ বলেছেন মালিক।
যদিও সব সময়ই আন্তর্জাতিক আইনের বিষয় হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু বসনীয় যুদ্ধের পরই বর্তমানে ধর্ষণ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। ধর্ষণের অপরাধে হেগের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বেশ কিছু সফল বিচার অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজকে বাংলাদেশ যখন ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের বিষয়টিকে নতুন করে দেখছে, তখন এই বিষয়টি আবার পর্যালোচনা ও বিবেচনা করা উচিত এবং দীর্ঘদিন স্থগিত রাখা জবাবদিহির ধরন অনুসন্ধান করা দরকার। আজ পাকিস্তানকে এর অতীতের ভয়ংকর অধ্যায়ের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে বলা উচিত।
প্রকৃতপক্ষেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কয়েক দশক পর জাপান সরকার তথাকথিত ‘প্রমোদনারী’দের প্রতি তাদের দায়িত্ব স্বীকার করেছে। কোরীয় উপদ্বীপ দখল করার সময় জাপানিরা এদের আটক করেছিল।
২.
১৯৭১ সালের যুদ্ধ তরুণ ও শিক্ষিতদের মধ্যে এক নতুন রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি করেছিল। অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ হলেও বাংলাদেশে অনেক এনজিও সমাজের দরিদ্রতম স্তরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের উদ্ভাবনী উপায় অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সাফল্যের দেখা পেয়েছে। ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক, গণস্বাস্থ্য এবং এ ধরনের আরও অনেক এনজিও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত নতুন রাজনৈতিক সচেতনতা থেকে উদ্দীপনা লাভ করেছে।
আজকের পাকিস্তান ও বাংলাদেশ যেমন দাঁড়িয়েছে তার সামাজিক নির্দেশকগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ আপেক্ষিকভাবে উন্নতি কতটা লক্ষণীয়, সেটা তুলে ধরবে। সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশকে এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে, এখনো আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জন বাকি রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত দেশটি ব্যাপক মাত্রায় এক সেকেলে অফিসার বাহিনীর মধ্যে সম্পদ বণ্টনে সক্ষম সামরিকযন্ত্রের জাঁতাকলে পঙ্গু হয়ে যায়নি।
আমার পরিচিত বহু পাকিস্তানি বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশিরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অর্থনৈতিক ভার থেকে মুক্ত হয়ে এবং পাকিস্তানের অর্থনীতির সঙ্গে সেনাবাহিনীর শিকারিসুলভ সম্পর্ক থেকে সরে এসে ভালো করেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে আজকের পাকিস্তানে গেছেন বা নিয়মিত যাতায়াত করে থাকেন এমন যে কেউ, যেমনটা গত কয়েক দশকে আমি করেছি, স্বীকার না করে পারবেন না যে অল্প কিছু নিবেদিতপ্রাণ প্রান্তিক এনজিও ও ব্যক্তিবিশেষেরই কেবল প্রগতিশীল সামাজিক কর্মসূচি রয়েছে। এককালে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টির কর্মসূচি গড়ে তোলা ‘রোটি, কাপড়া, মাকান’ স্লোগানটিকে ১৯৭৭ সালের অভ্যুত্থানের পর ভুট্টোর সঙ্গে কবর দেওয়া হয়েছে। জেনারেল জিয়াউল হকের অধীনে যা চলেছে, সেটা হলো আফগানিস্তানের যুদ্ধ, সামরিক আশ্রয়ে দ্রুত বর্ধিষ্ণু হেরোইন ব্যবসা এবং একটি পরিপক্ব ও ভারসাম্যপূর্ণ জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিনিয়োগের জন্য প্রাপ্য অবশিষ্ট উদ্বৃত্ত তহবিলও শুষে নেওয়া পারমাণবিক কর্মসূচি-অনুপ্রাণিত একটি লোভনীয় সেকেলে অর্থনীতি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত যেকোনো ব্যক্তির অন্যতম যে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটি পাঠ করার কথা ভাবা উচিত, সেটি হচ্ছে আয়েশা সিদ্দিকার মিলিটারি ইন্ক, ইংল্যান্ডে প্লুটো প্রেস কর্তৃক ২০০৭ সালে এটি প্রকাশিত হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কীভাবে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও এর জনগণের কল্যাণকে ধ্বংস করেছে, এটা তারই কাহিনি।
পাকিস্তানের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস সিদ্দিকার গ্রন্থটি প্রকাশ করার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এর প্রকাশনার বিরুদ্ধে বেশ কয়েক মাসব্যাপী এক ‘অপারেশন’ চালিয়েছিল। লেখককে হয়রানি করা হয়, হুমকি দেওয়া হয়। পর্দার আড়ালেও ঘটেছে অনেক ঘটনা, ইসলামাবাদ ক্লাবে বইটির প্রকাশনাসংক্রান্ত একটি আলোচনা অনুষ্ঠান বাতিল করে দেওয়া হয়। স্পষ্টই এখানে এমন একটি গল্প আছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যেটা বলতে দিতে চায়নি।
কোনো দেশে ‘রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী সেনাদলের অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসন’ ঘটলে কী ঘটে তারই বর্ণনা দিয়েছেন সিদ্দিকা। পাকিস্তানে আজ সেনাবাহিনী ‘এক বিশাল বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য পরিচালনা’ করছে। উৎপত্তিগতভাবে ‘সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি’র কোনো স্বচ্ছতা নেই, যদিও সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন বা নিয়ন্ত্রিত ব্যবসার মোট মূল্য যেকোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্পগোষ্ঠীর সম্পত্তিকে ছাড়িয়ে যায়। সিদ্দিকার মতে, ‘সেনাবাহিনীর দুটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান—ফৌজি ফাউন্ডেশন এবং আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট—দেশের বৃহত্তম ব্যবসায়িক সংগঠন।’
এই কাঠামোকে তিনি বলছেন ‘মিলবিজ’ বা ‘মিলিটারি বিজনেস’ এবং মিলবিজকে ‘সেনাবাহিনীর, বিশেষ করে অফিসার ক্যাডারদের ভ্রাতৃত্ববোধের জন্য নিয়োজিত সামরিক মূলধন’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন, ‘প্রতিরক্ষা বাজেটের অংশ হিসেবে যার উল্লেখ নেই বা রাষ্ট্রের স্বাভাবিক জবাবদিহির প্রক্রিয়া অনুসরণ করে না, যা একে পুঁজির এক স্বাধীন ধরনে পরিণত করেছে।’ সিদ্দিকা যুক্তি দেখিয়েছেন, ‘এই মূলধনের প্রাথমিক সুবিধাভোগী হলো অফিসার ক্যাডার।’
অবশ্য তাঁর যুক্তি এর চেয়ে আরও গভীরে যায়। ‘নিজেদের স্বার্থের প্রতি অভিজাত গোষ্ঠীটি এমনভাবে আচ্ছন্ন যে তারা জাতীয় সম্পদ গ্রাসের দীর্ঘমেয়াদি তাৎপর্য উপলব্ধি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। “সর্বহারাদের”র জন্য তাদের ভেতর সামান্যতম বিবেচনাবোধ কাজ করে না এবং সম্পদের সামগ্রিক হ্রাসের মতো নেতিবাচক পরিণতি নিয়ে মাথা ঘামায় না। এই আচরণ একধরনের শিকারিসুলভ পরিবেশ সৃষ্টি করে।’ সিদ্দিকার মতে, এই ধরনের লুণ্ঠনবৃত্তি তাঁর ভাষায় ‘তস্করতান্ত্রিক পুনর্বণ্টনের’ দিকে চালিত করে। সেনাবাহিনী সামগ্রিকভাবে গোটা জনগণের নয়, বরং নিজের স্বার্থে দেশের সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে।
শেষ পর্যন্ত ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ ‘ধর্মীয় আদর্শের মতোই সংস্কার’-এ পরিণত হয় এবং ‘আর্থসামজিক উন্নয়নের চেয়ে বরং ভারত থেকে আসা বাহ্যিক হুমকিকে প্রতিরক্ষা খাতে বৃহত্তর বিনিয়োগ জায়েজ করার কাজে লাগানো হয়।’ অংশত এখানেই বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান কেন এত সামান্য উন্নতি করেছে, তার জবাব নিহিত। তবে এখানে অন্য একটি ক্ষতির বিষয় তুলে ধরেছেন সিদ্দিকা, ‘সাংবাদিক, রাজনীতিক ও মানবাধিকারকর্মীদের মতো সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা, যাঁরা সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের যৌক্তিকতা মেনে নিতে পারেন না, তাঁদের প্রায়ই নির্যাতনের মাধ্যমে বশ মানানো হয়।’
প্রাথমিকভাবে ১৯৭১ সালের আশা ও স্বপ্নের স্মৃতিচারণা দিয়ে সূচিত একটি নিবন্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক বর্ণনা গুরুত্বপূর্ণ কেন? বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনী স্পষ্টতই ইতিহাসের অংশ। কিন্তু তাই বলে এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মতো স্বৈরাচারী চরিত্র গ্রহণ করবে এবং একই ধরনের অর্থনৈতিক স্বার্থ গড়ে তুলবে? নিশ্চিতভাবেই এটা অবিশ্বাস্য একটা প্রশ্ন। কিন্তু আদতে কি তাই? এখানেই রয়েছে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের বিপদ।
৩.
২০০৭ সালের আগস্ট মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণ সেনাসদস্যরা এক ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রহার করলে একটি বিস্ফোরণমূলক ঘটনা ঘটে। তখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্থাপন করা ঘাঁটিতে অবস্থান করছিলেন সেনাসদস্যরা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সেনাক্যাম্প স্থাপনের বিষয়টি ছিল উসকানিমূলক। সামরিক কর্মকর্তারা সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি শান্ত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। চিফ অব জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল সিনহা ইবনে জামালির বক্তব্য সেই সময় সংবাদপত্রে উদ্ধৃত করা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, ‘আমরা অবশ্যই ছাত্রদের বক্তব্য বিবেচনায় নেব। আমরা তাদের অনুভূতিকে সম্মান দেখাব।’
এখানে ক্যাম্পাস থেকে সেনাবাহিনীর ঘাঁটি প্রত্যাহারের দাবি প্রতিফলিত হয়েছে। সেনাসদস্যের তরফ থেকে সম্ভাব্য অসদাচরণের কথা উল্লেখ করে জামালি আরও এক ধাপ আগে বাড়েন। ‘আমাদের বিধিবিধান অত্যন্ত কঠোর। কেউ অপরাধী প্রমাণিত হলে আমাদের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ জামালি ঢাকা মেডিকেল কলেজে আহত ছাত্রদের দেখতেও যেতে চেয়েছিলেন। জেনারেল শান্তির পতাকা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
অবশ্য সহকর্মীদের হাতেই জেনারেলের শান্তির পতাকায় জ্বলন্ত তেল পড়েছিল। স্পষ্টতই স্বার্থান্বেষী চক্র ক্রিয়াশীল ছিল। শান্তিপূর্ণ সমাধানে আগ্রহীদের অকস্মাৎ সরিয়ে দেওয়া হয়। ডিজিএফআইয়ের নেতৃত্বে বিশেষ বাহিনী ছাত্রদের শান্ত করার চেষ্টায় রত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন শিক্ষককে সহসা গ্রেপ্তার করে। রাজশাহীসহ অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটে। ঢাকায়ও অসংখ্য গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটে।
দেশকে আতঙ্ক গ্রাস করে নেয়। ডিজিএফআইয়ের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন টিম কর্মতৎপর হয়ে ওঠে এবং লোকজন গোপন জিজ্ঞাসাবাদের সেলে অদৃশ্য হতে থাকে। অধ্যাপক ও ছাত্রদের ওপর এখানে সমান হারে অত্যাচার চালানো হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ড. সাইদুর রহমান খানকে ডিজিএফআই পরিচালিত এক ‘যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ সেলে’ আট দিন আটকে রাখার পর স্থানীয় জেলে গছিয়ে দেওয়া হয়। সংকটাপন্ন অবস্থায় স্থানীয় কারা-কর্মকর্তারা তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তর করেন।
‘একাত্তরের প্রজন্মের’ মধ্যে এমন ভীতি তৈরি হয়েছিল যে সেনাবাহিনী তাদের শীর্ষ অবস্থান প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীনতার পর যেসব সামরিক স্বৈরাচার দেশ চালিয়েছে, তাদের চেয়েও কঠিন পথ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জিয়া ও এরশাদ তাদের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতায়ও যেখানে যেতে সাহস করেননি, জেনারেল মইন ও তাঁর সহযোগীরা কি সেদিকেই পা বাড়াতে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?
সেনাবাহিনী কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পাইকারি হত্যাকাণ্ড চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছিল, যেখানে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নিষ্ঠুরতম কিছু অত্যাচারের ঘটনা ঘটেছে? সেনাবাহিনী তেমন কোনো পদক্ষেপ নিয়ে নিপীড়নের আওতা বাড়ালে তখন প্রশ্ন দাঁড়াত, তারা কি নিজেদের কর্মকাণ্ডের পরিণতি সামাল দিতে সক্ষম হতো? বাংলাদেশ কি আগের জায়গায় ফিরে এসেছে?
আমেরিকান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির মতো বাংলাদেশের বিদেশি বন্ধুরা হস্তক্ষেপ করেন ও কর্তৃপক্ষের প্রতি সংযম বজায় রাখার এবং আটক লোকজনের ওপর নিপীড়ন বন্ধ করার আহ্বান জানান। কেনেডি সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তার করা ছাত্র ও শিক্ষকদেরও ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও শিক্ষকেরা গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্র-শিক্ষকদের মুক্তির দাবিতে আয়োজিত অহিংস বিক্ষোভে লক্ষণীয় ও উল্লেখযোগ্য সংযম প্রদর্শন করেন। আস্তে আস্তে আগস্ট ও ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি ঢাকা ও রাজশাহীর অধ্যাপকদের অবশেষে মুক্তি দেওয়া হয়, ধীরগতিতে উত্তেজনার প্রশমন ঘটে ও ব্যাপক রক্তপাত এড়ানো সম্ভব হয়।
এসব ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরেছে, এখনো যার জবাব মেলেনি। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কি ১৯৭১ সালের আশা ও স্বপ্নের সামান্যই অবশিষ্ট আছে এমন এক সেনাবাহিনীর কাছে নিরাপদ? শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্থনৈতিক উন্নতির পক্ষে মৌল অগ্রাধিকারের বিষয় হওয়া উচিত, এমন এক দেশে কী ধরনের সেনাবাহিনী থাকা উচিত, তা নিয়ে সম্ভবত এক নতুন বিতর্ক শুরু করা প্রয়োজন।
বৈশ্বিক উষ্ণতার অনুমিত পরিণতি সঠিক হয়ে থাকলে বাংলাদেশ আগামী দশকগুলোতে ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করবে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে জন টমাস কর্তৃক বাংলাদেশে ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ কনফারেন্সে উপস্থাপিত এক নিবন্ধে রক্ষণশীলভাবে অনুমান করা হয়েছে যে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে ওঠার কারণে আগামী ২০ বছরে ১৫-২০ মিলিয়ন মানুষকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই পুনর্বিন্যাস করতে হবে।
প্রচলিত ধারার ব্যয়ের দিকে ঝুঁকে থাকা একটি গতানুগতিক ধারার সেনাবাহিনী কখনোই বাংলাদেশের মোকাবিলা করা অপ্রচলিত চ্যালেঞ্জের সমাধানের অংশ হতে পারে না। তা ছাড়া, গভীরভাবে নিজের কাজে নিমগ্ন ও নিজস্ব অফিসারদের জন্য একটি ‘সোনার কারাগার’ নির্মাণের লক্ষ্যে অটল একটি সেনাবাহিনী কোনোভাবেই সাধারণ নাগরিকেরা লাভবান হবে, এমন উন্নয়ন পরিকল্পনায় আগ্রহী বা অংশগ্রহণকারী শক্তি হতে পারে না।
প্রকৃতপক্ষেই, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ক্রমবর্ধমান হারে যেন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদলে নিজেকে গড়ে তোলার পথে অগ্রসর হচ্ছে। গত আগস্টে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ক্রমবর্ধমান ব্যবসায়িক স্বার্থের ওপর বিবিসির এক প্রতিবেদন ব্যাংকিং ও অর্থনীতির অন্যান্য প্রধান খাতে ব্যাপক বিনিয়োগের বর্ণনা দিয়েছে। ‘এটা এখন পরিষ্কার,’ লিখেছেন বিবিসি সাংবাদিক, ‘বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী মোটা দাগে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে তাদের পাকিস্তানি প্রতিপক্ষের প্রণীত মডেল অনুসরণ করছে।’
বিবিসি প্রতিবেদন যেটা উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেটা হলো পাকিস্তানি ‘সামরিক ব্যবসা’র মডেলের ‘সাফল্য’ই আয়েশা সিদ্দিকা এত জোরের সঙ্গে তাঁর মিলিটারি ইন্ক-এ তুলে ধরেছেন। সিদ্দিকা যুক্তি দেখিয়েছেন যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ‘করপোরেটিজম’ সামরিক স্বৈরাচারের দীর্ঘ শাসনামলে বারবার নিজের স্বার্থ রক্ষা করে আসা এক বিচ্ছিন্ন ও সুবিধাপ্রাপ্ত ক্রমবর্ধমান সামরিক বাহিনীর বিকাশের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে আগ্রসর হয়েছে।
৪.
প্রায় ৩০ বছর আগে মুক্তিবাহিনীর এক সাবেক সদস্য আবু ইউসুফ খান আমার সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা থেকে বিমানে চেপে কলকাতায় এসেছিলেন। ১৯৭০-এর দশকের গোড়া থেকেই ইউসুফকে চিনতাম। তখন বাংলাদেশে ছিলাম আমি। মুক্তিযুদ্ধের আগে ইউসুফ পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কাজ করতেন। এই মিতভাষী ও ভাবুক মানুষটির ভেতর উল্লেখ করার মতো অনেক কিছুই ছিল। একটা বিষয়ে তিনি অত্যন্ত গর্ব করতেন যে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দিন তিনিই প্রথম মুক্তিবাহিনীর প্রথম ইউনিটের ঢাকায় প্রবেশে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষেই ইউসুফের ইউনিটটি জেনারেল নিয়াজির হেডকোয়ার্টার্সে পৌঁছানো প্রথম মিলিটারি ইউনিট ছিল। ঢাকায় ইউসুফের বাড়িতে যদি বেড়াতে যেতেন আপনি, তাঁকে ভদ্রভাবে অনুরোধ জানালে নিয়াজির স্টাফ কার থেকে খুলে নেওয়া পাকিস্তানি পতাকা আপনাকে দেখাতেন তিনি।
স্বাধীনতার পর আবু ইউসুফ খানকে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বিশেষ সম্মাননা ‘বীরবিক্রম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়, মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য এটা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেতাব। জীবিতদের মধ্যে ‘বীরোত্তম’ সর্বোচ্চ, আর যেসব বীরযোদ্ধা প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের সর্বোচ্চ খেতাব ‘বীরশ্রেষ্ঠ’।
কলকাতায় ইউসুফের সঙ্গে দেখা হয় আমার, বেশ কয়েক বছরের কারাবাসের পর তখন মুক্তি পেয়েছিলেন তিনি। তিনি ছোট ভাই কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে পরিচালিত ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন। এটা এমন এক অভ্যুত্থান, যা বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর জনগণের স্বার্থ তুলে ধরে এই প্রক্রিয়ায় ‘উৎপাদনশীল সেনাবাহিনীতে’ পরিণত হওয়ার একটি ছবি তুলে ধরেছিল। নিজেদের তারা নিবেদিতপ্রাণ সমাজতন্ত্রী মনে করতেন। অবশ্য আবু ইউসুফ খান কোনোভাবেই অন্ধ মতানুসারী ছিলেন না। আমি তাঁর এই গুণের কদর করতাম।
আমার সঙ্গে দেখা করতে কলকাতায় এসেছিলেন ইউসুফ, কারণ সেই বছরগুলোয় বাংলাদেশে আমি নিষিদ্ধ ছিলাম। আমার লেখা একটি বই জেনারেল জিয়া বা তাঁর সহযোগীদের পছন্দ হয়নি। অন্যান্য প্রসঙ্গের ভেতর এই বইটি শেখ মুজিবকে হত্যাকারী সামরিক অভ্যুত্থানে জেনারেল জিয়ার গোপন সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আলোচনা করেছে। বিশেষ করে, অভ্যুত্থানের আগে মেজর রশীদ ও মেজর ফারুকের দলের সঙ্গে জেনারেল জিয়ার পূর্ব যোগাযোগ এবং খোন্দকার মোশতাকের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তুলে ধরেছে। এই কারণে কলকাতায় দেখা করতে হয়েছিল আমাদের। তখনকার সময়ে আমার পক্ষে ঢাকায় যাওয়া সম্ভব ছিল না, কিন্তু ইউসুফের সাক্ষাৎকার নেওয়ার দরকার ছিল; তাই তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে কলকাতায় এসেছিলেন।
আজকে যখন বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও এর বিশাল করপোরেট সাম্রাজ্য সম্পর্কে পড়ি, ইউসুফ ও তাঁর মতো মানুষগুলোর কথা মনে পড়ে আমার, যাঁরা মুক্তিবাহিনীতে লড়াই করেছিলেন। উচ্চ আদর্শ ও দেশের উন্নত ভবিষ্যতের গভীর আশায় অনুপ্রাণিত ছিলেন তাঁরা। কারাগার থেকে মুক্তির পর ইউসুফ বিশেষ একটি বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। কলকাতায় আমাদের দেখা হওয়ার পরপর তিনি প্রায়ই ইংল্যান্ডে আমাকে লিখতেন। আমি তখন ওখানে বাস করছিলাম। পড়ার বিষয়বস্তুর খোঁজ করছিলেন তিনি। বেশ আগ্রহী ছিলেন কোস্টারিকার ব্যাপারে। প্রথমে একে আমার কাছে অদ্ভুত ঠেলেও অচিরেই এ আগ্রহের কারণ বুঝতে পেরেছিলাম।
অবশেষে, আমি কোয়েকারস থেকে প্রকাশিত ছোট্ট একটা বই খুঁজে পেয়েছি যাতে ওঠে এসেছে কোস্টারিকার রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের ইতিহাস। ১ ডিসেম্বর, ১৯৪৮, কোস্টারিকার প্রেসিডেন্ট হোসে ফিগারেস ফেরার কোস্টারিকার সশস্ত্র বাহিনী বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। দেশের অন্যতম সামরিক দুর্গের প্রাচীরের কাছে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে স্লেজহ্যামার নিয়ে ‘সাংস্কৃতিক বেলাভিস্তার’ দেয়াল ভেঙে ফেলে কোস্টারিকার সামরিক চেতনার প্রতীকী অবসান তুলে ধরেন তিনি। এই বছরই এক রক্তাক্ত যুদ্ধের অবসান ঘটেছিল।
১ ডিসেম্বর ১৯৪৯ সালে সেনাবাহিনীর বিলোপ কোস্টারিকার সংবিধানে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধারা হিসেবে সংযোজন করা হয়। সাবেক সামরিক বাজেট শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি ও নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ করা হয়। কোস্টারিকা অসামরিক পুলিশ বাহিনী চালু রেখেছে, এর কোনো সেনাবাহিনী নেই। ১৯৮৬ সালে কোস্টারিকার প্রেসিডেন্ট ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অসকার আরিয়াস সানচেস ১ ডিসেম্বরকে ‘সামরিক বাহিনী বিলোপ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন, প্রতিবছর রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে দিনটি পালিত হয়। কোস্টারিকার নাগরিকেরা আপনাকে বলবেন, সেনাবাহিনী বিলুপ্ত ঘোষণার পর কোস্টারিকার অভ্যন্তরে খুবই নগণ্যসংখ্যক অপরাধমূলক ঘটনা ঘটেছে।
আমি বিশ্বস্ততার সঙ্গে বলতে পারি, আবু ইউসুফ খান কোস্টারিকাবাসীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। হোসে ফিগারেস ফেরারকে খুবই বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ও নীতিমান মানুষ মনে করতেন তিনি। বাংলাদেশের খুব বেশিসংখ্যক মানুষ ইউসুফের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত হবেন না। অবশ্য, আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্মৃতিময় একটা বছরের দিকে অগ্রসর হচ্ছি, আমার বিশ্বাস, নিয়াজির পতাকা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন যিনি, যাঁকে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য ‘বীরবিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়েছিল, তাঁর মতাদর্শ মানুষের কাছে স্মরণীয় থাকবে—এই প্রত্যাশা তিনি করতেই পারেন। ইউসুফকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন, ‘৭১-এর প্রজন্মে’র কাছে ইউসুফ একজন সম্মানিত ব্যক্তি।
ইউসুফ আর এখন বেঁচে নেই, যদিও তাঁর স্মৃতি তাঁকে যাঁরা চিনতেন তাঁদের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই বেঁচে আছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বর্তমান গতিপ্রকৃতি থেকে আমার মনে হয়, আবু ইউসুফ খানের মতামত আমলে নেওয়া হওয়া উচিত। সুতরাং আমি বাংলাদেশের জনগণের কাছে ইউসুফের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরছি। তিনি বিশ্বাস করতেন, বিশাল সামরিক প্রতিষ্ঠান রক্ষণাবেক্ষণের আর্থিক ভার ও অপচয় অযৌক্তিক ও অবর্ণনীয় ভোগান্তির উৎস। প্রকৃতপক্ষেই, ফেরারেরও একই অবস্থান ছিল। তাঁরও উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ রেকর্ড ছিল। আবু ইউসুফ খান ও হোসে ফিগারেস ফেরার একটি বিষয়ে একমত ছিলেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে প্রচলিত সেনাবাহিনীর একটি বিকল্প হচ্ছে সেনাবাহিনী একেবারেই না থাকা। আবু ইউসুফ যেমন বলতেন, ‘ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে দেখা যেতে পারে।’
লেখাটা পড়ার আগে একটা কথা বলে নেয়া যাক। ওদের জানিয়ে দাও বইটা এখনো খুঁজে বেড়াচ্ছি। আপনি যে বড় যন্ত্রণা করেন, জানেন? কী সুন্দর করে লেখেন, তারপর সেই বই পড়ার তুমুল ইচ্ছা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়।
সাগর পাবলিশার্সে পাবেন বইটা।
প্রশ্ন করা উচিৎ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পাকি মডেলের কতটুকু ফলো করে না?
ভাইয়া, বেশ গুরুত্বপূর্ণ লেখা।
আমার ভাতিজি দেশের বাইরে পড়াশোনা করে, সে জানালো, তার সাথে যেসব পাকিস্তানি ছেলে-মেয়ে পড়ে, তারা '৭১-এ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পৈশাচিকতার কথা কিছুই জানে না।
"আজ পাকিস্তানকে এর অতীতের ভয়ংকর অধ্যায়ের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে বলা উচিত।"- আমিও তা মনে করি।
প্রিয়তে নিলাম। একটানে পড়লাম। এসব লেখা পড়তে ভালো লাগছে। কত কি জানছি!মাসুম ভাইকে ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য।
চমৎকার একটা লেখা।
ধন্যবাদ শওকত মাসুম। আপনার এই লেখা গুলো নিয়মিত আসুক। অনেক কিছু জানার থাকে আপনার প্রতিটা পোস্টে।
পড়ে গেলাম। আমাদের সোনার দেশটা কেন এত পিছে পড়ে আছে তার কারন বুঝতে পারছি।
মাসুম ভাই, এই লেখাগুলো এত নিশ্চিন্ত মনে কিভাবে ব্লগে পোস্ট করে যাচ্ছেন? যেকোন সময় যেকোন কারণে এগুলো আপনার বিরুদ্ধে অজুহাত হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে আপনা-আপনিই। ২০-২২ আগস্টের ছাত্র বিক্ষোভের সময় খুব কাছ থেকে দেখেছি, কিভাব সেনাবাহিনী প্রয়োজনে নিজেদের জন্তুরও অধম বানিয়ে ফেলতে পারে। বিষয়টা নিয়ে আপনার আরো ভাবা উচিত বলে মনে করি।
মীরের সাথে পুরা একমত। মাসুম ভাই, এসব পোষ্ট দেয়ার আগে ভাবা উচিত।
আমারও এই ব্যাপারে ভয় হচ্ছে।
পড়লাম এবং জানলাম অনেককিছু...।
চমৎকার একটা লেখা।
ধন্যবাদ শওকত মাসুম। আপনার এই লেখা গুলো নিয়মিত আসুক। অনেক কিছু জানার থাকে আপনার প্রতিটা পোস্টে।
পড়লাম। মাসুমভাই, আপনাকে স্যালুট। প্রথম আলোতে মিস করেছিলাম লেখাটা।প্রিয়তে।
এখনও পাকিরা ১৯৭১এর অপকর্ম যথাসাধ্য ঢেকে রাখতে চেষ্টা করে।
পড়েছি আগেই!
ধন্যবাদ বস
"প্রচলিত সেনাবাহিনীর একটি বিকল্প হচ্ছে সেনাবাহিনী একেবারেই না থাকা। আবু ইউসুফ যেমন বলতেন, ‘ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে দেখা যেতে পারে'।" সত্যিই তো ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে দেখা যেতে পারে ।
মন্তব্য করুন