শুকনো পাতায় শূন্যতা
এর আগে কখনো রাতে বাইরোডে যাতায়াত করিনি।
রাতের ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছি, যেতে হচ্ছে। পরপর পেরিয়ে যাচ্ছি একটি একটি করে শহর, শহরতলী বা গ্রাম। স্নায়ুর চাপে কোনকিছুই ঠিকঠাক চিনতে পারছি না, নইলে এই যাত্রা উপভোগ করা যেত। রাত বাড়ছে কিন্তু গাড়ি চলাচল কমেনি। রাস্তার দুধারে দোকানপাট বেশীর ভাগই খোলা, এমন কি মধ্যরাতেও দোকানির ঝাঁপ তোলা দেখে অবাক লাগল। এরা কি সারা বছর এভাবে রাত্তিরেও বেচাকেনা করে নাকি রোজার রাত বলে এমন বুঝতে পারলাম না।
গাড়ির চালক রাত বলে প্রচন্ড সাবধানী। মাঝে মাঝেই বেজে উঠছে মুঠোফোন এর ওর হাতে। এক একবার ফোন বাজার সাথে সাথে বুকের মধ্যে ঘাই মেরে উঠছে যন্ত্রণা। আর কতদূর, এ যাত্রা শেষ হয় না কেন! মাঝে দুবার আমাদের আবার ঢাকা ফিরে যাবার জন্য ফোন এলো, পরক্ষণেই আবার জানালো, না ঠিক আছে দ্রুত পৌঁছে যাও। পথকে যদি কোনভাবে ছেঁটেকেটে ছোট করা যেত তবে আমরা তাই করতাম। থেকে থেকে গাড়ির চালক সোচ্চার হচ্ছে পথের দুর্দশা নিয়ে, আমরা চুপচাপ শুনে যাচ্ছি। পথ ফুরয় না কেন?
ময়মনসিংহে এসে গাড়ির চালক দুম করে ঘুরপথ ধরল ওর গাড়ি বাঁচাতে। ভাড়া করা গাড়ি, আমরা কীই বা করতে পারি! তবু অনুনয় করি, বারবার বলি এ পথে সময় অনেক বেশী লাগবে, দয়া করো ভাই- ও পথে যেও না।
শোনেনি সে—তার কাছে তার গাড়ির মূল্য অনেক বেশী।
মুঠোফোন বাজছে আবার। এইমাত্র জানাল, ওরা ঢাকার দিকে যাত্রা শুরু করেছে, আমাদের বলা হলো পরবর্তী সিদ্ধান্ত না দেওয়া পর্যন্ত পৌঁছে অপেক্ষা করতে। আমরা তখনও ঘুরপথে কানামাছি খেলছি। কখন পথ শেষ হবে?
অবশেষে নিজের শহরে ঢুকতে ঢুকতে চারপাশে এদিক ওদিক তাকালাম-সব কেমন অচেনা ঠেকছে, হয়ত রাত্তির বলে; হয়ত অনিশ্চয়তা অত্যধিক, কে জানে।
বাড়ির ফটকের সামনে গাড়ি থামল।
চুপচাপ যে যার মতো। সেহেরীর খুব অল্প সময় বাকি। নিঃশব্দে টেবিলে বসে সামান্য কিছু মুখে তুলে নেওয়া, এক কাপ গরম চা পাওয়া গেলে তখনকার মতো যেন একটু স্বস্তি পাওয়া গেলো। আজান পড়বে এখনই, আর—এক্ষুনি-- ফোন এলো, ওরা ফিরছে। দেওয়ালে ক্যালেন্ডারের পাতা হাওয়ায় হঠাৎ দুলে গেলো।
শূন্যতার পাথর চাপা দেওয়া সময়, ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে চায় না কেন যেন।
ওরা এলো, চারদিকের নিস্তব্ধতার মাঝে ওদের গাড়ি এসে পৌঁছে গেলো। সন্তর্পণে ওরা উঠে এলো।
মা’র মুখের দিকে তাকালাম আমি। দিদি বলল- এখানে নয়, বাবা ঘরে আসতে চেয়েছিল, ঘরে নিয়ে চলো। বোন পিছনে, আড়াল করে আছে ওর মুখ।
খুব সাবধানে বাবাকে ওরা বাবার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গেলো। আমার বাবার মুখ ছুঁয়ে বসে আছি। এই প্রথমবার আমি আমার বাবার শরীরের উত্তাপ পাচ্ছি না, বাবার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে।
আমার সদা হাসিমুখের, সদা কর্মব্যস্ত বাবা; আমার আলোর মানুষ, আমার বন্ধু আজ বিশ্রাম নিচ্ছে।
আজ কেন তুমি চোখ বন্ধ করে আছ বাবা? বোধ হবার পর থেকে কোনদিন দেখিনি তুমি আমার আগে ঘুমিয়েছ। তুমি ঘুমাতে কখন সেটাই আমরা কখনও বুঝতাম না। আজ কেন তুমি ঘুমিয়ে আছো! এই তো ভোরের আলো, এই তো আমরা জেগে- বাবা তুমি কেন ঘুমিয়ে...
ছোটবেলার কাজ সেরে ফেরা পাপার কোলে পাপার জেটপাখি, জেটপাখির গালে আদর করে নাক ঘষে দেওয়া পাপা; আমি তোমাকে ছুঁয়ে বসে আছি, তুমি একবার আমায় শুধু মা বলে ডাকো।
..............................
কেমন আছেন তানবীরা?
আহারে!বুকের ভেতর শূণ্যতা হাহাকার করছে। কিছুই বলার মত খুঁজে পাই না। ভালো থাকেন।
চেষ্টা করছি জয়িতা।
জেটপাখির জন্য আদর।
তারার হাসি, অনেক ধন্যবাদ।
লেখাটায় কি মন্তব্য করা যেতে পারে বুঝতে পারছি না।
শুধু পড়লেই অনেক কিছু বলা হয়ে যায় মীর।
ঠিক এই কথাটা আমারো মনে হয় মেঘদি'।
ব্যপার্স না, গ্রেট মেন থিংক এলাইখ।
লেখাটা হৃদয় ছুঁয়ে গেল। দিলেন তো মনটা একেবারে খারাপ করে!
আমার মন খারাপ থেকে হঠাৎ লেখা হয়ে গেলো। কী করি এখন!
অনেক অনেক বেশি মন খারাপ হৈলো লেখাটা পৈড়া।
স্মৃতিটাতো সাথে থাকবেই, শুধু আশা করি আপনার মন খারাপটা কেটে যাবে...ভালো থাকবেন।
চেষ্টা করে যাচ্ছি শাওন।
গতকাল যখন লগাউট হচ্ছিলাম তখনই 'মেঘ' নামের নিকটাতে চোখ পড়েছিলো। আশ্চর্য সুন্দর মায়াবী এই মেঘ আজ যে বৃষ্টি ঝরালো, তাতে আপাদমস্তক ভিজে গেলাম, কেঁপে উঠলাম। শব্দের চোখে জল আর চেনা দুঃখের ছায়াটা দেখে খানিকটা বসে গেলাম মেঘ বোনটির পাশে। এই শোকের কোনোই স্বান্তনা হয় না। হতে পারে না। তবুও জীবনের
তাগিদেই উঠে দাঁড়াতে হয় আমাদের। প্রয়োজনই করিয়ে নেয় সে কাজটা। বাবার এই জেটপাখিটাও নিশ্চয়ই পারবেন, শোকের চোখে চোখ রেখে বলতে, "হে শোক আমি অশোক হবো।" কারণ, আমাদের বাবা কিংবা মায়েদের আক্ষরিক অর্থে মৃত্যুই হয়না। সন্তান নামের এই আমরা তাঁকে-তাঁদের বুকের ভেতর বহন করে চলি আজীবন। চেয়ে দেখুন মেঘ, ঐ দূরে রঙধনুদের রাজ্যে বসে আপনার বাবা কেমন আগ্রহভরে চেয়ে আছেন।তাঁর জেটপাখির আগুনপাখি হয়ে ওঠা দেখবেন বলে.........এধরনের পোষ্টে এত কথা বলাটা হয়ত শোভন নয়, কিন্তু চেনা দুঃখ বলেই হয়ত তার চিবুক ছুঁয়ে দেবার তাগিদ তীব্র হলো, নইলে -------------
" যে শব্দ আমার নয় তাকে আমি কেন ব্যবহার করবো
এমন সোনার বরন কাঁচা দুঃখের মন্ডপে...."
প্রার্থনা থাকলো, মন খারাপের দুঃখপাখিটা উড়ে যাক দূরে অনেক দূরে।
শুভেচ্ছা নিরন্তর।
বাতিঘর, আমার শব্দে যতটা জল ছিলো, আপনার অল্প কথায় তা ভারী বর্ষণ হয়ে পড়লো যে।
বাবা স্ফুলিঙ্গ হয় বাঁচতে বলতেন, কিছুই হয়ত তার সম্ভব হয়নি। আমি সেই জল মেঘের মধ্যেই রয়ে গেলাম, তবু বাবার জন্য আমি একটিবার হলেও বিদ্যুতশিখা হয়ে উঠতে চাই।
.. শব্দের চোখে জল আর চেনা দুঃখের ছায়াটা দেখে........বাতিঘরের কাছ থেকে ধার নিলাম বাক্যটা।..... আজ সকালে আমার কন্যার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অফিসে আসার সময় বুকের কোথাও বেজে উঠলো হারানো সুর। আপনার লেখাটা পড়ে সেই সুরটা আরো করুন হয়ে বাজলো তেরো বছর আগের একটা বাঁশী।
সেই হারানোর অনুভূতি সবার জন্যই এক হয়ত, তবু কারও বুকে ওই বাঁশী থেকে থেকে বড় বেশী করুণ সুরে বাজে।
শুভেচ্ছা।
এই পোষ্টটাতে বারবার ঘুরেফিরে আসছি। সাদা তুলার মেতা আকাশে ঘুরেফিরে বেড়ানো শরতের সাদা মেঘ, আপনার জন্য শুভকামনা নিরন্তর। ভালো থাকার চেষ্টা করেন।বাবা সাথেই তো আছেন আপনার। বুকের ভেতর।
বাবা সাথে, বাবা পাশে, বাবা বুকের ভেতর এই বোধেই তো চলার চেষ্টা করছি জয়িতা।
এবিতে প্রথম পোস্ট পড়লাম। কিছু বলার নেই আপু। সত্যি কিছু বলার নেই।
এবি তে আপনার প্রথম পড়া পোস্টে প্রথম মন্তব্য, শুভেচ্ছা নিরন্তর।
মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো.।নিজের অনুভূতি খুঁজে পেলাম লেখাটায়..।আব্বুটা আছে বুকের ভেতর সবসময়....।
আছে তো, যখনই মন চায় ফিসফিসিয়ে বাবাকে বলি আনন্দের কথা, কষ্টের কথা। বাবা সব শোনে কিন্তু কথা বলে না যে....।
লেখাটা অনেক জীবন্ত হয়েছে। যেন জষ্টগুলো ছুঁতে পারছি। দেখতে পারছি চোখের সামনে ঘটনাটা।
ধন্যবাদ শাপলা।
.................।
ভালো থাকুন মেঘ
ধন্যবাদ নুশেরা।
অনেক দিন নতুন লেখা নাই
চিপায় পড়ছি রে ভাই। বেশী লিঙ্ক রাখনের যন্ত্রণা আর কি। আবার লেখলে এখানে দেব আগে।
ভাল থাকেন।
ধন্যবাদ আপনাকে।
মন্তব্য করুন