বিলাসিতা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যান জহুরুল হক। এই প্রথম তিনি চ.বি. ক্যাম্পাসে এসেছেন। চট্টগ্রামে এসেছেন দ্বিতীয়বারের মতো। তিনি থাকেন লক্ষীপুরে। শিক্ষকতা করেন একটি প্রাইমারী স্কুলে। গ্রামে গাছ-পালা, লতা-পাতা, ক্ষেত-খামার, পশু-পাখি দেখে তিনি অভ্যস্ত। তবুও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নম্বর গেট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলস্টেশন পর্যন্ত সড়কের দু’ধারে সারি সারি বৃক্ষ দেখে তিনি আপন মনে বললেন, বাহ ! কি সুন্দর !
অনাহূত ধর্মঘটের কারণে চবি’র ক্লাস স্থগিত। কিন্তু অনার্স ভর্তি কার্যক্রম চালু রয়েছে।প্রশাসনিক ভবনও সচল।শুধু ট্রেন চলছে না। হয়তো চলবে, তবে কোন শিক্ষার্থী থাকবে না। জহুরুল হক তার কন্যা নিঝুমকে নিয়ে অনেক্ষণ সময় পর্যন্ত বটতলীতে ভার্সিটির ৮টা ২০মিঃ এর ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু ট্রেন চলার কোনো সম্ভাবনা দেখতে না পেয়ে তিনি একটা সি.এন.জি ডাকলেন। ট্রেনে করে যাওয়ার পেছনে দুটি কারণ ছিল।প্রথম কারণ,তিনি কখনো ট্রেনে চড়েন নি,তাই ট্রেনে চড়ার একটা শখ পূরণের ইচ্ছা ছিল। আর দ্বিতীয় কারণ ছিল, ট্রেনে করে গেলে বিনা ভাড়ায় যেতে পারতেন। এতগুলো টাকা সি.এন.জি ভাড়া দিতে হতো না।
সি.এন.জি ক্যাম্পাসে ঢুকাবেন কি ঢুকাবেন না ভেবে অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটেই নেমে পড়লেন তিনি। নিঝুমকে নিয়ে নাস্তা খাওয়ার জন্য মউয়ের দোকানের দিকে গেলেন। নাস্তার অর্ডার দিলেন। পরোটা-ভাজি। ভাজিতে এক হাঁটু পানি দেখে মানে ঝোল দেখে চমকে উঠলেন তিনি। দোকানের ছোট ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাজিতে ঝোল কেন?
ছেলেটা জবাব না দিয়ে জহুরুল হক সাহেবের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল আর বুঝে নিল নতুন পাবলিক। কারণ নতুন আসা যে কেউ এই ভাজি দেখার পর এ জাতীয় বিস্ময় ভরা প্রশ্ন করবেই। সে এটা দেখে অভ্যস্ত।
জহুরুল হক সাহেব নাস্তা খেয়ে নিঝুমকে নিয়ে কাটা পাহাড়ের রাস্তাটা কড়া রোদ মাথায় করে হেঁটেই পার হন। পাহাড় ঘেরা ক্যাম্পাসে বৃক্ষরাজির অকৃত্রিম নিবিড়তা দেখতে দেখতে তিনি পৌঁছে যান সদ্য নির্মিত আইটি ভবনে।
জহুরুল হক সাহেবের ২য় কন্যা নিঝুম এবার চবিতে ভর্তি পরীক্ষায় “ক” ইউনিটের ফিজিক্যাল সায়েন্সে ১১তম স্থান অর্জন করে কম্পিউটার সায়েন্সে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে।
কন্যাকে নিয়ে নবনির্মিত আইটি ভবনের মোজাইককৃত সিঁড়ি পেরিয়ে উপরে উঠতে গিয়ে নিজের মনেই তিনি চাপা অস্বস্তি টের পান। মনে মনে ভাবছেন,পারবেন তো তিনি মেয়ের শখ পূরণ করতে! আইটি ভবনের ঝকঝকে, তকতকে, পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন করিডোর, রুম, পরিবেশ সবকিছুই ভালো লাগছে জহুরুল হক সাহেবের।তিনি নিঝুমের দিকে তাকান।হাসলে মেয়েটাকে খুবই চমৎকার লাগে। তবে নিঝুম কথাবার্তা বলে খুবই কম। বাবার মতো বকবক করা স্বভাব পায়নি। জহুরুল হক সাহেব যেখানেই যান সেখানেই মোটামুটি একটা আসর জমিয়ে ফেলেন। মানুষটার প্রিয় শখ হচ্ছে গল্প করা। যে কোনো তুচ্ছ বিষয় নিয়েও তিনি দারুণ গল্প করতে পারেন। তার স্ত্রী রেবু অবশ্য তার এই বকবকানি নিয়ে খুবই বিরক্ত। কিন্তু তাতে তি্নি মোটেও বিচলিত নন। স্ত্রীরা স্বামীদের প্রায় কাজেই বিরক্ত হন এটা খুবই স্বাভাবিক। আবার স্ত্রীরা স্বামীদের অতি তুচ্ছ কথায় মু্গ্ধ হয়ে গলে যান। এগুলো নিয়েই সংসার। নিঝুম পেয়েছে তার মায়ের স্বভাব। রেবুও কথাবার্তা কম বলে।
ভর্তি কার্যক্রম শেষ করতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগলো। প্রথমে অফিসরুম থেকে ফর্ম নিতে হলো। বেশ কিছু কাগজপত্র পূরণ করতে হচ্ছে।ফর্মের কোনো ঘরের তথ্য নিয়ে কোনো কনফিউশন হলেই নিঝুম ছুটে যাচ্ছে অফিসরুমের দিকে।এখানে কি লিখব? এখানে এটা হবে কিনা? এটা ঠিক আছে কিনা?এ জাতীয় প্রশ্ন নিয়ে।
নিঝুমের আশেপাশে আর ও কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী আছে। সবারই এক অবস্থা।ভর্তি কার্যক্রম শেষ করে জহুরুল হক মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,আজ থেকে তুমিও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী। কেমন লাগছে, মা?জহুরুল হক সাহেব মেয়েদেরকে সব সময় মা বলেই ডাকেন।সম্বোধনও করেন তুই ,তুমি মিলিয়ে।
নিঝুম বাবার কথায় মুচকি হেসে বলল, ভাল।
কথা শেষ করে সে রাস্তার বালিতে শব্দ করে জুতা টানছে।বিশ্রী শব্দে গা শির শির করে উঠছে জহুরুল হক সাহেবের।তবু তিনি মেয়েকে কিছু বললেন না।আজ মেয়েটার খুব আনন্দের দিন।
ভর্তি কার্যক্রম অবশ্য এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। কারণ এখনো ব্যাংকে টাকা জমা দেয়া হয়নি। টাকা জমা দেয়ার ডেট আরো পরে।
সুযোগ পেলেই ঘুরে বেড়ানোর শখ জহুরুল হক সাহেবের। অবশ্য সময় আর সাধ্যি তাকে খুব কমই সুযোগ দিয়েছে ঘুরে বেড়ানোর ।মেয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া শেষে মেয়েকে নিয়ে চবি ক্যাম্পাসটা ঘুরে দেখছেন তিনি। লাইব্রেরী, জারুলতলা, চাকসু, ঝুপড়ি থেকে মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউট পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে দেখলেন তিনি। ঝুপড়ি দেখে খুবই অবাক হলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝুপড়ি! এটা আবার কী? অবশ্য শুধু তিনি নন, যে কেউ প্রথম ঝুপড়ি কথাটা শুনলে এবং দেখলে কিছুটা অবাক হয়।
হাঁটতে হাঁটতে এক ফাঁকে জহুরুল হক সাহেব নিঝুমকে বললেন, মা তুমি নিজের যোগ্যতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সের মতো এমন একটা সাবজেক্টে পড়ার সুযোগ পেয়েছ এটা ভাবতেই গর্বে আমার মনটা ভরে উঠে।আমার মতো একজন হতদরিদ্র মানুষের কাছে এটা আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো দুর্লভ সুখ। যে সুখের কোনো সীমারেখা নাই। আল্লাহপাকের কাছে লাখ লাখ শোকরানা আদায় করছি আমি।
নিঝুম খেয়াল করলো, অতি আনন্দে তার বাবার চোখে পানি চলে এসেছে।
জহুরুল হক সাহেব চোখ মুছে আবার বললেন, কিন্তু মা একটা ব্যাপারে আমি খুবই চিন্তিত।
নিঝুম বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, কি ব্যাপারে চিন্তিত বাবা?
জহুরুল হক সাহেব বলবেন না বলবেন না করেও শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললেন, তোমার ভর্তিতে প্রায় ছয়-সাত হাজার টাকা খরচ পড়ে যাচ্ছে। থাকা-খাওয়া,আসা-যাওয়া খরচ বাদে। ভাবছি এ মাসটা চলব কি করে? তোমার জন্য একটা কম্পিউটারও কিনতে হবে। সেখানে কত টাকা লাগবে কে জানে?এছাড়া তোমার থাকা, খাওয়া, পড়াশোনার খরচ...।
নিঝুমের চেহারাটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়।বাবার দিকে তাকায় না সে। জারুলতলায় দাঁড়িয়ে আইটি ভবন আর লাইব্রেরীর সম্মুখভাগে লাল ইটের কারুকার্য দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। বাবার কথাগুলো তার কাছে খুবই অদ্ভুত লাগছে। বাবা মোটামুটি পাগলাটে স্বভাবের মানুষ। পড়াশোনা আর গল্প করা এ দুটি বিষয়ে দারুণ নেশা তার। বৈষয়িক ব্যাপারগুলো এ মানুষটা বোঝেন না এবং বুঝতেও চান না। সেই মানুষটার মুখে বৈষয়িক ভাবনার কথা শুনে সত্যিই অবাক লাগছে নিঝুমের।।
জারুলতলায় অনেকগুলো ছেলেমেয়ে ছোট ছোট দলে গল্প করছে ,আড্ডা দিচ্ছে। নিঝুম সেদিকে তাকাতেই জহুরুল হক সাহেব বললেন, মা, একজন বাবার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা কি জানিস?
নিঝুম চুপ করে থাকে।
সন্তানের কোনো সাধ পূর্ণ করতে না পারার ব্যর্থতা, বললেন জহুরুল হক সাহেব।
মাগো তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্নটা সত্যি করার এই দুঃসাহসিক চেষ্টা আমার মতো একজন সামান্য স্কুল শিক্ষকের জন্য বিলাসিতা হয়ে গেল কিনা বুঝতে পারছি না।মা রে,তুই তোর হতভাগ্য পিতাকে ক্ষমা করে দিস। কথা শেষ না করতেই জহুরুল হক সাহেব ফুঁপিয়ে উঠেন।
নিঝুম দেখল ,আশেপাশের লোকজন তাদের দিকে তাকাচ্ছে কৌতুহলী দৃষ্টিতে।
নিজেদেরকে আড়াল জন্যই নিঝুম জহুরুল হক সাহেবকে নিয়ে নাজিমের ঝুপড়িতে গিয়ে বসে। আর মনে মনে “বিলাসিতা” শব্দটির হিসাব মেলাতে গিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
জহুরুল হক সাহেব নাজিমের দোকানের ঠান্ডা সমুচায় কামড় দিয়ে দূরের পাহাড় দেখেন। যেখানে সারি সারি বৃক্ষ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা উঁচু বৃক্ষের দিকে তাকাতে তাকাতে জহুরুল হক সাহেবের মাথাটা লজ্জার ভারে ক্রমান্বয়ে নুয়ে পড়ে।
অসাধারন মানবিক গল্প!
মন খারাপ করে দিলেন।
গল্প হিসেবে বলব,
আপনার লেখা আমার পড়া সেরা গল্প এটা।
ভাল থাকুন।
মন আছে বলেই তো ভালো আর খারাপের প্রশ্ন ভাইজান।
পরে যা বললেন তাতে অবশ্য আমার মন ভালো হয়ে গেছে অনেক খানি।
সুন্দর গল্প !!
চমৎকার লিখেছেন-মন খারাপ হয়ে গেলো।
ধন্যবাদ অনিমেষ ভাই।
নিজেকে ভবিষ্যতের জহুরুল হক মনে হচ্ছে
না, সিরাজী ভাই আপনার ভবিষ্যত অবশ্যই অনেক সুন্দর এবং গোছানো হবে।
সুন্দর গল্প!!!
ধন্যবাদ
মনটাই খারাপ হয়ে গেলো । সুন্দর লিখেছেন।
মন খারাপ করে দেয়ার অপরাধে অবশ্যই আমি অপরাধী।
মন খারাপ করা গল্প....
দূর্দান্ত লেখা...
টুটুল ভাই বন্ধু ব্লগের সব বন্ধু এত উদার যে সবকিছুতেই তারা ভালো খুঁজে পায়।
আমি মেসবাহ ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞ তিনি আমাকে এমন এক উদার পৃথিবীর সন্ধান দিয়েছেন।
মন খারাপ করে দিলেন।
কিনতু আশাকরছি এটা শুধুই গল্প, সত্যি কিছু না
মন খারাপ করে দেয়ার অপরাধে অবশ্যই আমি অপরাধী।
এটা গল্পই।তবে গল্পগুলো জীবন থেকেই নেয়া।
মন্তব্য করুন