ইউজার লগইন

ট্র্যাডিশন

“আমরা যদি রাজকীয় কার্যক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে না পারি, তবে কৃষিক্ষেত্রে প্রবেশ করিব। ভারতে বর দুর্লভ হয়েছে বলিয়া কন্যাদায়ে কাঁদিয়া মরি কেন? কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিতা করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জন করুক।“ বেগম রোকেয়ার এই উক্তি প্রসঙ্গেই মনে পড়ে গেল একটা ঘটনা।
নিকট আত্নীয়ের সুপুত্রের জন্য বছর দু’য়েক ধরে হন্যে হয়ে পাত্রী খোঁজা হচ্ছিল।এদিক হলে ওদিক হয় না, পাত্রী পছন্দ হলে পাত্রীর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড পছন্দ হয় না, ফ্যামিলি পছন্দ হলে পাত্রী’র হাইট (উচ্চতা) কম, হাইট ঠিক থাকলে পাত্রীর গায়ের রঙ ঠিক ততটা উজ্জ্বল কিংবা ফর্সা নয়, আর টেনে টুনে সব মিলিয়ে পছন্দের একটা মাপকাঠিতে আসার প্রানান্তকার চেষ্টা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যায় পাত্রী পক্ষের ছেলে পছন্দ হয়নি, কিংবা ছেলের চাকরি পছন্দ হয়নি টাইপ সমস্যার কারণে।
সুপুত্রের বিয়ের পাত্রী খোঁজার এই দুরবস্থা দেখে অন্যদের মধ্যে কেউ কেউ বলে বসে এমনি রাস্তায় নামলে মেয়েদের যন্ত্রণায় চোখ মেলে রাখা দায়, অথচ ছেলের বিয়ের জন্য পুরো দেশে যেন মেয়ের হাহাকার লেগেছে।
সুপুত্রের গতি করার জন্য আত্নীয় স্বজনদের সবাই চোখে চশমা লাগিয়ে পথে নেমে পড়ে। যখনই কোনো পাত্রীর খবর পায় সবার চোখ মুখই কেমন চকচক করে উঠে।আবার যখন নেগেটিভ রেজাল্ট হয় সবার চোখে মুখেই এমন হতাশার ছায়া পড়ে যেন চোখের সামনে সোনার ডিম পাড়া হাঁসটা পেটে ডিম নিয়েই হঠাৎ করে মারা গেল।
সুপুত্র আবার বয়সে আমার সমবয়সী।সম্পর্কটা বন্ধুস্থানীয়। তার পাত্রী বিড়ম্বনার কথা কানে আসার পর আর চুপ করে থাকতে পারলাম না ।একটা কিছু করার জন্য অন্যদের মতো আমাকেও মরিয়া হয়ে উঠতে হলো।
নতুন পাত্রীর সংবাদ এলো। পাত্রী দেখায় এবার আমিও তাদের সহযাত্রী। পাত্রী নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্রী। পাত্রীর বাবার আর্থিক অবস্থা অনেকটাই ভঙ্গুর । কিন্তু ভদ্র লোকের চার ছেলে-মেয়ের সবাই খুব ভালো ভালো জায়গায় পড়ছে। পাত্রী পড়ালেখার পাশাপাশি একটা কোচিং সেন্টারে নিয়মিত ক্লাস নেয়।পাত্রীর চেহারা , গায়ের রঙ সব চলনসই থাকার পরও সুপুত্রের বাবার পাত্রী পছন্দ হলো না, কারণ পাত্রীকে যখন জিজ্ঞেস করল অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার পর পাত্রী কি করতে চায়, পাত্রী তখন খুব দৃঢ় কন্ঠে বলল, চাকরির জন্য পড়ব, বিসিএস কোচিং এ ভর্তি হব। সুপুত্রের বড় চাচা তখন আঁতকে উঠে বলল, চাকরি করবে?চাকরি করলে ঘর সংসার করবে কিভাবে? পাত্রী সুপুত্রের বড় চাচার দিকে তাকিয়ে জবাব দিল আমার আগে যারা চাকরি করেও সুন্দরভাবে ঘর সংসার সামলিয়েছে তাদের মতো করে।
সুপুত্রের বড় চাচা বেশ মর্মাহত হলেন এবং বললেন, না, না, চাকরি করা যাবে না, পড়ালেখা করছে ভালো কথা , কিন্তু চাকরি করা যাবে না , আমাদের বাড়ির বউরা কখনো বাইরে গিয়ে চাকরি করে না।এটা আমাদের ফ্যামিলির ট্র্যাডিশন।
পাত্রীর চাচা বললেন , আরে এখনো কোথায় কি, চাকরি পেলেই না করবে।
মেজাজটা আমার চরম খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম ঠিক সে সময় পাত্রী আগের চেয়েও দৃঢ় কন্ঠে বলল, আমি চাকরিই করব।
মেয়েটার প্রতি যে আমার কি ভালোবাসা কাজ করছিল, এমন পরিস্থিতিতে এমন দৃপ্ত কন্ঠে ক’জন বলতে পারে, কিংবা ক’জন বলতে চায়।
ফলাফল সুপাত্র আবারো অনিশ্চয়তায়। বলে বিয়ে বোধহয় কপালে নাই রে। বলতে বাধ্য হই এমন নপুংশকদের কপালে বিয়ে না থাকাই উচিত। তোর বড় চাচা যে এমন বাজখাই গলায় বলল, তোদের ফ্যামিলিতে বাড়ির বউরা কখনো চাকরি করে নি,এটা তোদের ফ্যামিলি ট্র্যাডিশন,তুই আমাকে বলতো এখন পর্যন্ত তোদের বাড়ির কোন বউটা চাকরি করার মতো যোগ্য ছিল,কিংবা চাকরির পরীক্ষায় পাস করে চাকরি পেয়েও চাকরি করে নি,এমন একটা উদাহরন দে তো দেখি।
ট্র্যাডিশন, না, খুব ট্র্যাডিশন দেখাচ্ছিস, ট্র্যাডিশন নিয়ে বসে থাকা মানে সব সময় অন্ধকারেই থাকা। ঐ মেয়েটা কি চমৎকার করে তোদের মুখের উপর তোদের ট্র্যাডিশনকে এক চোট দেখিয়ে দিল- দারুণ লেগেছে, সাবাশ কন্যা,সাবাশ।
আমার নিকট আত্নীয়দের মতো এমন আরো অনেক পরিবার আছে যারা খুব গলা বাজি করে ট্র্যাডিশনের কথা বলে বাড়ির বউ হওয়ার অপরাধে অনেক যোগ্য মেয়ের যোগ্যতা প্রকাশের ক্ষেত্রে কাঁটার মতো ঝুলে আছে । সেসব কাঁটাগুলো উপরে ফেলার সাহস যারা করেছে তাদের অনেক সাধুবাদ। আর যারা এখনো ট্র্যাডিশনের কাঁটা উপরে ফেলার সংগ্রাম করে যাচ্ছে তাদের জন্য শুভেচ্ছা ।

পোস্টটি ১৪ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

অতিথি's picture


ভালোই লিখেছেন, তবে একটা কথা মনে রাখা দরকার "বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে" Smile

মাঈশা's picture


আপনার লেখা পড়ে অনেক ভালো লাগলো। অনেক উৎসাহিত হলাম।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এইরকম একটা পোষ্ট শেয়ার করার জন্য।

শাতিল's picture


৯০ ভাগ পরিবারই এমন। কুদোস টু দ্যাট গার্ল Smile

মীর's picture


এই ধরনের সুপাত্ররা আজীবন অনিশ্চয়তাই থাকুক। সেটাই ভাল।

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

মোহছেনা ঝর্ণা's picture

নিজের সম্পর্কে

আমি খুব সাধারণ একজন।জীবন নিয়ে আমার তেমন কোনো অতৃপ্তি নেই।সেদিক দিয়ে সুখী মানুষ আমাকে বলা যায়। জীবনে আমি যা চেয়ছি ,তাই পেয়েছি।তীব্রভাবে চেয়েছিলাম ভালোবাসার মানুষটিকে।সৃষ্টিকর্তা যেদিন সত্যি তাকে শুধুই আমার করে দিয়েছে সেদিন আমি রবীন্দ্রনাথের মতোই মনে মনে বলেছিলাম,আমি পাইলাম,ইহাকে আমি পাইলাম।'বন্ধু ' শব্দটি ভীষণ প্রিয় আমার।আছে কিছু প্রাণের বন্ধুও।বই পড়তে ভালো লাগে।বেড়াতে ভালো লাগে।মাঝে মাঝে মনে হয় যদি ইবনে বতুতার মতো পর্যটক হতে পারতাম! লেখালেখির প্রতি বেশ দুর্বলতা আমার।লিখিও প্রচুর।যা মনে আসে।ওগুলো আদৌ লেখা হয়ে উঠে কি না ,তা আমি জানি না। আমি যখন লিখি নিজেকে আমার মুক্ত মানুষ মনে হয়।আমার মনে হয় আমার একটা উদার আকাশ আছে।লেখালেখিটা হচ্ছে সেই উদার আকাশে নিজের ইচ্ছে মতো ডানা মেলে উড়ে যাওয়া।উড়ে যাওয়া।এবং উড়ে যাওয়া।