আমরা ভালো আছি!
খুব স্বাভাবিক আর অন্য দশটা দিনের মতোই কেটে যাচ্ছে দিন।তরকারিতে লবন হলো কিনা, মাংসটা আরেকটু সেদ্ধ হলে ভালো হতো, চায়ের লিকারটা একটু পাতলা হয়ে গেছে এই বোধগুলো যখন এখনো জীবিত তার মানে সব ঠিক ঠাক আছে। শীতটা আসি আসি করছে।আলমারিতে তুলে রাখা শীতের কাপড়্গুলো নাড়াচাড়া করি। সেখান থেকে কর্পুরের গন্ধ ভেসে নাকে লাগে। শীতের প্রসাধনী কেনার লিস্ট করি। জীবনযাত্রা তো স্বাভাবিকই আছে।বাজার নিয়ে ভাবতে হয়। অফিসে যাওয়া, সংসার করা , এই শীতে কোথাও বেড়াতে যাব কিনা সেসব ভাবনা ও তো ঠিকই চলছে।রোজকার নিয়ম অনুসারে সকালে ঘুম থেকে ওঠা, রাতে ঘুমাতে যাওয়া, দিনভর নিত্য রুটিন কাজ সবই যখন ঠিক্টহাক আছে তাহলে নিশ্চয়ই আমরা ভালো আছি। হয়তো বেশ ভালোই আছি।
রাতের অন্ধকার ছাড়িয়ে এখন দিনের ফকফকা আলোয় যতই কুপিয়ে হত্যা চলুক না কেন আমরা ভালো আছি।
৩১ অক্টোবর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর মালক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করার পর হত্যাকারীরা আবার সেই পথ মাড়িয়ে দিব্যি চলে যায়। আবার হত্যার দায় স্বীকার করে বার্তা দেয়।
লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কার্যালয়ে ঢুকে প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল, ব্লগার রনদীপম বসু ও তারেক রহিমকেও কুপিয়ে মারাত্নকভাবে আহত করেছে দুর্বৃত্তরা।
আমরা ভালো আছি।
ফয়সাল আরেফিন দীপনের বাবা ঢাকা ব্বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কাসেম ফজলুল হকের ছেলে হত্যার বিচার চাই না মন্তব্য যেন তার ছেলে হত্যার আপরাধের চেয়েও বড় অপরাধ হিসেবে ধরা দিয়েছে কারো কারো কাছে। অন্তত আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক মাহবুবুল হক হানিফের নিন্দাচারে দীপন হত্যার চেয়েও দীপনের বাবার মন্তব্য বেশি নিন্দিত ছিল।
আমরা ভালো আছি।
গত ২ নভেম্বর প্রথম আলোর প্রথম পাতায় দীপনের মা আর শ্বাশুড়ির অশ্রুসিক্ত নয়নে শেষবারের মতো ছেলেকে দেখার ছবিটি সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছিল।হয়তো এভাবেই দিনের পর দিন মায়েদের বুক খালি হতে থাকবে.........হয়তো এটাই একটা চলমান প্রক্রিয়া।
আমরা ভালো আছি।
২৩ অক্টোবর পুরান ঢাকার হোসেনি দালানে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে গ্রেনেড হামলায় প্রায় দেড়শতাধিক মানুষ আহত হয়। বাদ পড়েনা ছোট্ট শিশু হাসানও। তাইতো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মা-ছেলের বিছানা পাশাপাশি লাগিয়ে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
আমরা ভালো আছি।
ফেনীর জেলে পল্লীতে সাম্প্রদায়িক হামলায় গর্ভবতী মায়ের পেটে লাথি মেরে গর্ভপাত করিয়েছে সন্ত্রাসীরা। গর্ভের শিশুটি গর্ভেই মারা গেছে ।পৃথিবীতে আসার আগেই এমন নির্মমতা দেখে লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সেই নারী নাকি আর কখনো মা হতে পারবে না।মা হওয়ার সুখটুকু, কষ্টটুকু, যন্ত্রণাটুকু বোঝার ক্ষমতা প্রকৃতি মা ছাড়া আর কাউকেই দেয়নি। কিন্তু যারা এ হামলা করেছে তারা নিশ্চয়ই মা ছাড়াই এ ধরাধামে এসেছে!!তা না হলে এই জঘন্য কাজটি করার সময় ও বেজন্মার দলের এতটুকু দ্বিধা হবে না কেন??
মাত্র কিছুদিন আগে মাগুরায় মায়ের গর্ভে শিশু গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় হয়ে গেল। অথচ সে ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে আবার মায়ের গর্ভে শিশু হত্যা!!
বিদেশী নাগরিকদের পরিকল্পিত ভাবে হত্যার পর হত্যা করে কত সহজে আসামিরা গা ঢাকা দিয়ে যাচ্ছে!!
আমরা ভালো আছি।
শিশু হত্যা, শিশু নির্যাতন,এগুলো তো এখন ডালভাত। রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে নিমিষেই তাজা প্রাণ রক্তাক্ত হয়ে নিথর ভাবে পড়ে থাকা, পেট্রোল বোমার ধ্বংসযজ্ঞের কথা এখনো মনে করতে হয়।
তারপরও আমরা ভালো আছি। কারণ আমাদের মন্ত্রী মহোদয়েরা বলেছেন, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা।দেশের অবস্থা স্বাভাবিক আছে। সব কিছু যেহেতু স্বাভাবিক আছে তাহলে নিশ্চয়ই আমরা ভালো আছি। শুধু মনে হচ্ছে বেশ ভালো থাকতে গিয়ে আমরা বোধহয় দিনে দিনে শূন্য হয়ে যাচ্ছি। অদ্ভুত শুণ্যতায় পূর্ণ হয়ে আছি।তারপর ও কেন জানি আশা হারাতে চায় না মন। মনে হয় এখনো কোথাও আলোর রেখা লুকিয়ে আছে।
তাইতো দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের কথাটা কানে বাজছে, আমরা শূণ্যের মধ্যে ভালো কিছু খূঁজছি।
হ্যাঁ আমরা ভালো আছি – বাচ্চার শোকে কোন এক মা কাঁদছে আর বাকীরা ভাবছে তাতে কি আমি তো বেঁচে আছি শুধু মনুষ্যত্বের মৃত্যু হয়েছে
আমরা ভালো আছি।
আমরা ভালো আছি - নিত্যকার জীবনে। শুধু জীবনটাই হয়ে যাচ্ছে চিরিয়াখানার প্রাণীদের!
মন্তব্য করুন