কেন ভয়ে ভয়ে কেটে যাবে একটা জীবন?
সময় গুলো কেমন নির্বিকার ভঙ্গিতে কেটে যাচ্ছে। বয়স বেড়ে যাচ্ছে প্রতিদিন।শীতের ঝরা পাতার মধ্যে ঝরে পড়ার দিকেই হয়তো এগিয়ে চলছি। অথচ জীবনে যে কিছুই করা হলো না এখনো। না ব্যক্তি জীবনে, না সামাজিক জীবনে। এমন কোনো কাজই তো করলাম না যে কাজটার কারণে জীবনের কোনো না কোনো সময় মনে হবে আমি অন্তত চেষ্টা করেছি ভালো কিছু করার।চেষ্টা সার্থক হয়েছে না কি বৃথা গেল সেটা পরের ব্যাপার।
বাইরে কাজ করতে গেলে বুঝা যায় নারী জীবনের চলার পথটা কত বেশি অমসৃণ। পায়ে পায়ে যেন কাঁটা বিছানো থাকে। তার মানে এই নয় যে ঘরে থাকা নারীদের জীবন পুরোপুরি ভীতিহীন কিংবা সীমাহীন আনন্দময়।
আমার এক বস একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ওনার সারা জীবনের চেষ্টা ছিল ওনাকে যেন কেউ কোনোদিন ভয় না পায়। আমরা ক’জন সহকর্মী একসাথে জিজ্ঞেস করলাম কেন স্যার।
তিনি বললেন,যাকে মানুষ ভয় পায়,তাকে কখনো আপন মনে করে না, তার প্রতি মন থেকে কোনো শ্রদ্ধা আসে না । আমার মা সারাক্ষণ আমার বাবার ভয়ে কুঁকড়ে থাকত।আমার বাবা খুব রাগী মানুষ ছিলেন। কোথাও কোনো ভুল হলে কিংবা পান থেকে চুন খসলেই খুব রেগে যেতেন। আমার মা এমনিতে খুব হাসি খুশি মানুষ ছিলেন। কিন্তু যখনই বাবা ঘরে ঢুকত মায়ের মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে যেত। কারণ এই বুঝি শুরু হয়ে গেল বকা-ঝকা। আমি অনেক ছোট ছিলাম।তারপরও আমার এত খারাপ লাগত।বাবাকে খুব ভয় পেতাম বলে কিছু বলারও সাহস হতো না । অথচ মা’র জন্য খুব কষ্ট হতো। তখনই মনে মনে ঠিক করেছিলাম আমার সারাজীবনের চেষ্টা হবে কেউ যেন কোনো কারণে আমাকে ভয় না পায়।
এরপর স্যার আবার বললেন, একটাই তো জীবন। এই একটা জীবন যদি সারাক্ষণ ভয়ে ভয়েই কাটাতে হয় তাহলে এর চেয়ে কষ্টের আর কি থাকতে পারে।
স্যারের কথা শেষে আমাদের এক মেয়ে সহকর্মী বলে উঠলেন, স্যার,আপনার মা তো শুধু তার স্বামীকে ভয় পেত। এছাড়া আপনার মা তো অনেক ভাগ্যবান মানুষ, কারণ তার তো আপনার মতো একজন সুসন্তান ছিল। আর আমাদের সমাজের সেসব নারীদের কথা ভাবুন, যাদের ঘরে বাইরে সারাক্ষণই ভয়ের মধ্যে থাকতে হয়, নিজেকে বাঁচানোর ভয়, নিরাপদে পথ চলার ভয়, কথার ভয়, শারীরিক নির্যাতনের ভয়, মানসিক নির্যাতনের ভয় , ভয়ের তো কোনো শেষ নাই , তারা যে কীভাবে বেঁচে আছে সেটা কে দেখছে? কী কষ্টের জীবনটাই না পার করছে আমাদের মেয়েরা।
স্যার বললেন, আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। এটা কোনো সুস্থ জীবন ই হতে পারে না । আমার মায়ের ঐ ভীত-সন্ত্রস্ত মুখের দিকে তাকালেই আমার কী কষ্ট হতো! আসলে নিজের অধিকার নিজেকে উদ্যেগী হয়েই আদায়ের চেষ্টা করতে হবে।
স্যারের সাথে এসব কথার রেষ ধরে মনে পড়ে যায় কয়েক বছর আগে প্রথম আলো ,আলোকিত চট্টগ্রামের প্রদায়ক হিসেবে কাজ করার সময় খুব সম্ভবত চট্টগ্রাম মহিলা আইনজীবী সমিতির আয়োজনে চট্টগ্রাম ক্লাবে ইভটিজিং বিষয়ক একটা গোলটেবিল আলোচনায় গিয়েছিলাম। সেখানে আলোচকদের মধ্যে শিক্ষক,আইনজীবী,সাংবাদিক,নারী উদ্যক্তা, ব্যবসায়ী, সমাজসেবীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত একজন শিক্ষক বলেছিলেন আমাদের নারীদের আমরা সম্মান তো দিতে পারিনিই, তারা অসম্মানিত হলে যে সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে নিরাপদে বিচার চাইবে সেই অধিকারটুকুও আমরা তাদের দিতে পারিনি। ইয়াসমিন হত্যা,সীমা হত্যার ইতিহাস কেউ ভোলেনি।
সবাই নিজেদের অভিজ্ঞতা এবং বাস্তবতার প্রেক্ষিতে কিভাবে ইভটিজিং রোধ করা যায় সেসব বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিলেন। এবার যখন আমার পালা এল কিছু বলার,আমি খুব সংক্ষেপেই একটা বাক্য বলেছিলাম ,আমাদের মেয়েদের প্রতিবাদ করতে হবে যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
অনুষ্ঠান শেষে যখন চলে আসছিলাম তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষক বললেন, এই প্রতিবাদী কন্যা, তুমি চমৎকার বলেছ। আমাদের মেয়েদের প্রতিবাদ করতে হবে। প্রতিবাদের কোনো বিকল্প নেই।
পারিপার্শ্বিক কিছু কারণে আজ মনটা অনেক বিক্ষিপ্ত ছিল। অথচ শুধু মেয়ে বলেই যেন আমার কিছু করার ছিল না বা আমাকে করতে দেয়া হয়নি। তখন আবার মনে হলো আমাদের মেয়েদের আমরা ছোটবেলা থেকেই সব কিছু নিরবে মেনে নেয়ার কৌশলটা শিখিয়ে দিই। তাদের সাথে কোনো কেউ কোনো অন্যায় করলে আমরা তার বিচার দাবি না করে তা চেপে যাওয়া কিংবা আড়াল করার চেষ্টা করি। আমাদের মেয়েদের সাথে আমরা এমন আচরণ করি যেন এমন একটা অনাকাংখিত ঘটনা ঘটার জন্য আমাদের মেয়েরাই কোনো না কোনোভাবে দায়ী।কী বিচ্ছিরি রকম শৈশব শিক্ষা আমাদের। আর কেউ যদি এই শিক্ষা ডিঙ্গিয়ে যেতে চায় আমরা কিন্তু তাদের বেয়াড়া হিসেবে গন্য করি। আর সামাজিক জীবেরা তো বসে আছেন তাদের বেয়াদব বলে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য। ধিক এমন সামাজিক জীবদের।
শুধু ধিক বলেই থেমে থাকা নয় ।আর ভয় তো নয়ই। ভয়ে ভয়ে জীবন কাটানোর চেয়ে এ জীবন না থাকাই ভাল। ভয়কে জয় করতে হবে।জয় তো আর মুখে বললেই হয়ে যাবে না। তাই জয়ের দ্বারপ্রান্তে যাওয়ার আগে দৃঢ়তার পরীক্ষায় পাস করা চাইই চাই।
অর্জন কিছু আদৌ হবে কিনা জানি না । তবে সুস্থ মনুষ্যত্ব সম্পন্ন কেউ কেউ নিশ্চয় "প্রতিবাদী কন্যা" বলে আলাদা করে চিনে নেবে। প্রাপ্তির খাতায় এই নাহয় ধরে নেব।
আসলে অধিকাংশ মানুষ খালি প্যান্ট পরা শিখসে। আদতে ওরা প্রাণীর চেয়ে বেশি কিছু হয়ে উঠতে পারে নাই। বিষয়টা বুঝতে হবে। লিঙ্গের ধারনার বাইরে যারা বের হইতে পারে নাই তাদের প্রতিবাদ করে কিছু শেখানো যাবে বলে মনে হয় না। ফলে প্রতিবাদী কন্যা পরিচয় পাইয়াও কারও বিশেষ লাভ নাই। যেহেতু জীবন একটাই, ভয়কে জয় করে আপনি আপনার মত বাঁচতে পারতেসেন কিনা সেইটাই আলোচ্য বিষয় হোক।
প্রতিবাদী কন্যা পরিচয় পাইয়া যে বিশেষ লাভ হবে এমন চিন্তা আমিও করি না ।কিন্তু এটা ও তো ঠিক যে কেবল সয়ে যাওয়ার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে প্রতিবাদ করে নিজর অবস্থানটা সুদৃঢ় করা সবারই উচিত।
ভয়কে জয় করে নিজের মতো করে আমাদের বাঁচতে দিচ্ছে কে? নিজের মতো বাঁচার জন্যই তো প্রতিবাদের প্রসঙ্গটা এলো।
ভালো লিখছেন।
অন্যায় সহ্য করা করা আর নিজে করা একই জিনিস।
মনের কথাটি বলেছেন।
সুস্থ মনুষ্যত্ব সম্পন্ন মানুষের বড়ই ওভাব,
ভাল লিখেছেন। শুভকামনা রইল।
ধন্যবাদ
ভালো থাকবেন। আপনার জন্যও শুভ কামনা।
একদম আমার মনের কথাটা বলেছেন আপু
হ্যাঁ, আমি একমত, প্রতিবাদ করতে হবে। বেগম রোকেয়ার সময় সামাজিক মোল্লারা মেয়েদের যেসব কাজ করাকে খারাপ মনে করতো, যে সব কাজকে মেয়েদের জন্য বিপর্যয় মনে করতো (একা বাইরে যাওয়া, পড়াশোনা করা, বাজারে যাওয়া, পরপুরুষের সাথে কথা বলা/কাজ করা ইত্যাদি) তার সবগুলোই আজকের মেয়েরা করে নিজের সম্মান বজায় রেখেই। মোল্লাদের সমস্ত চোখরাঙানিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সাহস করে এগিয়ে যাওয়ার কারণে মেয়েরা আজ এতদূর আগাতে পেরেছে। প্রতিবাদ কিন্তু সারাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয়ে গেছে। femen লিখে গুগলে সার্চ করুন। মেয়েরা বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কতটা সাহসী হতে পারে তা ভাবা যায় না। সারা বিশ্বের মেয়েরা ফেমেন চেতনাকে ধারণ করে প্রতিবাদ করছে। আফগানিস্তান, ইরান, মিশর, ইয়েমেন, তুরস্ক, সৌদী আরবের মেয়েরাও পিছিয়ে নেই। ইরানী মেয়েদের https://www.facebook.com/StealthyFreedom এই পেজটা কেউ দেখেছেন কি? তাহলে বুঝবেন চরম বিপদের মধ্যেও প্রতিবাদের ধরণ কিরকম হতে পারে। প্রতিবাদ করতে হবে। হাত কিংবা মুখ দিয়ে না পারুন তো অন্তত কলম দিয়ে করুন। বেশি বেশি।
মনের কথা বলতে পেরেছি জেনে ভালো লাগল।
ভালো থাকুন।অনেক শুভকামনা।
ভয়ে ভয়ে কেটে গেলো গোটা জীবন
আসো ভয়কে জয় করি :love
মন্তব্য করুন