ভিজে যাই এই বরষায়
বৃষ্টি নিয়ে মানুষের কত সুখকর স্মৃতি থাকে। কত আনন্দের স্মৃতি থাকে। কিংবা পথ চলতে গিয়ে ঘটে যায় দারুণ কোনো ঘটনা। কিন্তু আসিফের ক্ষেত্রে তার কিছুই হয় না। তার ক্ষেত্রে যা হয়, তা হলো- সকালবেলা খটখটে রোদ দেখে ছাতা না নিয়ে সে বেরিয়েছে আর অফিস শেষে বাসায় ফেরার পথে দেখে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। মাত্র ক’দিন আগে দু’দিনের প্রবল বর্ষণে চট্টগ্রাম শহর যখন ডুবে যাচ্ছিল, সেদিন অফিস থেকে ফেরার সময় সে নালার নোংরা পানিতে সাঁতার কেটেছে। এবং বহু কষ্টের অবসান ঘটিয়ে যখন সে বাসায় ফিরেছে তখন তার বউ তাকে ডেটল সাবান নয়, ডাইরেক্ট ডেটল দিয়ে গোসল করতে বাধ্য করেছে। সারারাত ডেটলের গন্ধে তার একটা ফোঁটাও ঘুম হয়নি। অথচ পাশেই তার বউ নীহা কি আরাম করে ঘুমাচ্ছিল।
বৃষ্টি নিয়ে কবি সাহিত্যিকদের আদিখ্যেতা দেখেও রাগে গা জ্বলে যেতে চায় আসিফের। যাও না সকালবেলা এই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে লোকাল বাসে ধাক্কাধাক্কি করে অফিসে, তখন বেশ বের হবে- ‘আজি ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে’ কিংবা পাগলা হওয়ার বাদল দিনে, পাগল আমার মন জেগে ওঠে। কবি সাহিত্যিকদের তো আর নয়টা-পাঁচটা অফিস করতে হয় না। বাজার করতে হয় না, বউয়ের ঘ্যান ঘ্যানও শুনতে হয় না। তাই বাসায় বসে বসে ভাব ধরতে পারে।
আর তার বেলায়- একটু খিচুড়ি খাওয়ার জন্য বউকে রাজি করানোর পর এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নিজেই বাজারে গিয়ে ইলিশ মাছ খুঁজে বের করতে হয়। নেহায়েত একটা ডিম ভাজি। সেই ডিমটা কেনার জন্যও এই পাঁচতলা বেয়ে নিচে নামতে হয়।
আর ছোট বেলার বৃষ্টি? মানুষজন কেমন নষ্টালজিক হয়ে পড়ে ছোটবেলার বৃষ্টির কথা বলতে গিয়ে। আর আসিফের ছোটবেলার বৃষ্টি দিন ছিল আরও ভয়াবহ। তাদের ঘরের সামনের শ্যাওলা পড়া উঠান দিয়ে সবাই হেঁটে যেত। কারও কিছু হতো না। অথচ এই একই উঠানে দিনে দু’তিনবার পিছলা খেয়ে পড়া ছিল তার বর্ষাবেলায় রুটিন। শুধু যে ছোটবেলায় পিছলা খেয়ে পড়েছে তা না এই বড় বেলায়ও এই রুটিন অব্যাহত আছে। বিয়ের পর নতুন বউ নীহাকে প্রথম বর্ষায় তাদের উঠান দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় এমনভাবে পিছলে পড়েছিল যে হাত-পা ভাঙার চেয়েও কোমল মনটা ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। নতুন বউয়ের সামনে এই ন্যক্কারজনক ঘটনাটি না ঘটলেও পারত। কিন্তু ঐ যে বলে বিধি বাম। কী আর করবে সে! বিধিকে তো ডান করার কোনো বশীকরণ তার জানা নেই।
ছোটবেলার বর্ষায় যে সে শুধু পিছলে পড়ে হাত-পা ভেঙেছে তা নয়, এর চেয়েও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে তার কৈশোরের বাদল দিনে। বিলে তখন কোমর পানি। মানুষের পুকুর ভেসে মাছ চলে আসে বিলে। আর সেই বিলের মাছ ধরার জন্য অন্য সবার মায়ের মতো আসিফের মাও তার জন্য কিনে আনত আন্তা (মাছ ধরার বক্স জাতীয় বস্তু)। যে কেনো বাঁধের মুখে আন্তা কিছুক্ষণ ধরে রাখলেই ধরা পড়ত ঝাঁকে ঝাঁকে পুঁটি মাছ, পোনা মাছ। মাঝে মাঝে দু’একটা কই মাছ, শিং মাছও আটকে যেত। একবার হলো কী-বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধ্যা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। ভাবল আন্তাটা এখনই একবার দেখে আসলে সারা রাত আর যেতে হবে না। খেজুর গাছের উঁচু জায়গাটা দিয়ে যাওয়ার মুখেই তার আন্তা। আন্তা তুলতে গিয়ে দেখে বেশ ভারী হয়ে গেছে। অনেক মাছ ধরা পড়েছে ভেবে যেই না সে আন্তার মুখ খুলল তার হৃৎপিণ্ডকে নাড়িয়ে দিয়ে বের হয়ে এল একটা সাপ। চিৎকার করতে গিয়ে খুব সম্ভবত অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। পরে সামাদ চাচা থেকে শুনেছিল এটা ধোড়া সাপ। কামড় দেয় না। আর কামড় দিলেও মানুষ মরে না। সাপের দাঁতে বিষ নাই। কিন্তু আসিফ ভাবছিল, যদি বিষ থাকতো। তাহলে তো এখন সে মরহুম থাকত।
বর্ষা নিয়ে অবশ্য একবার তার মনটা নেচে উঠেছিল। ক্ষণিকের জন্য ‘মন মোর মেঘেরও সঙ্গী’ সেও গেয়েছিল মনে মনে। চাকরির ভাইবা ছিল সেদিন। তুমুল বৃষ্টি। ‘ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে’ টাইপের অবস্থা। কিন্তু বেকার মন এসব বাধায় থমকে যেতে পারে না। ভাইবার সময় তার সঙ্গে অপেক্ষমান অনেকের সঙ্গে একটা সুন্দর মেয়েও ছিল। মেয়ে আরও বেশ ক’জনই ছিল। কিন্তু চোখে পড়ার মতো ঐ একজনই ছিল। সবার মতো আসিফও একটু পর পর উস্কখুস্ক নয়নে ঐ মেয়ের দিকে তাকাচ্ছিল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে একটা সময় ঐ মেয়ে আসিফের পাশে এসে বসে। বলে, হ্যালো ব্রাদার, এই চাকরিটা হলে আপনি কি করবেন?
আসিফ তার ভালোলাগার ভাবটা গোপন করে বলে, কি আর করব? একটা বিয়ে করব।
ভাল। খুবই ভাল। আমি কি করব জানেন?
আসিফ বলে, না, জানি না। জানার কোনো কারণ আছে?
হু। আপনি ঠিকই বলেছেন। জানার কোনো কারণ নাই। চাকরিটা হলে আমি পালিয়ে যাব!
আসিফ যেন স্পষ্ট শুনতে পারেনি, এমনভাবে বলল, কি করবেন? পালিয়ে যাব ব্রাদার। আমার জামাইরে একটা উচিত শিক্ষা দেব। আসিফ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আর মনে মনে ভাবে আহ্! পালিয়ে গিয়ে এই মেয়েটা যদি আমার হাত ধরতো।
শ্রাবণের শেষের দিকে বলেই হয়তো বৃষ্টি পড়ছে আবার টানা। আজ বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাসায় ফিরে আসিফ দেখে সেই মেয়েটি তাদের ড্রইংরুমে বসা। তার বউ নীহা বলে, এই জানো কি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে। বিকালের দিকে টেইলার্সের দোকান থেকে কাপড় নিয়ে বাসায় ফেরার সময় হঠাৎ শুনি কে একজন আমার নাম ধরে ডাকছে। তাকিয়ে দেখি আমার ছোটবেলার বান্ধবী তানি। আমাদের পাড়াতেই থাকে ও। প্রথমে ওর বাসাটা চিনে আসলাম। তারপর আমাদের বাসা দেখানোর জন্য নিয়ে এসেছি।
ভালো করেছি না?
আসিফ বলল, হু, ভালো করেছ।
তানি আসিফের দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলল, নীহা তোর বরকে তো আমি আগে থেকেই চিনি।
নীহা তানির দিকে না তাকিয়ে মুখ গোমড়া করে আসিফের দিকে তাকিয়ে বলল, তাই নাকি? কই ওর মুখে তো কোনোদিন শুনিনি। আসিফ ঘেমে যায় ভিতরে ভিতরে। এই মেয়ে থট্ রিডিং, জানে না কি? সেদিন শুধুমাত্র সেই একবারই তার মনে হয়েছিল ভিজে যাই এই বরষায় সেই ভাবনাই কি কাল হয়ে দাঁড়াল।
আসিফ কিছু বলার আগেই তানি বালল, সম্ভবত তোর বিয়ের আগ থেকেই চিনি আমি।
নীহা অনেকটা কাঁদো কাঁদো গলায় আসিফকে বলল, তুমি কখনো বলনি কেন?
আসিফ বলল, আরে না, একটা চাকরির ইন্টারভিউতে কথা হয়েছিল। আর উনি যে তোমার বান্ধবী সেটা কি আমি জানি?’
রাতে শোয়ার সময় নীহা আসিফের গা ঘেঁষে শুয়ে বলল, এই তুমি সত্যি করে বলো তো, তানির সঙ্গে তোমার পরিচয় কিভাবে?
আসিফ একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, আমি মিথ্যা কথা বলতে পারি না।
নীহা বিরক্ত হয়ে বলল, মিথ্যা কথা বলতে পার না, তাই না, এখন যা বলছ , তা কি?
নীহার কথায় জবাব না দিয়ে ঘুমের ভান করে আসিফ।
ঘুম তো আর আসেই না।এত বছর পর দেখা! অথচ তানিকে দেখার সাথে সাথেই কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো। এখনো কি স্নিগ্ধ মুখখানি!
আসিফের খুব জানতে ইচ্ছে করছিল তানি কেমন আছে? এত দিন পর কোথ থেকেই বা উদয় হলো? ভালো আছে তো! সত্যিই কি তানি তার জামাই বেটারে উচিত শিক্ষা দিয়েছে কিনা, সংসার আদৌ টিকে আছে কিনা কিংবা তার বাসায় কে কে থাকে কিন্তু তার এই কৌতূহল নীহার মনে নতুন কোনো শঙ্কা বা সন্দেহ তৈরি করতে পারে এই ভেবে সে তা চেপে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
ইন্টারেস্টিং ছিল। আরও একটু বড় হতে পারতো
একটু সময় করতে পারলেই পরের অংশটা কিছুটা পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন করে নিব।
ভালোই। এখনও বিষ্টির ফিলিংটাই পাইলো না বেচারা। তানির হুট করে বাসায় এসে পরাটা কেমন জানি লাগছে। শেষটায় আরেকটু টাইম নিতে পারতেন। প্রথম অর্ধেক দারুন লাগতেছিল পড়তে।
পড়ার জন্য যথারীতি ধইন্না।
শেষের দিকটা কিছুটা পরিবর্তন করে নিব।
দারুন লিখেছেন তো। মজা পেয়েছি।
মন্তব্য করুন