ইউজার লগইন

হটল্যান্ড থেকে ফ্রিজল্যান্ড ২ : দুবাই

রাতের ফাঁকা রাস্তায় একশ কিমিতে গাড়ি চালিয়ে মাইক্রোর ড্রাইভার বিশ মিনিটেই বিমানবন্দরে পৌছে দিল। এই প্রথম বিদেশ যাত্রা, মনের ভিতর টেনশন। বোর্ডিং এ ফরম পূরণ করে লাইনে দাঁড়াতেই এক যাত্রী অনুরোধ তার ফরম লিখে দেওয়ার। এই লোককে দেখে আমার মনের ভয় সবটাই নাই হয়ে গেল, সম্পূর্ণ নিরক্ষর একজন পাঁচ বছর সৌদিতে কাজ করতে পারে, যাওয়া আশা করতে পারে তবে আমার ভয় কী?

বোর্ডিং হওয়ার পর বিমানের জন্য অপেক্ষা। ঢাকা থেকে এ্যামিরেটসে দুবাই। সেখানে বারো ঘন্টা পর কেএলেমের আমাস্টারডাম ফ্লাইট ধরতে হবে। চাঁদপুরের একজনের সাথে পরিচয় হল। সাথে লাগেজ মাত্র একটা ব্রিফকেস। শুকনা পাউরুটি পানি দিয়ে খাচ্ছিলেন। ঐদিন ছিল হরতাল তাই রাতে হোটেলে ছিলেন। হোটেল থেকে এয়ারপোর্টে চলে এসেছেন। আমাকে পাউরুটি অফার করলেন। এই দরিদ্র প্রবাসীর আন্তরিকতায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। পোষাকেই বোঝা যায় বিদেশে থেকেও উপার্জন বেশি না। মনে মনে কামনা করলাম তার যেন আরো ভালো রোজগারের সুযোগ হয়।

বিমানে শতকরা একশ ভাগ যাত্রী বাংলাদেশি। কিন্তু ভিডিও, অডিও চ্যানেল, সংবাদপত্র কোথাও বাংলাদেশি কিছু পেলামনা। হয় হিন্দি না হয় ইংরেজি। হায় কী সেলুকাস! খাবার সময় অবশ্য খিচুড়ি পাওয়া গেল। যাত্রীদের নিরানব্বই ভাগ মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিকের কাজ করে। আমার পাশের জন বয়স্ক। অবস্থা মনে হয় সাধারণ শ্রমিকদের থেকে ভালো। মুখে গাম্ভীর্য এনে শক্ত হে বসে আছে,অন্যদের সাথে কথা না বলে। অন্যরা কিন্তু গল্পগুজবে চিৎকারে বিমানকে লোকাল বাস বানিয়ে ফেলছে।

আমার সিট জানালার পাশে। বিমান যখন টেক-অফ করে উড়ে যায় নিচে সংসদ ভবন, পরিচিত সব স্থাপনা, বুড়িগঙ্গা নদী দ্রুত চোখের সামনে থেকে ছোট হতে হতে সরে যায়। অনিন্দ্য সুন্দরী ইওরোপিয়ান বিমান বালা খাবার দিয়ে যায়। পেছনের সিটে বসা যুবক বলে, মি লাভ ইউ। বিমান বালা বদমায়েশি বুঝতে পেরে বলে, স্যরি আই ডোন'ট গেট ইউ। বলে অন্যদিকে চলে যায়। এদিকে আর আসেনা।

কয়েক ঘন্টার যাত্রা বিরক্তিকর লাগে। সময় কাটাতে জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকি। দেশের সীমান্ত পার হয়ে ভারতের আকাশে বিমান। এই প্রথম অন্য দেশের উপর। রোমাঞ্চ লাগে। কোলকাতা তারপর ভুবনেশ্বর ইতা্যদি শহরের উপর দিয়ে উড়ে যায় বিমান। নাম না জানা কত জনপদ নদী বন পার হয়ে যায়। উপর থেকে নদী দেখতে সরু বাঁকা রেখার মত লাগে। একে বেকে সমূদ্রে গিয়ে মিশেছে।

দুবাইতে পৌছি সকালে, এগারোটায় মনে হয়। আমার কানেক্টিং ফ্লাইট কেএলএম বিমানের। আশা ছিল আমার সাথে কেএলএমএর আর যাত্রী থাকবে। যাদের সাথে সাথে আমি সেই ফ্লাইট ধরতে পারব। কিন্তু হায়, আমিই একমাত্র কেএলএমএর যাত্রী। কেউ দুবাইএর বেশিরভাগই সৌদি আরবের পথে অন্য বিমানে দিকে ছুটে গেল। আমার কোনো ধারণা ছিলনা কীভাবে কানেক্টিং ফ্লাইট ধরতে হবে। কাউন্টারে বসা আমীরাতি লোকজন জিজ্ঞেস করলে ঠিকমত উত্তর দেয়না। বলল কেএলএমএর কাউন্টারে যাও। সেই কাউন্টার খুঁজে পাই না। একবার উপরে উঠি একবার নীচে নামি বিশাল এই এয়ারপোর্টের। নিজেকে অসহায় লাগে। ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে বসি, তখন দেখা হয় একই বিমানে ঢাকা থেকে আসা যুবকের সঙ্গে। আমার মতই অবস্থা তার। সে যাবে এলসালভেদর। সে ধরবে এুার ফ্রান্সের ফ্লাইট। এরকম আরো চারটা কানেক্টিং ফ্লাইট ধরে যেতে হবে এলসালভেদর। জানালো পাঁচ বছর ধরে সেখানে আছে। আমি অবাক হয়ে ভাবি, বাঙালি দুনিয়ার কোনো দেশ আর বাদ রাখে নাই।

অবশেষে বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া গেল। সম্ভবত জাপানি কোনো বিমানের ক্রু একজন কে জিজ্ঞেস করে সঠিক উপায় জানলাম। ভদ্রলোক জানালো ঐদিকে মারহাবার কাছে যাও সে আপনাকে সব ব্যাবস্থা করে দিবে। আমি বললাম, মারহাবাকে চিনব কীভাবে? মারহাবা কোনো লোক না, একটা প্রতিষ্ঠান। ওনাকে ধন্যবাদ দিয়ে মারহাবা খুঁজতে চললাম। পাওয়া গেল মারহাবা কাউন্টার। ওদের দায়িত্ব আমাকে হোটেলে রাখার ব্যাবস্থা করা। কাউন্টারের স্মার্ট শ্রিলংকান মেয়েটা দুবাইতে ঢোকার জন্য ভিসার ব্যাবস্থা হোটেলে ইনফর্ম করে বলে দিল কীভাবে যেতে হবে। এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার সময় আমিরাতি ইমিগ্রেশনের লোক বারবার পাসপোর্ট উল্টায় দেখে, চাপ দিয়া দেখে। হয়ত দুই নম্বরি কিনা চেক করে। একসময় ছেড়ে দেয়। এয়ারপোর্টের বাইরে মারহাবা মেয়েটার কথামত এস্টোরিয়া হোটেলের নামের প্ল্যাকার্ড হাতে একজনকে পাওয়া যায়। আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল। আমাকে নিয়ে হোটেলে যাওয়ার মাইক্রোতে নিয়ে উঠায়। সেখানে অপেক্ষা করছিল আরেকটা ভারতীয় দম্পত্তি। ঝকঝকে দুবাইয়ের রাস্তা দিয়ে মাইক্রো চলে। প্রথম বিদেশের মাটিতে পা রাখা।

হোটেলে রুমে গিয়েই বিছানায়। ঘুম থেকে উঠে গোসল করে থেকে বেরোই শহর দেখতে। রাস্তাঘাটে সর্বত্র সাব-কন্টিনেন্টের লোক ভরা। স্থানীয় লোকজন চোখেই পড়েনা। ফুটপাথ ধরে হোটের আশেপাশে হাটাহাটি করি। কিছু দূর গেলেই পাওয়া গেল খাবার দোকান। সবাই উপমহাদেশীয়। ফ্রাইড রাইস আর চিকেন ফ্রাই খাই। হোটেলে নানা লোকজন আসছে যাচ্ছে। টাইট টি সার্ট ও তার চেয়েও টাইট প্যান্ট পরে কয়েকজন আরবীয় মেয়ে ঘোরাফেরা করে। মুখে উৎকট সাজ। দোকানে এসে ড্রিংক কিনে খায়, দোকানদারের সাথে হাস্য মশকরা করে। আমার পাশে মলিন পোষাক পরা দুইজন নোয়াখালির ভাষায় কথা বলছে। দেশি পেয়ে আগ্রহ নিয়ে কথা বলতে যাই। পাত্তা দেয় না। রাস্তায় আরেকটু হাটাহাটি করতে সন্ধ্যা হয়ে আসে। হোটেলের দিকে ফিরি, এয়ারপোর্টে যেতে হবে আমাস্টারডামের বিমান ধরতে। হোটেলের গেটের কাছাকাছি এসেছি অন্ধকারে খাওয়ার হোটলে দেখা মেয়েদের মত একজন তার ভাষায় কিছু একটা বলে। আমি স্যরি বুঝিনা বলে তাড়াতাড়ি হোটেলে ঢুকে যাই।

পোস্টটি ৬ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মেঘকন্যা's picture


চলুক Smile

নাজ's picture


আমি বললাম, মারহাবাকে চিনব কীভাবে? মারহাবা কোনো লোক না, একটা প্রতিষ্ঠান। ওনাকে ধন্যবাদ দিয়ে মারহাবা খুঁজতে চললাম। পাওয়া গেল মারহাবা কাউন্টার।

মারহাবা মারহাবা Big smile

ঝকঝকে দুবাইয়ের রাস্তা দিয়ে মাইক্রো চলে।

দুবাই যায়াম Sad

মেসবাহ য়াযাদ's picture


হোটেলের গেটের কাছাকাছি এসেছি অন্ধকারে খাওয়ার হোটলে দেখা মেয়েদের মত একজন তার ভাষায় কিছু একটা বলে। আমি স্যরি বুঝিনা বলে তাড়াতাড়ি হোটেলে ঢুকে যাই।

সময়ের/সাহসের অভাবে চরিত্রবান। মারহাবা... মারহাবা

রাসেল আশরাফ's picture


সময়ের/সাহসের অভাবে চরিত্রবান। মারহাবা... মারহাবা

Rolling On The Floor Rolling On The Floor

জ্যোতি's picture


মেসবাহ ভাই এর কমেন্ট.....মারহাবা মারহাবা।

বাফড়া's picture


খিকজ Smile

জেবীন's picture


এই বুড়াকালে আব্বা আম্মা প্রথম গেলেন, কানেক্টিং ফ্লাইটের ঝামেলা পোহাতে পারবেনা বলে দুজনরেই হুইল চেয়ারের ব্যবস্হা করে দেয়া হইছিল এখান থেকে, মালেশিয়া এয়ারপোর্টে নাকি হুইলচেয়ারের বদলে এটেন্ডেন্সসহ ছোট্ট গাড়ি টাইপ দেয়া হইছিল।

উলটচন্ডাল's picture


বাহ!

কামরুল হাসান রাজন's picture


পেছনের সিটে বসা যুবক বলে, মি লাভ ইউ।

হোটেলের গেটের কাছাকাছি এসেছি অন্ধকারে খাওয়ার হোটলে দেখা মেয়েদের মত একজন তার ভাষায় কিছু একটা বলে। আমি স্যরি বুঝিনা বলে তাড়াতাড়ি হোটেলে ঢুকে যাই।

হুমমমমম

১০

কামরুল হাসান রাজন's picture


পরের কোট টা সবুজ হইল না কেন? Sad

১১

মীর's picture


দেখা যাচ্ছে রায়হান ভাই লোকটা ভালো। সচরাচর এমন চোখে পড়ে না।

১২

মেসবাহ য়াযাদ's picture


হাহাপেফা

এ মাসের সেরা সংলাপ !!

১৩

উলটচন্ডাল's picture


খুব ভালো লাগছে পড়তে।

১৪

নাহীদ Hossain's picture


হোটেলের গেটের কাছাকাছি এসেছি অন্ধকারে খাওয়ার হোটলে দেখা মেয়েদের মত একজন তার ভাষায় কিছু একটা বলে। আমি স্যরি বুঝিনা বলে তাড়াতাড়ি হোটেলে ঢুকে যাই।

১৫

নাহীদ Hossain's picture


এ যাত্রা রক্ষা পাইলেন তাইলে ... ... হুক্কা

১৬

জ্যোতি's picture


সিরিজ দৌড়াক। জটিল লাগতেছে।
মধ্যপ্রচ্যের দেশগুলোতে যারা কাজ কাজ করে এদর জন্য সত্যি মায়া লাগে। কি কষ্ট! তারপর এমনও হয় যে সুবিধামত কাজ না পেয়ে কেউ কেউ নিঃস্ব হয়ে যায় শুধু বিদেশে যাবার ব্যবস্থা করতে যেয়েই।

১৭

হাসান রায়হান's picture


যারা উৎসাহ দিলেন ও যারা মশকরা করলেন ধন্যবাদ সবাইরে।

১৮

বাফড়া's picture


চলতে থাকুক... রায়হান ভাই কি আসার পথে দুবাই নামছিলেন Smile Smile ?

১৯

তানবীরা's picture


অন্যরা কিন্তু গল্পগুজবে চিৎকারে বিমানকে লোকাল বাস বানিয়ে ফেলছে।

লন্ডনী ফ্লাইটে উঠেন নাই এখনো? মারাত্বক অভিজ্ঞতা হবে। উপন্যাস লিখতে পারবেন Big smile

২০

রশীদা আফরোজ's picture


ভালো লাগছে। একটু দেরিতে পড়ছি লেখাটা, কাল ৩ নং পর্ব পড়বো।

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

হাসান রায়হান's picture

নিজের সম্পর্কে

অথচ নির্দিষ্ট কোনো দুঃখ নেই
উল্লেখযোগ্য কোনো স্মৃতি নেই
শুধু মনে পড়ে
চিলেকোঠায় একটি পায়রা রোজ দুপুরে
উড়ে এসে বসতো হাতে মাথায়
চুলে গুজে দিতো ঠোঁট
বুক-পকেটে আমার তার একটি পালক
- সুনীল সাইফুল্লাহs