মিশুক ভাই
একুশে আসছে'। ছোট একটা নোটিশ দুলছিল সার্ক ফোয়ারার পাশের জাহাঙ্গির টাওয়ারে। ওটা দেখি প্রতিদিন। একুশে কি জানিনা। একদিন বিশ্ব সাহিত্যের কেন্দ্রের ছাদে বসে জানলাম বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন আসছে। সেখানে কাজ করবো সেটা ভাবনায় আসেনি। এই সময়টায় ভোরের কাগজে প্রধান ফিচার হিসেবে লিখা কয়েকটি বিষয় নিয়ে প্রামান্য চিত্র তৈরি সাধ জেগেছিল। যেমন চোরের গ্রাম। এছাড়া বায়ান্নোর ভাষা কণ্যাদের নিয়ে তথ্যচিত্র। সেই সাধ মেটানোর বাসনা নিয়েই একুশে টেলিভিশনে টেলিফোন করি। একুশের অফিস তখন বনানী। অপারেটর জানালেন- এই বিষয়ে মিশুক মুনীরের সঙ্গে কথা বলাই ভাল। প্রথম দিন তাকে পাওয়া যায়নি। তৃতীয় দফায় পেলাম। বললেন অফিসে গিয়ে বায়োডাটা দিয়ে আসতে। গেলাম, কিন্তু এর আগে যেহেতু তাকে দেখিনি কখনো, তাই অনায়াসে আমার সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আবার ফোন- তিনি চলে গেছেন শিল্পী শাহাবুদ্দিনকে নিয়ে শু্টিঙ-এ কুষ্টিয়া। ফিরলেন দিন পনের পর , গেলাম বায়োডাটা দিতে। দেখা হলো। কোন বাক্য বিনিময় ছাড়াই রেখে দিলেন বক্সে। তারপর প্রায় এক মাস কোন খবর নেই। বার চারেক চেষ্টার পর আবার টেলিফোনে পাওয়া গেল মিশুক মুনীরকে। বললেন- আপনি রিপোটার হিসেবে আমাদের সঙ্গে জয়েন করে ফেলুন। তারপর এমনিতেই প্রামান্য চিত্র তৈরি করা যাবে। তিনদফা ইন্টারভিয়ু্ বোর্ড ডিঙ্গিয়ে চাকরি হলো। একুশেতে যোগ দিয়ে জানলাম তিনি পরিচালক (অপারেশন)। ব্যস ঐ পর্যন্তই। নিউজ রুম বা পুরো একুশেতে তার ছুটোছুটিতে তাকে একজন কর্মিই মনে হয়েছে। যে কয়েকটি টিপস দিতেন, সেটা নিয়েই সম্প্রচার সাংবাদিকতায় এতোটা আসা। তবে তিনি একুশেতে দীর্ঘ সময় ছিলেন না। থাকলে হয়তো আমাদের জানার দিগন্তটা আরো বিস্তৃত হতো। এখন যে টেলিভিশন গুলো নেতৃত্বে আছে, তার প্রতিটিতেই কাজ করছেন মিশুক মুনীরের শিষ্যরা। তার জন্য শোক গাথা নয়, শ্রদ্ধা।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে ক্যামেরা অপারেশন কোর্সের আয়োজন করলাম আমরা ৯৯'এ। এই দেশে শিক্ষিত সিনেমাটোগ্রাফার তখন হাতেগোনা কয়েকজন। পুনে'র ইন্সটিটিউট ফেরত সেই কয়জনই ভরসা। কোর্সের কারিক্যুলাম নিয়া অপুদা'র সাথে কথা বলতে বলতেই মিশুকদা'র নাম আসলো। স্টুডিও লাইটিং এ্যান্ড টেকনিকের ক্লাসটা তিনি ফ্যাসিলিটেইট করতে পারবেন অপুদা'র বিশ্বাস।
আমি গিয়া যোগাযোগ করলাম। তখন তিনি একুশেতেই। এক কথায় রাজী। তার অনেক এলোমেলো জীবন, কথা দিয়া কথা না রাখতে পারার মীথ শুনছি তার আগে। অথচ ক্লাসের দিন তিনি নিজেই একটা ক্যামেরা আর থ্রি পয়েন্ট লাইটিঙের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যারেইঞ্জমেন্ট নিয়া হাজির সবার আগে। ছাদে কিছুক্ষণ আড্ডাবাজি আর চা খাওনের পর আমরা তার তারুণ্য দেখলাম ক্লাসে। এতোবড় একজন মানুষ, (আক্ষরিক অর্থেই) কিন্তু তার সাবলীলতা সবাইকে মুগ্ধ করলো।
মিশুক দা মনে হয় তার এক/দেড় বছর পরেই কানাডায় পাড়ি দিলেন। সেইখান থেইকাও তার কীর্তিকলাপ কানে আসতে লাগলো। অদ্ভুত উদ্যোগী মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাসকম এন্ড জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টরে তিনিই একক প্রচেষ্টায় আধুনিক বানাইয়া দিয়া গেছেন বইলাই জানি।
যুদ্ধাবস্থা নেই, দুর্ভিক্ষ নেই, তারপরও এত মৃত্যু! দেশটা কেন মৃত্যু উপত্যকা হয়ে যাচ্ছে?
তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরদের মত ব্যক্তিদের এমন চলে যাওয়া মেনে নেয়ার মত নয়।
বিনম্র শ্রদ্ধা।
তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরদের মত ব্যক্তিদের এমন চলে যাওয়া- কী করে এ ক্ষতি পোষাবে বাংলাদেশ !
মিশুক ভাই সম্পর্কে তেমন জানতাম না কারণ পর্দার আড়ালে থাকা ব্যাক্তি কে পর্দার সামনে থাকা আমরা কেমন করে জানবো ?
কালকে তাঁর সম্পর্কে জেনে বিস্মিত হয়েছি কিন্তু জেনেছি তাঁর চলে যাবার পর ।
তার জন্য শোক গাথা নয়, শ্রদ্ধা।
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা...
শ্রদ্ধা জানাই।
মন্তব্য করুন