দাউ দাউ পুড়ে যায় কায়েতটুলী
দাউ দাউ পুড়ে যায় কায়েতটুলী। ঝলসানো মাংসের গন্ধে বাতাস ভারী হইয়া উঠে। সাথে চলে আহাজারী। প্রিয়জন হারাইয়া ফেলা মানুষের আতর্নাদে পরিস্থিতি উসকায় না বরং আরো থমথমে হয়। অনুভূতিগুলি হয় পাথর পাথর। ঠিক যেই মুহুর্তে এই লেখায় মনোনিবেশ করছি তার আগমুহুর্তে সংখ্যাটা ছিলো ১৫৫...ওল্ড ট্র্যাফোর্ড টেস্টে তামিম ইকবাল ১৫৫ রান করতে পারলে এই মহল্লার অধিবাসীরাই হয়তো মিছিল বাইর করতো। আর এখন ১৫৫ দুঃখের বার্তাবহ হয়। আমি অজান্তেই আতকাইয়া উঠি। অস্থিরতা তৈরী হয় প্রাণে ও মননে।
পুরান ঢাকা। আমার প্রিয় শহর। যার বাতাসে নদীর গন্ধ ছিলো একসময়ে। ছোটবেলায় নানী বাড়ি যাইতাম, বুড়িগঙ্গার পানিতে ঝাপাইতে। সেই বুড়িগঙ্গা বহুদিন আর কোন স্বপ্নেও আসে না। পছন্দের বুড়িগঙ্গারে তো দেখছি অল্পসময়। বয়সের বেশীরভাগ জুইড়া তো বুড়িগঙ্গা বেদখল হইয়া যাওনের স্মৃতি। পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি গলিরে ভয় পাইতে দেখি নতুন ঢাকার নিউ জেনারেশনের পোলাপাইনরে। গাড়ি নিয়া ঐখানে অভিসারে যাওনের কল্পনাও নিশ্চিত তারা করে না। সময়ের লগে পাল্লা দিয়া ঢাকা প্রসারিত হইছে...পুরান ঢাকা তার গুরুত্ব হারাইছে। নদীবর্তী ব্যসায়িক কেন্দ্র হিসাবে যার ভিত্তি তৈরী হইছিলো, তারে এখন অনাধুনিকতার বদনাম সইতে হয়। ঢাকাইয়া পোলাপাইনের রসবোধ একসময় কিংবদন্তী হওনের সম্ভাবনা ছিলো...আর এখন পুরান ঢাকার পোলাপাইনের রুচীবোধ লইয়া ঠাট্টা তামাশা হয়।
আমরা পুরান ঢাকার ঠাশাঠাশি সংস্কৃতি লইয়া এখন আতংকিত হই। আমাগো মধ্যবিত্ত প্রাণে পুরান ঢাকার মানুষের মুখের ভাষা হয় কৌতুক কিম্বা মাস্তানীর প্রয়োজনীয় এক্সপ্রেশন। অথচ এই মানুষেরাই একটা শহুইরা সংস্কৃতি তৈরী করনের পাথেয় হইছিলো। বাঙালির যতোটুক বুর্জোয়াজি, তার শুরুটাতো এই পুরান ঢাকার মাইনষের হাত ধইরাই। তয় বুর্জোয়া কাঠামোর খারাপ প্রকাশগুলিও আগে পুরান ঢাকাতেই ঘটছে। দখলদারী মানসিকতা, অনিয়মতান্ত্রিক চোরাই ব্যবসার বিস্তার, জাল পণ্য উৎপাদন সবটা পুরান ঢাকাতেই শুরু হইতে দেখছি আমার বয়সকালেই।
এনামুল করিম নির্ঝর নামের এক স্থপতি একটা সিনেমা বানাইছেন পুরান ঢাকার বাড়িঘর ভাইঙ্গা এপার্টমেন্ট উঠানের সংস্কৃতিতে বিরক্ত হইয়া। যেনো আমাগো পুরানা সংস্কৃতি গেলো গেলো। আধুনিক বাড়িঘর তৈরী করবো সব নতুন ঢাকার মানুষেরা, পুরান ঢাকার মানুষেরা থাকবো গাদাগাদি কইরা। পুরানা বাড়িঘর গুলি সব ঠিকঠাক কইরা চলবো। যার বসবাসমূল্যের চাইতে যাদুঘর হওনের প্রয়োজন বেশি। পুরান ঢাকার মানুষেরা দরিদ্র হইবো তারা। তাগো রুচী থাকবো সেই আধুনিকতার প্রারম্ভিক প্রকাশেই...পৃথিবীর লগে তাল মিলানের লেইগা নতুন ঢাকার মধ্যবিত্তরাই তো আছে!
কায়েতটুলি পুইড়া যাওনের টাইমে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়িগুলি ঘুমে গড়াগড়ি যাইতে ছিলো। রাস্তায় বৃহস্পতিবারের শেষ তাড়াহুড়া চলতেছিলো যদিও। কিন্তু এই রাষ্ট্র এখন ভূমিদস্যুগো, এই রাষ্ট্র এখন জালিয়াতেরাই নিয়ন্ত্রণ করে। তার প্রবল প্রকাশের দায় নিতে হয় পুরান ঢাকারেই। তাই আগুন নির্বাপনের লেইগা কয়েক কদম দূরের ফায়ার ব্রিগেড সেন্টার থেইকা সহযোগিতা যাইতে আধাঘন্টা/একঘন্টা লাইগা যায়। পুরান ঢাকার ট্রান্সফরমার বার্স্ট হরহামেশাই হয়। এইটারেই বাস্তবতা হিসাবে লয় মহল্লাবাসীরা। দুইনাম্বার মালতো এইখানেই পাঠাইবো সরকার। পুরান ঢাকাতেই দাহ্য রাসায়নিক দ্রব্যের দোকান চলবো এক্কেরে বাসার লগে। লাইসেন্স আছে না! রাষ্ট্রের এতো দায় কিসের। মডেল টাউনতো হইতাছেই...রাষ্ট্রের নজর রাখনের দায়িত্ব সেইখানে...
রাজধানী উন্নয়ণ কর্তৃপক্ষের নজরদারী পুরান ঢাকায় চলতে দেওন যাইবো না। ঐ অংশ অকেজো হইলেই না শ্রীবৃদ্ধি হইবো নতুন পার্টের। আমরা গালি দিমু পুরান ঢাকার মানুষরেই...অগো স্বভাব খারাপ, অরা খ্যাত! অরা হুদাই বিলাস দেখায়, অরা সব কিছুতেই ব্যবসার ধান্দা করে...
কিন্তু রাষ্ট্র কেমনে দায় এড়াইতে পারে শহরের একটা অংশের এই অবনতিতে? রাষ্ট্রের কি কোন দায়িত্ব নাই পুরান ঢাকারে মানুষ করনের! পুরান ঢাকাকেন্দ্রীক সন্ত্রাসীগো যেই আড্ডাখানা চালু আছে...তার পৃষ্ঠোপোষক কারা? কারা এইখানে জনপদের মধ্যে বিপজ্জনক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রাখনের লাইসেন্স পাশ করে? এই লেখার এই পর্যায়ে হয়তো ১৫৫ সংখ্যায় থাইমা নাই মৃত্যুর তালিকা...এই মানুষগো হত্যার দায় দায়িত্ব সরকার সেই পানচিনি অনুষ্ঠান আয়োজকের ঘাড়ে সাফল্যের সাথে চাপাইয়া দিতে পারবো তো!?





একই শহরের মধ্যে কলোনিয়ালাইজেশনের মত ! এক অংশ দাঁড়াবে আরেক অংশের হাড়ের উপর পা রেখে । যে শহরের একপাশে গুলশান , বনানী - সেই একই শহরে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি ঢুকানোর রাস্তা নেই , কি আজব ব্যাবস্থা !
আমার ছোটো বোনের ক্লাসমেট ইমতিয়াজ (এবার এসএসসি ব্যাচ , উদয়ন ) , ওর বড় ভাই আর মা - তিনজনই মারা গেছেন । একটু আগে জানলাম ।
ইমতিয়াজের বড়ো ভাই ইশতিয়াক নাকি এ+ পাইছিলো এসএসসিতে...
হ্যা । ওদের আগের ব্যাচ ।
সরকারীভাবে সচেতনমূলক প্রচারণা চালানোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এ কাজে বেসরকারী সংস্থাগুলাও চাইলে এগিয়ে আসতে পারে।
সময় এসেছে ফায়ার বিগ্রেড ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানোরও, এবং অবশ্যই এর নামে টাকা লুট-পাটের মচ্ছব বসানো যাবে না
ওয়ার্ড কমিশনার অফিসগুলোতে অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা উচিত এবং যথেষ্ট পরিমাণে
ডিসিসি এবং ডেসার উদ্যোগে পুরান ঢাকাকে অগ্রাধিকার দিয়ে শহরের সব এলাকার বৈদ্যূতিক ও অন্যান্য স্থাপনা সংস্কার ও পুনঃস্থাপনের কাজ শুরু করা উচিত অবিলম্বে।
এ বছর এখনো বর্ষা-পূর্ব খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয় নি। এর আগে এই কাজগুলো করতে পারলে ভালো। নাহলে আবার কবে আরেকটা দুর্ঘটনা এসে আমাদের টনক নড়িয়ে দেবে -সে আশায় বসে থাকতে হবে।
ইয়ে, জাস্ট জোকিং আর কি।
জনাব মীর, এ বছর এখনো বর্ষা-পূর্ব খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয় নি। এটা সত্য নয়। চলছে পুরাদমে!
ভাই তথ্যের গাফিলতি ধরিয়ে দেয়ার জন্য অজস্র শুকরিয়া
আমার বড় মামা আগে কায়েতটুলী থাকতেন। নীচে কারখানা আর ওপরে বাসা। আর ঐ দিকে সেটাই স্বাভাবিক। আমরা মামার বিশাল দালানের ছাদে ওঠে গুনতাম, ঐটা রিগার্ডের কেওড়া জলের বাসা, তারপরেরটা কামাল সোপ ফ্যাক্টরীর ফুপুর বাসা, তারপরেরটা রেশমী চুড়িওয়ালার বাড়ি, একটু সামনের লাল বাসাটায় থাকেন চিত্রনায়িকা সুজাতা।
আমাদের ছোটবেলার অসংখ্য ঈদের দিন, শবেবরাতের দিন, নতুন বছরের দিন কেটেছে কায়েতটুলীতে। মামারা এখন উত্তরায়, তাই আপনজন হারানোর কষ্ট নেই। কতোদিন আর ঐদিকে যাওয়া হয় না তার হিসেব নেই। কিন্তু যতোবার ঐদিকের কথাটা ভাবি কেমন যেনো কানের কাছে মৃত্যু ছুঁয়ে যায় মনে হয়
সত্যি এসব শুনলে, দেখলে মনটা প্রচন্ড ভারী হয়ে থাকে। কিছু করতে না পারার অক্ষমতা দারুন পীড়া দেয়।
আমার সবচে' ভয়ঙ্কর অনুভূতি হয় যখন দেখি কোন জায়গায় মানুষ এবং দাহ্য বস্তুর কাঁচামাল সমৃদ্ধ কারখানা একই সাথে অবস্থান করে। আবাসন এরিয়ায় কারখানা থাকার ঝুঁকিটা মাথায় নিয়ে যারা বসবাস করেন তাদের সচেতনতা দরকার, সরকারের দেখভাল দরকার এবং যেসব লোভী বাড়ির মালিক এদের সহাবস্থান নিশ্চিত করেন তাদের শাস্তি দেয়া উচিত। আমি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি, পুরানো ঢাকায় আমার কিছু ক্লায়েন্ট আছে। এরা পুরো মৃত্যুকূপে বসবাস করে। গিন্জি ঘরবাড়ি, নীচতলায় কারখানা উপরে আবাসন। সামান্য একটা দিয়াশলাই এর কাঠি অসাবধানে নীচের কারখানায় যদি জ্বলে উঠে মূহুর্তে পুরো কাঁচামাল এবং মেশিনগুলো জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে কারণ এসব কাঁচামাল মারাত্মক দাহ্য বস্তু। লালবাগে যে পরিমানের প্লাস্টিক কারখানা রয়েছে সেগুলো একেকটা এ্যটম বোম হয়ে বসে আছে।
সরকারের কাছে অনুরোধ আপনারা এসব কারখানা সরিয়ে নিন, মৃত্যুকূপ থেকে মানুষকে রক্ষা করুন।
পুরান ঢাকার এই অপরিকল্পিত বিস্তার হইছে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যরে মাথায় রাইখা। এই রাষ্ট্র-সরকার তাতে কখনো বাধ সাধে নাই। দুর্নীতি'র মধ্য দিয়া তারাও এইটার অংশ হইছে বরঙ...
পারবে, সাফল্যের সঙ্গেই পারবে নিশ্চিত।
পুরান ঢাকার দুই বড় দলের এমপিরে দেখেন। হাজি সেলিম আর পিন্টু...আর কিছু কওয়া লাগবে?
এই দেশের সরকার সব কিছুই পারে
একমত, তাছাড়া তিনি নিজেই তো ঢাকা শহরের অনেক পুরানো বাড়ি ভেঙ্গে এপার্টমেন্ট বানানোর প্ল্যান করে দিচ্ছেন
ধুর! কিছুই বলার নাই। আর ভাল্লাগেনা
মন্তব্য করুন