শকুনের অপেক্ষা থাকে কখন গরু মরবে...পুঁজিবাদ গরুটাকে মারে
২০০০ সালে কোন এক কর্মশালায় বর্তমিন বিশ্বে তথ্যচিত্রের অগ্রগিত কদ্দূর গেছে তার উদাহরণ হিসাবে আমরা তখনো অখ্যাত মাইকেল মুরের রজার এন্ড মি দেখি। পৌনে দু’ঘ্টার এই প্রামাণ্য চিত্র সেই থেকে আমার এবং আরো অনেকেরই মনে দাঁগ কেটে যায়। আমরা যারা তথ্যচিত্রের গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে নতুন কিছু করতে চাইতাম মাইকেল মুরের এই ছবি আমাদের যেনো দিক নির্দেশনা দেখায়। তথ্য চিত্রের যেই্ ঘরানায় তিনি কাজ করেছেন বা এখনো করে যাচ্ছেন তাকে ব্যাকরণগত ভাষায় বলে পার্সোনাল ডক্যুমেন্টারী। আমাদের আজকের আলোচনা যদিও রজার এন্ড মি নয়, তবু তার প্রথম ছবিতেই তিনি আমার এবং আরো অনেকের মনে যেভাবে আসীন হয়ে আছেন আর তার নিত্য নতুন অনুসন্ধানী প্রয়োগ করে যাচ্ছেন চলচ্চিত্রের পরিভাষায় তাকে এককথায় বলা যায় তুলনাহীন।
মাইকেল মুর সম্পর্কে বলতে গেলে এককথায় বলে দেয়া যায় তিনি একটিভিস্ট। তিনি সমাজের বিভিন্ন অসংগতিগুলিকে তার ক্যামেরায় বন্দী করেন। নিজে এবং বিশেষজ্ঞদের অভিমত নেন। কেবল চারকোনা স্ক্রীন বাস্তবতায় তার বিশ্লেষণ সীমাবদ্ধ থাকে না। ব্যক্তিগত ভাবে আমি হয়তো তার প্রতি খানিকটা অনুরক্ত বলে আমার লেখায় তার প্রশস্তিটাই মূখ্য হয়ে উঠবে। কিন্তু তবু মাইকেল মুরের ভক্ত এবং অভক্ত সবাই এককথায় স্বীকার করতে বাধ্য হবেন, মাইকেল মুর কখনো অসততার আশ্রয় নেন নাই। তিনি প্রায়শঃই ক্যামেরার সামনে আসেন। কিন্তু তার অভিব্যক্তিতে বোঝা যায় তিনি অভিনয় করেন না। উপলব্ধির জায়গা থেকেই তার চলচ্চিত্রের পত্তন। বক্তব্য ধর্মীতাই তার পুঁজি।
আমাদের দেশে মূলতঃ ৯/১১ প্রামাণ্য চিত্রটি দিয়ে তিনি ভদ্রসমাজে পরিচত হয়ে উঠেছিলেন। সেখানে তিনি আমেরিকান সামরিক নীতি, ধ্বংস পরবর্তী আমেরিকান রাষ্ট্রীয় নীতির সমালোচনাকে সামনে তুলে নিয়ে এসেছিলেন। মাইকেল মুরের এই প্রামাণ্যচিত্র সারা বিশ্বেই আলোড়ন তুলেছিলো সেই সময়। তারই ধারাবাহিকতায় গতো সপ্তাহে আমি তার নতুন মুক্তি পাওয়া প্রামাণ্যচিত্র ক্যাপিটালিজম: এ লাভ স্টোরী নামক ছবিটি নিয়ে আসি। ঢাকায় এখনো খুব ভালো প্রিন্ট আসে নাই বলে হল প্রিন্টেই ভরসা করে দেখতে বসে যাই। মুর তার পুরনো ছবিগুলির মতোন এই ছবিতেও খুব প্রাযুক্তিকভাবে উন্নত কোন ক্যামেরা তিনি ব্যবহার করেন নাই।
ছবির শুরুতেই আমরা দেখি একটা ডাকাতির দৃশ্য। রূপক অর্থ মাইকেল মুর আমাদের নিয়ে যান সেই জোর মুল্লুক তার’এর জগতে। যেখানে স্বাধীনতা আছে। যেই জগতে আছে সবলের বেচে থাকার অধিকার। আর যারা ভীত তারা দাসানুদাস। মুরের ভাষায় এই দাসানুদাস মানসিকতা এসেছিলো পৃথিবীতে রোমক সাম্রাজ্যের পথ ধরে। যারা শিখিয়েছিলো বিভাজনের গল্প। যদিও এই প্রমাণ্যচিত্র উদ্দেশ্য ইতিহাস বর্ণনার নয়। ২০০৯’এ এই পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া অর্থনৈতিক মন্দার ইতিহাসের একটা ব্যখ্যা তিনি দাঁড় করাতে চেয়েছেন তিনি ভাগ্যাহত মানুষের আবেগ প্রকাশের মধ্য দিয়ে। তিনি গেছেন মার্কিন সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশে। যেখানে মানুষ ক্রমাগত গৃহহীন হয়েছে। তাদের অপরাধ কিছুদিনের ইউটিলিটি বিল আটকে যাওয়া। রাষ্ট্রের নির্দয় মনোভাবে ভবিষ্যতের দিকনিশানাহীন মানুষেরা অসহায় নিশ্চুপ বসে আছে। তাদের আক্ষেপ, তারাতো খেটে খাওয়া মানুষ। তাদের হাত দিয়েই এই রাষ্ট্রের সকল উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।
তার বাইরে মুর একটি প্রশ্ন বার বা এনেছেন সবার সামনে, খুব অবশ্যম্ভাবী হলেও তা হলো ক্যাপিটালিজম আসলে কী। আর্কাইভ ফুটেজ থেকে তিনি বিভিন্ন আলোচনা উপস্থাপিত করেছেন। কিন্তু এক একজনের ভাষ্যে ক্যাপিটালিজম বা পুঁজিবাদ এসেছে এক এক ভাবে। কেউ ক্যাপিটালিজমকে দেখেছেন স্বাধীনতার স্বরূপ, ব্যবসায়ী দেখেছেন তার পণ্যর বাজারজাত করনের মাধ্যম। আর নারীরা দেখেছেন নতুন পণ্যের আস্বাদে। কিন্তু কোন প্রশ্নেই বেরিয়ে আসেনা পুঁজিবাদ আসলে কার জন্য সুফল বয়ে আনে।
মুরের এই ছবিতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সময়কার রাষ্ট্রপতিদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তাদের জীবন কাহিনী এসেছে। জিমি কার্টার, রোনাল্ড রিগ্যান, রুজভেল্ট, জন ম্যাককেইন, সারাহ প্যালিন সকলের বক্তব্যই তিনি তুলে ধরেছেন তার তথ্যচিত্রে। যার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদের অংগতিগুলো মূর্ত হয়েছে প্রতি মূহুর্তে। মাইকেল এমুর একটি জেমোক্রেটিক পরিবারে বড় হয়ে উঠেছেন। আমেরিকান গভর্নমেন্ট কখনোই তাকে সমাজতন্ত্রী হিসাবে চিহ্নিত করতে পারে নাই। কিন্তু একটি সুষম সমাজের প্রতি তার আগ্রহ টের পাওয়া যায় তার প্রত্যেকটি চলচ্চিত্রেই।
মুর আমেরিকার খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষের সাক্ষাতকার নিয়েছেন। তাদের আবেগের জায়গাগুলো স্পর্শ করতে চেয়েছেন। যার থেকে স্পষ্ট হয়েছে মার্কিনী নাগরিকেরাও চায় বৈষম্যের অবসান। একদিকে প্রাইভেট পুলে সাতার কেটে পার্টি কেন্দ্রীক জীবন যাপন, আর অন্যদিকে গৃহহীন মানুষের আর্তনাদ...এর কোনটাই আমেরিকানরা আর চায় না। যুদ্ধবিগ্রহের নামে যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে ব্যবসা পুঁজিবাদের দ্বার উন্মোচন করে রোমাঞ্চ বাড়ায় কিন্তু তাতে বৈষম্যের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। করারোপ হয় সাধারণ মানুষের উপর। ম্যুর এই বিষয়টাকেও মূখ্য আলোচনায় এনেছেন বাবা জর্জ বুশের আর্কাইভ ফুটেজের মাধ্যমে। এসেছে সারাহ প্যালিন। যে আমেরিকাকে একটি খ্রিষ্টান রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলো। পুঁজিবাদের বিমাতাসুলভ আচরণকে ম্যুর দেখাতে চেয়েছেন আমেরিকার জীবনযাত্রার নিত্যনৈমিত্তিক পরিসীমা হিসাবে। পুঁজিবাদের স্বাধীন সত্ত্বা আসলে কোথায় গিয়ে ঠেকে, পুঁজিবাদ কিভাবে ভালোবাসার উপকরণ হয়ে উঠে...এই ছবিতে তার নমূনা আমরা দেখতে পাই। পুঁজিবাদের অন্তরালে আসলে ক্ষমতার যেই চর্চা আর মুখোশের ব্যবহার মার্কিন শাসকেরা যূগ যূগ ধরে দেখিয়ে আসছে ম্যূর তা উন্মোচিত করেছেন তার ক্যামেরায়।
তবে একটা সংলাপ দিয়ে এই লেখা শেষ করতে চাই। একটি রিয়াল স্টেইট কোম্পানী, যার নাম কন্ডো ভালচার। মুর তার মালিককে জিজ্ঞাসা করেন এই ভালচার নামের সাথে রিয়াল স্টেইট ব্যবসার কী সম্পর্ক? মালিক খুব নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর করেন। the only difference is, I do it by my ownself…
আশা করি এই্ আলোচনা আপনাদের উৎসাহিত করবে মাইকেল ম্যুরের এই ছবিটি দেখবার জন্য। সেই আশা রেখে আজকের আলোচনার সমাপ্তি টানছি।
ভাল্লাগছে আলোচনাটা। ছবিটি দেখার আশা রাখি।
বাংলাদেশে যেই প্রিন্ট পাওয়া যাইতেছে সেইটা দেইখা আমি হতাশ। খুব বাজে প্রিন্ট। তয় মাইকেল ম্যুরের ছবির ভরসা প্রিন্টে না বইলা দেখতে পারছি পুরাটা...আরেকটা বিষয় আছে ফাহিমে যেই কপি আছে তাতে সাবটাইটেল নাই...
প্যারাতে একটা লাইন স্পেস দিয়া দিলাম। পাঠকদের পড়ার সুবিধার্থে। আপনার অনুমতি না নিয়েই।
ভালো লাগলো ।
৯/১১ দেখা হয়নাই, দেখবো দেখবো করেও।
মাইকেল ম্যুরের সবচাইতে ভালো ছবি মনে হয় রজার এন্ড মি...ঐটা দেখার চেষ্টা কইরেন...
আফসোস আছে, মাইকেল মুরের কোনো ছবিই দেখা হয় নাই। আপনার এই লেখায় দেকার ইচ্ছা বাড়ল।
দেখেন দেখেন...মাইকেল ম্যুরে আনন্দ আছে...
ঠিক মুভি পাগল না হয়েও ছবিটি দেখার আগ্রহ তৈরী করে।
ধন্যবাদ লেখককে
ছবিটি দেখা হয়নি। দেখার আগ্রহ থাকলো।
মাইকেল মুরের ছবিগুলো আসলে পার্সোনাল ডকুমেন্টরিই। একটা বক্তব্য ঠিক করা থাকে। তারপর সেই বক্তব্যের সপক্ষ যুক্তিগুলোকে তুলে ধরেন তিনি।
"যার থেকে স্পষ্ট হয়েছে মার্কিনী নাগরিকেরাও চায় বৈষম্যের অবসান।" মার্কিন নাগরিকদের সাক্ষাতকার নিয়ে তিনি এই চিত্রটি তুলে ধরেছেন তথ্যচিত্রে। কিন্তু মার্কিনীরা সিংহভাগ আসলে সাম্রাজ্যবাদরেই সমর্থন করে না কি? যেখানে সমগ্র বিশ্বের উপর মার্কিন প্রভুত্বই কায়েম থাকবে?
সাধারণ খাইটা খাওয়া মার্কিনীরা কি মনে করে সেইটা ম্যুর সাহেব দেখাইছেন। তয় তাগো বক্তব্যে রিসেশনের প্রভাব হয়তো কাজ করছে...সাম্রাজ্যবাদ সমর্থন করাতে জনগণের কিছু আসে যায় না বস। ঐটা এক্কেরেই শাসকগো মানে পুঁজির নিয়ন্ত্রকগো বিষয়...যেই কারণে মার্কিনীরা আজকাল ভোট দিতেও যায় না...
ভালো লাগলো লেখাটা।
অঃটঃ আপনাকে দেখাই যায় না এখানে
কিছু ব্যক্তিগত ঝামেলার কারণে কোনখানেই এতোদিন আমারে স্বরূপে দেখা যায় নাই...তয় এইবার থেইকা কিছু জায়গায় দৃশ্যমান হওনের চেষ্টায় থাকুম বইলা সিদ্ধান্ত নিছি। কেবল একটা জায়গায় আমি সবসময় দৃশ্যমান সেইটা হইলো ফেইসবুক...আমারে যুক্ত করতে পারেন আপনের তালিকায়...যদি থাকে আপনের একাউন্ট...আমারে vashkar abedin দিয়া সার্চ মারলেই পাইবেন...
চমৎকার আলোচনা।
ধন্যবাদ নুশেরা...আরিফ জেবতিকের অনুরোধে চলচ্চিত্র আলোচনা করতে শুরু করছি। ধন্যবাদটা আসলে তারো প্রাপ্য...
মন্তব্য করুন