আগুণ কি আর বোঝে, কে মালিক কে শ্রমিক!
কিভাবে আগুণ জ্বললো? কেনো আগুণ জ্বললো? কার বা কাদের চক্রান্তে অথবা দোষে আগুণ ছড়িয়ে পড়লো? তাজরীন ফ্যাশন্স নামের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরীতে সরকারী হিসাবে ১১২ আর অনুমেয় দুই শতাধিক আগুণে পোড়া লাশের গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ার আগেই এসব প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে। সরকারী মহলে যখন জোরেসোরে রব উঠেছে এই আগুণ লাগার ঘটনা বিরোধী দলের নাশকতা তখন বেসরকারী মহলেও আগুণের বিষয়টাই মূখ্য হয়ে উঠেছে। শ'য়ে শ'য়ে আগুণে পোড়া লাশের জন্য দায়ী করা হচ্ছে ফায়ার এস্কেপের অভাব আর কর্তৃপক্ষের আগুণ সম্পর্কীত জ্ঞানের অপ্রতুলতা।
দেশের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরীগুলিতে আগুণ লেগে মানুষ মরে যাওয়াটা যদিও বেশ কয়েক বছর ধরেই স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে; তাই দেখলাম সাধারণ মানুষরাও জানে আগুণে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া গার্মেন্ট কর্মীর পরিবার একলক্ষ টাকার অঙ্কে ক্ষতিপূরণ পায়। গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এই ক্ষতিপূরণের মাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে তা'ও বছর দুয়েক। এবার দেশের বেশকিছু শ্রমিক ঘনিষ্ঠ বামপন্থী দল অবশ্য দাবী জানিয়েছে এই ক্ষতিপূরণের অঙ্ক যেনো বাড়িয়ে পাঁচ লক্ষ টাকা করা হয়। হয়তো দ্বি বা ত্রিপক্ষীয় সমঝোতায় এই অঙ্ক বাড়বে। দেশের জিডিপি আর এনডিপিতে যে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। সারা বিশ্বেই যে তাদের নিষ্ঠার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে বহুকাল।
আগুণ লাগার পর আমি আমার চারপাশের মানুষের আহাজারী শুনতে পেয়েছি; এতোগুলো মানুষ মারা গেলো! অধিকাংশ গার্মেন্ট কর্মী নারী হওয়াতে অনেকেই তাদের ফেইসবুক স্টেটাস উৎসর্গ করেছেন সেলাই দিদিমনিদের উদ্দেশ্যে। যাদের অনেকের মুখেই গার্মেন্ট সেক্টরে চাকরীর জন্য আজকাল বাড়ির কাজের জন্য প্রয়োজনীয় ঝি খুঁজে পাওয়া যায় না বলে আক্ষেপ করতেও শুনেছি বছর কয়েক আগে। দিনে দিনে সব সয়ে যায়। তাই গার্মেন্টস শ্রমিক আমাদের সমাজের বাস্তবতা হিসাবে দাঁড়িয়ে গেছে। সকাল হলেই ঘুম ভাঙে হাস্যোজ্জ্বল গার্মেন্ট কর্মীদের দলে দলে ফ্যাক্টরীতে যাওয়ার পদশব্দে। তাদের জন্য সকালের মর্নিং ওয়াক যদিও বাঁধাগ্রস্ত হয় মধ্যবিত্ত অনেকের, যারা আমার মতোই এখনো শহরের প্রান্তীয় এলাকাগুলোতে বাস করে।
দেশের অধিকাংশ গার্মেন্ট ফ্যাক্টরীতে অগ্নি নির্বাপনে সুব্যবস্থা নাই, বিকল্প সিঁড়ি নাই, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নাই এসবই এখন আলোচনার মূখ্য বিষয়। যেনো আগুণ না লাগলেই আমরা খুশি অথবা লাগলে পড়ে যাতে লাফিয়ে ঝাপিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে শ্রমিকেরা-যাতে তাদের বেশিরভাগই বেঁচে যায়-যাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো কম হয়। আমাদের গার্মেন্ট সেক্টরে যেনো মূল সমস্যা আগুণ খেলার; এভাবেই আমরা মধ্যবিত্তরা ভাবতে ভালোবাসি। তবে এবারে তাজরীন ফ্যাশন্সের ফ্যাক্টরীতে আগুণ লাগার পর কর্তৃপক্ষীয় আচরণের জন্য কিছু বিষয় সামনে চলে এসেছে। যেমন আগুণ লেগেছে এটা জানার পরেও কর্তৃপক্ষ বেরিয়ে যাওয়ার ফটকে তালা লাগিয়ে দিয়েছিলো। তারা ফায়ার এলার্ম নিয়ে মিথ্যাচার করেছে শুরুতে কর্মীদের শান্ত করার জন্য। কি নিষ্ঠুর তাজরীন ফ্যাশন্সে চাকরীরত ম্যানেজারেরা! আবারো এমনি উঠেছে মধ্যবিত্তের হায় হুতাশ!
কিন্তু বাস্তবতা হলো দেশের প্রায় সব গার্মেন্ট ফ্যাক্টরীতেই নিরাপত্তার নামে এমন প্রক্রিয়া চালু আছে। নিরাপত্তা মানে শ্রমিকের নিরাপত্তা নয়। এই নিরাপত্তা পোষাকের বা পণ্যের নিরাপত্তা। এই নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা। শ্রমিকরা কি মানুষ নাকি যে তাদের জন্য ফটক খুলে দিতে হবে খানিক আগুণ জ্বললেই! যেই কারণে এর আগে ফায়ার এস্কেপ থাকা সত্ত্বেও আরো বেশ কিছু গার্মেন্ট ফ্যাক্টরীতে শ্রমিকরা আটকা পড়ে আগুণে ভস্মীভূত হয়েছে। কর্তৃপক্ষীয় বা মালিকপক্ষীয় অনুধাবনে চাকরী করতে আসা বেশিরভাগ শ্রমিক চোর। তাদের মধ্যযূগীয় দাসদের মতোন পোষাক খনিতে ঢোকানো হয় আবার আগাপাশতলা পরখ করে বাইরে বের হওয়ার অনুমতি মেলে!
শ্রমিকদের চাহিদার কোনো গুরুত্ব গার্মেন্ট ফ্যাক্টরীগুলোতে নাই। ট্রেড ইউনিয়ন মানেই মালিক পক্ষের জবাবদিহিতার জায়গা তৈরী হওয়া। এতো টাকা ইনভেস্ট করেও আবার তুচ্ছ শ্রমিকের চাহিদাপূরণে ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহিতা! এও সয়! গার্মেন্ট শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরী ধার্য্য করে দিয়েছিলো সরকার গতো বছর। কিন্তু অধিকাংশ ফ্যাক্টরীতেই তা মানা হয় না। মজুরীর নিয়ম মানা হয়েছে কিছু ফ্যাক্টরীতে তবে সেসব কারখানায় শ্রমিকের প্রাপ্য নাস্তার ডিম ছেটে ফেলা হয়েছে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার উছিলায়। দেশের একজন গার্মেন্ট শ্রমিকও নিশ্চিত করে বলতে পারে না আগামী দিন তাদের চাকরী থাকবে কীনা! অধিকাংশ ফ্যাক্টরীতে ঈদের বোনাস দেয়া হয় ঈদের পরের মাসে। সেখানেও থাকে শুভঙ্করের ফাঁকি।
শ্রমিক স্বার্থের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েই আমাদের গার্মেন্টস এসোশিয়েনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা দাবী করেন এভাবেই তারা রেমিট্যান্স উপহার দেন দেশকে। অথচ স্বল্প মজুরীতে অধিক দক্ষ শ্রমিক আছে বলেই পশ্চিমা বায়াররা এখনো বাংলাদেশে আসতে পারে। শ্রমিকদের উপর ভর করেই আসে হাজার কোটি টাকার অর্ডার। অথচ গার্মেন্টস মালিকরা ট্যাক্সে ছাড় পায়...সিআইপি হওয়ার বেলায় প্রেফারেন্স পায়। শ্রমিকের বেলায় কিচ্ছু জোটে না। তাদের যে কে সেই আগুণে পুড়তে পুড়তেই জীবন কাটিয়ে দিতে হয়!
অগ্নিনির্বাপন কিম্বা ক্ষতিপূরণে কখনোই দেশে বিরাজিত বর্তমান সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব না। গার্মেন্ট সেক্টরে শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া এই পুড়ে ছাই হয়ে মরে যাওয়ার নিয়তি ঠেকানো সম্ভব না। তবে এখনো বিশ্বাস রাখি অথবা আপ্তবাক্যের মতোন মাঝে সাঝে আউড়ে যাই আগুণ কি আর বোঝে, কে মালিক কে শ্রমিক! একদিন এমন আগুণ ছড়িয়ে পড়বে দিকেদিকে দিগ্বিদিকে...বারিধারা-গুলশান-বনানী-ধানমণ্ডিতেও!
রেভ্যুলেশন ছাড়া বদলাবে না, কবে শুরু হয় সেটাই হলো কথা এখন
কৃষক, পোষাক-শ্রমিক আর প্রবাসী-শ্রমিক এই তিনে টিকে আছে দেশটা। আর এদেরকে যে যেভাবে পারছি ব্যবহার করে নিজেদের জীবনের সুখটান দেয়ার ব্যবস্থা করছি...
~
কিছু বলার ভাষা নাই।লাশের এমন মিছিল পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় কি!!!!!!!!!
এমন বোবা বেঁচে থাকায় লজ্জা হচ্ছে বেশি।
শুধু কথায় কোন লাভ নাই। রাস্তায় না নামলে সরকার দেখবে না, আর যখন দেখবে জেলে পুরে দিবে। আগুন লাগতেছে গার্মেন্টসে আর পুড়তেছে আমাদের অর্থনীতি।
মন্তব্য করুন