সুনামগঞ্জ হাওড়ে স্মৃতিময় দুই দিন
২৭ তারিখ রাত সাড়ে ১০ টার বিআরটিসিতে চেপে বসলাম আমরা ৩ জন। এক দিন আগে চলে গেছে আমাদের আরো ২ জন। তৃতীয় বারের মত আমরা যাচ্ছি সুনামগঞ্জ শিশু পল্লীতে। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে এতিম খানা। এর আগে দুবার গিয়ে সেখানকার ১০০ এতিম শিশুদের সাথে কিছু সময় কাটিয়েছিলাম। ওদের জন্য টুকটাক এটা-সেটা নিয়ে গিয়েছিলাম। শেশবারের মত ওদের দাবী ছিল- কিছু খেলনা। সেটা আগেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ছোট মেয়েগুলো বায়না ধরেছে- আমরা কজন না গেলে ওরা সে খেলনায় চড়বে না। অগত্যা আমাদেরও যেতে হলো। আমরা মানে আমি, গিয়াস আহমেদ, রাশেদুল হুদা, অঞ্জন আর শিবানীদি। শিলং থেকে ট্যুর সংক্ষেপ করে আমাদের সাথে যোগ দিলো- সুবীর মহাজন আর চট্টগ্রাম থেকে সুবীরের বন্ধু ফারুক।
২৮ তারিখ সকাল ৭ টায় আমরা ৩ জন পৌঁছলাম সুনামগঞ্জ। সড়ক ও জনপথের রেস্ট হাউজে আমাদের থাকার জায়গা। সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আমরা সবাই যখন এতিমখানায় গেলাম- তখন বেলা বারোটারও কিছু বেশি। ১০০ টি ছোট ছোট মেয়ে আমাদের অপেক্ষায়। আমাদের দেখে ওদের আনন্দের আর সীমা নেই। শিল্পী বন্ধু রাশেদের কল্যাণে শিশুদের জন্য নিয়ে যাওয়া খেলনাগুলো স্থাপন করা হলো। লাকড়ি দিয়ে বানানো হলো গেট। আমরা যাব শুনে সুনামগঞ্জ থেকে আরো গেলেন- প্রেস ক্লাব সভাপতি, চেম্বারের প্রেসিডেন্টসহ বিভিন্ন টিভি আর পত্রিকার ডজন খানেক সংবাদকর্মী। টুকটাক আনুষ্ঠানিকতা সেরে শিশুদের জন্য খুলে দেয়া হলো- ওদের কাঙ্খিত প্লে প্লেআউণ্ড। ওদের আর আনন্দের সীমা নেই। এক একটি খেলনায় ঝাপিয়ে পড়লো ছোট ছোট বাপ-মা হারা এতিম মেয়েগুলো। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম। অবাক হয়ে দেখলাম- কত অল্পতে ওরা খুশি...। দুপুরে ওদের সাথে খেলাম। তারপর ওদের বিভিন্ন পরিবেশনা। গান, নাচ চলতে থাকলো। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা। আমরা ফিরে আসলাম শহরে।
আজ জন্মাষ্ঠমী। কালীবাড়িতে গেলাম। মনোজ্ঞ এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখলাম। কালী মন্দিরের পাশেই সুদ্বীপ আর প্রদ্বীপদের বাসা। জমজ দুই ভাই। নিয়ে গেলো বাসায়। নিজেদের দোকানের মিষ্টি আর দই দিয়ে আপ্যায়িত করলো আমাদের। সেখান থেকে সুনামগঞ্জ চেম্বার অফিস। চেম্বারের প্রেসিডেন্ট এতিমখানার মেয়েদের জন্য একটা রঙ্গীন টেলিভিশন গিফট করলেন। সেটা আমাদের উপস্থিতিতেই হস্তান্তর করা হলো- এতিমখানার সুপারিনটেনডেন্টের হাতে। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শহরের মিডিয়াপল্লী মানে বিভিন্ন পত্রিকা আর টিভি অফিসে। ক্ষাণিক সময় কুশলাদি বিনিময়। তারপর সদলবলে অলোকদার বাসায়। আমাদের রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখানে। খেতে বসে আক্কেল গুড়ুম। হরেক রকমের খাবার। একটার পর একটা আস্ই থাকলো। প্রায় সবই মাছ দিয়ে বানানো। হাওড়ের টাটকা মাছ বলে কথা। টেংরা মাছ, কৈ মাছ, রুই মাছ, পাবদা মাছ, বোয়াল মাছ, ছোট মাছ... আমরা খেতে থাকলাম, খেতেই থাকলাম। একসময় খাওয়া শেষ হলো। মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। অলোকদার বাসা থেকে হেটে চলে এলাম অঞ্জনদাদের বাসায়। চললো আড্ডা, চা, পান আর সাথে গানতো আছেই। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম- এই শহরের সবাই গান করে। সে গান শুধু গান নয়- প্রাণ থেকে আসা শব্দাবলী। এত দরদ দিয়ে কাউকে কোথাও গান করতে দেখিনি আমি। রাত দুইটার পরে আসর ভাঙতে হলো। গেলো রাতেও ঘুমাইনি। আজ একটু না ঘুমালে আর চলছেনা। তাছাড়া সকালে আবার বজরা নিয়ে হাওড়ে যাব। রুমে এসে ঘুমাতে ঘুমাতে সকাল।
কথা ছিল, দশটার মধ্যে আমাদের নিয়ে বজরা ভাষানো হবে সুরমায়। আমরাও মোটামুটি দশটার মধ্যে হাসন রাজার বাড়ির ঘাট থেকে বজরায় উঠলাম। একজন একজন করে আসতে আসতে এগারোটা বেজে গেলো। আমাদের ২৮ জনকে নিয়ে আমাদের বজরা স্টার্ট করলো সাড়ে এগারোটায়। এদিকে সকাল থেকেই টিপ টিপ বৃষ্টি। কারো মধ্যেই বিকার নেই। মনের আনন্দে সবাই বজরার ছাদে দাঁড়িয়ে ভিজছে। সিদ্ধান্ত হলো- বিকেল ৪/৫ টার মধ্যে আমরা ফিরে আসবো। দুপুরে খাবারের জন্য শুকনো খাবার নিয়ে নেয়া হলো। চানাচুর, লুচি, ভাজি, চিপস, পাউরুটি, মুড়ি, পানি, পুরো এক কাঁধি কলা বজরায় ঝুলিয়ে আমরা ছুটছি মানে আমাদের বজরা ছুটছে। সুরমা নদী পেরিয়ে আমরা পড়লাম- খরচার হাওড়ে। সেখান থেকে মনীপুরি ঘাট। আমাদের বজরার মাঝি তেল নিলেন। তারপর আবার ছুটে চলা...। এর মধ্যে গান, খাওয়া আর ছবি তোলা চলছে-পাল্লা দিয়ে। বেলা তিনটা নাগাদ পৌঁছলাম নারায়ণতলা। যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে জিরো পয়েন্ট। নদীর ওপাশেই মেঘালয় আর আসাম অঞ্চল। পাহাড়ের কোলে সাদা তুলার মত মেঘ ভাসছে। কী অপার্থিব দৃশ্য! বজরা ভেড়ানো হলো নদীর পাড়ে। আশে পাশে শখানেক ইঞ্জিন চালিত ট্রলার আর ছোট ছোট নৌকা। নদী থেকে সিলেটি সেন্ট আর পাথর তুলে ট্রলার আর নৌকা বোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছে। এটাই এখানকার লোকজনের মূল আয়ের উৎস। নদীর পাড়ে বিশাল বালুকাবেলা। আমরা সবাই নামলাম। আগেই জেনেছে- মাইল খানেক দুরে রয়েছে একটি গণকবর। সেটা না দেখে যাই কী করে ?
.jpg" />
বালুর উপর দিয়ে হাঁটা শুরু আমাদের। একটু কষ্টেরই সেই হাঁটা। তারপরও আমরা হাঁটছি। একসময় এসে পৌঁছলাম সেই গণ কবরের পাশে। সবাই কেমন জানি চুপ। এই গণ কবরটিতে শুয়ে আছেন স্বাধীনতা যুদ্ধের ৪৮ জন বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। পাশেই তাঁদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ। যদিও এই স্মুতিসৌধের নির্মাতার নাম কেউ বলতে পারলেন না। পেয়ে গেলাম ৪৮ জন শহীদ বীরের নাম। এরা হলেন- মো. মন্তাজ মিয়া, সালাহ উদ্দিন, মো. রহিম বখত, মো. জবান আলী, মো. তাহের আলী, মো. আ. হক, মো. মুজিবর রহমান, মো. নুরুল ইসলাম, মো. আ. করিম, মো. সুরুজ মিয়া, মো. ওয়াজেদ আলী, মো. সাজু মিয়া, মো. ধনু মিয়া, মো. ফজলুল হক, মো. সামছুল ইসলাম, মো. জয়নাল আবেদিন, মো. মরম আলি, আবদুর রহমান, মো. কেন্তু মিয়া, মোস্কফা মিয়া, মো. ছাত্তার মিয়া, মো. আজমান আলি, মো. সিরাজ মিয়া, মো. সামছু মিয়া, মো. তারা মিয়া, মো. আবেদ আলি, মো. আতর আলী, মো. লাল মিয়া, মো. চান্দু মিয়া, মো. সমুজ আলি, মো. সিদ্দিকুর রহমান, মো. দান মিয়া, মো. মন্নাফ মিয়া, মো. রহিম মিয়া, আলী আহমদ, মো. সিদ্দিক মিয়া, মো. এম বি সিদ্দিক, মো. সায়েদুর রহমান, মো. রহমত আলি, মো. আবদুল হামিদ খান, মো. আ. সিদ্দিক, মো. আবদুল খালেক, যোগেন্দ্র দাস, শ্রীকান্ত বাবু, হরলাল দাস, অধর দাস, অরবিন্দু রায় ও কবিন্দ্র নাথ। আশেপাশের এলাকায় নিহত এই সব বীর শহীদদের এনে এখানে গণকবর দেয়া হয়েছে। এটি সুনামগঞ্জ শহর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দুরে। বাই রোডে আসা যায়। ইজি বাইক বা মোটর সাইকেলে। দুটোই ভাড়ায় পাওয়া যায়। এক মোটর সাইকেলে ২ জন করে আসা যায়। ভাড়া জন প্রতি ৫০ টাকা করে। ইজি বাইকে আসলে ৮ জন আসা যায়। আপ-ডাউন নেবে ৫০০/৬০০ টাকা। এই জায়গার নাম ডলুরা।
গণকবর দেখে বেরিয়ে আসলাম আমরা। বিকেল হয়ে গেছে। একটু দুরের এক দোকানে গরম গরম পিঁয়াজু আর চিতই পিঠা ভাজছে। সবাই খেলো গোগ্রাসে। সাথে টিউবওয়েলের ঠাণ্ডা পানি আর লাল চা। এবার আবার হাঁটা আমাদের বজরার উদ্দেশ্যে। বিকেল ৫ টা নাগাদ আমরা সবাই বজরায়। বজরা ছুটে চলছে সুনামগঞ্জের দিকে। সবাই ছাদে। আবার গানের আসর। এতটুকুন ক্লান্তি নেই সুনামগঞ্জের গায়েনদের মধ্যে। এক এক করে গেয়েই চলছে ওরা। সুহেল রানা, তুলিকা, দেবদাস গেয়েই চলছে... অন্যরা গলা মিলাচ্ছে। সুনামগঞ্জ হাসনরাজার ঘাটে যখন আমরা তখন ৬ টা বাজে। ক্লান্ত সবাই যে যার বাড়ির দিকে। আমরাও আমাদের রেস্ট হাউজে। একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার। রাতের বাসে আবার ঢাকায় ফিরতে হবে।
রুম থেকে বেরুলাম- ৮ টার পরে। শহরটা একটু ঘুরে দেখলাম। তারপর আবার অঞ্জনদার বাসায় আমরা সবাই। আবার শুরু হলো গানের আসর। রাতে আমাদের এখানেই খাবার কথা। গান শুনতে শুনতে রাত ১০ টা ৩০ বেজে গেলো। গান ছেড়ে উঠতে মন চাইছে না। কিন্তু উপায় নেই গোলাম হোসেন। রাত এগারোটায় গাড়ি আমাদের। খেতে বসে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। একটার পর একটা খাবার আসছে। সবগুলোই মাছের আইটেম। ছোট মাছ বেগুন দিয়ে, কাঁইক্কা মাছ ভাজি, চিংড়ি মাছ, কৈ মাছ, বোয়াল মাছ, পাবদা মাছ, দেশি মাগুর মাছ, রুই মাছ, আড় মাছ, কালি বাইশ মাছ...। আমরা একটা একটা করে খাচ্ছি। এদিকে ঘড়ির কাঁটা এগুচ্ছে...। বাড়ির মালিক কোন ফাঁকে যেনো একজনকে বাস কাউন্টারে পাঠিয়ে দিয়েছেন। যতই বলি, সময় নেই। খেতে পারবো না- ততই তিনি হাসেন। আর একটার পর একটা মাছের আইটেম তুলে দিচ্ছেন পাতে। একসময় খাওয়া শেষ করি। ততক্ষণে ১১ টা বেজে গেছে প্রায়... বাস কাউন্টার সে বাসা থেকে ৫ মিনিটের রাস্তা। রাস্তায় বেরিয়ে দেখি অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছুটছি আমরা। আমাদের ৫ জনকে বিদায় জানাতে আমাদের সাথে আরো ১০/১২ জন এলেন বাস কাউন্টার পর্যন্ত। বাস দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জন্য। আমরা সবাই ভিজে একাকার। বাসে উঠলাম। বাস ছাড়লো। বাইরে আমাদেরকে বিদায় জানাতে আসা মানুষগুলো দাঁড়িয়ে আছে... প্রকৃতির বৃষ্টিতে ভিজছে ওরা। আর আমরা ভিজছি ভেতরের বৃষ্টিতে...
আপনাকে অভিবাদন। আপনার / আপনাদের জীবন কত আনন্দময় সার্থক। এই এতিম শিশুগুলির হাসিমুখের চেয়ে পবিত্র আনন্দ আর কোথায় আছে দাদা ভাই। আপনার ভ্রমনের চেয়ে আমাকে আকৃষ্ট করেছে আপনার বাচ্চারা। ভাল হোক আপনার /আপনাদের সবার।
অনেক ভালো লাগলো আপনাদের এই ট্যুর। একসাথে এতগুলা পিচ্চির আনন্দের কারন হতে পারাটাই অসাধারন সৌভাগ্যের ব্যাপার।
বহুদিন পর আপনার পোস্ট, তাও এত সুন্দর একটা ভ্রমনের কথা...
গুড জব
বাচ্চাদের আনন্দ দেখে আনন্দ লাগলো ।
আর মাছের কথা শুনে লালা ঝরতেছে । খাবারের বিবরণ দিতে কইছে ক্যাডা ?
মাছ কোন খাবার হলো? শুধু কাটা
(
লিখতে ভুলে গেছি। এত্ত এত্ত টাটকা মাছ রাস্তা- ঘাটে দেখে আমাদের সফরসঙ্গী রাশেদ বললো,

চল সবাই মিলে বাসার জন্য মাছ কিনে নেই।
আমরা বললাম, নেব কিভাবে ?
ক্যানো, ফরমালিন দিয়ে- রাশেদের তড়িৎ জবাব...
শিশুদের জন্য আপনাদের উদ্যোগ সত্যি অনেক অনেক ভালো কাজ।
ঘুরাঘুরিও সিরম হলো। জীবন এমন আনন্দময়ই থাকুক জীবনভর। এসব ট্যুরের ছবি দেখে, গল্প পড়ে হিংসা হয় এমন মানুষের ভাগ্যকে।
মাছের কথা শুনলেই খেতে ইচ্ছা করে।
এতিমদের জন্য আপনার ভালবাসা দেখে মুগ্ধ। ইচ্ছা করে শেয়ার করতে। কিছু করতে ইচ্ছা করে। আমিও আমার পরিসরে আমার গ্রামে কিছু চেষ্টা করি। একদিন লিখবো। আপনার মত অত সুন্দর করে বর্ননা করতে হয়ত পারবো না।
উফ্ !
লোভ জাগানিয়া পোষ্ট! দারুণ লাগলো।
হাওড়ে যাইতে চাই মেসবাহ ভাই।
লাভ ইউ মেসবাহ ভাই।
মন্তব্য করুন