দূরত্ব
বাসার দরজায় আমাকে দেখেই লিজা প্রান খোলা হাসি দিয়ে আমাকে স্বাগত জানালো। আমাকে বসতে
বলে নিজে সামনের সোফায় বসতে বসতে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করলো --কি ব্যাপার? এতদিন পর মনে পড়লো। আমিও রহস্যময় হাসি হাসতে হাসতে বললাম -- মনে পড়ে আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগে আমরা আজকের দিনে কোথায় ছিলাম?
--হ্যাঁ, কলকল করে হাসতে হাসতে বললো ---একটা সবুজ পাহাড়, তার নীচে কুলকুল বেগে বয়ে যাওয়া নদী।।
---মনে পড়ে সেই নদীর তীরে ঘাসের উপর বসে আমার হাত দুটি ধরে কি বলেছিলে তুমি? আমি মৃদু হাসতে থাকি। এরপর একদিন খুব কাছে আসতে চেয়েছিলাম।
মনে মনে ভাবি --ঐ একদিন তোমার সেই হাত দুটি আমি আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়েছিলাম। ভালবাসার আবেগে একটু সাহসী হয়ে যখন তোমার ঠোঁটে চুমু খেলাম, তখন তুমি থর থর করে কাঁপছিলে। তোমাকে দেখে আমি বোধ হয় আর একটু বেশী দুঃসাহসী হয়ে পড়েছিলাম। আর তাই তুমি আমার আদর মাখা সেই হাত দিয়ে ইশারায় বাইরের গেট দেখিয়ে দিয়েছিলে। আমি বিনা বাক্যে তোমার নির্দেশ পালন করেছি। এতদিন আর আসিনি।
--তারপর এই এলে।
-- তুমি বলেছিলে আমাকে স্বাধীকার আন্দোলনে অথবা সাম্যবাদী আন্দোলনে যোগ দিতে । দু’বছর আমি ওদের দলে ছিলাম। ওরা আসলে সন্ত্রাসবাদী। সংগ্রামী রূপটা লোক দেখানো। অনেক পরে বুঝেছি।
আমি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় বাইরে খুব হৈচৈ হচ্ছে শোনা গেল। লিজা মাথা উঁচু করে বাইরে দেখতে চেষ্টা করলো। আমি তাকে বললাম --এমন হৈচৈ তো প্রতিদিনই হচ্ছে। হাত ঝেড়ে বিরক্তি প্রকাশ করে আমাকে চুপ থাকতে বললো। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে আমি দেখলাম বাগানের পিছন দিক দিয়ে একজন মাঝবয়সি লোক দৌড়ে আসছে। সে সোজা দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে ডুকরে কেঁদে উঠলো। আমাকে বাঁচান। আমার কোন দোষ নেই। আমাকে পেলে ওরা মেরে ফেলবে।
এমন সময় বাইরে থেকে একটি কন্ঠস্বর চিৎকার করে বললো-- আমি দেখেছি তাকে এই বাড়িতেই ঢুকতে।
আমি ব্যাস্ত স্বরে বললাম “কে আপনাকে মেরে ফেলবে? কেন?
লিজা হাত তুলে আমাকে বাধা দিয়ে চাপা স্বরে বলে উঠলো আহ্ । আমি বুঝে গেলাম ও লোকটিকে সাহায্য করতে চাচ্ছে।
একপাশে সরে দাঁড়িয়ে ও লোকটিকে একটানে ঘরের ভিতরে নিয়ে এল। তাকে জিজ্ঞাসা করল --আপনাকে কী আমার কাজের লোকেরা কেউ দেখেছে।
সে উত্তর দিল--মনে হয় না, আমি জানি না।
---- আপনি আমার সাথে আসুন, বলে তাকে সোজা ওর বেড রুমে নিয়ে এল। আমকে খুব বিরক্তির সাথে বললো --ওখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? এখানে আসো।
আমি ঘরে ঢুকবার সাথে সাথে লিজা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। আমি বুঝে পেলাম না এখানে সে কোথায় এই লোকটিকে লুকাবে? আমরা সবাই না আবার বিপদে পড়ি। এমন সময় দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে লিজার কাজের মেয়ে জাসিকা বললো --আপা ওরা বাগানে ঢুকে পরেছে। লিজা দরজা খুলে দিয়ে ওকে বলল-- দরজা ধাক্কা না দেয়া পর্যন্ত দরজা খুলবে না। আর খুব স্বাভাবিক থাক। এখন তুমি রান্না ঘরে যাও।
তাকিয়ে দেখি লোকটি ভয়ার্ত মুখ করে ঘরের এককোনে দাঁড়িয়ে আছে। যেন আমরা তার ত্রানকর্তা। --আপনি অবশ্যই বাচঁবেন, বলে লিজা বিছানার কাছে গেল। ক্ষিপ্র হাতে উপরের তোশকটি তুলে ফেললো। জাজিমটি উঠাবার জন্য আমাকে ও লোকটিকে ইশারা করলো। আমরা তিনজন মিলে জাজিমটি একপাশে সরালাম। এবারে খাটের একটি পাতাটন সরিয়ে লোকটিকে ওর মধ্যে শুয়ে পরতে বলো। লোকটি ভিতরে শুয়ে পড়তেই উপরে পাটাতন বসিয়ে দিয়ে জাজিমটি বিছিয়ে দিলাম দুজন মিলে। এবারে লিজা তোশকটি বিছিয়ে দিয়ে উপরে পরিপাটি করে বিছিয়ে দিল বিছানার চাদর। বেড কাভারটি বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে এক কোনা ধরে ছুঁড়ে ফেললো ঘরের মেঝেতে। সম্পূর্ন কাজটি করতে মোট দেড় মিনিট সময় লাগলো।
প্রধান দরজা ধাক্কার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ওরা খুব অস্থীর। কাজের মেয়ে জাসিকা খুব জোড়ে জোড়ে বলছে ---কই কেউ তো নেই । দরজ়া তো বন্ধই আছে। তল্লাশী করতে চান করুন ।
লিজা তাড়তাড়ি বিছানার চাদরটা একটু দলামলা করে ফেলল। সে ইশারা করলো আমাকে বিছানায় শুয়ে পড়তে। আমি তাড়াতাড়ি সটান শুয়ে পড়লাম।
এরপর যা দেখলাম তাতে আমার চোখ একেবারে চড়ক গাছ। যে লিজার কাছে আবেগে আপ্লুত হয়ে একদিন সামান্য দুঃসাহসী হয়েছিলাম বলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে সেই লিজা তার পরনের কাপড় খুলে ফেলছে এক এক করে। ওড়না ,গাউন, ব্লাউজ খসে খসে পড়তে লাগলো তার যৌবন মদির দেহ থেকে। কৃত্রিম কামনার আগুন জ্বলে উঠলো তার চোখে মুখে। প্রায় অর্ধনগ্ন অবস্থায় বিছানায় উঠে এলো আমার একেবারে গা ঘেঁসে। ফিস ফিস করে কানে কানে বললো এ মূহূর্তে ওদের বোকা বানাবার এই একটা মাত্র উপায়।
বুঝলাম নিখুঁত প্রেমিকের অভিনয় করতে হবে আমাকে। আমি আবেগে আবেশে লিজার সোনালী চুলে আঙ্গুল চালাতে লাগলাম। লিজার নির্দেশে আমি আন্ডার ওয়ার ছাড়া এখন প্রায় দিগম্বর পুরুষ।
এসময় ঘরের দরজায় ঘন ঘন ধাক্কা। একটি ওড়না গায়ে জড়িয়ে বিরক্ত মুখে দরজা খুলে দেয় লিজা। প্রথমে ঘরে ঢুকে এক তাগড়া জোয়ান তার পিছু পিছু কয়েকজন সশস্ত্র যুবক। ঢুকেই লিজা এবং বিছানায় আমার দিকে চোখ পড়তেই কেমন অপ্রস্তুত হয়ে যায় তারা। একজন বলে উঠলো --প্রেম করার সময় বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।
আর একজন লিজার দিকে লোভাতুর দৃষ্টি ফেলে আমাকে বললো ----আপনার কপাল মশাই। ঈশ্বরের কাছে দিনরাত চেয়েও কোন সুন্দরী আমাদের দিকে ফিরে চায় না আর এতো স্বর্গের অপ্সরী। দলনেতা টাইপের একজন বললো --চলো চলো সময় নষ্ট করার মত সময় আমাদের নেই। পুলিশ চলে এলে ঝামেলা হবে। ওরা যেমন দুদ্দাড় করে এসেছল তেমনি দুদ্দাড় করে চলে গেল।
এতক্ষন লোকটি খাটের ভেতরে নিঃশ্বাস বন্ধ করে পড়েছিল। পাটাতন সারাতেই সে বললো--- ওরা কি চলে গেছে।? লিজা মুচকি হাসি হাসতে হাসতে বললো--- আপাতত বিপদ কেটে গেছে।
----পুলিশ এসে তোমাকে নিয়ে যাবে। বলে আমি হাসি হাসি মুখে লিজার দিকে তাকালাম। আর সাথে সাথেই আমার মনে হল --আজ এতদিন পর আমার আর লিজার মধ্যকার দূরত্বটা অনেক, অনেক কমে গেছে। কোন ফাঁকই যেন নেই। লিজা আমার দিকে তাকিয়ে বললো ---এর জন্য তোমার এই ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দেয়া উচিত।
ভদ্রলোক খাটের ভিতর থেকে বেরিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন-- ঈশ্বর আপনাদের মঙ্গল করুন, তিনি আপনাদের খুব সুখী করুন। শান্তিতে রাখুন।
গল্পঃ রিমুভ অব হিচ্চ, লেখকঃ আনাতোলে ফ্রান্স, অনুবাদঃ (সামসা আকিদা জাহান) ।
দূর্দান্ত গল্প, ততোধিক দূর্দান্ত অনুবাদ।
এবং অতি অতি চমৎকার।
অনুবাদ ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগছে। ধন্যবাদ।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচার ইমো কি আছে!
কি হয়, কি হয় এই আতঙ্কে ডুবে ডুবে তোমার গল্প একটানে পড়ে ফেললাম। শুরুটা খুব ভালো লেগেছে। পুরো অনুবাদ কেমন হয়েছে বললে বলতে হয়, ভাল। হয়তো কয়েকটি বাক্য/শব্দ একটু পাল্টে দিলে খুব ভালো লেগেছে এটি বলতে পারতাম।
'দূরত্ব' নামকরণের সার্থকতাপূর্ণ গল্প নিয়ে অনেক দিন পর ব্লগে হাজির হলো ব্লগে অনিয়মিত আকিদা।
অভিনন্দন আকিদা।
লীনা হুবহু বইটা লাইন বাই লাইন অনুবাদ করিনি। প্রতিটি লাইন কে সহজ ভাবে অনেক ক্ষেত্রে আমাদের দেশীয় ভাবটা আনবার চেষ্টা করেছি। তোমরা উৎসাহ দিলে আরও অনুবাদ করবো, ধন্যবাদ।
এটা যে অনুবাদ সেটা পড়তে পড়তে নিচে এসে বুঝতে পারলাম। ঝড়ঝড়ে অনুবাদ , অনেক ভালো লাগলো।
অনেক ধন্যবাদ। ভাল লাগার জন্য আবারও ধন্যবাদ।
অসাধারন ....
আর কিছু বলার নাই...
ধন্যবাদ ভাই । বড় ভয়ে ভয়ে লিখেছি যদি কেউ গ্রহন না করে। এখন বেশ সাহস পেলাম।
অনুবাদের অসাবলীলতাটুকু ছিলো না বলে পড়তে ব্যাপক আরাম লাগলো
ধন্যবাদ
আমি চেষ্টা করেছি সাবলীল করতে। কারন ছোট বেলায় রুশ গল্পের বাংলা অনুবাদ পড়ে অনুবাদের উপর মেজাজ বিগড়ে ছিল। আমি অনুবাদ করার সময় হুবহু বাংলা না করে ভাবার্থ ঠীক রেখে আমাদের দেশীয় ঢং আনবার চেষ্টা করেছি। ভাল লাগার জন্য ধন্যবাদ।
চলমান সিনেমা দেখলাম যেনো! দারুণ জীবন্ত লাগলো আপনার অনুবাদের ভঙ্গিমা আরো আসুক এমন কিছু। আমার পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম-অভিনন্দন
ধন্যবাদ। আরও লেখার চেষ্টা করবো।
দূর্দান্ত গল্প, ততোধিক দূর্দান্ত অনুবাদ। Smile
এবং অতি অতি চমৎকার।
গল্প দূর্দান্ত সন্দেহ নেই। অনুবাদ ভাল লেগেছে বলে আমারও ভাল লাগছে।
অনুবাদ ! বুঝতেই পারিনি। গল্পটি সুন্দর, অনুবাদ ততোধিক সুন্দর ও সাবলীল। অভিনন্দন সামছা আকিদা জাহান।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
কোন গল্পে আমার নামে নায়িকার নাম হলে খুব মজা পাই
আসলেই, আপনার অনুবাদ অনেক অনেক সুন্দর ।
ধন্যবাদ লিজা। গল্পে নায়িকার নাম ছিল লুজি। আমি তাকে সহজ করেছি লিজা নাম দিয়ে। আপনার নামের সাথে মিলে ভালই হয়েছে।
এতই সুন্দর লেখা যে পড়তে পড়তে মনে হলো "শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে গেলো"।
ধন্যবাদ। এটা যে ছোটগল্প। কিছু রেশ তো থাকবেই।
দারুন করে লিখেছেন, অনুবাদ লাগেই নাই... :) অনুবাদ বেশ ভালো হয়েছে কাঠকাঠ লাগে নাই...
ধন্যবাদ জেবীন। আমার ব্লগে আপনাকে বারবার পাব আসা করি। ভাল থাকুন সব সময়।
ধন্যবাদ সাহাদাত উদরাজী।
মন্তব্য করুন