চাকরানী।
একটা বাচ্চা। খুব আদরের। যখন সে জন্ম নিলো তখন সবার মনে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। নানাবাড়িতে সে একমাত্র "নাতি"। কাজেই এক্সট্রা খাতির। অনেক পরিচর্যা।
বাড়িতে অনেকদিন কোন ছেলেসন্তান হয় নি। অনেক দিন পর একটা ছেলে সন্তান আসার পর সবাই মহাখুশী। ছেলেটির মাকে অকথ্য মানসিক নির্যাতন চালানো হত কেন না, ১৯৮৪ সালে ছেলেটির বাবার প্রেম করে বিয়ে করা পরিবারের আর কেউই মেনে নেয় নি। যদিও ছেলেটির বাবা চিকিৎসক আর মা মাস্টার্স পাশ করা মেধাবী মেয়ে। সন্তানটিকে জন্ম দেওয়ার পর থেকে পরিবারে সেই মা-এর আদর অনেক খানি বেড়ে গেল। মা টি যেন হাতে পেল ঈদের চাঁদ। ছেলেটি একদিন অনেক বড় হবে। কখনো কারো পেছনে পড়ে থাকবে না। ছেলেটিকে নিয়ে শুরু হলো সে মা-এর পথচলা। সঙ্গী ছেলেটির বাবা। আর পিছনে রয়েছে পুরো পরিবার।
আর ছেলেটি? বাচ্চা একটা ছেলে। বাবা-মা এর পরিকল্পনার শিকার। ঘরের মাঝে একটুখানি জায়গা তার পড়াশোনার জন্যে বরাদ্দ। তাকে কঠিন করে বলে দেওয়া আছে পরীক্ষাতে একটুও খারাপ করা যাবে না। পড়াশুনাতে সামান্য গাফিলতিও করা যাবে না। করে ফেললে চরম শাস্তি। সেই শাস্তি পেতে পেতে যখন ছেলেটি বাচ্চাবয়েসেই জীবনের প্রতি হতাশ, তখন তার সঙ্গী হলো একজন মানুষ।
সেই মানুষটির নাম রেজিয়া। ছেলেটি যখন মায়ের পেটে, তখন বাড়ির কাজ দেখাশুনা করার জন্যে তার এই বাড়িতে আগমন। জনসমাজে তার পরিচয় "চাকরানী"।
বাচ্চাটি জন্মের পর থেকে সে তার মা কে আর বাবা কে দিনের বেলায় বাড়িতে দেখে নি বললেই চলে। বাবা চিকিৎসক, সারাদিন হাসপাতাল, সারা সন্ধ্যা চেম্বার আর গভির রাত পর্যন্ত ক্লিনিক। মা কলেজের শিক্ষক। সারাদিন সে কলেজে, বিকালে সে লেডীস ক্লাবে। বাচ্চাটির সারাদিন দেখাশোনা করার দায়িত্ব, খাওয়ানোর ভার সেই "চাকরানী"র উপর। তার শুধু একটাই অভিযোগ। "আমি সারাদিন বাচ্চাটাকে দেখেশুনে রাখি, গায়ে ফুলের টোকাও পড়তে দেই না, সেই বাচ্চাটাকে সারাদিন পর এসে উনারা কেন মারধর করবেন?" তার মূর্খ মস্তিষ্ক ধরতে পারে না, তার "বাবু" যেখানে সব পরীক্ষাতেই ফার্স্ট হচ্ছে সেখানে শুধু পড়াশুনার জন্যে তাকে মারধর করার কী আছে?
মার খেয়ে ছেলেটি কাঁদে, "চাকরানী" তার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়, আর বলে, "বাপ-মা শাসন করলে কিছু হয় না, সব সময় বাপ-মায়ের কথা শুনতে হয়"। ছেলেটি মেনে নেয়। আর কিছু করার সামর্থ্য তার নেই।
"চাকরানী"ই ছেলেটির ঘরে বাইরের একমাত্র বন্ধু। ছিলো, আছে। ছেলেটি বড় হয়ে গেছে। "চাকরানী" সারাজীবন ছেলেটির মায়াতে ওই বাড়িতে কাটিয়ে এখন বুড়ো হয়ে গেছে। তার ডায়াবেটিস হয়েছে, জরায়ুমুখে ক্যান্সার হয়েছে। তার চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করা হয়েছে, চিকিৎসকের বাড়ির মান সম্মান রাখতে হবে বলে, কিংবা ঋণ শোধ করতে হবে বলে, কিংবা ছেলেটির জোড়াজুড়িতে। কিন্তু "চাকরানী"কে দিন রাত শুনানো হচ্ছেই, হচ্ছেই যে কত হাজার টাকা তার পিছনে খরচ হচ্ছে প্রতিদিন।
"চাকরানী" তার মৃত্যুর দিন গুনছে এখন বসে বসে।
আর ছেলেটি?
তার ছাত্রজীবন এখনও শেষ হয় নি। সে জীবনে যত টাকা বৃত্তি পেয়েছে সবটাই সেই চাকরানীর হাতে তুলে দিয়েছে। তাকে বারবার শুনতে হয়েছে,"মায়ের থেকে মাসীর দরদ বেশি", তাও সে দিয়েছে। তার ইচ্ছা সে চাকুরী পেলেই তার "দিদা"কে একটা সোনার চেইন কিনে দেবে যে সোনার চেইন তাঁর আজীবন আরাধ্য, কিন্তু কেউ তাকে দেয় নি। সে ছেলেটির "দিদা", কিন্তু বাকি সবার "চাকরানী"।
তবুতো মানুষটার চিকিতসার ব্যাবস্থা হইছে । সত্যি ঘটনাই তো? তাহলে সেই ছেলেটির কাছে অনুরোধ থাকবে, সে যেন তার দিদাকে ভুলে না যায় । তাঁকে দেখেশুনে রাখে ।
রাখবো। আসলেই রাখবো।
এই জন্যই কবি বলেছেন -
বন্যের চিড়িয়াখানায় সুন্দর , শিশুরা বুয়ার কোলে ।
তার জন্য কিছু করার সুযোগ থাকলে অবশ্যই করার উচিত ।
আমার দিদাকে "বুয়া" বলবা না!!!

দিদার মনের আশা পূরণ করুক তার বাবু এই কামনা রইলো।
কয়জন মানুষ ঋণ শোধ করে ভাই? আজকের মর্ডাণ ছেলে-মেয়েরা যেখানে নিজেদের বাপ-মাকে ওল্ড হোমে রেখে বাসায় বন্ধুদের নিয়ে পার্টি করে সেখানে আপনি চাকরানীর ঋণ শোধ হবে বলে আশা করেন?
যাই হোক, এমন সত্য ঘটনা যেমন আছে, ব্যতিক্রমও আছে। দিদার সুচিকিৎসা হবে আশা করি। ছেলেটা যেন অন্তত দিদাকে ভুলে না যায়।
সেটাই।
ছেলেটি দিদাকে ভুলবে না। দিদাকে ভোলা মানে নিজের অস্তিত্ব কে ভুলে যাওয়া, তাই ছেলেটি কখনোই দিদাকে ভুলবে না।
খুবই ভাল লেখা । হৃদয় ছুঁয়ে যায় !
ধন্যবাদ, ভাইয়া!
লেখাটা মন ছুঁয়ে গেল। ছেলেটার দিদার জন্য শুভকামনা।
দিদা'র জন্যে অনেক শুভকামনা আসলেই দরকার।
লেখাটি পছন্দ করার জন্যে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
শুভ কামনা
আপু, ডরের ইমো দিলেন ক্যান?
ডরের ইমো দেই নাই, মন খারাপের দিয়েছি। এখানে আনন্দের কিছু আছে বলেন আনন্দবাবু ?
এটাই মনে হয় দিদা'র জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার।
ভাল লাগছে।
কী যে ভালো লাগলো তোমার কমেন্টটা, নাহিদ ভাইয়া।
হৃদয়স্পর্শী পোস্ট। খুব ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ ভাই।
লেখকের জন্যেও বিষয়টা অনেক হৃদয়স্পর্শী।
মন্তব্য করুন