ব্লগর ব্লগর
১।
আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি যখন ছোট তখন আমাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম একবার। পাঁচ-ছয় বছর বয়সের স্মৃতি যতটা পরিষ্কার হওয়ার কথা তার থেকেও ভাল করে ওই বাড়িটির কথা আমার মনে আছে। বিশাল উঠান, শানবাঁধানো সিঁড়ি, আধাপাকা বড়সড় বাড়ি। সেটা ঘিরে আরো কিছু ঘর, বাসার সীমানার বাইরে সারি সারি সুপুরি গাছ। ডান দিকে একটা খেলারমাঠ, তার পাশে এক বিশাল বটগাছ। বাম দিকে প্রমত্তা যমুনা। বগুড়া জেলার একটি গ্রাম, নাম খাবুলিয়া।
ওই বাসাতে বেশীদিন থাকার ব্যাপারে আমার ঘোরতর আপত্তি ছিল, কারন, টিভি দেখা যেত না, ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না বলে। টিভি না দেখে তো থাকা অসম্ভব। কতদিন পর ওখান থেকে বাড়িতে ফিরেছিলাম তা মনে নেই, কিন্তু এটা মনে আছে যে ওই জায়গায় আমি আর কখনই যেতে চাইতাম না।
এই বয়সে এসে আমার খুব ইচ্ছে করে আর মাত্র একটি বারের জন্য ওই জায়গাটাতে যাব। ছোট বেলায় কোন টান না থাকার পরও গ্রামটি আবছা আবছা আমার চোখে কেন ভাসে তা আমার দেখা খুব দরকার ছিল। কিন্তু বাড়িটা আর আমাদের নেই। রাক্ষুসী যমুনা শুধু বাড়িটা নয়, পুরো গ্রাম এবং এর আশেপাশের সবকিছু খেয়ে ফেলেছে। তাও অনেক দিন আগে।
২।
গত ২০০০ সালে, আমি যখন এইট এ পড়ি, তখন আরেকবার ওই জায়গাটাতে গেছিলাম। যাবার আগে নানা বারবার বলছিলেন কী দেখতে যাবি তুই, কিছুই তো আর নাই। আমি বলে গেছিলাম কী কী নাই তাই দেখতে যাব। সেটা ডিসেম্বর ছিল। আমি, আম্মা, আমার ছোট বোন গেছিলাম। রমজান মাসে। গিয়ে দেখি বিশাল বালুর চর। তাতে লোকজন ভিটে তুলে ফেলেছে যদিও চরের মালিকানা নিয়ে গন্ডগোল প্রতিদিনের ব্যাপার। বিশাল নীল আকাশের নিচে চওড়া সে নদী। মাঝে শুভ্র বালুচর, তাতে ভুট্টার ক্ষেত, এও এক অন্যরকম সুন্দর কিছু একটা। আরেকটা ব্যাপার ছিল, তা হল আমি যেদিকেই যাই, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমার পেছন পেছন আসতে থাকে। গ্রামের সবাই বাসায় নিয়ে গিয়ে এটাওটা খাওয়াতে চায়।
কিন্তু আমি কিছুতেই খুব খুশী ছিলাম না, আমার মন খুঁজছিল ওই যে সেই জায়গাটা। আমি খুঁজে ফিরছিলাম আমার শৈশবের সেই একটুফোঁটা সুখস্মৃতি, কোথায় যে কোন অতলে হারালো আর খুঁজে পেলাম না। আমার ছোট্ট কিশোর বুকটা যেন দুমড়েমুচরে গিয়েছিল। আমার সেই দীর্ঘশ্বাস আমি আজও শুনতে পাই।
৩।
আমার সারাজীবনই কেটেছে শহরে। গ্রামে থেকেছি এরকম একবার দুইবার। জন্মসুত্রে আমাদেরকে বলা হয় জাত ভাটিয়া। কিন্তু ভাটি এলাকার প্রতি কোন মোহ নেই, দুই দশ বছর পর পর একটু একটু টান ফুটে উঠে, ঠিক ওই সব লোকজনদের মত যারা সারাজীবন দেশের বাইরে কাটিয়ে দেয়, পাঁচ দশ বছর পর মাস খানেকের জন্য দেশে ফিরে আচমকা বিরাট বাঙ্গালি হয়ে যায়।
আজ হুট করে আমি গ্রামীণ সৌন্দর্যের কথা মনে করে স্মৃতিকাতর হয়ে গেলাম। তার পেছনে নিশ্চয়ই কারন আছে। আর সেটা হলো আমাদের রোকেয়া সরণি। এই শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা, এক মহাগুরুত্বপূর্ণ মানুষের নাম এ। এই মানুষটির মাহাত্ম্য বর্ণনা করার কিছু নেই। তিনি তাঁর কাজ দিয়ে কুসংস্কারের দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা দূর করেছিলেন, যার সুফল এখন আমরা সবাই ভোগ করছি। এই মহিয়সী নারী সমাজের ময়লা দূর করেছিলেন তাই তাঁর নামের রাস্তার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে তিনটা বিশাল ডাস্টবিন বসানো হয়েছে, তিনটিই বাসস্টপ। শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া আর ১০নম্বর গোলচক্কর এবং পুরো রাস্তা জুড়ে বিশ্রী জ্যাম তৈরি হওয়ার জন্য এগুলোই বেশী দায়ী। আমার প্রশ্ন হলো, মূল রাস্তার অর্ধেক দখল করে ঠিক বাসস্টপের মুখে ডাস্টবিন বসানোর বুদ্ধিটা কার?
৪।
আমাদের মাঝে শ্রদ্ধাভক্তিবোধ এম্নিতেই কম, এ নিয়ে কিছু বলার নেই। তাই বলে সাধারণ বুদ্ধিটুকুন লোপ পেয়ে গেলে তো বিশাল বিপদ। শুধু তো রোকেয়া সরনি নয়, ঢাকা শহরটাই আস্তে আস্তে ডাস্টবিন হয়ে যাচ্ছে।
আজ আমি মিরপুর ১০ নম্বর পার হবার সময় খুব মিস করছিলাম সেই বাড়িটাকে। কেউ যদি আমার এই এলাকাটা বদলে দিতো, যেখানে থাকত একবাগান ভরা গাছ, পাশ দিয়ে একটা নীল নদী, ভুলে যাওয়া পাখির কিচিরমিচির...
ছোটবেলার স্মৃতিময় জায়গাগুলো যেখানে গেলে কিছুক্ষন হাপ ছেড়ে বাঁচা যেতো, সেসব জায়গা এভাবে হারিয়ে গেলে সত্যই খারাপ লাগে........ ।
জ়ীবনটাই এরকম। সব হারায়ে যায়।
খারাপ লাগাটাই রয়ে যায়।
শুধু তো রোকেয়া সরনি নয়, ঢাকা শহরটাই আস্তে আস্তে ডাস্টবিন হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের চিন্তা কী? মাঝে মাঝে জাপানীরা এসে তো পরিষ্কার করে দিয়ে যায়।

ফিরিয়ে দাও অরন্য
কে দিবে?
(
তানবীরাপ্পি, আপনি এই লাইনটা কোট করলেন কেন?
আপনি আর ওই সব ভুঁইফোড় বাঙ্গালীদের মাঝে পার্থক্য আছে, এটাই আমার বিশ্বাস।
আননদ,
আমারতো মনে হয় পুরো বাংলাদেশটাই ডাসবিন হয়ে গেছে ! যেদিকে তাকাই শুধু ময়লাই দেখি । হেজি ফেজিদের কথা নাহয় বাদই দিলাম, রথি-মহারথিদের মুখ থেকে ও শুধু বদবু বেরোয় যা পারথিব ময়লা থেকে শতগুণ খারাপ । সংসদ, ভারসিটি, বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় - সবখানেইতো শুধু ময়লা আর ময়লা । সেখানে যারা থাকে তাদের বেশিরভাগই পচা - দূরগনধ ছড়িয়ে পুরো পরিবেশই পলুটেড করে রেখেছে ।
তোমার গায়ের বাড়ির জন্য দূ খ হল ।
বহুদিন পর তোমার লেখা পেলাম । মন ছুয়ে গেল । আমার পি সি খারাপ হয়ে গেছে । আরেকজনেরটা থেকে লিখছি । ঠিক মতো ইউজ করতে পারছিনা । বানান ইত্যাদির ভুল মাফ করো । ভাল থেকো ।
সালাম, আংকেল। আপনার কমেন্ট পাইলেই আমার মন ভরে যায়।
আমি তো বলতে গেলে লিখিই না। তারপরেও আমার কথা আপনি মনে রেখেছেন, এতেই আমি অনেক খুশী।
কয়েকদিন আগে তালতলা বাসস্ট্যান্ড গিয়ে দেখি পুরা ডাস্টবিন এবং ভ্রাম্যমান বাথরুম রীতিমতো। দুর্গন্ধের কারণে দাড়াতে আর পারিনি । বেশীরভাগ এলাকা একই রকম ।
হুমম।
পুরো বাংলাদেশটাই ডাসবিন হয়ে গেছে , আরো হবে সামনে ।
কেমনে হলো?
মন্তব্য করুন