গ্রীক পুরাণের দেবতা ও দেবীরা
যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন প্রথম বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য হই। আমার হাতে প্রথম যে বইখানা তারা তুলে দেয় তা হল “ট্রয়ের উপকথা”(নামটা স্পষ্ট মনে নেই)।আমি সেই বইটা এক সপ্তাহে প্রায় চার বার পড়ে ফেলি।আবার ক্লাস থ্রি কি ফোর থেকে আমার সখ্য বিটিভির হারকিউলিস সিরিজের সাথে।তখন হারকিউলিসে বেশ কিছু সিন ছিল বাবা মনে করতেন আমার উপযোগী না।রাত ১০টার নিউজের পর তাই তিনি আমার সাথে যেগে থাকতেন হারকিউলিস সেন্সর করতে।কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই ১০ মিনিট বাদে আমি তার নাকের কলের গান শুনতাম আর নির্বিঘ্নে হারকিউলিস উপভোগ করতাম। মূলত তখন থেকেই আমার গ্রীক মিথোলোজির প্রতি আকর্ষণ। আমি সবসময়ই গ্রিক মিথোলোজি নিয়ে ভাবতাম। ট্রয় নিয়ে যে বইটা সেটা পড়ে আমার নিজেকে কেন জানি হেক্টর মনে হত। এত কথা বলার মানে হল আমি গ্রীক মিথের প্রতি আগ্রহী। তাই আমার আজকের লেখাটা তাদের নিয়ে।
ইংরেজি Mythology শব্দের সহজ অর্থ আমার কাছে সোজা ভাষায় (পুরাণ) রূপকথা।তবে বাংলা রূপকথায় সাধারন মানুষেরা থকতেন , থাকত তাদের হাসি কান্না আর চাওয়া পাওয়ার নানা রূপক। সর্বোপরি বাংলা রূপকথা পুরোটাই মানুষকে নিয়ে।রাক্ষসকে পরাজিত করে এখানে রাজকুমার বা কোন এক রাখাল বালক।কিন্তু গ্রিক বা রোমান উপকথা গুলা মূলত নানা রকম দেবতা দেবিদের নিয়ে । তাদের জীবনই এখানে মুখ্য। তাদের চাওয়া পাওয়ার গল্পের মাঝে মাঝে মাঝে অনুষংগ হিসেবে আসে কিছু মানুষের কথা।কিন্তু ঘুরে ফিরে দেবতা দেবীরাই এসব মিথের মুল কুশিলব।
গ্রীক রূপকথার এক গুরুত্বপুর্ণ অংশ হল অলিম্পিয়াস পর্বতের দেবতারা।আর এদের মধ্যে প্রধান দেবতা হল জিউস। উপকথা মতে পৃথিবীর দেবি গায়া (Gaia) এবং আকাশ ও স্বর্গের প্রতিনিধি ঊরানুস বিয়ে করেন। তারা টাইটানস নামক এক দল দানব এর জন্ম দেন। ক্রোনাস তাদের একজন। গায়া ও ঊরানুস ক্রোনাস কে ভবিষ্যত বাণী করেন যে তার পতন হবে তার এক সন্তানের হাতে। আর এই ভবিষ্যত বাণীকে ঠেকাতে ক্রোনাস তার স্ত্রী রিহার গর্ভজাত সকল সন্তানকে গিলে ফেলে। কিন্তু কনিষ্ঠ সন্তান জিউস জন্ম নিলে গায়া ক্রনাসকে একটা পাথর কাপড়ে পেচিয়ে দেয়। ক্রোনাস তাই তার সদ্যোজাত সন্তান মনে করে গিলে ফেলে। গায়ার কাছে বেড়ে উঠে জিউস। একসময় সে হেইডেস, হেস্টিয়া, হেরা, ডেমেটার ও পসেডিওন মিলে টাইটান দের মূলত ক্রোনাস কে আক্রমণ করে। এবং প্বরিথিবীর শাসন ভার নিজেদের হাতে তুলে নেয়। জিউস তার অনুসারী অন্য দেবতারা থাকতেন অলিম্পাস পাহাড়ে । আর পাহাড়ের নিচে থাকত জিউসের সৃষ্ট মানুষ আর তার বিরোধিরা।
অলিম্পিয়াসের দেবতারা আর দেবীরাঃ
জিউসঃ জিউস হল অলিম্পিয়াসের প্রধান দেবতা। জানা যায় যে খ্রিস্টপুর্ব ২১০০ এর দিকে বলকান এলাকার মানুষেরা আবহাওয়ার দেবতা হিসেবে জিউসের পূজা করত। জিউস মুলত আকাশের দেবতা ও সে সুত্রে বৃষ্টিপাতের দেবতা। হোমারের ঈলিয়াডে জিউসকে তার বিরুদ্ধাচয়ারীদের দিকে বাজ মারতে দেখা যায়। সুতরাং ধারণা করা হয় জিউস বজ্রপাত ও আলো ও নিয়ন্ত্রন করত। জিউস নাম টা মূলত গ্রীক শব্দ Dios থেকে যার মুল অর্থ হল bright.
হেরাঃ হেরা একই সাথে জিউসের স্ত্রী এবং সহোদরা। সে মূলত জন্ম ও নর নারীর মিলনের দেবী। যেহেতু নিজের বোনকে বিয়ে করসে তাই জিউস বাবাজির চরিত্র যে সুবিধার না বুঝাই যায়। আমার এক বন্ধু নিজেরে জিউস মনে করত আর সবাইরে কইত “আরে আমি হইলাম জিউসের মত” । আমরা তখন ভাবতাম বারে বা এখন বলি মাদারী আমাদের বলছ ভাল আর কাউরে কইসনা যে তুই জিউসের মত।ইজ্জত আর জায়গায় থাকবনা। যাউকগা আবার আতলামিতে আসি। হেরা জিউসের এই বদ স্বভাব পছন্দ করতনা। সে তাই জিউসের সব গার্লফ্রেন্ডদের আর তাদের বাচচাদের সেরকম সাইজের উপরে রাখত। তাই সে জিউসের পুত্র এপোলোর জন্মেও বাধা দিয়েছিল। সম্ভবত হেরার প্রতি জিউসের ভালোই দুর্বলতা ছিল। তাই তার হাজার অপকর্ম ও সে মেনে নিত। কিন্তু অনেক সময় মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে হেরাকে অলিম্পাস পাহাড়ের পাদদেশে শিকল দিয়ে বেধে রাখা হত। আর তার পায়ের নিচে রাখা ভারী লোহা জাতীয় কিছু ঝুলিয়ে রাখা হত। মূলত ওলিম্পাস, স্পার্টা, মাইসিন আর ডেলোস দ্বীপে হেরার উপাসনা করা হত। রোমান উপকথায় হেরাকে জুনো নামে ডাকা হয়
আফ্রোদিতেঃ আফ্রোদিতে গ্রীক সীমানা ছাড়িয়ে পুরা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া এক দেবী। এমনকি বাংলার কিছু উচচমার্গীয় কবি রাস্তায় কোন কোন মেয়ে দেখলেই আফ্রোদিতের সাথে তুলনা করে বিমলানন্দ অনুভব করেন।আফ্রোদিতে ভালোবাসা, যৌনতা আর সৌন্দর্যের দেবী। তার জন্ম কাহিনী নিয়ে মূলত দুধরনের কাহিনী শোনা যায়। হোমারের মতে আফ্রোদিতে হল জিউসের মেয়ে। কিন্তু আরেক মতে দানব ক্রোনাস তার পিতা ঊরানুসকে হত্যা করে তার অন্ডকোষ কেটে সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে। সমুদ্রে এতে ফেনীল ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়। গ্রীক ভষায় আফ্রোস শব্দের অর্থ ফেনীল ঢেউ। এই ফেনা থকেই জন্ম হয় বলে তার নাম রাখা হয় আফ্রোদিতে। জিউস সবসময় ভয়ে থাকতেন এই বুঝি অলিম্পাসের দেবতারা নিজেদের মাঝে যুদ্ধে নেমে যায় আফ্রোদিতের জন্য। আফ্রোদিতে বিয়ে করেন দেবতা হেফেস্টাসকে। পরিশ্রমী হেফেস্টাসকে নিইয়ে সুখী ছিলেননা বা সন্তুষ্ট ছিলেন না আফ্রোদিতে। তাই তার সাথে প্রেম হয় অনেক দেবতা আর মানুষের। আফ্রোদিতের বিখ্যাত মানুশ প্রেমিক হল এডোনিস। রোমান মতে আফ্রোদিতের মতই ভুমিকা যার তার নাম ভেনাস।
হেফেস্টাসঃ হেফেস্টাস হল আফ্রোদিতের স্বামী। সে দেবী হেরার ছেলে। মূলত আগুনের দেবতা হলেও তাকে আবার কামার দেবতাও বলা যায়। হেফেস্টাস অন্যান্য দেবতার চেয়ে আলাদা আর সে প্রচুর পরিশ্রমী ছিল। আফ্রোদিতেকে সন্তূষ্ট রাখার জন্য সে তার জন্য সবচেয়ে মুল্যবান সব পাথর আর মুক্তা-মনি দিয়ে অলংকার বানিয়ে দিত।
ঈরোসঃ গ্রীক অনেক দেবতাকেই আমরা চিনি। কিন্তু এমন কোন দেবতা কি আছে যাকে আমরা সেই ছোটবেলায় কার্টুনেও দেখেছি কিন্তু হয়ত সবাই তার নাম জানিনা? মনে পড়ে বিভিন্ন কারটুনে হাতে তীর ধনুক আর ডানাওয়ালা কোন ছেলের কথা যে তীর ছুড়ে মারত কার্টুনের বিভিন্ন চরিত্রের মাঝে আর তাদের মাঝে চরম প্রেম হয়ে যেত। সেই বালকই হল গ্রীক প্রেমের দেবতা ঈরোস। ঈরোসের মা হল আফ্রোদিতে। হাজার নরনারীর প্রেমের কারিগর ঈরোস নিজেও প্রেমে পড়েছিল এক মানবীর। আফ্রোদিতে নিজেকে খুব সুন্দরী মনে করতেন। তার চেয়ে সুন্দর কোন দেবী বা নারী জন্ম নেক এটা তিনি সহজ ভাবে নিতে পারতেন না। কিন্তু সাঈক (psyche) নামের এক অনিন্দ সুন্দরী মহিলার কথা চারদিকে ছড়িয়ে পরলে আফ্রোদিতে ঈরোসকে পাঠান সাঈকের কাছে যেন তার সাথে পৃথিবীর কুতসিততম মানুষের পেম হয়। কিন্তু ঈরোস নিজেই সাঈকের প্রেমে পড়ে যায়।প্রতি রাতে সে সাঈকের কাছে যেত যখন তার ঘর অন্ধকার থাকত। একসময় সাঈকেও ঈরোসের প্রেমে পড়ে যায়। একদিন সে আগ্রহভরে ঈরোসের চেহারা দেখার জন্য আলো জ্বালে। এসময় ঘুমন্ত ঈরোসের মুখে একফোটা তেল পড়ে। ঈরোস পালিয়ে যায় আর সাঈকে পাগলের মত তাকে খুজতে থাকে। একসময় জিউসের কারণে তাদের মিলন ও বিয়ে হয়। এই না হলে প্রেমের দেবতা!
এপোলোঃ গ্রীক পুরাণের আরেক বিখ্যাত দেবতা এপোলো। এপোলো হল জিউসের পুত্র। এপোলো গ্রীক পুরাণে আমার দৃষ্টিতে এক আশ্চর্য চরিত্র। তার চরিত্রে একই সাথে আছে সুর আর অসুরের মিশেল। সে একই সাথে সংগীত, আলো আর তীরন্দাজির দেবতা। আবার হোমারের ইলিয়াডে তাকে দেখা যায় গ্রীক সৈন্যদের মাঝে মহামারী ছড়াতে। পিতার ন্যায় এপোলোর চরিত্র ও বিশেষ সুবিধার ছিলোনা। বহু নারী আর দেবীর সাথে তার প্রণয় ছিল। এপোলো সম্ভবত বাইসেক্সুয়াল ছিল । কারণ শুধু নারী ই নয় সে প্রেমে পড়েছিল স্পার্টান রাজকুমার হায়াসিন্থাসের। এছাড়াও এপোলোর আরো কিছু প্রেমিকের নাম শোনা যায়।
শুধু ভালোবাসাতেই নয় নিষ্ঠুরতায় ও এপোলো কম যায়নি। নিওবে নামক এক মহিলা নিজের বেশী সন্তান থাকায় এপোলোর মা লেটোকে অপমান বা অহংকার করেছিলেন। এপোলো ও তার জমজ বোন আর্তেমিস তাই জবাই করে হত্যা করে নিওবের সকল ছেলেমেয়েকে।
এথিনাঃ এথিনা যুদ্ধ আর শিল্পকলার দেবী ছিল। জিউসের প্রথম স্ত্রী মেটিসের গর্ভে জন্ম এথিনার। জিউস যেমন তার পিতাকে হত্যা করেছিল তেমনি ভবিষ্যতবাণি ছিল জিউসের ব্যাপারে। তাই সে গিলে ফেলে মেটিসকে। মেটিস জিউসের শরীরে ভিতর তার গর্ভে থাকা এথিনার জন্য একটা ধাতব শিরস্ত্রাণ আর জামা বানায়। এ শিরোস্ত্রান তৈরিতে প্রচুর শব্দ হয় ফলে জিউস মাথা ব্যাথায় উন্মাদ হয়ে যায়। হেফেস্টাস তাই জিউসের মাথা চিড়ে ফেলে আর তা থেকে পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় জন্ম নেয় মায়ের দেয়া জামা আর শিরোস্ত্রান পরিহিত দেবী এথিনা। এথিনা আর পসেঈডন দুজনেই গ্রীসের একটা শহরকে খুব পছন্দ করতেন। তাই সিদ্ধান্ত হয় যে নগরের মানুষ যার পূজা করবে শহরটা তার হবে। পসেঈডন শহরে একটা ঝরনা তৈরী করে দেয়। কিন্তু লবনাক্ততার কারনে তা পরিত্যাক্ত হয়। আর এথিনা তাদের জলপাই গাছ দেয় যা থেকে তারা ফল, কাঠ ও তেল পেত। তাই তারা এথিনার পুজা করে। ফলে এথিনা নিজের নামে শহরটির নাম দেন এথেন্স।
মুলত এরাই গ্রিক পুরানএর সবচেয়ে বিখ্যাত চরিত্রের অন্যতম।
মূলত গ্রীক পুরান আমাকে আকর্ষন করে নানা কারনে তার চেয়ে বেশী আমাকে অবাক করে এর অমরত্ব। কেউ যদি গ্রীক পুরাণ পড়ে- তবে দেখবে এটা সাধারন মানবের ই গল্প।মানুষের হাসি কান্না, ভালবাসা, জিঘাংসার গল্প। আর এতে আছে যৌনবিকৃতির মেলা উদাহরণ। কেন তারপরো আজো তা বেচে আছে। আমি পন্ডিত নই। আমার মনে হয় বেচে আছে কারণ এগুলা আমাদের মনে করিয়ে দেয় দেবতারা মানুষের চেয়ে বড় কেউ নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে মানুষের থেকে তাদের অনেক শেখার আছে- মানুষের চেয়ে বড় দেবতা যে আর নেই এটা বোঝাতেই বুঝি আজো বেচে আছে গ্রীক পুরাণ গুলি।
দারুন পোস্ট। যেহেতু আপনার গ্রীক মিথলজি ভালো লাগে, গড অফ ওয়ার সিরিজের গেমগুলা খেলে দেখতে পারেন। গ্রীক মিথলজি নিয়ে এতো ব্যাপক কিছু আমার মনে হয় না অন্য কেউ করেছে।
ধন্যবাদ। গেম গুলা দেখি যোগার করা যায় কিনা।
প্রিয়তে রেখে দিলাম, ইনফরমেশনের কাজে লাগবে।
কোন দেশের কিংবা কোন ধর্মের মহামানবদের চরিত্র সুবিধার বলতে পারেন?
প্রিয়তে রাখার জন্য ধন্যবাদ।
কিন্তু পরের প্রশ্নটা কত কঠিন চিন্তা করছেন? কোন উত্তর নাই।
কি না কি বলি আর...
ভালো পোস্ট। শেষ প্যারাটা এক্কেবারে আমার নিজের কথা যেন।
কাঁকন কিছু পোস্ট দিয়েছিলো পুরাণের চরিত্রদের নিয়ে।
মহাভারত নিয়েও লেখা আসুক।
পড়ে গেলাম।
গৃক পুরাণ আমাকে সবসময় খুব টানে। ধন্যবাদ।
গ্রীক পুরান বরাবরই দারুন।
সামনে টাইটানদের নিয়ে পোষ্ট আশা করছি।
টাইটান রা তো আরো বজ্জাত। বজ্জাতদের আমি আবার ভালা পাই।

আপনার পোস্ট দেখে কাঁকনকে মনে পড়লো। কাঁকন কুথায়?
হুমম ভালো তো ।
"মানুষের চেয়ে বড় দেবতা আর নেই"
লেখাটা পড়েছি অনেক আগেই, ভাল্লাগলো।
মন্তব্য করুন