ইউজার লগইন

"তারা এদেশের সবুজ ধানের শীষে"

- কলেজে আমাকে নিয়ে একচোট হাসাহাসি হয়ে গেল । গাঁয়ের ছেলে আমি, লুঙি পড়েই স্কুলে যেতাম । গাঁয়ে পেন্টের চল হয়নি তখনো--আমার ছিলও না । সবার উৎসাহে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়েছি । ওখানে লুঙ্গি চলবেনা । সমস্যা হয়ে গেল ! তো অগতির গতি বড়বু’কে খবর দে’য়া হলো । দূলা ভাই জাহাজী । বাড়ী আসার সময় অনেক জামা-কাপড় নিয়ে আসতেন । ফিরে যাবার সময় ওগুলো আর নিয়ে যেতেন না, সিন্দুকে তোলা থাকতো । বুবু ওখান থেকে দু’জোড়া শার্ট-পেন্ট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “ নে -- লম্বায়তো মা’শাল্লা তাল গাছ হয়ে গেছিস, কোমরে ঢিলে হতে পারে –বেল্ট কষে নিস’ । ‘কই পামুনে বেল্ট’! আমি নাকি স্বরে বললাম । বুবু একটু ভাবলেন, তারপর বললেন, ‘ ঈদের পা’জামা তোলা আছেনা তোর ? ওটার নেড় [ফিতা] বের করে নে । তার পর পরে দেখা, কেমুন লাগে দেখি’ ! অগত্যা কি আর করা!

- কলেজে প্রথম দিন । কক্ষ খুঁজে পেতে একটু দেরী হয়ে যায় । সে বেঢপ শার্ট-পেন্ট পরে, ‘May I come in sir’ ? বলে যখন দরজায় উঁকি দিলাম, তখন স্যারের দু’টির সাথে ক্লাসের এক ঝাঁক নয়ন বাণ আমাকে এক সাথে বিদ্ধ করল । রোল কলের সাথে পরিচিতি পর্ব চলছিল, ওটা রেখে দিয়ে স্যার আমার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন ।

- ‘ইয়েস, সুস্বাগতম ! দয়া করে ভেতরে আসুন ! Do come please’ । স্যারের চোখে দুষ্টু হাসির ঝিলিক ! আমি এগুতে যাব, স্যার বললেন, ‘তা মশাই’র স্যূট জোড়া কোন ফ্যাশন শপ থেকে নে’য়া হয়েছে জানতে পারি’ ? বিকট হাসিতে ফেটে পড়ে ক্লাস । অপ্রস্তুত আমি জবুস্থবু দাঁড়িয়ে থাকি !

- ‘কি নাম’ ? হাসি একটু স্তিমিত হলে স্যার জিজ্ঞেস করলেন ।

- ‘বুলবুল চৌধুরি’ ।

- ‘রোল নং’ ?

- ‘ফিফটিন’ ।

- ‘বয় অর গার্ল’ ? আবারো দম ফাটা হাসির হিল্লোল ! মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিলাম, পিঠে চাবুক পড়ল যেন ! ক্যাবলা কান্ত ছিলাম না কখনো । প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়লাম ।

- ‘সরি স্যার’ ! পরিষ্কার গলায় বললাম, ‘ এটা গণিতের ক্লাস – জীব বিজ্ঞানের নয় । গণিতে জেন্ডার বিবেচ্য নয়’ । পরিস্থতি পাল্টে গেল নিমেষে । হাসির কলরোল নিভে গেল মুহূর্তে । পেছনের দিকে হাততালিও পড়ল দু’চারটা । অনুচ্চ কন্ঠে কেউ বলে উঠল, ‘ওয়েল ডান ফ্রেন্ড ! কংগ্রেজুলেশন’ ! স্যারের হাসি হাসি মুখটা ক্ষণিকের জন্য দন্ত্য-স হয়ে গেল ।

- ‘ওয়েল’ স্যার সামলে নিয়ে বললেন, ‘তা গণিতে কত পেয়েছ তুমি’ ?

- ‘নাইনটি সিক্স এন্ড নাইনটি সেভেন’ ।

- ‘গুড ! এনি প্যালেস’ ?

- ‘বলার মতোনা , সেভেনত্’ ।

- ‘ভেরি গুড ! বস গিয়ে’ ।

- মেয়েদের বেঞ্চ পেরিয়ে এগুতে যাব, দেখি একজন হাত বাড়িয়ে আছে ।

- ‘এখানে বন্ধু ! এখানে’ । ‘ও’ অনুচ্চ কন্ঠে বলল । ঠেলেঠুলে ওর পাশে বসে পড়লাম ।

- ‘আমি দেবাশীষ’, ‘ও’ বলল, ‘রোল – ৫১ । তোমার বিপরীত’ ।

- ‘বসতে দেবার জন্য ধন্যবাদ’ ! আমি হেসে বললাম ।

- ‘নো ফর্মালিটি প্লিজ ! আমরা এখন থেকে বন্ধু । দারুণ বলেছ তুমি । স্যার না—অনেককে নাকানি চুবানি খাইয়েছেন । ওই যে মেয়েটা দেখছো, ওর রোল- ১৬ । বেচারী একটু উত্তেজিত ছিল হয়তো ! ফিফটিন কল হতেই ইয়েস স্যার বলে দাঁড়িয়ে গেছিল । ‘বয় অর গার্ল’ ? স্যারের তড়িৎ প্রশ্ন । কিযে অবস্থা হয়েছিল মেয়েটির যদি দেখতে’ ! দুঃখ হল মেয়েটির জন্য ।

- ঘণ্টা পড়লো । ক্লাস শেষ । স্যার মেয়েদের নিয়ে বেড়িয়ে গেলে হুটোহুটি লেগে গেল । এসব আমার পছন্দ না । বসে রইলাম । দেবাশীষ ও । এগিয়ে এসে পরিচিত হলো ক’জন । রিফাত, অনি, মঈন, অলক ; – দারুণ সব ভাল ছাত্র ! আমরা সবাই একসাথে বের হলাম । পরের ক্লাস ফিজিক্সের ।

- বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে শেষ হল প্রথম দিনের ক্লাস । দেব, অনি রিফাত’ রা সারা্রদিন আমার সাথে রইল । লাইব্রেরি, কেন্টিন, কমন রুম; সব খানে ঢুঁ মারলাম । এবার ফিরব । অলকরা ‘শেরে বাংলায়’ থাকে । ওদের টা টা দিয়ে দেব আর আমি গেটের দিকে এগুলাম । ওখানে ঝটলা করছিল ক’জন । আমাদের দেখে এগিয়ে এসে যে যার পরিচয় দিল । ইশমত, শ্যামা, নাজ আর ‘রূপা’—সেই মেয়েটা যার রোল – সিক্সটিন ।

- ‘আপনাদের সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম’ ! আমার বিনয়ী কন্ঠ ।

- ‘ওসব ফালতু লৌ্কিকতা রেখে দাও প্লীজ’ ! রূপা প্রতিবাদ করে, ‘আমরা সবাই ক্লাসমেট, বন্ধু ! তুই, তুমি করে বলবো পরস্পরকে’ !

- ‘আমি গাঁয়ের ছেলে, অত তাড়াতাড়ি পারবোনা ভাই’ !

- ‘ডানার রোদ্রের গন্ধ মুছে ফেল’ ! রূপার কন্ঠে রিনিঝিনি । চোখ তোলে তাকালাম । অপরূপ রূপা ! হায় আল্লা ! মা্নুষ এতো সুন্দর হয় ! নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলাম ! কতক্ষণ থাকতাম জানিনা ! দেবের কনুই’র গুতোয় ফিরে এলাম ।

- ‘দারুণ বলছেন আপনি! স্যারের মুখের উপর উত্তর দেননি যে’ ! আমি বললাম ।

- ‘ঘাবড়ে ছিলামতো একটু ! তাছাড়া উত্তরটা যে তোমার পেঠে ডুব মেরে ছিল, আমি পেতাম কই থেইকা’ !

- ‘বা রে কত সুন্দর বলেন আপনি ! থাকগে ! ওই ঘটনাটা মনে রাখবেন না আর !

- অফকোর্স ! তবে তোমাকে মনে রাখবে সবাই । কেমন লাগসই উত্তরটা না দিলে ! স্যারের মুখটা একেবারে লটকে গেছিল’ ! সবাই হেসে উঠলাম একসাথে ।

- সপ্তাহ দু’য়েকের মধ্যে আমার গেঁয়ো গন্ধ মুছে দিল ওরা । ওদের যন্ত্রণায়,বিশেষ করে রূপার, আমার ঢাউস জামা কাপড় গুলো আলনা ছেড়ে পালিয়ে বাঁচল । পরিবর্তে উঠে এল স্কিন টাইট জিনস, বেলবটমরা ।

- প্রথম দিনের ঘটনার জন্য ক্যাম্পাসে বেশ পরিচিতি পেয়ে গেছি । বাংলা ম্যডাম, হোছনা আপাতো আমার নামই দিয়ে দিলেন ব্ল্যাক পেপার - গোল মরিচ । দূলাভাই আমাকে খেপানোর জন্য ডাকতেন ‘টমেটো’ আর এখানে হয়ে গেলাম গোল মরিচ । রূপা কিন্তু জবর প্রতিবাদ করে । বলে, ‘ম্যাডাম আপনার মূল্যায়ন কিন্তু একেবারে ঠিক না । অমন চাঁদপানা মুখ যার তার নাম ব্লাক পেপার হবে কেন ? হওয়াতো উচিৎ ‘মুন’ । রূপা আমাকে ‘মুন’ নামে ডাকতে শুরু করে ।

- আমাদের সাত জনের একটা গ্রুপ তৈ্রী হয়ে যায় । ক্লাস, ক্যান্টিন, লাইব্রেরি, সবুজ হোটেল – সবখানে আমাদের মিলিত উপস্থিতি । যে জন্য আমাদের নামই হয়ে গেল ‘সেভেন ষ্টার’ । আমাদের সবারই অবশ্য কোন না কোন গুণ ছিল । রূপা-অনি-রিফাতের গানের গলা । দেব তবলায় দারুণ, নাজ গীটারে । আর শ্যামা ! ওটা যেন সাক্ষাৎ মায়া হরিণ ! হাঁটে নাতো নাচে ! নবীন বরণ অনুষ্টানে নাচার পর তার নামই হয়ে গেল বেহুলা । কে জানে বেহুলা অমন ভাল নেচেছিল কিনা ! সব শেষে আমি । ছ’জনের সযত্ন মাজা ঘষায় ছ’সপ্তায় একেবারে সতেজ ধনেপাতা হয়ে উঠলাম । এখন সব তাতে ঢালা যায় আমাকে । সবখানে প্রক্সি দিতে পারি । গাইতে পারি, বাজাতে পারি, এমন কি শ্যামার সাথে চরণ মিলিয়ে নাচতেও পারি । কলেজের সব অনুষ্টানে আমরা অপরিহার্য হয়ে উঠলাম ।

- ওদের সহযোগিতায় সকাল সন্ধ্যা দু’টি টুইশন ও জুটে যায় আমার । বিনিময়ে যা পেতাম তা তখনকার দিনে অনেক । সারা মাসের খরচ সামলেও বেঁচে যেতো বেশ কিছু টাকা ! বেশ ভালোই কাটতে লাগলো দিন ।

- কি দ্রুত দিন যায় ! দিন, মাস, বছর শেষ হয় । পরের বছর ও । আমাদের মঝে একটা কমিটমেন্ট ছিল, যত কিছু করিনা কেন পরীক্ষায় ভাল্ করতেই হবে ! আমরা করিও ! এইচ এস সি ফাইনালে আমাদের গ্রুপ দারুণ ভাল করে । সবাই প্রথম বিভাগে পাশ করি আমরা । মেধা তালিকায় আমি ৩য়, অনি ৯বম এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে রুপা ৫ম । এস এস সি ‘তে কোন সাবজেক্টে ডিস্টিংশন পর্যন্ত ছিলনা তার । কোন মতে টেনে টুনে ১ম বিভাগ । কি দারুণ উত্থান ! আরো অবাক হওয়ার ব্যাপার সারা’খণ দুষ্টুমিতে মেতে থাকা চঞ্চল হরিণীটা বাগিয়েছে চার চারটে লেটার । দিল দরিয়া দেব, যে সব সময় ফেলের করার ভয়ে অস্থির থাকত, পেয়েছে তিনটা আর ‘আমাতু’ [কম কথা বলতো বলে নাজের আরেক নাম] নাজ পেয়েছে দু’টো ।

- সে সন্ধ্যায় আমরা বাকি ছয় জন রূপাকে অভিনন্দন জানাতে ‘সেন কুঞ্জে’ যাই । হল ঘরে আমাদের বসিয়ে বুয়া ভেতরে যায় খবর দিতে । অনেকটা উড়ে আসে রূপা । আমার সামনে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, ধরে ফেললাম । বুকের সাথে নিবিড় লেপ্টে গেল ‘ও’ । ধ্যাৎ বলে ছাড়াতে যাবো, সবাইকে অবাক করে দিয়ে রূপা আমার ঠোঁটে চুমু খায় । তারপর বলে উঠে, ‘তোর জন্যই আমার এত ভাল করারে ‘মুন’ ! বুঝলি ? I love you moon, I love you ’--- ! আবারো কিস করে ‘ও’ । তাকে ঠেলে ছাড়িয়ে ধপাস বসে পড়লাম সোপায় । ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব দেব হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠে ।

- ‘তুই একটা আস্ত গাধা’ ! তার পিঠে গুড়ুম গুড়ুম কিল মারতে মারতে আমি বললাম । কিন্তু দেবের সে প্রাণ খোলা হাসি যেন অনন্তকাল থামবার নয় । অন্য সবাইও যোগ দিল হাসিতে । নাজ কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘আমাদের কিন্তু ‘তুংফং’ এর খাওয়া পাওনা রইল ! কিপ্টেমি চলবেনা কয়ে রাখলাম’ !

- রূপার মা-বাবা এলেন একটু পরে আমাদের মিষ্টিমুখ করাতে । আমরা উঠে দাঁড়ালাম । অনিই হঠাৎ বলে উঠল, ‘আরে শ্যামা গেল কইরে ? দেখছিনাতো’ ! চুপিসারে শ্যামা কখন চলে গেছে , আমরা কেউ টের পাইনি ।

- আমাদের সেভেন ষ্টার ভেঙে গেল একদিন । অনি, রিফাত চলে গেল আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে, রূপা নাজ আর দেব গেল মেডিকেলে । শ্যামা চান্স পেয়েও গেলনা , অনার্স পড়তে পুরানো কলেজে রয়ে গেল । আর্থিক কারণে আমারো যাওয়া হলনা আর কোথাও !

- মেহেদীবাগে ওয়াসার পাম্প হাউজের লাগোয়া ছোট বাসায় এক চাচার সাথে থাকি । সন্ধ্যায় দেব আসে প্রায় প্রতিদিন । রূপা আর নাজ ও আসে মাঝে সাঝে । রূপা ফ্রি হয়েছে আরো । চাচার সামনেই খুনসুটি করে । চাচা না থাকলে নাজ আর দেবের সামনেই কিস করে । আমি কপট রাগ করি, বলি , ‘বেহায়া, !

- ‘আরে হায়াতো সব তোর থলেতে ঢেলে দিয়েছে ভগবান’ ! রূপা আমার কান কামড়ে দিয়ে বলে, ‘তোর বউ হবো যখন নাহয় ধার-টার দিস কিছু’ ।

- ক্যাম্পাসে পুরানো দিনের সে প্রাণ চাঞ্চল্য আর নাই । আমার বেশিরভাগ সময় কাটে ক্লাস আর লাইব্রেরি করে । শ্যামা অবশ্য পারত পক্ষে লগ ছাড়েনা । তবে আজকাল কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে হরিণীটা । কেমন অচেনা অচেনা চোখে তাকায় । রাগ করে, অভিমান করে, কথা বলাও বন্ধ রাখে মাঝে মাঝে । কিংবা কলেজেই আসেনা সপ্তা ভর । আমি উপভোগ করি । ইচ্ছে করে উল্টো-সিধে বলে রাগিয়ে দিই । ‘ও’ থম থম করে চলে যায় কিংবা মুখে মেঘের ঢাউস ঘোমটা টেনে বসে থাকে চুপচাপ ।

- সকাল থেকে ঝুম ঝুম বৃষ্টি আজ । লাইব্রেরিতে বসে নোট করছিলাম । চুড়ি বাজিয়ে শ্যামা তার উপস্থিতি জানান দিল । ক’দিন থেকে কি যেন বলি বলি করছিল, আমি টেলে গেছি ।

- ‘যা বলবি ঝটপট বল’, তার দিকে না তাকিয়েই বললাম, ‘দেখছিসতো ব্যস্ত আছি’ ।

- ‘তুই একটা আস্ত গাধা’ ! কোন রাখ ঢাখ না রেখেই ফেটে পড়ে শ্যামা । লাইব্রেরিতে অন্যদের উপস্থিতিও মনে রাখেনা সে ।

- ‘কবে থেইকা বুঝলি’ ? আমার ঠাণ্ডা গলা ।

- ‘ ইউ স্টুপিড’ ! রাস্কেল ! ইউ ডংকি ! ইউ হার্টলেস ইউ ইউ ইউ--‘ শ্যামা তোতলাতে থাকে !

- ‘মেডিকেলে গেলেই পারিস ! ওই হার্ট ফার্টের ব্যাপার ওরাই ভাল বুঝে’ আমি কপট গাম্ভীর্য ধরে রাখি ।

- ‘তুই হারামির জন্য যাইনি – বুঝতে পাস উল্লু’? বলে ঝর ঝর করে কেঁদে দেয় শ্যামা । হতবাক আমি তাকিয়ে থাকি ! তাহলে এই ছিল কারণ সেদিন রূপাদের বাড়ী থেকে চুপিসারে চলে আসার ! ঝড়ের বেগে চলে যায় শ্যামা । আমার নোট করা আর হয়না ।

- কাক ভেজা হয়ে ঘরে ফিরি । গেটের কাছে দেব আর রুপা দাঁড়িয়ে । আজ শনি বার । চাচা বাড়ী গেছেন । গেট বন্ধ, ওরা ঢুকতে পারেনি । চাবি বের করে গেট খুলছি --- দেব বলল, ‘আমি গেলামরে মুন — তাড়া আছে । রূপাকে পৌঁছে দিস’ । দেব চলে যায় ।

- ঘরে ঢুকে আলো জ্বালতে যাব, রূপা বলল, ‘থাকনা মুন ! তারচে বরং তুই একটু আদর কর আমাকে , বড্ড শীত করছে’ ।

- ‘তোর খালি নেকামি’, আমি বললাম, ‘কলোনির ছেলেরা টের পেলে দু’জনের হাড়গোর আর আস্ত রাখবেনা’ ।

- ‘পি কে সেনের মেয়ের গায়ে হাত দেয় এমন বুকের পাটা কার’ !

- ‘চ্যালেঞ্জ’ ?

- ‘ইয়েস, চ্যালেঞ্জ’ ! রূপা বলে । কি যে হয়ে গেল আমার সে মুহূর্তে আমি জানিনা । হ্যাঁচকা টানে তাকে বুকের উপর টেনে নিয়ে দু’হাতে আদুরে কিল দিতে লাগলাম তার পিঠে । রূপার ও কি জানি কি হয়ে গেল । আবেগে আঁখড়ে ধরল আমাকে । তারপর কবুতরের মত কাঁপতে থাকল !

- বৃষ্টি ভেজা সাঁঝের আধো আঁধারে সে ছোট কক্ষটিতে সাত সাতটি স্বর্গই বুঝি নেমে এসেছিল সেদিন ! একটি মাত্র সাঁঝে আমাদের সমস্ত নৈতিকতা, আদর্শের স্খলন হল, ওলট পালট হয়ে গেল সব কিছু ! আদিম মানব-মানবীর মত নিষিদ্ধ বৃক্ষের ছায়ায় আবিষ্কার করি আমরা নিজেদের, -- প্রকৃ্তির কোলে, সমস্ত সুখের নিগড়ে ! এত সুখ কি সয় কারো !

- অবশ্যই সয়না ! বাইরের পৃথিবীর হিসেব নিকেষ ও পালটে গেছে এ ক’য় মাসে । রাজনীতির আকাশে ধেয়ে এসেছে দুর্যোগের ঘনঘটা । সমস্ত নিয়ম কানুন, ওয়াদা ভঙ্গ করে প্রেসিডেন্ট আহুত পার্লামেন্ট বৈঠক স্থগিত ঘোষণা করে । বজ্র কন্ঠে গর্জে উঠে বঙ্গ শার্দুল, ‘এবারের সংগ্রাম ------- আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রা্ম’ । জনতা ফেটে পড়ে রুদ্ররোষে, আওয়াজ উঠে ‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ !

- খাঁ সা’ব আসে বাংলাদেশে । আলোচনার আড়ালে চলতে থাকে মারণ প্রস্তুতি । ‘সোয়াত’ ‘বাবর’ ভরে আসে গোলা বারুদ । সেনারা বেসামরিক পোষাকে নামাতে থাকে সে সব । কি ঘটতে যাচ্ছে না বুঝার কোন কারণ ছিলনা । কিন্তু নেতা তবু কেন নিয়মতান্ত্রিক পথে সমাধান খোঁজার গোঁ ধরে বসে ছিলেন তা আমার কাছে আজো ‘ভারমুদা’র রহস্য, স্মরণাতীত কালের রাজনীতির চরম বিস্ময় ! সাধারন মানুষের ধৈর্য তখন ভেঙে গেছে প্রায় । আর যারা তরুণ তাদেরতো শিরায় শিরায় আগুণের ফুলকি নাচন । ২৬ শে ‘সে আগুণ ছড়িয়ে গেল সবখানে’ । এক রাতেই ঝড়ে গেল অগুণিত প্রাণ, জ্বলে পুড়ে ছারখার হল আধেক বাংলাদেশ । কিন্তু রক্তে যার দুর্নিবার দ্রোহ সে বীর বাংলাকে দমায় কার সাধ্যি ! ধ্বংস্তুপ থেকে শির উঁচু করে হুঙ্কার দিয়ে উঠে ‘দি রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ ! ‘আমি মেজর জিয়া বলছি -------‘। ইথারে ইথারে ছড়িয়ে পড়ে সে খবর পুরো বিশ্বে । ‘সাবাস বাংলাদেশ , অবাক -------------------তবু মাথা নোয়াবার নয়’

- যুদ্ধ ! যুদ্ধ ! যুদ্ধ ! কে কোথায় ছড়িয়ে গেছে জানা সম্ভব ছিলনা । শহর ছাড়ার আগে রূপাদের খোঁজ নিতে গেছিলাম । প্রকাণ্ড সেন কুঞ্জ সুনসান । বুড়ো শংকর কাকা শুধু গেট আগলে পড়ে আছেন । ম্লান মুখে । কাছে যেতে পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করে দিলেন । রূপা লিখেছে, ‘জানি তুই আসবি ! আমরা আপাততঃ গ্রামে দাদুর কাছে থাকবো । ওখানে কিন্তু আমাকে খুঁজতে আসিসনে ! তুই আমার ভালবাসা, পরম আরাধ্য ! তবে মা ! হ্যাঁ, মা’ই কিন্তু সব ভালবাসার আধার । বন্দিনী মাকে যেদিন মুক্ত করতে পারবি সেদিন আসিস, আমি হাজার বছর অপেক্ষা করবো ! তুইতো জানিস তোর সাথে নরকে যেতেও আমার দ্বিধা নাই !
- ভাল থাকিস, চুমু নিস !
- তোর রূপা’ ।

- ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ । শির উঁচা করে ফিরে আসি আমরা । দানবের থাবা থেকে ছিনিয়ে আনি একটি লাল টকটকে সূর্য, রক্ত স্নাত একখানা উজ্জ্বল মানচিত্র; আমাদের একান্ত বাংলাদেশ !

- চার দশক পেরিয়ে গেছে অতঃপর । আজ ৪০ বছর পর হিসেব মিলাতে গিয়ে দেখি জমার খাতায় রক্তাক্ত দুটি শব্দ, ‘ছাব্বিশ’ আর ‘ষোল’, ‘স্বাধীনতা’ আর ‘বিজয়’ । বাকি সব ঢাউশ শূন্য ! আজ অবাক হয়ে দেখি সত্য, সুন্দর, ন্যায় আদর্শ, বিচার বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট নাই, সব লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেছে সমাজ থেকে ! মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলো নিহত হয়েছে একে একে । রাজনীতির নামে যা হচ্ছে তাকে মস্তানী ছাড়া কি আর বলা যায় ! নেতৃ্ত্বের একগুঁয়েমি আর স্বেচ্ছাচারিতার নামই এখন গণতন্ত্র ! কোটি নির্যাতিত মানুষ, লাখো শহীদ আর দুর্ভাগ্য বশতঃ বেঁচে যাওয়া মুক্তি যোদ্ধারা কি ‘রক্ত দিয়ে কিনলাম শালার এমন স্বাধীনতা’ জন্য লড়েছিল ?

- হারাতে হারাতে আমার আর হারাবার কিছু ছিলনা । বন্ধু, নিকট আত্মীয়দের অনেকে হারিয়ে গেছে চিরজনমের মতো । প্রিয় সখা ‘দেব’ আজো নিখোঁজ । পা খুইয়ে এসেছে রিফাত । রূপাও কথা রাখেনি, কিংবা রাখতে পারেনি ! একদিন শিশির স্নাত ভোরে আক্রান্ত হয়েছিল রূপাদের গ্রাম । নিরুপায় রূপা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয় ! জ্বলে যায় ভালবাসা !

- জ্বলতে জ্বলতে আমি আজো আছি । শ্যামা, সে মায়া হরিণীটা, পাশে আছে ! জেলে ছিলাম ’৭৪ এ । অপরাধ আমার একটা কবিতা !

- ‘আমরা স্বাধীন ? মানতে পারিনা !

- শেকলে বাঁধা ও বাড়ীর কুকুরটা !

- সে ওতো আমার চেয়ে অধিক স্বাধীন ।

- সে ইচ্ছে হলে ডাকতে পারে !

- এমন কি চেঁচাতে ও !

- অথচ আমি-------‘ !

- শ্যামার এডভোকেট পিতা মুচলেখা দিয়ে ছাড়িয়ে এনে নিজেদের ঘরেই তোলেন আমাকে ।

- আমার বুকের উসুম মাখতে মাখতে আজো প্রতিরাত শ্যামা অভিযোগ করে, ‘তুই হারামি আজো আমার হলিনে, রূপারই রয়ে গেলি’ !

- ‘তুইইতো আমার ‘মায়াবন বিহারিণী হরিণী’, আমি কথার মোড় ঘোরানোর চেষ্টা করি । ‘এই ষাট ছুঁই ছুঁই বয়সেও এতটুকু ফুরোলিনে ! ভয় হয় যদি রূপার মতো, আমার সব প্রিয়জনদের মতো তুইও কোন দিন হারিয়ে যাস’ !

- ‘নো, নেবার ! রূপা হারায়নি ! ওরা হারায়না ! তোর, আমার, সব বাঙ্গালীর হৃদয়ে, এ দেশের আকাশ-বাতাস-জলে, ফুল- তরু-লতা-গুল্মে, এ মাটির সব কিছুতেই ওরা মিশে আছে, থাকবে চিরকাল’ ! আমাকে আরো নিবিড় করে বুকে মিশিয়ে নিয়ে শ্যামা গুন গুন করে গাইতে থাকে !

- ‘তারা এ দেশের সবুজ ধানের শীষে,--------------------------চিরদিন আছে মিশে, চিরদিন র’বে মিশে’--------- ---------!

পোস্টটি ১২ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


টিপ সই

উচ্ছল's picture


বাংলাদেশ

মেসবাহ য়াযাদ's picture


অনেক চমৎকার লিখেছেন। চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছিলাম রুপা, শ্যামা, অনি, রিফাত , নাজ সবাইকে... সেটা আপনার লেখার গুনেই... ভাল থাকবেন। এভাবে লিখতে থাকুন নিয়মিত।

এ টি এম কাদের's picture


মেসবাহ ভাই,
খুবই সমস্যা হয়ে গেল । ব্লগ খুলতে পারছিনে অনেকদিন থেকে । তাই আপনাদের কমেন্ট পড়তে পারিনি-- উত্তরও দিতে পারিনি । দূঃখিত । সমস্যাটা কিছুতেই কাটছেনা । নূতন পাস ওয়ার্ড নিয়েও একবারের বেশি খুলতে পারছিনে । এমনিতেই আমার লিখতে অনেক টাইম লেগে যায় --তার উপর এই সমস্যা একেবারে নাকাল করে রেখেছে । মন্তব্যের জন্য ধ্ন্যবাদ ।

বাই দ্য বাই , ওমরার জন্য মক্কা গেছিলাম । এবি'র সব বন্ধুর প্রতি ছালাম ও শুভেচ্ছা ।

স্বপ্নের ফেরীওয়ালা's picture


টিপ সই

আনন্দবাবু's picture


- ‘আমরা স্বাধীন ? মানতে পারিনা !

- শেকলে বাঁধা ও বাড়ীর কুকুরটা !

- সে ওতো আমার চেয়ে অধিক স্বাধীন ।

- সে ইচ্ছে হলে ডাকতে পারে !

- এমন কি চেঁচাতে ও !

- অথচ আমি-------‘ !

Star Star Star

এ টি এম কাদের's picture


আনন্দ,

কেমন আছো ? অনেকদিন ব্লগ খুলতে পারিনি । তাই তোমাদের কমেন্ট পড়া হয়নি । দূঃখিত । ইমো আমি খুব একটা বুঝিনা--সেকেলেতো !

ভালো থেকো ।

তানবীরা's picture


অনেক চমৎকার লিখেছেন।

রাগিব হাসান's picture


ইন্টারেস্টিং গল্প। আপনি কি চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ছিলেন?

আমি, আমার মা, বোন, বউ, শালা, শ্বশুর, দাদা/চাচা/ফুফু/শ্বশুর এই সবাই চট্টগ্রাম কলেজে পড়েছি। গল্পটা তাই খুব কাছের মনে হলো ...

১০

এ টি এম কাদের's picture


জ্বি ভাইয়া ! সে অনেক দিন আগে ১৯৬৭ তে এই প্রিয় কলেজের ছাত্র ছিলাম আমি । এখনো মনে হয় এইতো সেদিন ! কেমন করে যে এত দ্রুত চলে গেল মধুর দিন গুলো ! এখন অবশ্য আমার এক মেয়ে পড়ে এই কলেজে । দেশে গেলে তার হাত ধরে যখন ক্যাম্পাসে হাঁটি, মনে হয় আমি এখনো আমার প্রিয় কলেজের ছাত্র আছি ।

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ !

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

এ টি এম কাদের's picture

নিজের সম্পর্কে

আমি একজন নগণ্য মুক্তিযোদ্ধা । বিদ্যুৎ প্রকৌশলী । স্বাধীনতা পরর্বতী রাজনীতির প্রতি প্রবল বীতশ্রদ্ধ । অসামপ্রদায়িক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ।
'৭৮ এ নানা কারণে চাকুরি বিদেশে চলে আসি ।