১১৩৪ - সংখ্যা নয়, প্রাণ
বাংলাদেশের পোষাক শ্রমিকদের প্রাণ হারানো যেন নিত্যনৈমত্তিক বিষয়, দিনে দিনে বাড়ছে সেই বঞ্চনা নিপীড়নের গল্প। হ্যা, সব কিছু একসময় গল্পই হয়ে যায়! পোষাক কারখানার কষ্টকর জীবনযাপন তো চলছেই দিনমান, তবে পোষাক শ্রমিকদের প্রাণ হরণের যে যজ্ঞ শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল, সেই অভিষপ্ত রানা প্লাজা'র কথা ভুলতে পারা যায় না। ১১৩৪ এর পরও অগুনিত প্রাণের আত্নাহুতি হয়েছিল মৃত্যুকূপ রানা প্লাজায়। এই ১১৩৪ কেবলি হাতে গোনা সংখ্যা নয়, এই গুনিতব্য সংখ্যার হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর সাথে জড়িয়ে ছিলো আরো হাজারো প্রানের আশা আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন। সেই হাজারো স্বপ্ন কি অবলীলায় চুরমার হয়ে গেল। বছর পেরিয়ে আসছে ভয়াবহ সেই দিন।
এইদিনটির স্মরণে পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইন্সটিটিউটে আয়োজিত হচ্ছে ৫দিন ব্যাপী এক প্রদর্শনীর। নানা মাধ্যমের শিল্পীরা তাদের আলোকচিত্র ইন্সটলেশন, পারফরমেন্স আর্ট প্রামাণ্যচিত্র,গান,নাটকসহ নানান শিল্পমাধ্যমে প্রতিবাদ জানাতে "১১৩৪ সংখ্যা নয়, প্রাণ" নামের এই যৌথ প্রদর্শনীটি আয়োজন করেছেন। আজ ২২এপ্রিল ছিলো এর উদ্বোধনী।
এই উপলক্ষ্যে পাঠশালা সেজেছে অপূর্ব এক সাজে, উঠোন, প্রতিটি দেয়াল, ডার্ক রুম, স্মোকিং এরিয়া, ক্লাশ রুম, ছাদ কিচ্ছু বাদ নেই। পাঠশালার প্রতি কোনায় চলছে কষ্টের মূহুর্তগুলোর উপস্থাপনা, প্রথিতযশা ফটোগ্রাফারদের তোলা সেই ট্র্যাজিডির খন্ড খন্ড চিত্র। আজ উদ্বোধনী দিনে উপস্থপিত হলো তিনটি পরিবেশনা। সামনের উঠোনে একজন সর্বাঙ্গে রংবেরঙ্গের সুতোয় মোড়ানো, মাথায় জুতো তোলা, নাক-মুখে স্কচ টেপ মুড়ানো - যেন পোষাক কারখানার কর্মীর দমবন্ধ করা কষ্টকর কাজের পরিস্থিতির প্রতিচ্ছবি দেখাচ্ছেন। চারপাশ ঘিরে থাকা এতো মানুষের ভিড়ে শেষটুকু দেখে উঠতে পারিনি।
সামনের দেয়াল খোদাই করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, প্রদর্শনীর নাম আর নীচে তাসলিমা আক্তারের সেই সুবিখ্যাত ছবি 'The Final Embrace'
সাদা এই দেয়ালের বিপরীত পাশটা কালো রঙের, আর তাতে আবীর আব্দুল্লাহ'র তোলা বড় একটা ছবি ঝোলানো। জীবন যে কি ভীষন সুন্দর, সেই মৃত্যুকূপ থেকে বেচেঁ ফেরার আনন্দের ছবি, কিন্তু তা দেখেও বুকটা মুচড়ে ওঠে, কষ্টে বিবমিষা লেগে যায়।
ছবিঃ আবীর আব্দুল্লাহ
পাঠশালার গেট দিয়ে ঢুকতেই সুলেখা দি'র একটা কাজ উপস্থাপিত হচ্ছে। লাল সুতোর ঝালর দেয়া একটা ছোট্ট ঘর, সামনে পোষাক শ্রমিকদের ছোটছোট ছবি। ঝালর পেরিয়ে ঘরে ঢুকতেই রক্তমাখা ধূলায় মলিন ছিন্ন পোষাক, লাল আলোয় রাঙ্গা বড় একটা আয়নায় লেখা, "why! God why!" শিল্পী স্রষ্টার কাছে এই প্রশ্ন করেছন। সত্যিই তো পোষাক কারখানার রক্তচোষা মালিকেরা দিব্যি আয়েশি জীবনযাপন করে চলে, অকাতরে প্রাণ দিয়ে গেলেন এতো এতোগুলো মানুষ, স্রষ্টার কি আশ্চর্য লীলাখেলা।
করিডোরের দেয়াল জুড়ে সার সার ছবি, যেসব দেখে চোখ ফেরানো যায় না, দম ধরে আসে। আর করিডোর বরাবর বিপরীত বারান্দার দেয়ালে সুবিশাল এক ছবি, তাতে মেয়েটির দৃষ্টি বিদ্ধ করবেই যে কাউকে। অনুভূতি শূন্য হয়েও যেন কতশত অনুভূতির সমাহার সেই চোখে।
ছাদে শুরু হতে যাচ্ছে রীতু সাত্তারের একটি প্রতিবাদী উপস্থাপনা, ভীড়ের কারনে সিড়িই পেরুতে পারলাম না দেখে এগিয়ে যাই স্মোকিং জোনের দিকে। প্রথম দেখায় মনে হবে অবিন্যস্তভাবে গার্মেন্টেসের কার্টন সাজানো, এগিয়ে যেতেই চোখে পড়বে, এর ফাকেঁ ফাকেঁ গোজা মানুষের হাত, পা, আধভাঙ্গা শরীর! চাপ চাপ কষ্ট যেন থরেথরে সাজানো!
পাশেই ডার্করুমে ঢুকতেই কতকগুলো এক্সরে প্রিন্ট ঝোলানো, কোমরের অস্থি গুড়ানো, ভাঙ্গা ভাঙ্গা পায়ের হাড়। প্রথমে কিছুই মনে হয়নি, কিন্তু খেয়াল করে রুমে বাজতে থাকা শব্দগুলো শুনতেই কেপেঁ ওঠে আত্মা, এবার মেলানো যায় এক্সরে গুলো, কালো ডার্করুমে দাঁড়ানো যায় না বেশিক্ষন। উঠোন পেরিয়ে প্রথম রুমের সামনের দেয়াল জুড়ে আকাঁ ছবি, রানা প্লাজার ভগ্নদশা।
এই রুমটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, সাজ অভিজাত রকমের! সৌন্দর্য্যতার যেন পরাকাষ্টতা করা হয়েছে এখানে, কিন্তু সব দেখে শুনে ধাক্কাটা ঠিকঠিক পাবেন। কি ভীষন নোংরা যেন এই সুন্দরতা!
এক দেয়াল জুড়ে খোপ খোপ করা, একটায় টিভিতে ফ্যাশন শো চলছে, একেক খোপে একেক দামী পণ্য, কিন্তু দুপাশে এক খোপে বড় এক হাতুড়ি, অন্যটায় বড় এক যন্ত্র।
রুমের মাঝ বরাবর স্পট লাইটের আলোয় এক কাচেঁর বাক্সে ১১৩৪ সংখ্যায় পরিনত হওয়াদের গুচ্ছগুচ্ছ চুল।
আরেক সুদৃশ্য রঙ করা দেয়াল জুড়ে কেবলি গল্প হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর টুকরো টুকরো স্মৃতি চিহ্ন, কষ্টে মুড়ানো সেসব।
একটা দেয়ালে একটা ভায়োলিন, তারগুলোর উপর যে ছড়াটা আছে তা একটা হ্যক্সো ব্লেডের মতোন, কাছে গিয়ে উচ্চারন করবেন ১১৩৪, বেজে উঠবে ভীষন মর্মস্পর্শী এক সুর। মনোহর কাপড় তৈরীর পেছনের কারিগরের করাত কাটার মতো কষ্টের প্রতিচ্ছবি যেব এটা। সুরের মাধুরীতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়েই দাঁড়িয়ে রইবেন এর সামনে।
মন খারাপ করে দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই দেখি ছাদ থেকে ঝুলে পড়েছে রীতু সাত্তারের মাথা, আরো ভয়ংকর ব্যাপার হলো, এলানো উনার সুদীর্ঘ চুল বেয়ে বেয়ে পড়া রক্তে ভেসে যাচ্ছে সামনের উঠোন, তাতে পড়ে আছে খাবারের টিফিনবাটি। প্রতিবাদের ভাষার কত রুপ!
উঠোনের দেয়াল জুড়ে স্বজন হারানোদের আর্তনাদের কথাগুলো লেখা, পাশে একটা হেডফোন, শুনতে সাহস হয়নি।
মনে রাখার মতোন এক প্রদর্শনী "১১৩৪ সংখ্যা নয়, প্রাণ"। চমৎকার এই প্রদর্শনীটি সবান্ধবে সবাই দেখে আসতে পারেন।
প্রদর্শনীঃ "১১৩৪ সংখ্যা নয়, প্রাণ"
২২-২৬ এপ্রিল ২০১৪
প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা
আয়োজনেঃ পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইন্সটিটিউট
১৬ শুক্রাবাদ,পান্থপথ,ঢাকা-১২০৭
দারুন!
আসলেই দারুন এক প্রদর্শনী। তুমি তো কত জায়গায় ঘুরে আসো, একবার ঢু মেরে আসতে পারো পাঠশালাতে
দারুণ এক আয়োজন। তবে সবকিছুই আসলে চোখ ভিজিয়ে দেয়, মন খারাপ করে দেয় আহারে জীবন!
হুম, কত কত জীবনের অপচয়, দুর্দশা, কষ্টের হাহাকারের ভরা ছবিগুলো। সত্যিকারের পরিস্থিতি কত লক্ষগুন বেশি ভাবো।
সহ্য করার মত নয় (
"১১৩৪ - সংখ্যা নয়, প্রাণ "
অসাধারন একটা শিরোনাম
শিরোনামটা আসলে ধার করা বলা যেতে পারে, মূল এক্সিবিশনের নাম ছিল ইংরেজীতে, ওটাকেই বাংলা করে পোষ্টের শিরোনাম করেছি
ধন্যবাদ আল-আমিন
মন্তব্য করুন