প্রযত্নে-হন্তা :: গল্প শেষের পরে ...
হিমালয়ের বাছাইকৃত বা বলা ভাল পছন্দের ১০টি ছোট গল্প নিয়ে অবশেষে গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হলো। প্রযত্নে-হন্তা। প্রকাশকাল অক্টোবর ২০১১। ব্লগার হিমালয় লিখছে অনেকদিন ধরে। কিন্তু লেখাগুলো কেন গতবারের কিংবা তারো আগের কোন বইমেলায় মলাটবদ্ধ করেনি কে জানে! ব্লগে মূলত গল্পই পড়েছি তার। আমার অনেক দিন কাগজে-কলমে, ওহ না! কি-বোর্ড চেপে চেপে ডিজিটাল পাতায় কোন ‘বুক রিভিউ’ লেখার অবসর হচ্ছিল না। ভেবে ছিলাম প্রযত্নে-হন্তা’র রিভিউ লিখব।বই প্রকাশের পর রিভিউ শুরু করতে করতে বেশ খানিক সময় গড়িয়ে গেল। চাইলে বইয়ের গল্পের নাম জেনে ব্লগ ঘেঁটে আগেভাগে লিখে রাখা যেত। লেখকের কাছ থেকে একটা ই-সংস্করণ চেয়ে নিয়েও লিখে ফেলা যেত। কিন্তু অপেক্ষা ছিল করপুটে বই পুড়ে নেয়ার। বই নতুন হোক আর পুরনো, গন্ধ শুঁকে শুঁকে পাতা উল্টেপাল্টে না দেখলে নাড়ির টান টের পাই না মোটে। জোরজার করে লিখলে শেষমেষ একটা ক্লিশে রিভিউ দাঁড়া করানো যাবে সর্বোচ্চ!
হিমালয়ের লেখা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করা আমার জন্য কঠিন। শেষ শব্দটা পাল্টে দিয়ে, বাক্যের পুনরাবৃত্তি করা যায় - হিমালয়ের লেখা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করা আমার জন্য সহজ। সহজ এজন্য যে, ব্লগে ইতোমধ্যে ওর অনেক লেখা আমার পড়া। এখনও কোন কোন গল্পের ছায়া শরীর মনে করতে পারি। ওর ব্লগে প্রকাশিত অনেক গল্পেই আমার মন্তব্য রয়ে গেছে। গল্পপাঠ পর সেই প্রতিক্রিয়া সহজেই টেনে আনতে পারি এখানে। এ সহজ কারণে রিভিউ লেখাটা আমার জন্য সহজ। তবে একটা কঠিন কারণেও বিষয়টা সহজ আমার জন্য। লেখক হিসেবে হিমালয় নিজের যে কোন গল্পের ডেপথ অফ ফিল্ডে খনন করে যায় স্থিরচিত্তে। তার লেখায় যাপিত চরিত্রেরা ভাবে বেশি। হিমালয়ের যে ছোট গল্পগুলো, সম্পূর্ণ পড়া শেষ করার পর ছোট গল্পের চিরায়ত রূপে অসম্পূর্ণ অনুভূতির জন্ম দেয়, সেখানেও ভাব দর্শনের গাঢ় ছাপ থাকে। পাঠক হিসেবে এভাবে লেখকের বিশেষত্বকে ধরে ফেললে, তার লেখার রিভিউ করা সহজ। অথবা আমি চাইলেই উৎসাহ প্রদান এড়িয়ে, নিরেট স্তুতিবাক্য বয়কট করে লেখকের গল্পশৈলীর খুঁত খুঁজে সমালোচনার পথে যেতে পারি। হিমালয় পাঠকের সমালোচনা অধিক খুঁটিয়ে পড়ে বলে আমার ধারনা। তাই সমালোচনামূলক রিভিউ লেখাও জলবত তরলম আমার জন্য। তবে যে কারণে কঠিন সে কারণটা রিভিউকে সহজে ছাড় দেবেনা। হিমালয় ডেপথ অফ ফিল্ডে যাওয়ার জন্য প্রতি গল্পের চরিত্র নিয়ে বেশ এক্সপেরিমেন্ট করে। প্রতি গল্পের অবয়বে লেখকের নিরীক্ষণ চোখে পড়ে। তাতে গল্প থেকে গল্পান্তরে বুনন পাল্টে যায়, চরিত্রের রং বদলায়। এক গল্পে ব্যবহৃত চাদর-পর্দা অন্য গল্পের অন্দরমহলে দ্বিতীয়বার দৃশ্যমান হয় না। তাতে পাঠক হিসেবে লেখককে পুন:আবিষ্কার করতে হয়। উৎসুক হতে হয়, নতুন একটা ভাব দর্শনের জন্য। এরুপ নব নব অন্বেষণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাই। তাতে রিভিউ কঠিন হয়ে যায়। আমি জানি বই প্রকাশের পূর্বে হিমালয় তার প্রতিটি গল্পের গভীরতা পুনরায় মাপঝোঁক করে দেখেছে। পুন:খনন করেছে। তাই আমার জন্য দুম করে একটা রিভিউ লিখে ফেলা কঠিন! ফলে ১৪২ পৃষ্ঠার একটি বইয়ের পাতায় পাতায় চোখ রাখা অনিবার্য হয়ে ওঠে আমার জন্য।
আগেই বলেছি, ১০টি ছোট গল্পকে মলাটবন্দী করা হয়েছে প্রযত্নে-হন্তা’য়। একটু থমকে গেলাম শুরুতে; 41 গল্পটা আগে পড়িনি। গল্পটা পড়তে পড়তে কৌতূহল দমনে অপারগ হয়ে একবার গুগলে বাংলা, ইংরেজিতে ৪১ লিখে খোঁজ দিলাম। কেন এমনটা করেছি, সেটা পাঠক ১৬ পৃষ্ঠায় এসে বুঝতে পারবেন। আমি বরং 41 সাদৃশ্য ভবনে প্রবেশ করি আরমানের সাথে। ঘুরতে ঘুরতে ইউটোপিও ধারনার সঙ্গে আশ্রমের মিল খুঁজছিলাম সন্তর্পনে। ২১ পৃষ্ঠায় রীতিমত চমকেই উঠেছিলাম, যখন আরমান একই কথা পাড়ল মনসুর মজিদের কাছে। গল্পে মনসুর মজিদ একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র । ৪১ এর জট তারই সৃষ্ট। এ জটের প্রতিটি গিঁট অবশ্য তিনি নিজেই অবলীলায় খুলে গেছেন আরমানের কাছে। গোপন আলাপে কোন সদ্য পরিচিতের কাছে তিনি কেন এতটা সহজ প্রকাশ্য ভেবে কাহিনীর এই অংশে পাঠক হিসেবে প্রবল আপত্তি তৈরী হচ্ছিল আমার। এ নিয়ে কুলীন আর কয়েদিদের মত মুখোমুখি দ্বান্দিকতায় পড়েছিলাম গল্পটা শেষ না করা অব্দি। লেখার ধরণের কারণে গল্পটা পাঠকের কাছে এক ধরণের রহস্য-রোমাঞ্চের শিহরণ দিতে পারে। হতে পারে পাঠক কিছু দিন ৪১ সংখ্যাটিকে ভিন্ন চোখে দেখবেন। সংখ্যার প্রতি হিমালয়ের দূর্বলতা রয়েছে, তার পুরনো পাঠক হিসেবে জানি। লেখকের আপন স্বীকারোক্তিও মিলে গেল গল্পের পরে ।
এ গল্পগ্রন্থের একটা বিশেষ দিক হলো, প্রতি গল্পের পরে, গল্পের পেছনের গল্পটা ছোট্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। পেছনের গল্প নিয়ে আমরা আরো জানবো। তবে আপাতত পরের গল্পের জন্য এগুতে পারি আমরা।
মৃম্ময় আকাশের ডায়রী পড়তে পড়তে বস্তুত লেখকের ভেতরকার বিলক্ষণ মনীষী দর্শনের সাথেই পরিচিত হবেন পাঠক। দ্বিতীয় গল্প মনীষী সিনড্রোম - এর কথা বলছি। পাঠক এ গল্পে কারো চুরি করা ডায়রী পড়ার অপরাধবোধের চেয়ে কারো ব্যক্তিগত জগতে চোরাগুপ্তা হানা দেয়ার নিষিদ্ধ শিহরণ টের পাবেন। হিমালয় তার অনেক লেখায় গল্পোচ্ছলে কোন না কোন চরিত্রের মুখ দিয়ে মনীষীদের জীবন দর্শন, জীবন যাপনের কথা বলিয়ে নেয়, যা পড়তে গিয়ে পাঠক চমকৃত হবেন সব সময়। পাঠক, আপনার মধ্যে যদি নাখাস্তা সমাজ-জীবন কাঠামো নিয়ে ছটাক পরিমাণ শ্লেষও থেকে থাকে, তবে এ গল্পপাঠ পর আপনিও দু’চারটে খিস্তিখেউর লিখে রাখবেন ডায়রিতে। এ গল্পের গল্প নিয়ে অতি কথন না করে বলি, পাঠক এই অংশে পুনরায় লেখকের মনীষী সিনড্রোমের সাক্ষাৎ পাবেন।
পঁচিশে অক্টোবর শিরোনামের গল্পে এই তারিখ বিশেষ কোন তাৎপর্য রাখে না। লেখকের ভাষ্য অনুযায়ী, এ তারিখ তার ব্যক্তি জীবনে ভূমিকা রাখে। ২৫শে অক্টোবর নিয়ে আমার নিজের কোন স্মৃতিকাতরতা নেই। তবে মনে করে দেখলাম, ওই তারিখে যে হলভর্তি দর্শক ’একদা একসময়’ টেলিফিল্মটি উপভোগ করছিল, তাদের মধ্যে আমিও একজন। কিন্তু পঁচিশে অক্টোবর গল্পের পটভূমি কী? লেখক কারো কারো মনোজগতে সন্তর্পনে ঢুকে গেছেন। তাজুল, তানভীর, সেঁজুতি, পিয়া, আর একটি অ-মুখ্য চরিত্র ড্রাইভার। এদের কারো মনস্তত্বে অপরাধ প্রবণতা ’সাইকো’ পর্যায়ে। কারো চিন্তাজগত বিধ্বংসী। কেউ উড়নচন্ডী। এদের পরিণতি সম্পর্কে একজনই জানাতে পারেন পাঠককে, তিনি সুমাইয়া। তবে দৈনন্দিন জীবনের ডাক পার হয়ে এতোটা সময় ব্যয় করার সুযোগ দেয়া হয়নি তাকে। বরং পাঠককে আগ্রহের চুড়ান্ত সীমায় পাঠিয়ে এক নিরাসক্ত বিভঙ্গে লেখককে তার লেখকীয় দর্শনবোধ তুলে ধরতে দেখা গেল গল্পের শেষাংশে ।
পরের গল্পের শিরোনামও সংখ্যাবাচক। তবে এ সংখ্যার সাথে আমাদের জাতিগত যোগাযোগ আছে। গল্পের নাম ৭দশ১’একাত্তর।মুক্তিযুদ্ধকালীন পটভূমি নয়। তবে গল্পে আজকের চরিত্রেরা অতীতগাঁথার সেই চরিত্রদের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। এই বেরিয়ে পড়ায় নাটকীয়তা তৈরী করেছে তিনটি মূল চরিত্র। গল্প এক সময় আবেগের জায়গা নিয়ে বিকিকিনি রকমের ছিনিমিনি থেলার গল্প হয়ে ওঠে। গল্পে দ্বন্দ এসেছে। সংঘাত দেখা গেছে। কারো মধ্যে অন্তর্দহন দেখা গেছে। বলছি না যে, গল্পে কোন মুক্তিযোদ্ধার শতেক ছেঁড়াতালির জীবনযাপন বর্ণনাশৈলীতে আপ্লুত আবেগ ছিল, এমনও না যে, কোন মুক্তিযোদ্ধার দু:সাহসিক স্মৃতিচারণ ছিল, তবে সবেদ চরিত্রটিকে সামনে আনাটা পাঠককে উৎসুক করে। সময়ের সাথে সাথে ব্যক্তিদর্শন পাল্টে ফেলা একজন হলো সবেদ। চরিত্রটি কিছু অপ্রিয় বাস্তবতা পাঠকের সামনে তুলে ধরে। গল্প যতই শেষান্তের পথে এগুচ্ছিল, ততই এক কষ্টচিত্র উপলব্ধিতে ভেসে ওঠছিল- ৭১ কিভাবে পণ্য হয়ে গেছে ৪০ বছর পর!আসলেই তো ৪০ বছর পর ৭১ এভাবেই পণ্য হয়ে গেছে!
র্দাপ! মাত্রই যা লিখলাম, তার স্বাভাবিক পঠনে উচ্চারণ করতে পূর্বেও পারিনি, আজো না। লেখক এই গল্পের নাম পরিচিতি কীভাবে করে, আর পাঠকরাই বা কিভাবে এই গল্প শিরোনাম উচ্চারণ করেন, জানার প্রবল আগ্রহ থাকলো। গল্পকে সংগীতের মত রূপবন্ধে ভাগ করে দেখলাম, পুন: রচনায় লেখক গল্পের স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী আর আভোগে সূক্ষ থেকে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। ২০০৮ সালে যে গল্প পড়েছিলাম, আজ ২০১১’তে সে গল্পে পুরনো প্রতিক্রিয়া চালিয়ে দেয়ার অবকাশ মিলল না। পর্দা পাল্টে গেছে। না! র্দাপ! গল্পে মুখ্য অস্তিত্ব লাবনি।যে সামাজিক জীবনে সফল, প্রতিষ্ঠিত। গল্পে মুখ্য ভ্রম ক্ষণে ক্ষণে আকার পাল্টানো এক ছায়া শরীর। ছায়া শরীর অনর্গল দর্শন উগড়ে গেছে। কখনো বোধি জাগানিয়া, তো কখনো উন্নাসিক বচন! অশরীরির অস্তিত্ব, পরস্পর বিরোধী জীবন দর্শন লাবণির চিন্তাজগৎকে সতর্ক, ঘোলাটে ও প্রভাবিত করছিল। ব্ইয়ের গল্পগুলো যারা ধারাবাহিক ভাবে পড়ছেন, তারা এ গল্পে এসে লেখকের সাথে যোগাযোগ পুন:স্থাপন করবেন। কারণ এ গল্প অনেক পাঠকের কাছে অপরাপর গল্পের তুলনায় সামান্য দুর্বোধ্য মনে হতে পারে। তবে যদি পাঠক ছায়া শরীরকে লাবণির সৃষ্ট স্রেফ এক কল্পনাপ্রসূত কাঠামো ধরে নেয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হন, তবে গল্পের এ্যাববসার্ডিটি দর্শনবোধ কম অনুভূত হবে।
বইয়ের মাঝামাঝিতে এসে নামভূমিকার গল্প পাওয়া গেল। গল্পগ্রন্থের নামে বইয়ের একটি গল্প, প্রযত্নে-হন্তা। চলচ্চিত্রে নামভূমিকায় অভিনয় করেন অভিনেতা। অনবরত ঘুরতে থাকা কলমালেবু সাদৃশ্য গোলকপিণ্ডেরে ভেতর বন্দি মানুষ নামক দলা দলা মাংসপিণ্ড যার যার নাম ভূমিকা পালন করে যায়। এমন কতগুলো নাম - দাউদ, লকিব, সুবিলাশ, সালেহীন। এদের জীবন যাপন প্রান্তিকতায় গিয়ে ঠেকেছে। আবার ওই অবস্থান থেকে এরা জীবনকে পিষ্ট করে দিতে উদ্যত। এরা অদৃষ্টবাদী। আবার অদৃষ্ট বৈরীও। পরিশেষে অদৃষ্টকর্তা তালাশি। হত্যককে প্ররোচনাকারীই কি প্রকৃত হন্তারক নন? প্রশ্নটা খুঁচিয়েই যাচ্ছে গল্প শেষের পর। গল্পটা শেষ করার পর লেখক সম্পর্কে পাঠকের ধারনা আরো উর্ধ্বমুখী হবে। জীবনের, জীবিকার, পথের, ক্ষোভের, নৈরাশ্যের, স্বপ্নের, শরীরের, মনের যে কত রকম বিভঙ্গ আছে তা লেখক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আনতে পেরেছেন গল্পে।
হিমালয়ের বেশিরভাগ গল্পের শিরোনামে বিচিত্রতা থাকে। সব গল্পের শিরোনাম বৈষয়িক হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই নৈবর্তিক হয়। ’লিখি চলো…’ শিরোনামে যথেষ্ট রোমান্টিসিজমের আঁচ পাওয়া গেল। তবে এ গল্প নিটোল প্রেমের গল্প নয়। নিছক প্রেমের গল্পও নয়। যদিও পাপড়ির সাথে গল্পের মূল চরিত্রের সম্পর্কটা প্রেমই। প্রেমের এক অদ্ভূদ প্রকাশ দেখা গেছে গল্পে। শুরুতে পাপড়ির টুকটাক সংলাপ থাকলেও, এরপরের দীর্ঘ সময়, একেবারে গল্পের অন্ত অবধি পাপড়িকে নির্বাক থাকতে হয়েছে।গল্পটা এগুনো শুরু করেছে পাপড়ির নির্বাকতার মধ্যে দিয়েই। এরপর যে খেলা শুরু হলো তার পরিনতি পাপড়ির বিপরীতে থাকা মূল চরিত্রটিকে বিকারগ্রস্থতার দিকে নিয়ে যায় কি না ভেবে শুরুতে সামান্য আশংকা হচ্ছিল। আশংকাটি ক্রমেই শতভাগ অমূলক হয়ে ওঠে। পাপড়ির সাথে মূল চরিত্রের অদ্ভূত খেলাটি সাহিত্যদর্শনের পথে ধাবিত হয়। উন্মুখ হয়। উন্মনা হয়। পরিশেষে একটা স্থিরতায় পৌঁছায়। গল্পের গল্পে জানা গেল, লেখক সৃজনশীল লেখনী কর্মশালায় কখনো অংশ নিয়েছিলেন, যেখান থেকে, তিনি কিছু চিন্তা সংগ্রহ করেন। বোঝা গেল তাই -ই এক নাটকীয় আবহে গল্পের কাঠামোয় রূপান্তরিত হয়েছে। গল্পটি বোরিং হয়ে ওঠে কিনা, কিছুটা পড়ার পর সেরকম একটা ভাবনা মনে এসেছিল বটে, তবে পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে সে ভাবনাও তলিয়ে গিয়েছিল।
চলচ্চিত্রে ফ্ল্যাশব্যাক আবহের প্রতি আমার মোহগ্রস্থতা কাজ করে ভীষণ। বর্তমান থেকে অতীত, অতীত থেকে বর্তমানের ’ব্লেন্ডিং’ সিনেমাকে চোখের সামনে ধরে বসিয়ে রাখে।ওরকম একটা মজা আছে পরের গল্প ’গ,ল,হ; তবু গলগ্রহ’ -তে। গল্পে বর্তমান নয়, অতীতেরই মুখ্য চিত্রায়ণ হয়েছে। অতীতের সাথে অতীতের দূরত্ব ছিল, অথচ, গল্পে অতীতেরা একে অন্যের সাথে সমান্তরাল ভাবে ’ব্লেন্ড’ হচ্ছিল। ২০১০ সালে গল্পটা যখন পড়ি তখন কালো পিঁপড়ে, লাল পিঁপড়ে দিয়ে ধর্মীয় সামাজিক বিভেদের বিপরীতে প্রেমদর্শনের অবস্থান নিয়ে কিছু পাবো ভেবেছিলাম। গায়ত্রী দত্তের উপস্থিতি পাঠকের হিসেবের পাল্লাটা প্রতিবার প্রচ্ছন্নভাবে নাড়িয়ে দিলেও, গল্পটা সেদিকে আর হেলে পড়েনি শেষাবধি। ব্লগে মন্তব্য বিনিময়ে লেখক জানিয়েছিলেন, গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র শৈবাল। এটা অবশ্য অধিকাংশ পাঠকের চোখে ধরা নাও দিতে পারে। উপস্থিতির কারণেই হোক, ঘটনা, আলাপকে ধারণ করার কারণেই হোক, সমান্তরাল চরিত্র আরশাদকেই মুখ্য মনে হবে। তবে এটাও স্পষ্ট অনুভূত হবে যে আরশাদ ঘটনার ও অন্যান্য চরিত্রের নিয়ন্ত্রক নয় বরং পর্যবেক্ষক।
ঈশিতা একটি আমগাছ খুঁজেছিল - পরের গল্প। ঈশিতার সাধামাটা জীবনের ভেতরের গল্প। গল্পটা ঈশিতার মনকূপের তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ঈশিতার ভয়, সংকোচ, প্রেম, স্বপ্ন, স্নেহছায়া কাতরতা এই নিয়ে গল্প। দক্ষিণ দিক থেকে আগত ভয়ে চেতন-অবচেতনে থাকা নিশ্চয়তা সন্ধানী মনের প্রতিবর্তক্রিয়ায় পরিচালিত ব্যক্তি যেমন করে উর্ধ্বমুখী হয়ে উত্তরদিকে ছুটতে থাকে, গল্পে তেমনি ভাবে হিজল গাছ ভীতির বিপরীতে আম গাছ দাঁড়িয়েছে নির্ভরতা হয়ে। অন্তর্মুখী মানুষেরা বহুসংসর্গ বিবর্জিত হলেও বিশেষ কারো প্রেমছায়া, স্নেহছায়ার প্রত্যাশা তারা লালন করে। কারণ কেবল এই অংশেই তারা যথেষ্ট প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু যদি নির্ভরতার সেই আম গাছ কেটে ফেলা হয়, তবে ব্যক্তি কার ছায়ায় বসে স্থির হবে? ওর জগৎটা ওলোটপালট হয়ে যাবে না কি? এমন প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে পাঠকের মধ্যে, তবে লেখক অবশ্য এ গল্পের শেষাংশে আচমকাই সবকিছু সময়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজের দায়মুক্তি ঘটিয়েছেন।
সর্বশেষ গল্প- পাঠক সমীপেষু, পড়ার পর মনে হলো, বইয়ের এই গল্পটাকে বিশেষভাবে প্রিয় তালিকায় নিতে পারি। যদিও এ গল্পটা ‘হিমালয় ধারা’ থেকে খুব ব্যতিক্রমী কিছু নয়। রচনায় সেই চৌকসতা আছে। উপমার ব্যঞ্জন আছে। চরিত্রের মুখ দিয়ে সংলাপের আদলে অনেক দর্শন-তত্ত্ব আছে। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে কোন কোন যশোপ্রার্থী লেখকদের প্রবাসী নারী পাঠকদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা প্রাপ্তির বিষয়টি মুখরোচক আলোচনা ছিল। গল্পে এমনই একটি প্রসঙ্গ সামান্য মচমচে অনুভূতি দেবে পাঠককে। ভাবছিলাম, গল্পের গল্পতে গিয়ে খোলাসা হব, লেখক সেরকম কোন সুনির্দিষ্ট ঘটনা থেকে আলোড়িত কিনা। তবে লেখকের বক্তব্য আমার ধারনার সাথে মিল খায়নি। যা হোক, গল্পে ফিরে আসি। গল্পটা সাহিত্যধারা নিয়ে। সাহিত্য বাজার নিয়ে। সাহিত্য হুজুগ নিয়ে। যশোপ্রার্থী আর যশোখ্যাত, এ দু’দলে ভিড় করা লেখকদের মধ্যকার হিম ও তপ্ত সম্পর্ক নিয়ে। কোন কোন প্রসঙ্গের দ্বৈত মত গ্রাহ্য করা অত্যাবশ্যকিয় হয় প্রসঙ্গের ব্যাপকতার স্বার্থেই। পরিশিলিত শব্দে গাঁথা, জটিল ভাবব্যঞ্জনায় রচিত সু-সাহিত্য নিয়ে সাহিত্য কৌলিন্য ধরে রাখতে হয় যেমন, আবার সহজ-সাবলীল-গপগপ করে গিলে ফেলা যায়, এমন রচনাকেও সার্বিকভাবে হেলা করার সুযোগ নেই। হুমায়ুন আজাদ আর হুমায়ুন আহমেদ ধারার মধ্যে যোজন যোজন ফাড়াক। অথচ দু’জনের লেখাই পাঠকের বোধজগৎ নিয়ে দারুণ খেলা করতে পারে। হুমায়ুন আজাদের হয়ত হুমায়ুন আহমেদ রচনার প্রতি উন্নাসিকতা থাকতে পারে, তবে তাতে করে পাঠক সমাজকেও যে দু’ভাগে খণ্ডিত হতে হবে এমন বাধ্যবাধকতার অবকাশ নেই। গল্পের চরিত্র মুরশিদ জাহিদ, জামাল কোরেশি, রইস ইমতিয়াজ, নিয়ামত মঞ্জুর, কিংবা প্রত্যয় হাবিব - এদের যার যার অবস্থান থেকে সাহিত্য ব্যবচ্ছেদকরণ পড়তে পড়তে এমনটাই মনে হচ্ছিল। লেখক অবশ্য তাদের আলোচনাকে এক ঘেয়েমি আনুষ্ঠানিক সমাপ্তিতে পৌঁছুতে দেয়নি। তার আগেই সাহিত্যিকদের ধৈর্য্ বিপরর্যয় ঘটে যায়। সাহিত্যকে একটি মাত্রা দিতে সোচ্চারদের নিজেদের মাত্রাজ্ঞান হারানোর সাক্ষী হবেন পাঠকরা । তারপরের ঘটনায় ধুন্ধুমার গতিশীলতা উপভোগ্য হবে পাঠকের কাছে। তবে শেষটায় পাঠক একটু থম মেরে ভাবতে বসবেন। পাঠকের পাঠানুরাগকে উপজীব্য করে লেখকরা নির্মম পুঁজিবাদী হয়ে ওঠে কিনা - গল্প শেষে আমার নিজের উদ্বেগ ছিল এমনটা।
১০টা গল্প পড়া শেষ। রিভিউ লেখাও শেষ। এখন পর্যন্ত একুশে বই মেলাই বই প্রকাশ ও বিকিকিনির প্রধান মৌসুম হয়ে রয়েছে। সে হিসেবে অফ-সিজনে প্রকাশ করেও হিমালয়ের প্রথম বই ইতিমধ্যে বেশ ভাল আলোচনা জিইয়ে রেখেছে কয়েকটি ব্লগে। বয়সে যথেষ্ট নবীণ হলেও লেখক হিসেবে হিমালয়কে নবীন ভাবার সুযোগ নেই, বরং তার লেখনি তাকে যথেষ্ট রাশভারি করে তোলে। হিমালয়কে নবীন লেখকদের কাতারে দাঁড় করিয়ে কয়েক আউন্স উৎসাহ যুগিয়ে তার কাছ থেকে আগামিতে কেবল ভাল লেখনী প্রত্যাশা করা সমীচিন হবে না। বরং প্রত্যাশার মাত্রাটাও ভারিক্কি করে দেয়া জরুরী।
ছোট গল্প লেখা সহজ কিছু নয়, তবে ছোট গল্পে গল্পকার চাইলেই অন্তে এসে বিশাল রহস্য সৃষ্টি করে পাঠকের হাতে পরিণতি তুলে দিয়ে নিজেকে পাশ কাটাতে পারেন। উপন্যাস সে তুলনায় পরিণতিমুখী, যদিও এটা শর্ত নয়, ফলে অবধারিত হয়। তবুও উপন্যাসে প্রতিটি চরিত্র নিয়ে অনেক বেশি খেলার অবকাশ থাকে লেখকের। পরিণতিকে আচমকা নয়, ক্রমাগত উপলব্ধি করার সুযোগ পান পাঠকেরা। হিমালয় তার গল্পের চরিত্রগুলোকে কতটা সুষ্পষ্ট পরিণতির দিকে কতটা ঠেলে দিতে পারেন তা দেখার আগ্রহবোধ করি সহ-ব্লগার, পাঠক হিসেবে বিধায় আমার ব্যক্তিগত প্রত্যাশা থাকবে আগামিতে গল্প সংকলন নয়, হিমালয়ের একক উপন্যাস প্রকাশিত হোক।
হিমালয়ের গল্প আমারো প্রিয় কিন্তু এত লম্বা গল্প, এক সাথে বসে শেষ করা যায়না , ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়তে হয়।
দেখি বইমেলায় ওর বইটা কিনতে পারি ।
ঠিক আছে, ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়েন। বই মেলার আগেও বইটা সংগ্রহ করতে পারেন।
আপনি কি এই আইরিন সুলতানা?
http://blog.bdnews24.com/laboni/52025
রাইট এন্ড একজাক্টলি!
রিভিউ পড়লাম। হিমালয়ের গল্প অনেক পড়েছি। এই লিস্টের কয়েকটিও সামুতে পড়া। শুনেছি হিমালয় এগুলো নতুন করে লিখেছে। বইটা পড়ার আগ্রহ তো আছেই। বই পড়ার পর রিভিউ মিলিয়ে আবার কমেন্ট করবো। তোমার করা প্রচ্ছদটা সুন্দর হয়েছে। তুমি হিমালয়ের আগেই তাই প্রসংশা পাচ্ছো
ইশশ! প্রসংশা পেয়ে যে কি খুশি লাগছে!
হুমম, সম্ভবত প্রতিটি গল্পই রিরাইট করা হয়েছে। যার কতক আমার আগে পড়া ছিল বলে রিরাইটেড জায়গাগুলো ধরতে পেরেছি।
বাহ! চমৎকার পাঠ-প্রতিক্রিয়া।
হিমালয়ের লেখক জীবন সমৃদ্ধ হোক।
আপনার মন্তব্য পেয়ে ভাল লাগছে কামাল ভাই!
হিমালয়ের জন্য শুভ কামনা।
রিভিউটি পড়ে মন্তব্য করবার লোভ সামলাতে পারলাম না। হিমালয়ের লেখাগুলোর বেশিরভাগই সামু ব্লগে পড়া হয়েছিলো। তবে বই প্রকাশের আগে তার পুণর্লিখিত গল্প এবং আগের গল্পগুলোর একটা তুলনা মূলক ফিডব্যাক আমি দিয়েছিলাম। তার জের ধরেই কিছু কথা বলবার ইচ্ছা রাখি।
আপনার রিভিউটা পড়ে আমার কাছে মনে হয়েছে আপনি বইটা পড়ার আগে ব্লগের গল্পগুলোর ভূত মাথা থেকে তাড়াতে পারেননি। মানে একই শিরোনামে থাকলেও গল্পগুলো পারস্পরিকভাবে গুণ গত এবং মাংত ভাবে আলাদা এই জিনিসটা বিবেচনায় নেননি। তাই পূর্বপাঠের রেশ রয়ে যায় কিছুটা। বিশেষ করে ৭১ গল্পের কথাটা বলবো। আমার মনে হয়েছে রিভিউতে এই গল্পটার প্রতি একটু অন্যায়ই করা হয়ে গিয়েছে। সমকালীন প্রেক্ষাপটে ৭১ এর চেতনার বাস্তব চিত্রকে ফোকাস পয়েন্ট ধরে গল্প লিখা হলেও গল্পের বেড়ে যে চরিত্রগুলোর হাত ধরে তারা গল্পকে একটা নতুন মাত্রা দিয়েছে। সেই সকল সফল অথবা ব্যর্থ মানুষগুলোর গল্প ৭১ এর ফোকাসের বাইরে প্যারালালে বেড়ে উঠা আরেকটি গল্প। ৭১ বিষয়ক রোমান্টিক ধারণা থেকে বেরিয়ে আসাটাকেও আমি গল্পটির শক্তির দিক হিসাবে ধরবো।
২৫ শে অক্টোবর অসম্পূর্ণ গল্প বলে আমি নিজেও মত দিয়েছিলাম আমার লেখা একটা রিভিউতে। তবে লেখকের এবং আরো একজন পাঠকের ভিউ পয়েন্ট থেকে গল্পটা পুণরায় দেখবার সুযোগ হলে আমারও সন্দেহ থাকে এটি নিঃসন্দেহে একটি পূর্ণাঙ্গ গল্প এবং এই বইয়ের প্রথ পাঁচ বেছে নিলে অবশ্যই থাকবে।
অন্য গল্পগুলো নিয়েও অল্প বিস্তর মতভেদ আছে। অবশ্য আমি আমার রিভিউতে একটা জিনিস মিস করে গগিয়েছিলাম। সেটা এখানে বলে গেলাম। প্রচ্ছদটা খুব সুন্দর হয়েছে।
ভালো থাকবে।
শুভকামনা।
ধন্যবাদ আইরিন আপু; এত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় করে রিভিউটা লিখেছেন।। আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং শ্রদ্ধা দুটোই কিছুটা বৃদ্ধি পেল। তবে একটা অনুযোগও আছে।।। এই বইয়ের প্রচ্ছদও অনন্যতার দাবিদার।।। এমন অসাধারণ প্রচ্ছদটি আপনি ডিজাইন করেছেন, অথচ তা উল্লেখের প্রযোজন বোধ করেননি, এটা আমার জন্য যথেষ্ট বিব্রতকর। তাই আপনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি বইয়ের প্রচ্ছদ করবার জন্য।
এবার আপনার লেখাটি প্রসঙ্গে আসি।। আপনার স্টাইলটা বেশ আকর্ষণীয় ছিল। জানিনা আপনি একে কী বলবেন, তবে একে রিভিউ মানতে আমার ঘোরতর আপত্তি আছে। আমার একে গল্পপরিচিতি মনে হচ্ছে। একটি গল্প কখনোই শতভাগ ভাল লাগেনা, প্রতিটি গল্পেই কিছু ভাল না লাগা দিক থাকে, লেখকের সকল ফিলোসফির সাথেও পাঠক সবসময় একমত হতে পারেনা। ফলে রিভিউয়ে লেখক-পাঠকের মতানৈক্য থাকা অনিবার্য; সেখান থেকেই সৃষ্টি হয় উন্মুক্ত আলোচনার মাধ্যম। কিন্তু আপনার লেখাটিতে আমি আপনার ফিলোসফিকাল পয়েন্টগুলো খুঁজে পাইনি, অর্থাৎ গল্পগুলোকে আপনি কীভাবে দেখছেন তা বুঝতে পারিনি। শুধু শেষ গল্পটার ক্ষেত্রে বোঝা গেছে, ওটা আপনার ভাল লেগেছে। বাকিগুলোর ক্ষেত্রে একটা নিরাপদ অবস্থান বজায় রেখেছেন বলে মনে হল। গল্পের নির্মম-নির্মোহ ব্যবচ্ছেদ বলতে যা বোঝায় তার কোথাও যেন ঘাটতি পেলাম।।।তবে, আপনার বিশ্লেষণকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেই বলেই বোধহয় ঘাটতিটা প্রকট মনে হল আরও।।
উপন্যাস লেখা প্রসঙ্গে।।। আমি মনে করি, ৩০ বছর উপন্যাস লেখার পারফেক্ট বয়স।।। তাই আমাকে আরও ৫টা বছর অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।।।
হিমালয়ের বইয়ের সাফল্য কামনা করি।
আইরিন আপনার রিভিউ যথেষ্ঠ মমত্বময়
মন্তব্য করুন