লেখকরঙ্গ
চার্লস ডিকেন্স লোকটা অন্য রকম ছিলেন। পত্রিকায় তিনি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতেন। তাঁর উপন্যাসের কিস্তি পড়ার জন্য অধীর আগ্রহে পাঠকেরা অপেক্ষা করতেন। মাস্টার হামফ্রেজ ক্লক নামের একটা সাপ্তাহিকে তাঁর উপন্যাস প্রকাশিত হতো। দি ওল্ড কিউরিসিটি শপ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হতে শুরু করে ১৮৪০ সালে। উপন্যাসটি ইংল্যান্ডের গণ্ডি ছাড়িয়ে আমেরিকায়ও তুমুল জনপ্রিয় হতে শুরু করে।
কাহিনি তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। আর মাত্র একটি পর্ব বাকি। সবার আগ্রহ উপন্যাসের নায়িকা নেলের পরিণতি নিয়ে। সে কি বাঁচবে, নাকি মারা যাবে। তখন সাপ্তাহিকটি আমেরিকা যেত জাহাজে করে। জাহাজ যেদিন ভিড়বে, সেদিন ঘাটে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। পত্রিকা হাতে পেয়ে পড়ার জন্য সবাই অস্থির। আর সহ্য করতে না পেরে জনতা চিৎকার করে জাহাজের নাবিকদের কাছেই জানতে চাইল, ‘নেল কি মারা গেছে?’
এ রকম এক গল্প জানার পর লেখক হতে কার না ইচ্ছা করে! আমারও হলো। মনে হলো, লেখক হওয়া এমন কী কঠিন কাজ। আমিও লেখা শুরু করলাম। কিছুদিন পর মনে হলো, নিজের একটা ল্যাপটপ থাকলে লেখালেখির সুবিধা হবে। ব্যাংকঋণ নিয়ে তা-ও কিনলাম। এভাবে চলতে চলতে একসময় মনে হলো, আমি লেখক প্রায় হয়েই গেছি। বইটা প্রকাশ পেলেই তো লেখক। শুরু হলো প্রকাশক খোঁজার পালা। কীভাবে প্রকাশক খুঁজে পেলাম সে অন্য গল্প, আরেক দিন বলা যাবে। কেবল জানিয়ে রাখি একটি কথা। আর সেটি হলো—টেরোরিস্ট আর প্রকাশকদের মধ্যে পার্থক্য কি জানেন তো? টেরোরিস্টদের সঙ্গে আপনি দর-কষাকষি করতে পারবেন, প্রকাশকের সঙ্গে নয়।
আমার বই শেষ পর্যন্ত প্রকাশ হলো, এমনকি বইমেলায় প্রকাশকের স্টলেও দেখা গেল। আমি প্রতিদিন মেলায় যাই, স্টলের আশপাশে ঘুরঘুর করি, বুকপকেটে কলম রাখি, গোপন পকেটে রাখি আরও এক কলম। বইয়ে অটোগ্রাফ দিতে দিতে কলমের কালি শেষ হয়ে গেলে যাতে কেউ ফিরে না যায়, সে জন্যই এই ব্যবস্থা। কালি শেষ হওয়া তো দূরের কথা, কলম পকেট থেকে বের করতেই হচ্ছে না। বইমেলার সময় প্রকাশককে সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। আমি একসময় খুঁজে পেয়ে তাঁকে পাকড়াও করলাম। জানতে চাইলাম, বই কেমন বিক্রি হচ্ছে? খুব ভালো সংবাদ শোনাচ্ছেন, এ রকম হাসি হাসি মুখ করে তিনি বললেন, ‘গেছে মনে হয় দু-তিনটা।’
আমার মুখ দেখে মনে হয় মায়া হলো কারও। পাশের এক বালিকা বলল, ‘রয়্যালটি দিতে হবে, এই ভয়ে প্রকাশকেরা বই বিক্রির কথা বলতে চান না।’ কথাটি শুনে আমি আবার বুক-পকেটে হাত দিলাম, দেখলাম, অটোগ্রাফ দেওয়ার কলমটা এখনো আছে।
তারপর একদিন বইমেলা শেষ হলো। তার পরও দিন গেল, সপ্তাহ গেল, মাসও গেল। একদিন প্রকাশকের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম। তিনি জানালেন, বিশেষ কারণে প্রকাশনীর অফিস পরিবর্তন করতে হচ্ছে। নতুন অফিসটি আকারে ছোট, বইয়ের সংকুলান হচ্ছে না। তারপর বিনয়ের সঙ্গে লিখলেন, আমার অবিক্রীত বইয়ের কপিগুলো যদি নিয়ে যাই, তাহলে তাঁর জন্য খুব সুবিধা হবে।
তারপর আমি একদিন গিয়ে ৪৯৪টি বই ফেরত নিয়ে এলাম। বইগুলো রাখার জন্য দোকান থেকে নতুন একটা বইয়ের শেলফ কিনলাম। সেই শেলফে বইগুলো সাজিয়ে রেখে ফেসবুকে নতুন একটা স্ট্যাটাস দিলাম, ‘আমি এখন এক হাজার বইয়ের একটি ব্যক্তিগত লাইব্রেরির মালিক, যার প্রায় পাঁচ শই আমার লেখা।’
বিখ্যাত লেখক জুলমাত খোন্দকারও যে ফেসবুকে লেখালেখি করে, তা আমার জানা ছিল না। থাকলে আর এই স্ট্যাটাস দিতাম না। সে ইতিমধ্যে একজন জনপ্রিয় লেখক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছে। তার উপন্যাস মুড়িমুড়কির মতো বিক্রি হয়। জুলমাত খোন্দকার আমাকে লেখক হিসেবে মানতেই চায় না। তার সঙ্গে আমার বিরোধ আরও পাঁচ বছর আগে থেকে—আমরা যখন একই ব্লগে লেখালেখি করতাম, তখন থেকে। তারপর আমরা ব্লগ বদলে ফেলেছি। তা-ও এড়ানো গেল না জুলমাতকে। সে আমাকে নিয়ে, আমার লেখা নিয়ে লম্বা লম্বা নোট লিখতে লাগল ফেসবুকে। আর সেই নোটে আমার সমস্ত পরিচিতজন ট্যাগ করতে শুরু করল। একসময় ব্যাপারটা অসহ্য হয়ে উঠল।
আমার দুরবস্থা দেখে এগিয়ে এল আমার বন্ধু কিসমত। বুদ্ধি দিয়ে বলল, ‘দোস্ত, ওরে গুম কইরা দিই।’ আমি আঁতকে উঠে বললাম, ‘আমরা বেসরকারি খাতের লোক, সরকারি কাজে না ঢোকাই ভালো।’
এবার নতুন এক বুদ্ধি দিয়ে বলল, ‘লেখালেখিতে তো আর জুলমাত খোন্দকারের সঙ্গে পারবি না, তুই ওকে আগেকার মতো দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানা।’ আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে কিসমতের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। জুলমাত মোটাসোটা স্বাস্থ্যবান একজন মানুষ। তার সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ!
এবার কিসমত বলল, ‘দোস্ত, রাগ করিস না। তুই জুলমাত খোন্দকারকে চ্যালেঞ্জ দিয়া বল যে ছবির হাটে দ্বন্দ্বযুদ্ধটা অনুষ্ঠিত হবে। এ জন্য কিছু নিয়মকানুন আছে। দুজনই দুজনার অবিক্রীত বই নিয়ে আসবে। তারপর একজন অপরের দিকে সর্বশক্তিতে সেই বই ছুড়ে মারবে। দোস্ত, তোর তো ম্যালা বই। তুই নিশ্চিন্তে জিতে যাবি। তুই আনবি প্রায় ৫০০ বই, আর জুলমাত আনতে পারবে বড়জোর ৫০টা।’
আমি চোখ গরম করে কিসমতের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে এলাম। লেখক হতে গিয়ে আমার বন্ধুত্বটাও মনে হয় গেল।
বাসায় এসে দেখি আরেক সংকট। মোহাম্মদপুরের যে বাসায় থাকি, সেটি নতুন হয়েছে। গ্যাসলাইন যে অবৈধ, তা জানতাম না। গ্যাস কর্তৃপক্ষ প্রায়ই অভিযান চালায়, লাইন কেটে দেয়। আবার ঠিকই লাইন জোড়া লেগে যায়। এখন শুরু হয়েছে নতুন কৌশল। সকালে বাড়িওয়ালা নিজেই লাইন খুলে রাখেন, রাতে আবার জোড়া লাগান। ফলে আগের রাতেই রান্নাবান্না শেষ করে রাখতে হয়।
সেদিন বাসায় এসে দেখি ঘরভর্তি মেহমান। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কিচিরমিচির ঘরজুড়ে। দেখেই ঘাবড়ে গেলাম। এত মানুষের খাওয়ার ব্যবস্থা কী হবে। কিন্তু বউ দেখলাম নিরুদ্বিগ্ন। হাসিমুখে গল্প করছে। আড়ালে ডেকে নিয়ে জানতে চাইলাম রান্নার কী হবে। গোপন কথা ফাঁস করে দেওয়ার মতো ফিসফিস করে বউ বলল, নতুন একটা পদ্ধতি বের করেছে সে। মাটির চুলা বানানো হয়েছে বারান্দায়। আজ থেকে জরুরি রান্না হবে সেই চুলায়। আমি আঁতকে উঠে বললাম, ‘এত কাঠ কই পাব। ঢাকায় তো লাকড়ি পাওয়া যায় না।’
বউ আমাকে হাত ধরে নিয়ে গেল বারান্দায়। দেখলাম, সেখানে রান্না হচ্ছে। পাশে জ্বালানি হিসেবে থরে থরে সাজানো একগাদা বই। বললাম, ‘পুরোনো আর আজেবাজে বইগুলো পুড়িয়ে ফেলবা। দেখো, আবার জরুরি বই যেন পুড়িয়ে না ফেলো।’ বউ তখন হাসিমুখে বলল, ‘জরুরি কোনো বই না। কেবল তোমার বইগুলোই নিয়ে এসেছি। এসব বই তো আর বিক্রি হবে না। তাই ভাবলাম কাজে লাগাই। কী, ভালো বুদ্ধি না?’
যাক, লেখক হওয়ার একটা উপকার তো পাওয়া গেল।
পাদটীকা: লেখাটা আজকের রস+আলোতে প্রকাশিত। এর একটা পেছনের গল্প আছে। সেদিন আমার বইয়ের সর্বশেষ প্রকাশকস বেঙ্গল গ্যালারিতে বইমেলা পুর্ণমিলনী করলেন। সৈয়দ হক সহ বিখ্যাতরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে লেখক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমাকেও বক্তব্য দিতে বলা হল। হাঁটু কাপিয়ে এক মিনিট বক্তৃতাও দিলাম। তারপর ক্যাডেট কলেজ ডে-তে আরও অনেকের সঙ্গে আমাকেও লেখক হিসেবে সম্বন্ধনা দিল, সঙ্গে একটা ক্রেস্ট। এই তথ্য ফেসবুকে দেওয়া মাত্র অনেকেই অভিনন্দনও জানালো। তাই ভাবলাম আমার লেখক স্বত্ত্বার পেছনের গোপন কথাটাও বলা প্রয়োজন।
পাদটীকা ২-আজ লেখা প্রকাশ হওয়ার পর দেখছি অফিসের অনেকেই আমার দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন। আবার তিনজন পাঠক প্রথম আলোতে মন্তব্যও করেছেন।
সায়মন খান ।
২০১২.০৫.১৪ ০৫:৫৩
এই প্রথমবার কোন রম্য রচনা পড়ে কষ্ট পেলাম।কারন- আমিও আপনার মতোই একজন লেখক।লিখালেখির নেশাতে ইউরোপ ছেড়ে দেশে ফিরে যেতে চাচ্ছিলাম কিন্তু আপনি তো হতাশ করলেন।
Zahid Hasan
Zahid Hasan
২০১২.০৫.১৪ ১০:৪৫
আপনার লেখা পরে অনেক ভাল লাগল - হেসেচি । আমার মনে হসসে আপনি ভাল লেখেন। চালিেয যান
Ayub
Ayub
২০১২.০৫.১৪ ১১:৫৭
ভাই, আপনােক ধন্যবাদ। By this time, I am also existing under your team and negotiating with a publisher for the target of next Boi-mela. Still I did not agree to pay him. Let see what will happen.
(
লেখার ভিত্রে এই মাত্রার মিথ্যাচার

আমার কাছে খবর আছে একাধিক এডিশনে আপনের বই এইবার বিক্রি হইসে
কে কয় মিথ্যাচার?? পুরাই সত্যাচার
great
আর আমরা যে লিংক শেয়ার দিয়ে আহ উহু করলাম তার কোন দাম নাই?
আবারো আফসোশ।
উহু উহু না কইরা কয়টা বই কিনলে তো আর এই লেখা লিখতে হইতো না। আফসুস
করুণ রস।
দারুন রঙ্গ।।।।।
করুণরস
অনেকদিন পর রসালুতে একটা সত্যি হাসির লেখা পড়লাম
কপি পেস্ট মানিনা ।
মডু ঘুমায়
আহারে বইগুলা!!
মজা পাইলাম
লিখলাম করুণ কাহিনী, আর পাইলেন মজা
চুলার জ্বালানী হিসাবে আপনার বই ব্যবহারের তীব্র প্রতিবাদ জানাই। ক্যান, আমরাতো অনেকেই কিনছি আপনার বই। তারপরও জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার না কৈরা আমগোরে (যারা নিজ টাকা দিয়া কিনছি) একটা কৈরা গিফট দিলে কী এমন ক্ষতি হৈতো
কেন? আরও বই নিবেন কেন? আপনার বাসায়ও গ্যাস নাই?
আহারে বইগুলা!!
মন্তব্য করুন