সাংবাদিকের দিনলিপি
১.
পদ্মা সেতু নিয়ে প্রায় দেড় বছর ধরে টানা লিখে যাচ্ছি। সেই লেখার একটা অধ্যায়ের শেষ হল শুক্রবার। ঘুম থেকে উঠেই দেখি বিশ্বব্যাংকের এক কর্মকর্তার এসএমএস। বললো, মেইল চেক করেন। মেইল দেখলাম, জানলাম যে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অধ্যায় শেষ।
অফিসে গিয়েই দেখি আমার টেবিলে একটা চিঠি। লিখেছেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। এইটা একটা মজার কাহিনী। যতবার আমি বা আমার অন্য সহকর্মীরা পদ্মা নিয়ে লিখেছেন, তারপর দিনই অবধারিত ভাবে আসবে একটা চিঠি। লেখেন সৈয়দ আবুল হোসেন নিজেই। লম্বা লম্বা চিঠি। তিনি যে ফুলের পতো পবিত্র সেটিই ইনিয়ে বিনিয়ে লেখা হয। তবে মজা হয় যদি শিশিরদার কার্টুন থাকে। কার্টুন জিনিষটা সম্ভবত তিনি একদমই সহ্য করতে পারেন না। কার্টুন ছাপা হলে চিঠির দৈর্ঘ আরও বাড়ে।
একাধিকবার অফিসে ফোনও করেছেন। বার বার বলেছেন, দয়া করে যেন কার্টুনটা না দেই। কিন্তু কে শোনে তাঁর কথা। কালকেও নতুন একটা কার্টুন যাচ্ছে।
কেবল চিঠি না, ফোনও করেন। নামে কোনো রিপোর্ট ছাপা হলে, অফিসে তাকেই ফোন করেন। আর ফোন ধরলে আরেক যন্ত্রণা। কথা বলতেই থাকেন। বিষয় একটাই, তিনি ফুলের মতো পবিত্র।
তবে কপাল খারাপ থাকলে যা হয়। কয়েকদিন আগে পদ্মা নিয়ে নিজের নামে একটা রিপোর্ট লিখেছিলাম। সেখানে আবুল হোসেন প্রসঙ্গ ছিল। বিকালে অপারেটর বললো, আবুল হোসেন সাহেব ফোন করেছেন, আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। কপাল তারও খারাপ। অপারেটরকে বলে দিলাম, বলেন যে আমি নাই।
আজ যে চিঠিটা দিয়েছেন তার কয়েকটা লাইন বলি, 'পুরো সংবাদটি আমাকে সম্পৃক্ত করে, আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করে লেখা হয়েছে-তা স্পষ্ট। প্রতিবেদনে ঘটনাপ্রবাহের ছক বিন্যাস, যুক্তি এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থান এমন সুক্ষ্ম ও সুফিয়ানা ও মুন্সিয়ানাভাবে তুলে আনা হয়েছে-তাতে যেন আমি অভিযুক্ত এবং আমার সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা জনমনে প্রতিষ্ঠিত হয়।'
আচ্ছা. এইখানে সুফিয়ানার অর্থ কি দাঁড়ায়?
২.
পদ্মা সেতুর রিপোর্ট করতে গিয়ে মজার অভিজ্ঞতাও হয়েছে। পদ্মা নিয়ে সরকারের মধ্যে দু্ই ভাগ তা খুব স্পষ্ট ছিল। একদল চেয়েছেন বিশ্বব্যাংক ছাড়াই করা হবে পদ্মা। আরেকদল বিশ্বব্যাংককে চেয়েছেন। বিশ্বব্যাংকে চাওয়ার দলে ছিলেন অর্থমন্ত্রী নিজেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিও পারেননি আবুল হোসেনের সঙ্গে।
সরকারের দুই পক্ষের সঙ্গেই কথা হয়েছে। একদল মনে করেছে, বিশ্বব্যাংক খালি শর্ত দিয়েই যাবে, ঋণ আর দেবে না। কারণ উদ্দেশ্য অন্য। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সঙ্গে হিলারী-ইউনূসসহ নানা জাতীয় জিনিষ আছে।
আরেকদল মনে করে, ওরা ষড়যন্ত্রকারী। শীর্ষ পর্যায়ে নানা ধান্দায় ঘোরাঘুরি করে নিজেদের গুরুত্ব বাড়ায়। এরাই দেশের ক্ষতি করে বেশি।
একদল মনে করে, মিডিয়া বিশ্বব্যাংকের ভাষায় কথা বলে। আরেকদল মনে করে মিডিয়া যদি ঠিকমতো লেখে, তাহলে আসল মানুষটি দেখবেন, পড়বেন এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে পারবেন।
আহা, নাম-ধাম সব লিখতে পারলে ভাল হতো।
৩.
সাংবাদিকতারও দৈন্যদশা চলছে। সরকার গত বুধবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, বিশ্বব্যাংককে না করে একটা চিঠি লেখা হবে। বৈঠকটি হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কেন্দ্রিক সাংবাদিকরা খবরই পেলেন না।
পরের দিন বৃহস্পতিবার ইআরডি, অর্থমন্ত্রণালয় ও অর্থমন্ত্রী চিঠি লিখে বিশ্বব্যাংককে পাঠিয়েও দিলেন। কিন্তু সারাদিন সচিবালয়ে ঘুর ঘুর করা সাংবাদিকেরা তাও জানতে পারলো না।
বিশ্বব্যাংক জানানোর পর সবাই জানতে পারলো। এখন সহজ সাংবাদিকতার যুগ চলছে। একটা বৈঠক হবে, সাংবাদিকেরা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন, মন্ত্রীরা বাইরে এসে যা ইচ্ছা তাই বলবেন-সেটাই নিউজ। ইলেকট্রনিক মিডিয়া তো এভাবে করেই, প্রিন্ট মিডিয়াও একই কাজ করছে। বৈঠকে কি হলো সেই খবর আর রাখে না। এমনও হয়েছে, ভেতরে আলোচনা হয়েছে এক বিষয়ে, আর বাইরে বলা হয়েছে অন্য কিছু। অথচ সেইটাই নিউজ হয়েছে।
সহজ সাংবাদিকতার যুগ শেষ হোক।
৪.
সাংবাদিকতা করতে হলে সোর্স মেইনটেইন করতেই হয়। সোর্স না থাকলে সাংবাদিকতা করা যায় না। সোর্স থাকতে হবে, এবং সময়মতো যোগাযোগ রাখতে হয়।
উদাহরণ দেই, দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান লুই ওকাম্পো চিঠি দিল ৯ জানুয়ারি। কিন্তু দুদক বিট করা সাংবাদিকেরা সেই চিঠি উদ্ধার করতে পারলো না। কেবল যুগান্তর সম্ভবত চিঠির কথা শুনে কিছু লিখেছিল। আর কেউ না।
তারপর ১৪ জানুয়ারি অফিস করছি। সন্ধা প্রায়, তখন টিভিতে দেখলাম দুদক কমিশনার সাহাবুদ্দিন সাংবাদিকদের বলছেন যে, দুদকের তদন্তে বিশ্বব্যাংক সন্তুষ্ট। শুনেই খটকা লাগলো। ফোন করলাম আমার সোর্সকে। তিনি ফোন পেয়েই বললেন, আসেন, দেখা করেন। সেই সন্ধ্যায় চলে গেলাম এক জায়গায়। নিলাম চিঠিটা। সোর্স অনুরোধ করলো পুরো চিঠি যেন না ছাপাই। তাহলে তার বিপদ হবে। সেই কথা দিয়ে আসলাম।
অফিসে এসেই লেখা শুরু করি। এক্সক্লুসিভ কিছু করার উত্তেজনা এখনও আছে। মনে হচ্ছিল যেন আর কেউ না পায়। কিন্তু পরদিন দেখি ডেইলি স্টারেও নিউজটি আছে। চিঠিটা হুবহু ছেপে দেওয়া হয়েছে। এটা মনে হয় ঠিক হয়নি।
অথচ পরে দেখি এই রিপোর্ট নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া। বিশেষ একটি সংস্থা চেষ্টা করলো, আমরা কিভাবে অতি গোপনীয় চিঠিটা পেলাম তা বের করতে। কারণ চিঠিটা পাওয়ায় সরকারের জোর গলায় কিছু বলার উপায় কমে গিয়েছিল। স্পষ্ট হয় আবুল হোসেনের বিষয়টি। সাবধানে কথাবার্তা বলতে হয়েছে কয়েকদিন। প্রধানমন্ত্রীও বক্তৃতা দিলেন আমাদের চিঠি পাওয়া নিয়ে।
তবে এটা ঠিক, নিউজটা করে রিপোর্টিং করার সেই মজা আবার পেয়েছিলাম।
৫.
পদ্মার এক অধ্যায় শেষ। এবার নতুন অধ্যায়ের অপেক্ষা।
৬.
টিসিবির সামান্য কর্মচারি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমলেই চাকরি চলে যায় দুর্নীতির জন্য। এরশাদকে তুষ্ট করে 'সাকো' গড়লেও আসল সাঁকো করতে সবচেয়ে বাঁধা হয়ে থাকলো সৈয়দ আবুল হোসেন।
৭.
পুরোনো গল্পটা আবার বলি।
হোসেন মিয়া একদিন মন্ত্রণালয়ে বসে আছেন। তাঁর এপিএস কুবের দুঃখ দুঃখ চেহারা বানিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। হাতে একটা খাম। দেশের এক সাধারণ মানুষ চিঠিটি দিয়েছেন। ঠিকানা দেখে অবাক হলেন হোসেন মিয়া। সেখানে লেখা, ‘প্রাপক, দেশের সেরা চোর।’ কুবের তাঁর স্যারকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘দেখেন স্যার, কত বড় সাহস। এভাবে ঠিকানা লিখল! এভাবে কেউ লিখে?’
হোসেন মিয়া উদাস গলায় বলল, ‘বুঝলে কুবের, লিখছে সেটা নিয়ে আমার দুঃখ নাই। কিন্তু ওই বেটা পোস্টম্যান এই চিঠি কেন ঠিক আমার কাছেই পাঠিয়ে দিল!'
অসাধারন দিনলিপি!
পদ্মা সেতু মরিচীকার নাম!
বেশী দারুণ পোষ্ট । মাসুম ভাই রক্স ।
১. সুফিয়ানা মানে মাসুমীয় ।
২. সরকার দলেও সরকারী আর বিরোধী দল । থাক নাম না বলাই ভালো । সাবধান হোন ।
৩. এজন্যই সবসময় সত্য খবর ছাপা হয় না
৪. হায় আবুল! কত খাটাইলো, নাচাইলো! আসলে কিন্তু আবুল না ।
৫. দেখা যাক কি হয় !
৬. এই হলো বাংলাদেশের সোনার মানুষ ।
সাবধানে থাকার তো চেষ্টা করি
পদ্মাসেতু বিষয়ে বিশ্বব্যাংক থেকে ঋন নেয়ার প্রস্তাব প্রত্যাহার করা যতটা কঠিন তারচেয়ে অনেকগুণ বেশী কঠিন প্রকৃত অভিযুক্তদের বিচার করা।
খুব ভাল পোষ্ট মাসুম ভাই।
ধন্যবাদ ভাই
আপনার সাহস আছে রে ভাই, এই সব ভি আই পি'র সাথে কথা বলা, তারপরে কি হয় না হয়। শাকিলের মত বিশ্বজিৎ কোপানো সোনার সন্তানতো দেশে মেলা।
যাই হোক, আমি সমকালের সুহৃদ পাতায় একটু লেখি। তবে জাপানের বাংলা কমিউনিটি পত্রিকার নিযমিত লেখক।
আপনাকে সালাম।
আপনাকেও শুভেচ্ছা। পড়বো আপনার লেখা
প্রথম লগিন করে আপনার লেখাটি পড়লাম। বরাবরের মতোই চমৎকার।
ধন্যবাদ
দারুন পোস্ট।
এটা একটা সিরিজ হলে চমত্কার লাগবে।
সিরিজ করার ইচ্ছা আছে
মাসুম ভাইয়ের কাছে আর সাধারণ দিনলিপি চাই না, সাংবাদিকে দিনলিপি চাই সবসময়
একদফা একদাবী
দাবি মানা হইছে। তবে নিয়মিত না অনিয়মিত তা বলা যাবে না
চমতকার ব্লগ।
মিনিষ্টার মনে হয় হিন্দী মুভির বড় ভক্ত। কদিন আগে ইশক সুফিয়ানা লাইনধারী একটা গান বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখেছিলাম, সেইখান থেকে সুফিয়ানা মেরে দিয়েছেন মনে হয়।
কিন্তু সুফিয়ানা মানে আসলেই কি? জানি না, জানার ইচ্ছে।
ঘটনার আড়ালে যে কত্ত কি থাকে... আমরা টের ও পাই না
মাঝে মাঝে এইরম দুই/চারটা লেখা দিয়েন ... অনেক কিছু জানার থাকে
হ, মাঝে মধ্যে দিমুনে
বেশ সাহসী লেখা! চিঠির ঘটনাটি পড়ে হাসি পাচ্ছে, উনার লাজ-শরম এত কম ক্যান?
লেখায় পাঁচতারা।
একটু আধটু সাহস না দেখাইলে কি আর চলে!
অনেক সাহসী লেখা!
সুযোগ-সুবিধা মতো এই ধাচেঁর লেখা আরো চাই।
সাকোঁ'র কান্ডারি'র দেখি চিঠি লেখার দারুন হাত!
ইদানিংকালে নানান ব্যান্ড যে সুফিয়ানা নাম লাগায়ে গান ধরে সেই জাতীয় কিছু কি এই "আবুল সুফিয়ানা"
বেশ সাহসী না, অল্প সাহসী। নাম-ধাম সহ লিখতে পারলে বেশ সাহসী লেখা বলতে পারতা
লেখা ভালো লেগেছে মাসুম ভাই। ভালো থাইকেন, সাবধানে থাইকেন
চেষ্টা করি ভাল থাকার ভাইডি
আপ্নে সাবধানে থাকেন সেটাও চাই আর এই ধরনের লেখাও আরো চাই..
~
ভাল থাকতেই তো দুনিয়া
আজ আবুল হোসেন আবার একটা চিঠি লিখছে। শেষ কয়টা লাইন শুনাই

''আমি বা আমার পরিবারের কেউ কখনো মামলা করিনি, করার এখনো কোনো ইচ্ছেও নেই। তবে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে FIR করে রেখেছি। মহান আল্লাহ তায়ালা আপনাদের মধ্যে পরিবর্তন আনুক, আপনার পত্রিকায় বদলানোর অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আপনাকে তৌফিক দিন। আমাদের মনে রাখতে হবে, মৃত্যুর পর আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।''
সাংবাদিকের দিনলিপি সিরিজ হবে এই আশা রাখি...
সবার উপ্রে আবুল সত্য তাহার উপ্রে নাই
আসলেই
দারুন লেখা.......
মন্তব্য করুন